আফগানিস্তান : পরাশক্তিদের কবরস্থান
আফগানিস্তান : পরাশক্তিদের কবরস্থান - ছবি : সংগৃহীত
আফগানিস্তান হলো সেই জায়গা যেখানে বার বার সাম্রাজ্যবাদ পরাজিত হয়েছে। এক সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে তো আরেক অতি-আত্মবিশ্বাসী (বিশ্বাসী) শক্তি আগ পিছ না ভেবে ঝাঁপিয়ে পড়েছে নিজের শক্তি পরীক্ষার জন্য। এ যেন কার্ল মাকর্সের ইতিহাস নিয়ে করা মন্তব্যকে বাস্তবতায় পরিণত করেছে, এটাও ইতিহাসের শিক্ষা যে কেউ ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয় না। আধুনিক আফগানিস্তানের ইতিহাস যেন সেই শিক্ষাই দিয়ে চলছে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে। আমরা আধুনিক বিশ্ব ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখতে পাব, তিন তিনটি বিশ্ব পরাশক্তি (ব্রিটিশ, সোভিয়েত ও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী) যারা তাদের শক্তি সামর্থ্যের সর্বোচ্চ পর্যায়ে অবস্থান করার সময়ে কিভাবে নিয়তির টানে তাদের চেয়ে শক্তি সামর্থ্যে শত গুণ পিছিয়ে পড়া আফগান জনগোষ্ঠীর কাছে সবচেয়ে করুণ পরিণতি ভোগ করে তিল তিল করে গড়ে তোলা সাম্রাজ্যের ধ্বংসের সূচনা পর্ব তৈরি করেছিল এবং তা থেকে আর কখনোই ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। নিক্ষিপ্ত হয়েছে ইতিহাসের অচেনা চোরাবালিতে।
ব্রিটিশদের কবরস্থান
আহমেদ শাহ দুররানি ১৭৪৭ সালে আধুনিক আফগানিস্তানের কান্দাহারকে রাজধানী করে দুররানি রাজবংশের প্রতিষ্ঠা করেন। যা ১৮২৬ সালে দোস্ত মুহাম্মদ শাহ আমিরাতে আফগানিস্তান পরিবর্তিত করে নিজেকে আমির ঘোষণা করে। কিন্তু রাজ্যতন্ত্র বহাল ছিল ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত। দোস্ত মুহাম্মদের শাসনকাল থেকে আফগান হয় গ্রেট গেমের ক্রীড়াভূমি যা আজো চলমান। ভৌগোলিকভাবে দক্ষিণ পূর্বে হিমালয় পর্বতমালা আর দক্ষিণ -পশ্চিমে হিন্দুকুশ পর্বতমালায় আফগানিস্তান হয়ে আছে পৃথিবীর অন্যতম সুরক্ষিত ভূমি। এই ভূমির নিয়ন্ত্রণ নিয়েই গ্রেট গেমের সূচনা হয় তৎকালীন সুপার পাওয়ার ব্রিটিশ আর রুশ সাম্রাজ্যের মধ্যে। এশিয়া বিস্তৃীর্ণ অঞ্চলে নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে যা আজো বিশ্ব পরাশক্তি গুলোকে বার বার টেনে আনে আফগান ভূমিতে।
অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে ব্রিটিশদের ভারতীয় উপমহাদেশের অবাধ নিয়ন্ত্রণে হুমকি হয়ে দেখা দেয় রুশ সাম্রাজ্যের আফগানিস্তান নীতি।তারা আফগানিস্তান হয়ে ভারত অভিমূখী হওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছিল।
তাই ব্রিটিশরা আফগানিস্তানের প্রবেশ মুখেই রুশদের প্রতিরোধের জন্য আফগান আমির দোস্ত মুহাম্মদের কাছে দূত পাঠায় এবং আফগানিস্তানকে অধীনতামূলক মিত্রতা নীতি মেনে আশ্রিত রাজ্য হওয়ার হীন প্রস্তাব দেয়।
