চীনা প্রেসিডেন্টরা যেভাবে দেশকে এগিয়ে নেন
চীনা প্রেসিডেন্ট শি - ছবি : সংগৃহীত
আধুনিক সময়ে দেং জিয়াও পিং ও বর্তমান প্রেসিডেন্ট শি জিং পিংয়ের আমলে কমিউনিস্ট পার্টি অব চায়না আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক সম্পর্ক বৃদ্ধি করেছে এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়িয়ে ‘ইকোনমিক শক্তি’তে পরিণত হয়েছে। শত বছরে সিপিসি অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে ধাপে ধাপে অগ্রগতি করেছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের ভেঙে পড়া, গর্ভাচেভের প্রশ্নবোধক নোবেল শান্তিপদক প্রাপ্তি, কমিউনিজম বা সোসিয়ালিজম বা মার্কসবাদের শুয়ে পড়া অবস্থাও চীনের উত্থানে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। পূর্ব ইউরোপেও অনেক কমিউনিস্ট পার্টি বা সোসিয়ালিস্ট পার্টি ভেঙে পড়েছে। মার্কসবাদের করুণ পরিণতি, খোদ রাশিয়ায় লেনিনের মূর্তি ও ভাস্কর্য্য ভেঙে ফেলায় মানুষের প্রতিবাদকে গণতান্ত্রিক পশ্চিমারা প্রচার করেছে এসব ‘ফালতু’ মতবাদ টিকে থাকে না। তবুও চীনের কমিউনিস্ট পার্টি খুব ভালো করতে লাগল, চীনকে বিশ্বের দ্বিতীয় ইকোনমিক ক্ষমতাধর শক্তিতে নিয়ে এলো।
চীনের মহীরূহ হয়ে গড়ে ওঠায় সিপিসির ভূমিকা এখন আর কেউ অবমূল্যায়ন করতে পারছে না। চীনকে বিখণ্ডিত করার চেষ্টা করা হলেও রাশিয়া ও গর্ভাচেভের মতো কোনো অবস্থার সৃষ্টি হয়নি। অনেকে প্রশ্ন রাখবেন, চীনে মার্কসবাদের কী অবস্থা হলো! চীনের কমিউনিস্ট পার্টি ও রাশিয়ার কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে পার্থক্য কী? পার্থক্য তো অনেক, নেতৃত্ব, ব্যবস্থাপনা ও ইন্টিগ্রিটি ও ভিন্ন পটভূমি। রাশিয়া শিল্পপ্রধান সমাজ ব্যবস্থা, শ্রমিকরা শিল্প-কারাখানায় পারদর্শী; লেনিন মাকর্সবাদকে রাশিয়ান শিল্পবিপ্লবের সাথে সহমর্মী করে তুলেছিলেন। অপর দিকে চীন কৃষিপ্রধান দেশ ও চীনা বিপ্লবের সাথে চাষি ও কৃষিসম্পদের সাথে যারা জড়িত তারা বেশি সংযুক্ত। মাও দে জুং নিজেই এক কৃষক ও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। তিনি তার চিন্তাভাবনা ও মাকর্সবাদকে চীনা সমাজের সাথে সম্পৃক্ত করে তৈরি করেছিলেন। দেং জিয়াও পিং অর্থনৈতিক মতবাদ প্রতিষ্ঠা করে চীনকে বিশ্বে উন্মুক্ত করার প্রয়াস পান। প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং সিপিসিকে বর্তমান উদ্ভূত ভূরাজনৈতিক সমস্যার আলোকে ‘রিফর্ম’ করার প্রয়াস পান। প্রেসিডেন্ট শি’র চিন্তাভাবনাকে ‘সোসিয়ালিজমের চীনা চরিত্র’ বা চাইনিজ ভ্যারিয়েন্ট হিসেবেও অভিহিত করা হয়।
গত সাত দশক ধরে চীনে যারা নেতৃত্বে ছিলেন তাদের কাজে দেশ-বিদেশের কেউ প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করতে পারেনি। নেতৃত্বের কর্ণধাররা ছিলেন বিজ্ঞ-দেশপ্রেমী ও জনগণ ছিল পরিশ্রমী। বৈশ্বিক কোনো মতবাদ চীনে চাপিয়ে দেয়া সম্ভব হয়নি। চীনের মূল ভূখণ্ডে কোনো চাপ না পড়লেও অধুনা হংকং ও তাইওয়ান নিয়ে বিশ্বশক্তিরা অনেকে খেলছে। শতবর্ষ উদযাপনের উৎসব পালনকালে প্রেসিডেন্ট শি সাবধানবাণী উচ্চারণ করে বলেছেন, ‘তাদের হাত গুড়িয়ে দেয়া হবে’। চীনকে চাপ দিয়ে নত করে রাখার দিন শেষ। চীনের উত্থানে বাধা দেয়ার দিনও ফুরিয়ে গেছে। চীন শুধু অর্থনীতির টাইকুনই নয়, সামরিক পরাশক্তিও।
