সামরিক হস্তক্ষেপ : পাতা ফাঁদে পা ও পরাজয়
সামরিক হস্তক্ষেপ : পাতা ফাঁদে পা ও পরাজয় - ছবি : সংগৃহীত
অনেকেই বলে থাকে, তালেবানের এমন আচরণের কারণেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে সামরিক হামলার বাহানার সুযোগ খুঁজতে থাকে। এর মধ্যেই ঘটে যায় ইতিহাসের দৃশ্যপট পরিবর্তনের অকল্পনীয় ৯/১১-এর টুইন টাওয়ার হামলার ঘটনা। এর আগেও সুদান, কেনিয়া, তানজানিয়া, সোমালিয়াসহ অনেক দেশে মার্কিন দূতাবাসে এবং মার্কিন স্বার্থে হামলার ঘটনা ঘটে।
কিন্তু ৯/১১সহ সকল হামলা কোন অদৃশ্য শক্তির ইশারায় হচ্ছে তা হয়ত সিআইএ অনুমান করতে পেরেছিল। কিন্তু তাদের হাতে যথেষ্ট প্রমাণ ছিল না, যা কোনো ব্যক্তি, গোষ্ঠি বা রাষ্ট্রকে দায়ী করার জন্য যথেষ্ট ।
কিন্তু ৯/১১ হামলা তাদের ধৈর্যচ্যুতি ঘটায়। এটা ছিল প্রতাপশালী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গালে চপেটাঘাত করার সমান। কারণ তারাই বলে বেড়ায় যে তারা বিশ্বে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বদ্ধপরিকর। যদিও এই নিরাপত্তার আওতায় কোনো মুসলিম ভুখণ্ড ছিল না। উল্টা মুসলিম ভূখণ্ডে দস্যুবৃত্তি চালাত সহযোগী পশ্চিমাদের সাথে নিয়ে।
আফ্রিকার খনিজসম্পদে ভরা মুসলিম দেশগুলোকে শোষণ করে আসছে স্বাধীনতা, সভ্যতার বুলি আউরিয়ে। ফিলিস্তিনে বুকে আগুন জ্বলছে প্রায় শতাব্দী ধরে, ইউরোপের মুসলিম ভুখণ্ডে মুসলমানদের রক্তে হলি খেলা শুরু করেছে নব্য ক্রুসেডাররা। অথচ শান্তি নিরাপত্তার ধব্জাধারী জাতিসঙ্ঘের কোনো হাঁকডাক চোখে পড়ত না।
এই দীর্ঘ প্রায় এক শ' বছরের মধ্যে মুসলিদের কোনো অর্জন চোখে পড়ে না। সামরিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক আর না আছে জ্ঞানে বিজ্ঞানে। তাদের আষ্টেপৃষ্টে যেন বেঁধে রেখে বলা হচ্ছে তোমরা স্বাধীন। নিষ্ঠাবান মুসলিম নেতা, বিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানী, রাজনৈতিক কর্মীরা, কেউ রেহাই পায়নি মোসাদের প্রত্যেক্ষ সহযোগিতায় টার্গেট কিলিং থেকে। মুসলিমদের নেতৃত্বহীন করে রাখাই তাদের প্রধান এজেন্ডা। সেই সাথে চাপিয়ে দেয়া হয়েছে সামাজিক সাংস্কৃতিক আগ্রাসন তাদের প্রণীত শিক্ষাব্যবস্থা। এত সব অনাচার কোনো সচেতন মুসলিমের পক্ষে মেনে নেয়া সম্ভব না। আর এই সমস্যাগুলো তাদের প্রণীত পুঁজিবাদী গণতন্ত্র কিংবা লিবারেল দর্শনের ফ্রেমওয়ার্ক দিয়েও সমাধান করা সম্ভব না।
উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, জাহেলিয়াতের সময়কালে আরবরা খেজুর দিয়ে মূর্তি তৈরি করত। কিন্তু ক্ষুধা লাগলে ওই মূর্তি তারা নিজেই ভেঙে খেয়ে ফেলত। তেমনি পশ্চিমারা মুসলিম ভুখণ্ডে তাদের প্রণীত গণতন্ত্র, পুঁজিবাদ, স্বাধীনতার কথা বললেও যখন এই সমস্ত ফ্রেমওয়ার্কের মধ্য দিয়েই কোনো একনিষ্ঠ মুসলিম নেতা শাসক নির্বাচিত হতেন, তখন আমেরিকা নানা ষড়যন্ত্র করে গণতন্ত্র, স্বাধীনতা আর পুঁজিবাদকে খেয়ে ফেলত। আর তাদের গোলামিতে সন্তুষ্ট এমন কাউকে যেকোনো উপায়ে ক্ষমতায় নিয়ে আসত। ৯০-এর দশকে তিউনিসিয়ায় আন নাহদা পার্টিকে হটিয়ে দিয়ে ক্ষমতায় বসায় পশ্চিমা পাপেট সেনা প্রধানকে। সাম্প্রতিক সময়ে মিসরে মুরসিকে হটিয়ে ক্ষমতায় বসায় পাপেট সিসিকে। এছাড়াও বিশ্বের সকল অত্যাচারী স্বৈরশাসক ও রাজতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রেখেছে আমেরিকার নেতৃত্বে পশ্চিমারা।