সুযোগ বুঝে দোস্ত মুহাম্মদ ব্রিটিশদের শিখ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে তাকে সামরিক সহায়তার প্রস্তাব দেয়। কারণ শিখরা পেশওয়ার প্রদেশ দখল করে নিয়েছিল। কিন্তু ব্রিটিশরা এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। দোস্ত মুহাম্মদ রুশদের সাথে যোগাযোগ করবেন- এই আশঙ্কায় ব্রিটিশরা আফগানিস্তান আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেয়।
প্রথম ইঙ্গ-আফগান যুদ্ধ (১৮৩৮-৪২)
১৮৩৮ সালে আফগান অভিমুখে সৈন্য পাঠালে শুরু হয় প্রথম ইঙ্গ-আফগান যুদ্ধের। যুদ্ধে প্রচুর ক্ষয়ক্ষতির সত্ত্বেও ইংরেজরা ব্রিটিশপন্থী শুজা শাহ দুররানিকে আমির বানাতে সক্ষম হয়।
কিন্তু স্বাধীনতাপ্রিয় আফগান জাতি তা মেনে নিতে পারেনি। ব্রিটিশরা আফগানস্তান ত্যাগ করা কালে দোস্ত মুহাম্মাদের পুত্র ওয়াজির আকবার খাঁনকে আমির মনোনীত করে আফগান জনগণ সংগঠিত হয়ে ব্রিটিশ সৈন্যদের আক্রমণ করে। তাদের মধ্যে শুধু ড. উইলিয়াম ব্রাইডন জালালাবাদ ঘাঁটিতে পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি ফিরতে পেরেছিলেন কেবল ওই আক্রমণের ভয়াবহতার বিবরণ ইংরেজদের কাছে পৌঁছানোর জন্য।
দ্বিতীয় ইঙ্গ-আফগান যুদ্ধ
যুক্তরাজ্য ও আফগানিস্তানের মধ্যে ১৮৭৮ সাল থেকে ১৮৮০ সালের মধ্যে সংঘটিত হয়। এসময় শের আলি খান ছিলেন আফগানিস্তানের শাসক। ব্রিটিশ ভারতের এটি ছিল দ্বিতীয় আফগানিস্তান আক্রমণ। যুদ্ধে ব্রিটিশরা বিজয়ী হয়। অধিকাংশ ব্রিটিশ ও ভারতীয় সৈনিক আফগানিস্তান থেকে ফিরে এসেছিল। আফগান গোত্রগুলোকে অভ্যন্তরীণ শাসন ও স্থানীয় প্রথা বজায় রাখার অনুমতি দেয়া হয়েছিল। তবে বৈদেশিক বিষয়াদির নিয়ন্ত্রণ ব্রিটিশদের হাতে চলে যায়। ভারতের দিকে রুশ সাম্রাজ্যের বিস্তার রোধের জন্য ব্রিটিশরা এই পদক্ষেপ নেয়।
তৃতীয় ইঙ্গ-আফগান যুদ্ধ
দ্বিতীয় ইঙ্গ-আফগান যুদ্ধের পর দীর্ঘ ৪০ বছর তেমন কোনো সামরিক সংঘাতে জড়ায়নি দুই পক্ষ। কিন্তু তৎকালীন আমির হাবিবুল্লাহ মৃত্যুর পর দুই পক্ষের সম্পর্ক ক্রমেই বৈরী হতে থাকে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ আফগান জাতি নিরপেক্ষ থাকার নীতি অবলম্বন করে। যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে নতুন আমির আমানুল্লাহ ক্ষমতা গ্রহণের পর পরই তার চাচা নাসরুল্লাহকে পিতৃহত্যার সন্দেহে গ্রেফতার করে কারাদণ্ড প্রদান করেন। নাসরুল্লাহ দীর্ঘকাল আফগান রক্ষণশীল চিন্তা-চেতনার ধারক ছিলেন। এর ফলে পরিস্থিতি কিছুটা খারাপের দিকে এগুচ্ছিলো। এপ্রিল ১৯১৯ নাগাদ, আমানুল্লাহ বুঝতে পারেন যে রক্ষণশীলদের শান্ত করা না গেলে তিনি ক্ষমতায় টিকতে পারবেন না। অভ্যন্তরীণ আফগান আদালতে গন্ডগোল থেকে বেরিয়ে আসার জন্য এবং অমৃতসর হত্যাকাণ্ডকে ঘিরে ক্রমবর্ধমান নাগরিক অশান্তির সুযোগ ব্যবহার করে আমানুল্লাহ ব্রিটিশ ভারত আক্রমণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। যুদ্ধে পরাজিত ব্রিটিশরা অবশেষে ডুরান্ড লাইনকে সীমানা করে চুক্তিতে পৌঁছাতে একমত হয় এবং শর্ত হিসেবে আফগানিস্তানের পূর্ণ স্বাধীনতার মূল্য হিসেবে ইংরেজ নিয়ন্ত্রিত ভূমিতে কোনো সামরিক তৎপরতা না চালানোর জন্য আফগানিস্তানকে রাজি করায়।
এই যুদ্ধের মাধ্যমে পরাধীনতার লজ্জা গান্দাক চুক্তি থেকে বের হয়ে স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়নর অধিকার লাভ করে আফগানরা। অপর দিকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের কফিনে যুক্ত হয় আরো একটি পেরেক। এর মাত্র ২০ বছর পরই ব্রিটিশ সাম্রাজ্য ইতিহাসের অংশ হয়ে যায় পৃথিবী মানচিত্র থেকে।
সোভিয়েতের ইউনিয়নের গোরস্তান
১৯৩৩ থেকে ১৯৭৩ পর্যন্ত আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট ছিলেন জহির শাহ্। তিনি বাদশাহ নাদির শাহর পুত্র। জহির শাহ ছিলেন চিন্তাচেতনায় মধ্যপন্থী কমিউনিস্ট। তার রাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় ১৯৬৫ তে কমিউনিস্ট ভাবধারায় গঠিত হয় পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টি অফ আফগানিস্তান।
প্রতিষ্ঠাকালীন পিডিপিএর সাধারণ সম্পাদক ছিলেন নুর মুহাম্মাদ তারাকি। আর হাফিজুল্লাহ আমিন এবং তার সরকারের রাশিয়ায় নিযুক্ত আফগানের রাষ্ট্রদূত বারবাক কারমাল ছিলেন এ পার্টির গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। পরে আফগানের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে এই তিন চরিত্রের নাটকীয় ভূমিকা লক্ষণীয়।
প্রতিষ্ঠার এক বছরের মাথায় ১৯৬৭ সালে পিডিটিএ দুটি দলে বিভক্ত হয়ে যায়। একটি নুর মুহাম্মাদ তারাকীর নেতৃত্বাধীন খালক পার্টি। অপরটি বারবাক কারমালের নেতৃত্বে পারচাম পার্টি।
জহির শাহ ব্রিটিশদের মডেলের অনুকরণে একটি রাজতান্ত্রিক কমিউনিস্ট কাঠামোয় রাষ্ট্রের সংস্কার করতে গিয়ে চিরাচরিত রাজতন্ত্রের ব্যাপক পরিবর্তন নিয়ে আসেন যা পরে তার জন্য ভয়াবহ সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। তিনি সকল রাজবংশীয় স্বজনকে ক্ষমতাচ্যুত করেন, নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের নিয়ে আইন পরিষদের লয়াজিরগা গঠন করেন।
রাজনৈতিক পেক্ষাপটে আফগানিস্তান অস্থিতিশীল হয়ে উঠে ১৯৭৩ সালের ১৭ জুলাই। জহির শাহ যখন অবকাশযাপনে ইতালিতে, দাউদ খান তখন পারচাম পার্টির সমর্থন নিয়ে ক্যু করে জহির শাহকে উৎখাত করেন।যা আফগান ইতিহাসে সাওর বিপ্লব নামে প্রসিদ্ধ। দাউদ খান ছিলেন রাজপরিবারের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য এবং জহির শাহের প্রধানমন্ত্রী (১৯৫৩-৬৩) এবং বোন জামাই।
