৪ বিয়ে সম্পর্কে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি
৪ বিয়ে সম্পর্কে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি - ছবি : সংগৃহীত
নারীর অধিকার সম্পর্কিত পবিত্র আল কুরআনের একটি সূরা আন-নিসা। যার তিন নম্বর আয়াতে একজন পুরুষকে অনূর্ধ্ব চারটি বিয়ের অনুমতি দেয়া হয়েছে। অনেকে এই আয়াতটিকে বহুবিয়ের একটি যৌক্তিক কারণ হিসেবে দেখান। সেটি ছিল একটি ভিন্ন প্রেক্ষিতে। সেই আয়াতটির সঠিক ব্যাখ্যা বা অর্থকে বিকৃত করে নারীবৈরী হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। অথচ এই আয়াতটি নাজিলের সময় তা ছিল নারীবান্ধব। এর প্রয়োজনীয়তা যে এখন ফুরিয়ে গেছে সে কথা বলা মোটেই উচিত নয়। কারণ আল্লাহ প্রদত্ত বিধান সবসময় শাশ্বত। বরং এ আয়াতের সঠিক ভাবটি বোঝা উচিত। তাহলে এই বৈরী মনোভাব দূর করা সম্ভব।
যেখানে বলা হয়েছে, ‘আর যদি তোমরা এই ভয় করো যে, তোমরা এতিম মেয়েদের মাঝে ন্যায়বিচার করতে পারবে না, তাহলে অন্য সাধারণ নারীদের মধ্য থেকে যাদের ভালো লাগে তাদের দুইজন, তিনজন কিংবা চারজনকে বিয়ে করে নাও। যদি তোমরা এই আশঙ্কা করো যে, একের অধিক হলে তাদের সাথে ইনসাফ করতে পারবে না, তাহলে তোমাদের জন্য একজনই যথেষ্ট।’ (সূরা আন-নিসা, আয়াত-০৩)
যে সমাজের প্রেক্ষিতে এই বিধানটি নাজিল হয়েছিল সেই জাহেলি যুগের পুরুষদের স্ত্রী গ্রহণে সংখ্যার কোনো সীমাবদ্ধতা ছিল না। যত ইচ্ছে বিয়ে করত তারা। কোনো দায়-দায়িত্ব পালন করত না। রাসূল সা:-এর একজন সাহাবি গায়লান ইবনে সালামাহ আল-সাকাফি। ইসলাম গ্রহণের সময় তার ১০ জন স্ত্রী ছিল। রাসূল সা: তাঁকে নির্দেশ দিয়েছিলেন চারজন রেখে বাকিদের তালাক দিতে। তিনি তা-ই করেছিলেন। সুতরাং চার স্ত্রীর বিধানটি এসেছে অসংখ্য স্ত্রীর সংখ্যাকে সীমাবদ্ধ করতে, বাড়াতে নয়। এ আয়াতটিকে নারীবৈরী ভাবার আগে যারা এ বিষয়ে কথা বলছেন তাদের ভালো করে বোঝা উচিত, তিনি যা করছেন তা কুরআনের ভাষা নয়। ইসলামের নামে বিদ্বেষ ছড়ানোই এর লক্ষ্য।
ইসলাম চার বিয়ে জায়েজ রেখেছে ঠিকই, কিন্তু একাধিক স্ত্রী গ্রহণের ক্ষেত্রে তাদের মাঝে ইসনাফ প্রতিষ্ঠার কড়া নির্দেশ দিয়েছে। আর যদি সেটি সম্ভব না হয় তাহলে এক বিয়েতেই সীমাবদ্ধ থাকতে বলা হয়েছে। অনেকেই সূরা আন-নিসার এই আয়াতটিকে বহুবিয়ের অনুমতির জন্য ব্যবহার করে থাকেন। কিন্তু একাধিক স্ত্রীর সাথে বৈষম্যমূলক আচরণের প্রতিকারে এ আয়াতটির কথা উল্লেখ করেন না। যদি এটিকে একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ হিসেবে পেশ করা হতো তাহলে সংসার জীবন থেকে অনেক বিশৃঙ্খলার অবসান হতো।