সিপিসির ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, সিপিসি নিজের সুবিধা আদায়ের জন্য আত্মম্ভরি হয়নি বরং মানবসম্পদ উন্নয়ন ও শান্তির কাজও করেছে। প্রঙ্গত, উইঘুরদের ব্যাপারে বিভিন্ন অভিযোগ এলেও হুইদের উন্নয়নের কথা কেউ বলে না। চীনে দু’টি বড় মুসলিম গোষ্ঠী রয়েছে। একটি হলো জিনজিয়াংয়ের উইঘুর এবং অপরটি হুই। চীনা জনসংখ্যার বিশাল সাগরে তারা স্রেফ কয়েক ফোঁটা পানির মতো। এক কোটি করে লোকসংখ্যা উভয় গোষ্ঠীর, আকারে তাইওয়ানের সমান। কিন্তু উইঘুরদের যখন পুলিশি চাপ সইতে হয় তখন হুইরা সমৃদ্ধ হচ্ছে, বিষয়টি ভেবে দেখার মতো।
সিপিসির আন্তর্জাতিক বিভাগের বড় কাজ কোনো আক্রমণ বা যুদ্ধ প্রতিহত করা, বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করা, আন্তঃরাষ্ট্র সম্পর্ক গভীরতর করা, দেশে ও বন্ধু দেশে আধুনিক অবকাঠামো নির্মাণ করা। ১৯৭০ সালে চীন রিফর্ম শুরু করে এবং চীনকে আন্তর্জাতিক অবস্থানে নিয়ে শক্তভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে শুরু করে। বলা যায়, মার্কসবাদে চীনা চরিত্র ঢুকতে থাকে। দেং জিয়াও পিংয়ের মতবাদগুলো কাজ করতে শুরু করে ও এসব মতবাদ প্রতিষ্ঠা করতে নীতিমালা তৈরি শুরু হয়। উল্লেখ্য, মাও দে জুংয়ের সময়ের মতো লাল বই ছাপিয়ে তা বিলি বণ্টন করা হয়নি বরং পার্টি সভাগুলোকে কার্যকরী রূপ দেয়া হয় এবং কর্মীদের উদ্বুদ্ধ করা হয়। শুধু বিদেশী কমিউনিস্টদের সাথে সংযোগ রক্ষা করা, শুধু কমিউনিস্ট শ্রমিক ও বামপন্থীদের সাথে বৈঠক-বন্ধনের নীতি সম্পূর্ণ পরিত্যাজ্য হয়। অন্য ঘরনার ও মতবাদের দল ও রাজনৈতিক নেতাদের সাথে আলাপ-আলোচনার দ্বার উন্ম্ক্তু করায় পারস্পরিক সম্পর্ক আরো উচ্চতায় অবস্থান করছে। সিপিসির সদস্যদের সবাইকে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বিষয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে একই কাতারে রাখার চেষ্টা করা হয়। দেশ পরিচালনায় যোগ্যতা সৃষ্টির পাশাপাশি অভিজ্ঞান অর্জনের সুবিধা দেয়া হয়। ‘গ্লোবাল ভিশন’ কেমন তার স্বচ্ছ ধারণা দেন সিপিসির পণ্ডিত নেতারা। সিপিসির রয়েছে নিজস্ব প্রশিক্ষণ ও গবেষণাকেন্দ্র। গ্লোবাল ভিশন সম্পর্কে সঠিক ধারণা নিতে পার্টি-পার্টি বৈঠকের ব্যবস্থা করা হয় যেখানে সামাজিক উন্নয়ন, সোসিয়ালিস্ট ভাবধারার পরিচর্যা ও কমিউনিস্ট পার্টি পরিচালনার কৌশলাদি শেখানো হয় ও সমসাময়িক অন্যান্য দেশের পার্টি পলিসিগুলো নিজেদের নীতিমালার সাথে তুলনামূলক মূল্যায়ন করা হয়; এই স্তর থেকে নিজেদের ভাবধারার আরো উন্নয়নের শিক্ষা উপকরণ সংগ্রহ করে সিপিসি।
বর্তমান বিশ্ব রাজনীতি ছাড়াও, চারটি বিষয়- অর্থনীতি, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান ও টেকনোলজিও চর্চিত হয়। এতসব বিষয়ের চর্চায় সদস্যরা সমৃদ্ধ হয় যা সরকার পরিচালনায় নীতি নির্ধারণে, কৌশল প্রণয়নে কাজে লাগে। বিদেশী রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পর্কোন্নয়নের জন্য সিপিসি স্টাডি ট্যুর করে, যদিও এটি সনাতন পদ্ধতি। প্রাদেশিক ও মিউনিসিপাল পার্টি নেতারা বিদেশ সফরের সময় গ্রামপর্যায়ের নেতাদের সাথে নিয়ে যান। দুদেশের সহযোগিতামূলক প্রকল্প কিভাবে বাস্তবায়িত হয় তা হাতে-কলমে শেখা বা দেখার সুযোগ এসব সফরে থাকে। চীনা সরকারি প্রকল্পগুলোতেও বিদেশীদের সমানভাবে সফরের ও স্টাডির সুযোগ থাকে। পদ্ধতির সঠিক বাস্তবায়নের ফলে এসব প্রকল্প সন্তোষজনক পর্যায়ে রয়েছে।