দাউদ খান পারচামের সদস্যদের অতিরিক্ত সুযোগ-সুবিধা দিতে থাকেন। ফলে সৃষ্টি হয় সোভিয়েতপন্থী খালক পার্টির সাথে সরকারের দূরত্ব। দাউদ খানের স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতির কারণে আফগানিস্তানে রাশিয়ার প্রভাব ক্রমে হ্রাস পাচ্ছিল।
ক্ষমতা নিয়েই তিনি রাজ্যতন্ত্র বিলুপ্ত করে নিজেকে প্রসিডেন্ট ঘোষণা করেন। একই সাথে সকল রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করে সকল রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের গণগ্রেফতার করে ওয়ান পার্টি সিস্টেম কায়েম করে নিজের ক্ষমতাকে আজীবনের জন্য সুসংহত করার উদ্যোগ নেন। দাউদ খানে এই সিদ্ধান্তে সোভিয়েত এবং খালক পার্টি বিচলিত হয়ে পড়ে। দাউদ খানকে সরিয়ে দেয়ার প্রয়োজনবোধ করে রাশিয়া। এসময় ক্ষমতার স্বপ্নে বিভোর হয়ে রাশিয়ার সহযোগী হয় খালক পার্টি।
অবশেষে ১৯৭৮ সালের ২৮ এপ্রিল আফগান সামরিক বাহিনীর অভ্যুত্থানে দাউদ খান সপরিবারে নিহত হন। ক্ষমতা চলে যায় খালক পার্টির কাছে রাশিয়ার সমর্থনে। তার একসময়ে গুরুত্বপূর্ণ সহযোগীরাই সেনাবাহিনীর গুটি কয়েক সদস্য খালক পার্টি এবং সোভিয়েত সমর্থন নিয়ে দাউদ খানকে সপরিবারে (১৬ সদস্য) নির্মমভাবে হত্যা করে।
এই হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে আফগানিস্তান চলে যায় সোভিয়েত রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে। পরে নুর মোহাম্মদ তারাকি প্রসিডেন্ট এবং হাফিজুল্লাহ আমীন প্রধানমন্ত্রী হয়। তারাকি এতইটাই অকর্মন্য ছিলেন যে তার সময়ে সব গুরুত্বপূর্ণ পদে রাশিয়ানদের নিয়োগ দেয়া হয়। এবং কেজিবির সদস্যরা প্রকাশ্যে চলাফেরা করতে থাকে।
আফগানিস্তানে ওই সময় বিবেচনা করার মতো তিনটি রাজনৈতিক দল ছিল। পিডিপিএর বিভক্ত দুটি শাখা- খালক পার্টি ও পারচাম পার্টি এবং তিন নম্বরে কাবুল বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ফ্যাকাল্টির ডীন প্রফেসর বুরহানুদ্দীন রব্বানী, গুলবুদ্দীন হেকমতিয়ার, আহমাদ শাহ মাসউদ, দীন মুহাম্মাদ, কাজী আমিন প্রমুখের কমিউনিস্টবিরোধী ইসলামপন্থী ছাত্র আন্দোলন।
নুর মুহাম্মাদ তারাকি সরকারের প্রধানমন্ত্রী হাফিজউল্লাহ আমিন (২৭ মার্চ ১৯৭৯–২৭ ডিসেম্বর ১৯৭৯) ব্যাপারে মস্কো সন্তুষ্ট ছিল না। তারা প্রেসিডেন্ট নূর মুহাম্মাদ তারাকিকে সংকেত দিচ্ছিল হাফিজউল্লাহকে বরখাস্তের জন্য। আর গোয়েন্দা মারফত এ ব্যাপারে আগেই জেনে যান হাফিজউল্লাহ নিজে।
এরপর ১৪ সেপ্টেম্বর, ১৯৭৯। রাষ্ট্রপতির বাসভবন আক্রমণ করে নুর মুহাম্মাদ তারাকিকে হত্যা করে হাফিজুল্লাহর অনুসারীরা।
