নোয়াখালীতে গান্ধীর ছাগল চুরি : নেপথ্য কাহিনী
নোয়াখালীতে গান্ধীর ছাগল চুরি : নেপথ্য কাহিনী - ছবি : সংগৃহীত
মহাত্মা গান্ধী হিসেবে পরিচিত মোহনচাঁদ গান্ধীর নোয়াখালী সফর বহুল চর্চিত একটি বিষয়। বিশেষ করে এখানে তার ছাগলটি চুরি করে খেয়ে ফেলার ঘটনাটি বেশ ফলাও করে প্রচার করা হয়। ১৯৪৬ সালে হিন্দু-মুসলিম উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে ঘটনা নতুন করে আলোচনার দাবি করাখে।
এই ঘটনার একটি ভাষ্য পাওয়া যায় অধ্যক্ষ তাফাজ্জল হোসেইনের ‘স্মৃতিকণা’য়। এখানে তা তুলে ধরা হলো।
“মুসলিম লীগ অর্থাৎ পাকিস্তান আন্দোলনের বিরুদ্ধে যদি কোন মুসলমান ক্ষীণ প্রতিবাদও করতো তবে তার আর রক্ষা ছিল না। তথাপি কংগ্রেস ও হিন্দু মহাসভা মুসলিম লীগের পাকিস্তান আন্দোলনকে বানচাল করবার জন্য জমিয়তে ওলামায়ে হিন্দ নামক একটি মুসলমান রাজনৈতিক দল খাড়া করালেন এবং অজস্র অর্থ দিয়ে তাদের পুষ্ট করবার জন্য প্রাণান্ত হয়ে লেগে গেলেন। নোয়াখালী জেলার রামগঞ্জ অঞ্চলে গোলাম সরোয়ার হোসাইনী এই জমিয়তে ওলেমায়ে হিন্দ পার্টির টিকেটে মুসলিম লীগ প্রার্থীর বিরুদ্ধে নির্বাচনে অবতীর্ণ হলেন। নোয়াখালী জেলার হিন্দু মহাসভার তৎকালীন সভাপতি রাজেন্দ্র লাল রায় চৌধুরী জমিয়তে ওলেমা পার্টির প্রার্থীগণের আর্থিক সাহায্য দানের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। নির্বাচনে গোলাম সরওয়ার অত্যন্ত শোচনীয়ভাবে মুসলিম লীগ প্রার্থীর হাতে হেরে যান। পাকিস্তানের বিরোধিতা করার দরুন গোলাম সরওয়ারের পৈতৃক যে পীর-মুরিদীর খানকা ছিল তার আয়ও অস্বাভাবিকভাবে কমে যায়। এমতাবস্থায় গোলাম সরওয়ার হিন্দু মহাসভার সভাপতি রাজেন্দ্র বাবুর নিকট থেকে পূর্ব প্রতিশ্রুত মতে বাকী আর্থিক সাহায্য চাইলেন।
কার্যসিদ্ধি হলো না বলে রাজেন্দ্র লাল গোলাম সরওয়ারকে আর কোন টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানালে উভয়ের মধ্যে গরম গরম কথা কাটাকাটি হয়। রাজেন্দ্র লালকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য গোলাম সরওয়ার তার মুরিদানকে রাজেন্দ্র বাবুর বাড়ি লুট করে আনার জন্য নির্দেশ দেন, তখন ছিল দুর্গা পূজার সময়। রাজেন্দ্র বাবুর গ্রামের বাড়ি করপাড়াতে মহাসমারোহে পূজার আয়োজন হচ্ছিল। দাঙ্গা আরম্ভ করবার পূর্বে দাঙ্গাকারীগণ চিরাচরিত প্রথা অনুযায়ী সত্যমিথ্যা নানা প্রকার গুজব ছড়ায় এবং ধর্মের নামে নানা অধার্মিক ফতোয়া দিয়ে কাফের নিধন করার আর হিন্দু দাঙ্গাকারীগণ শাস্ত্রের নামে যবন নিধন করার শ্লোগান দিয়ে জনতাকে উত্তেজিত করতে থাকে।