বিয়ের ক্ষেত্রে সক্ষমতার প্রয়োজন। এই সক্ষমতা বলতে শারীরিক, মানসিক, আর্থিকসহ সব ধরনের সক্ষমতাকে বোঝায়। আর বহুবিয়ে এই শর্ত আরো কঠিন ও যুক্তিযুক্ত হওয়া একান্ত প্রয়োজন। বহুবিয়ের বৈধতা কেবল ব্যক্তির প্রয়োজনে নয়, অনেক সময় সমাজিক কারণেও হতে পারে। যে সময়ে এই বিধান দেয়া হয়েছে সেকালে যুদ্ধবিগ্রহ লেগেই থাকত। যুদ্ধের কারণে অনেক পুরুষ মারা যেত। নারীরা হতো বিধবা। এ কারণে সমাজে বিধবার সংখ্যা ছিল অনেক বেশি। নারীদের সামাজিক সুরক্ষার ব্যবস্থা হিসেবেই বহুবিয়ের বৈধতা দেয়া হয়েছে। সুতরাং রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক নানা প্রয়োজনে সুনির্দিষ্ট শর্ত পূরণ সাপেক্ষে বহুবিয়ের অনুমতি রাখা প্রয়োজন। এমনকি এই উপযোগিতা কখনো ফুরাবে না। তবে এটিকে যথেচ্ছ ব্যবহারের সুযোগ ইসলাম দেয়নি।
এশিয়া, ইউরোপ, আমেরিকা ও আফ্রিকাসহ বিভিন্ন মহাদেশের মানুষের মাঝে স্থান-কাল-পাত্রভেদে রুচি-অভিরুচির ভিন্নতা রয়েছে। কোনো কোনো দেশে বহুবিয়ে বৈধ। আবার কোনো কোনো দেশে বিয়ে ছাড়াই দৈহিক সম্পর্ক তৈরি হয়। একসময় তা ভেঙেও যায়। যা সামাজিক অনাচার বৃদ্ধি করে। মানুষের নৈতিক পতন ঘটায়। ইসলামে যেটি স্পষ্ট হারাম। আফ্রিকার বহু দেশেই মুসলিম-অমুসলিম বহু বিয়েতে সামাজিক প্রতিবন্ধকতা নির্বিশেষে বহুবিয়ে একটি স্বাভাবিক বিষয়। যদিও এসব দেশে মুসলমানরা শরয়ী বিধান মেনে চার বিয়েতেই সীমাবদ্ধ থাকে। কিন্তু অন্যদের ক্ষেত্রে তা-ও মানা হয় না।
বাংলাদেশে একসময় বহুবিয়ের ব্যাপক প্রচলন থাকলেও এখনো তা সীমিত পর্যায়ে এসেছে। বহু আগে সমাজের অভিজাত শ্রেণীর মাঝে বহুবিয়ের প্রচলন ছিল। এখন সেই ধারা পরিবর্তিত হয়ে নিম্নআয়ের মানুষের মাঝে চলে এসেছে। ফলে সক্ষমতাহীন এই মানুষগুলোর ভারসাম্যহীন কার্যকলাপের ফলে পারিবারিক কলহ বেড়ে চলেছে। সৃষ্টি হচ্ছে নানা সমস্যা।
বহুবিয়ের ক্ষেত্রে সবসময়ই নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ছিল। আমাদের দেশেও কাবিননামায় একসময় উল্লেখ করা হতো- স্ত্রীর অনুমতি ব্যতীত স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করতে পারবে না। এমনকি এখনো এ কথা বলা হয় স্বামীর প্রথম কোনো স্ত্রী আছে কি-না। এই বিষয়টি বহুবিয়ের ক্ষেত্রে অবশ্যই নেতিবাচক মনোভাবেরই বহিঃপ্রকাশ। তবুও যুগ, সময় ও পরিস্থিতি বিবেচনায় এর অপরিহার্যতাকে কখনোই অস্বীকার করা যায় না।
লেখক : সাহিত্যিক ও গবেষক