তারাকির হত্যাকণ্ডকে রুশরা সহজভাবে নেয়নি। তারা ২৪ ডিসেম্বর হাফিজুল্লাহকে কাবুলে হত্যা করে। সরাসরি কাবুলে থাকা রাশিয়ান সৈন্যরা আফগান সেনাবাহিনীর পোশাক পরে এই ন্যাক্কারজনক ঘটনা ঘটায় এবং ক্ষমতায় বসায় আরেক পাপেট বারবাক কারমালকে এবং আফগানিস্তানে কারমালের শাসনামালে অত্যাচার নিপীড়ন বহু মাত্রায় বেড়ে যায়। যারা কমিউনিস্ট কাঠামোর বিরোধিতা করত তাদের কপালে জুটত জেল-জুলুম আর মৃত্যু।
জোরপূর্বক কমিউনিস্ট আদর্শ চাপিয়ে দেয়া হয় জনগণের ওপর। যা ছিল আফগান মানুষের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক এবং ধর্মবিরুদ্ধ একটি নতুন আদর্শ। এসময় মসজিদের মেম্বার থেকে আহবান আসে জিহাদের। এতে দেশ বিদেশের বরেণ্য আলেমদের সহযোগিতা এবং পরামর্শ নেয়া হয়। বিশেষ করে পাকিস্তানের উলামায়ে কেরাম ছিলেন সর্বাগ্রে, তারা আফগান জনগণের জন্য স্বাধমতো সব করে।
সোভিয়েত আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ইসলামপন্থী ছাত্র আন্দোলন গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ার, বুরহানউদ্দীন রব্বানির নেতৃত্ব প্রতিরোধ যুদ্ধের সূচনা হয়। পরে মার্কিনপন্থী পাকিস্তান, সৌদি আরব, মিসর তাদের সমর্থন দেয়। যার পরে সকল ইসলামপন্থী জনগোষ্ঠী জড়িয়ে পরে পবিত্র জিহাদি চেতনায়।
রাশিয়ার ৩০ হাজার সৈন্য আফগানিস্তানে অনুপ্রবেশ করে। প্লান ছিল কয়েক মাসের ভিতর আফগানের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে তারপর চলে যাবে। কিন্তু সে যাওয়া আর হলো না। দীর্ঘ নয় বছর দুই মাস পর সোভিয়েত আর্মির শেষ ডিভিশন যখন আমু দরিয়ার ব্রিজ পার হয়ে রাশিয়ায় ফেরৎ যাচ্ছিল, তত দিনে বিশ্বের দ্বিতীয় পরাশক্তি আফগানের পাহাড়ে এমনই আঘাত পেয়েছে যে যার দরুণ অন্তিমশয্যায় কাতরাচ্ছিল। এবং সেই আঘাতেই সোভিয়েত ইউনিয়ন খণ্ডবিখণ্ড হয়ে যায়। আফগানিস্তানের মাটিতে রচিত হয় আরেক সাম্রাজ্যবাদী সোভিয়েত ইউনিয়নের কবর।
বস্তুত যারাই পৃথিবীতে নিজেদের আধিপত্য আর মানুষকে নিজেদের ইচ্ছেমতো চালাতে চেষ্টা করছে তাদেরই শক্তি পরীক্ষার জন্য ইসলামি আদর্শের আর মুসলিমদের সাথে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়েছে যুগে যুগেই।
তালেবানের উত্থান এবং মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের পতন ঘণ্টা
মিডিয়া প্রপাগাণ্ডা ভিকটিম আমাদের প্রজন্মের কাছে তালেবান পরিচিত আইএসআই এজেন্ট নয়ত সন্ত্রাসী মৌলবাদী গোষ্ঠী হিসেবে। শতকরা হিসেবে ৯৫ ভাগ সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ধারণাই এই দুই দুষ্ট চক্রের মধ্যে গেঁথে গেছে।
এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় যে ভুল ধারণা তা হলো তালেবান কিন্তু সোভিয়েত আগ্রাসন যুদ্ধ জয়ের পড়ে গঠিত একটি শান্তিকামী সংগঠন তা অনেকেই জানে না।