যাই হোক ৯/১১-এর হামলা ছিল বিগত এক শ' বছরের মধ্যে মুসলিদের পক্ষ থেকে পশ্চিমাদের জন্য সামান্য উপহার, যদিও এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে নানা ধরনের মিথ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ ঘোষণ করেন সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধের। তিনি আরো ঘোষণা করেন, যারা এই যুদ্ধে তাদের সাথে থাকবে না তারা মার্কিনিদের শত্রু হিসেবে গণ্য হবে। এখানে নিরপেক্ষ থাকার কোনো সুযোগ নেই। অর্থাৎ ইসলামের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ যুদ্ধ ঘোষণা।
প্রথমে মার্কিন প্রশাসন তালেবানের প্রধান মোল্লা মুহাম্মদ ওমরের কাছে বার্তা পাঠায় ওসামা বিন লাদেনকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাতে তুলে দিতে। কিন্তু আত্মমর্যাদাবান মোল্লা ওমর তা অস্বীকার করেন। অবশেষে ৭ অক্টোবর আমেরিকা শুরু করে এক যুদ্ধ, যা দীর্ঘ ২০ বছর ধরে চলে। কিন্তু তারা সাময়িক সময়ের জন্য তালেবান সরকারকে উৎখাত করতে পারলেও ২০ বছর পর এসে দেখা যায়, তালেবান আগের চেয়ে আরো শক্তিশালী। আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক রাজনীতিতে এবং কূটনৈতিকভাবে নিজেদের যোগ্যতার প্রমাণ তারা যথাযথভাবে দিয়ে যাচ্ছে। অবশেষে ২০২০ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারিতে কাতারে রাজধানী দোহায় সকল আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উপস্থিতিতে মার্কিনিদের সাথে তালেবানের শান্তি চুক্তি হয় ট্রাম্প প্রশাসনের।
বাইডেন ক্ষমতায় আশার পরও ওই সীদ্ধান্ত থেকে সরে আসার ধৃষ্ঠতা দেখানোর সাহস করেনি। ১১সেপ্টেম্বর ২০২১ এর মধ্যে সকল সৈন্য প্রত্যাহারে বাইডেন প্রশাসন তালেবানদের সাথে একমত হয়।ইতিমধ্যেই ৯০ শতাংশ সেনা সদস্যদের ফিরিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছে।
এদিকে তালেবানের ক্রমাগত হামলায় কাবুল সরকার যথেষ্ট বেকায়দায় আছে। অভ্যন্তরীণ শান্তি আলোচনা ফলপ্রসূ না হওয়া উভয় পক্ষই জড়িয়ে পড়েছে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে। সেই সাথে চলমান রয়েছে কূটনৈতিক যুদ্ধ। আশরাফ গনি এরই মধ্যে বাইডেনের সাথে চলমান পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলার জন্য হোয়াইট হাউস সফর করেছেন। কিন্তু বাইডেন তাকে খুশির সংবাদ দিতে পারেনি। যেকোনো মূল্যে সেনা প্রত্যাহার বাইডেনের প্রাথমিক লক্ষ্য হিসেবে উল্লেখ করে হোয়াইট হাউজের প্রেস সেক্রেটারি। সান্ত্বনা স্বরূপ অর্থ সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিলেও তা কতটা বাস্তবতায় রূপ নেবে বলা মুশকিল। যুদ্ধে কাবুল রিজিমের চেয়ে বহু গুণ এগিয়ে তালেবান বিদ্রোহীরা।