এক্ষেত্রে গোলাম সরওয়ারও অনুরূপ পন্থা অবলম্বন করে দাঙ্গা বাধিয়ে দেয়। রাজেন্দ্র বাবুসহ প্রায় দুইশত হিন্দু দাঙ্গায় নিহত হয় এবং বহু ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়। কোন কোন ক্ষেত্রে হিন্দু নারীদের উপর অকথ্য অত্যাচার করা হয়। কলকাতার আনন্দবাজার, অমৃতবাজার প্রভৃতি পত্রিকায় পাঁচ হাজারের উপর হিন্দু নিহত হয়েছে বলে অতিরঞ্জিত সংবাদ প্রচার করে সারা ভারতে হিন্দুদের উত্তেজিত করে। মহাত্মা মোহনদাস করম চাঁদ গান্ধী শান্তি মিশন নিয়ে ৭ই নভেম্বর ১৯৪৬ নোয়াখালীতে আগমন করেন (১৯৪৭ সালের মার্চ পর্যন্ত তিনি নোয়াখালিতে ছিলেন)। যুক্ত বাংলার শেষ প্রধানমন্ত্রী শহীদ সোহরাওয়ার্দী ইতিপূর্বেই পুলিশ ও মিলিটারী এনে দাঙ্গা দমিয়ে ফেলেন। দাঙ্গা প্রশমিত হলেও উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে এই অবিশ্বাস ও উস্মা তখনও থেকে যায়। গান্ধীজী এসেই উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে এই অবিশ্বাস ও হিংসার মনোভাব দূর করবার জন্য তাঁর দৃঢ় সংকল্পের কথা ঘোষণা করলেন। যতদিন না তাঁর সংকল্প সফল হচ্ছে ততদিন তিনি নোয়াখালী ত্যাগ করে অন্য কোথায়ও যাবেন না একথাও সংশ্লিষ্ট মহলে জানিয়ে দিলেন।
গান্ধীজী চৌমুহনী শহরে অবতরণ করে দুদিন এখানে থেকে দত্তপাড়া হয়ে কাজির খিল কাশী পণ্ডিতের বাড়িতে এসে নোয়াখালীতে গান্ধীজী মিশনের প্রধান কার্যালয় হিসেবে এ বাড়িটি মনোনীত করেণ। কাশী পণ্ডিত সুদের ব্যবসা করে অতুল ঐশ্বর্যের অধিকারী ছিলেন। সুদ আদায়ের জন্য মামলা মোকর্দমা করে তার আশেপাশের মুসলমান কৃষকদের ভূসম্পত্তি সবই প্রায় আত্মসাৎ করে নিয়েছিলেন। দাঙ্গায় তিনিও নিহত হন।
দাঙ্গার প্রধান হোতা গোলাম সরওয়ার হোসাইনী তাঁর রাজনৈতিক জীবনের প্রারম্ভিক যুগে কৃষক আন্দোলন করেন। সে জন্য কৃষককুলের উৎপীড়ক জমিদার মহাজনের প্রতি তাঁর একটা ঘৃণা ও হিংসার মনোভাব ছিল। কৃষক আন্দোলনের সময় তিনি হিন্দুর ন্যায় বহু মুসলান জমিদার ও মহাজনের ঘরবাড়িও পুড়িয়ে দিয়েছিলেন। এবারের দাঙ্গা বাধিয়ে ছিলেন প্রধানত তিনটি উদ্দেশ্যে
: এক-রাজেন্দ্র বাবুর উপর ব্যক্তিগত প্রতিশোধ নেয়া, দুই-মুসলিম লীগের তথা অধিকাংশ মুসলমানের তিনি বিরোধিতা করে তাঁর মুরিদগণের মধ্যে হারানো আস্থা ফিরিয়ে আনা এবং তিন-স্থানীয় লোকদের মধ্যে বীর সাজার লোভে তিনি এই পথ বেছে নিয়েছিলেন।
কিন্তু দাঙ্গা যে এত দ্রুতবেগে এবং বিস্তৃত অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়বে তা তিনি নিজেও আশা করেননি। দাঙ্গা যখন বেধে গেল তখন চোর ডাকাত ও গুণ্ডা প্রকৃতির লোক একদিকে লুটতরাজ ও ধনী মহাজন জমিদারদের দ্বারা নিষ্পেষিত গরিব হত্যা করার স্পৃহা মনের অবচেতন স্তর থেকে জ্বলে ওঠে। এই পাপ কামনাকে পীর সাহেবের গোলাম সরওয়ার দোহাই দিয়ে সমাজে জায়েজ (বিধেয়) করে নিয়ে অনেক জমিদার মহাজন হত্যা করে। দাঙ্গার এই প্রকৃতি লক্ষ্য করে অনেক মুসলিম লীগ পন্থী অন্যায় ভীর জমিদার ও মহাজন ভয়ে নিজ নিজ বাস্তুভিটে ত্যাগ করে পালিয়ে যায়। রায়পুরা ও গোপালপুরে মুসলিম জমিদারগণ দাঙ্গা লাগার সঙ্গে সঙ্গেই গ্রাম ছেড়ে শহরে বন্দরে গিয়ে আত্মগোপন করে থাকেন।”