যাই হোক আসল কথায় ফেরা যাক। দীর্ঘ নয় বছর ২ মাস সোভিয়েত আগ্রাসনের মোকাবিলা করে যখন সবাই আশায় বুক বাঁধছে এবার বুঝি শান্তি ফিরবে আফগানিস্তানের রক্তস্নাত ভূমিতে।
কিন্তু ওই আশা দুরাশা মাত্র যুদ্ধ শেষ হতেই দেখা দেয় অভ্যন্তরীণ নানা কোন্দল আর হিংসাত্মক নৈরাজ্য। ক্ষমতার দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে সব ইসলামপন্থী কমান্ডার। যারা কয়েক দিন আগেও শত্রুর বিরুদ্ধে একসাথে কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন একে ৪৭ রাইফেল। কিন্তু বিধি বাম। এবার শত্রুর অনুপস্থিতিতে সেই অস্ত্র একে অপরের বুকে বিদ্ধ করতে এতটুকুও ভাবছে না। এদিকে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের আতুড়ঘর জাতিসঙ্ঘ চাপ দিয়ে যাচ্ছে পরাজিত নাজিবুল্লাহর সাথে ক্ষমতা ভাগাভাগি করে সরকার ও দেশ পরিচালনার জন্য। কারণ পশ্চিমারাও চায় না একক কোনো সরকার গঠন করতে পারুক মুজাহিদ ইসলামপন্থী গ্রুপগুলো।
অবশেষে বুরহান উদ্দিন রব্বানী রাষ্ট্রপতি, গুলবুদ্দিন হেকমাতিয়ার প্রধানমন্ত্রী, এবং আহমেদ শাহ মাসুদ সেনাবাহিনীর প্রধানের দায়িত্ব নিয়ে ক্ষমতা ভাগবাঁটোয়ারা করে। এতে কোনো সমন্বয় তো ছিলই না, উল্টা একে অপরের বিরুদ্ধে নানা চক্রান্তের খেলা শুরু করে।এদিকে জেনারেল আব্দুর রশিদ দোস্তমের নেতৃত্বে উত্তর আফগানিস্তান ছিল সোভিয়েতপন্থীদের নিয়ন্ত্রণে সেখানে কাবুল সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না।
এই তথাকথিত ইসলামি সরকারের না ছিল কোনো নিয়মশৃঙ্খলা, না ছিল কোনো কর্মপন্থা। এই সুযোগে পশ্চিমাসহ সব বিরোধী পক্ষ মুজাহিদদের নামে নানা ধরনের অপপ্রচার করতে থাকে।
অথচ নিষ্ঠাবান মুজাহিদরা যুদ্ধ শেষে তাদের নিজ নিজ দায়িত্বে ফিরে গিয়েছিল। এবং দ্বীনি শিক্ষার প্রচার প্রসারে আত্মনিয়োগ করেছিল। অপর দিকে ক্ষমতা লোভীরা ব্যস্ত হয়ে পড়ে বিভিন্ন গ্রুপের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করতে।
এই সুযোগে গোটা দেশে ছড়িয়ে পড়ে ভয়াবহ এক গৃহযুদ্ধ। বলা হয়ে থাকে যে সোভিয়েত আগ্রাসনের সময় কাবুল প্রায় অখ্যাত ছিল কিন্তু এই ক্ষমতাকেন্দ্রিক দ্বন্দ্বে তা প্রায় ধ্বংস স্তুপে পরিণত হয়।
সারা দেশে চেকপোস্ট বসে হাইওয়েগুলোতে এবং অবাধে চলে চাঁদাবাজি আর ডাকাতি।
নারীদের না ছিল কোনো আত্মসম্মান, না ছিল কোনো নিরাপত্তা। জানমালের কোনো নিরাপত্তা কাবুল সরকার দিতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছিল।মানুষ এই দূর্বিষহ পরিস্থিতিতে দাউদ শাহকে স্মরণ করতেছিল।
এমন একটি সংকটকালীন সবাই হয়ে পড়েছিল হতাশাগ্রস্ত।তখন পূর্ব আকাশে ঘনকালো মেঘের আড়ালে উঁকি দিয়ে উঠেন আলোকরশ্মি যাকে তামাম দুনিয়া মনে রেখেছে আমীরুল মুমিনিন হিসেবে যাকে তৃতীয় ওমর বলা হলে অতুক্তি হবে না। তিনি হলেন মোল্লা মুহাম্মদ ওমর মুজাহিদ রহ...।
প্রতিদিনের মতো মোল্লা ওমর মাদরাসায় তার ছাত্রদের নিয়ে দারস দিচ্ছিলেন। এমন সময় এলাকাবাসী তার কাছে আসে একটি অভিযোগ নিয়ে। যেখানে বলা হয় যে কিছু হাইওয়ে ডাকাত তাদের উপর আক্রমণ করে সবকিছু লুট করে। সাথে নারীদেরকে তুলে নিয়ে গেছে। তিনি যেন এর একটা সুরাহা করেন।
এই কথা শুনে মোল্লা ওমর তার সামনে পাঠ্যদানের কিতাবটা বন্ধ করে কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে তারপর সামানে উপবিষ্ট তার ছাত্রদের উদ্দেশ বললেন, এইরকম জরুরি অবস্থার মধ্যে শুধু পড়ালেখা নিয়ে ব্যস্ত থাকা সম্ভব না। আর এই সমস্যাগুলো স্লোগান দিয়ে সমাধান করা সম্ভব না, যার পিছনে কোনো সমর্থন নেই।
তোমরা শরিয়তের ছাত্র অথচ আজ গোটা দুনিয়ায় আল্লাহর মনোনীত শরিয়ত/দ্বীন ভূলুণ্ঠিত, মানুষের কোন অধিকার নাই, নেই নারীদের কোনো সম্মান আর মর্যদা। যত্রতত্র চেকপোস্ট বসিয়ে মানুষের জীবন বিষিয়ে তুলেছে বিভিন্ন আঞ্চলিক সন্ত্রাসী দলগুলো।
কেউ কাউকে মান্য করছে না, করছে না ২০ লাখ মানুষের রক্তের বিনিময়ে যেখানে আল্লাহ দ্বীনকে প্রতিষ্ঠিত করার কথা ছিল। উপরন্তু নিজেদের ব্যক্তি স্বার্থের জন্য আফগান জাতির স্বার্থকে নিয়ে তারা তামাশা করছে।
তোমরা কি এইভাবে নিজেকে পড়ালেখার মধ্যেই আবদ্ধ রাখবে? নাকি জাতির প্রয়োজনে আবার জিহাদের জন্য প্রস্তুত হবে মুনাফিকদের বিরুদ্ধে!
সাথে সাথে এলাকাবাসীর সহযোগিতায় এবং কিছু অনুগত তালেবে ইলমের প্রত্যক্ষ সহায়তায় অপহরণকারীদের ধরে শরিয়ত অনুযায়ী বিচার ফায়সালা করা হয় এবং অপহৃতদের মধ্যে যারা যারা বেঁচে ছিল তাদের উদ্ধার করা হয়।
কাবুল সরকারের পুলিশ ফাঁড়িতে গিয়ে অভিযোগ করা হলেও তারা কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করত না। এতে রুষ্ট এলাকাবাসী পুলিশ ফাঁড়ি অবরোধ করে তাদের বিতাড়িত করে।
এরপর শুরু হয় মোল্লা ওমরের তালেবান আন্দোলন। তিনি মাদরাসায় গিয়ে, তালিমের হালকায় বসে, ছাত্রদের সাথে বসে অদ্ভূত পরিস্থিতিতে করণীয় সম্পর্কে তাদের বোঝাতে থাকে এবং আল্লাহ জমিনে দ্বীন ইসলামকে বিজয়ী করার জন্য নিজেদের আত্মনিয়োগ করার কথা বলতে থাকে।
অবশ্য এতে যে সবাই তাৎক্ষণিকভাবে তৈরি হয়ে গিয়েছিল এমনটা নয়। গুটিকয়েক মাদরাসায় তার দাওয়াতি কার্যক্রমের ফলে ৫৩ জন নিষ্ঠাবান তালেবে ইলম নিজেদেরকে এই আন্দোলনের জন্য তার হাতে বাইয়াতবদ্ধ হয়ে যায়।শুরু হয় বিপ্লবী তালেবান আন্দোলন। প্রথমে তারা সোভিয়েত বিরোধী যুদ্ধে নিষ্ঠাবান যোদ্ধাদের এবং এলাকাবাসীর সহযোগিতায় কিছু সাধারণ অস্ত্র যোগাড় করে। এরপর এক এক এলাকায় গিয়ে গিয়ে অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদের আত্মসমর্পণের আদেশ দিয়ে শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নেয়ার আহবান জানান। যারা তাদের কথা মেনে নেয় এবং প্রকৃতপক্ষেই শান্তি প্রত্যাশী ছিল তারা আত্মসমর্পণ করে তালেবান আন্দোলনে যোগ দেয়। আর যারা বিরোধিতা করে তাদের বিরুদ্ধে তালেবান সামরিক পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হয়। এভাবে অল্প কিছু দিনের মধ্যেই তালেবান তাদের নিয়ন্ত্রিত ভূমিতে শান্তি প্রতিষ্ঠিত করতে সমর্থ হয়। এই খবর আশেপাশের এলাকায় ছড়িয়ে পড়লে লোকজন তালেবানকে নিজেদের এলাকায় আমন্ত্রণ জানায় এবং এখানেও তালেবান যেন শান্তি প্রতিষ্ঠিত করে আহবান জানাতে থাকে। সন্ত্রাসী এবং অযোগ্য কাবুল সরকারের বিরুদ্ধে তালেবানকে সহায়তার প্রস্তাব দিতে থাকে।
এভাবে খুব অল্প সময়ে যখন তালেবান তাদের নিয়ন্ত্রিত এলাকায় শান্তি এবং জনগণের আকাঙ্ক্ষিত ইসলামি খেলাফতের আদলে ইসলামি ইমারাহ শরিয়াহ শাসন প্রবর্তন করে। যা জনগনের মধ্যে ইতিবাচক সাড়া জাগায় এবং এর ফলে দলে দলে তালেবে ইলম মাদরাসার ছাত্ররা এসে তালেবানে যোগ দিতে থাকে।
১৯৯৬ সালের মধ্যেই মোল্লা ওমরের নেতৃত্বে তালেবান আফগানিস্তানের ৯০ ভাগ এলাকায় ইসলামি হুকুমাত কায়েম করে এবং সর্বশেষ কাবুলও অধিকার করে নিতে সক্ষম হয়। আফগানিস্তানকে ইসলামি ইমারাহ ঘোষণা করে। শুধু বাদ থাকে উত্তর পশ্চিমের কমিউনিস্ট-সমর্থিত জেনারেল মুহাম্মদ আব্দুর রশিদ দোস্ত-নিয়ন্ত্রিত অল্প কিছু এলাকা।
এরই মধ্যে তালেবানের এই নতুন সরকারব্যবস্থা পশ্চিমাসহ তাদের সমর্থিত পাপেট মুসলিম শাসকদের কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলে দেয়।তারা আতঙ্কিত হয়ে পড়ে নিজ দেশে ইসলামি শাসন কায়েমের পক্ষে জনমত গড়ে উঠার ভয়ে।
আফগানিস্তানের ব্যাপারে দুই পরাশক্তির (সোভিয়েত-মার্কিন) মূল শঙ্কা কী? এটি একটি বড় সওয়াল। পাকিস্তানের মশহুর বুদ্ধিজীবী জাভেদ ইকবাল আফগান থেকে এসে এক বক্তৃতায় বলেছিলেন, যে অবস্থা দেখে এসেছি, আরো দুই-চারটি মুসলিম দেশে একই অবস্থা হলে সারা দুনিয়া মুসলমানদের হয়ে যাবে। এ বক্তব্য তিনি যখন দিয়েছেন, তখন তালেবানের শাসন চলছে। এ ছিল তালেবান শাসন সম্পর্কে সেক্যুলার চিন্তার একজন ‘রওশন খেয়াল’ মানুষের উপলব্ধি।
ইসলাম সম্পর্কে পশ্চিমা দুনিয়া, সে সাথে প্যাগানদের এমন শঙ্কার কথা বহু আগে আল্লামা ইকবালও বলেছিলেন, হো না যায়ে শারয়ে পয়গাম্বার আশ্-কারা কাহেঁ। অর্থাৎ বিশুদ্ধ পয়গম্বরি মেজাজ পৃথিবীর কোনো স্থানে থিতু হতে দেয়া চলবে না! আফগান সম্পর্কে পশ্চিমাদের শঙ্কার আসল জায়গা মূলত এটিই।
আফগানিস্তানের সংস্পর্শে এসে আরেকটি বিষয় সবাই বুঝেছে, এখানে ইসলামের প্রতি মানুষের প্রবল জযবা, যে জযবা মিটে যাবার মতো নয়। পশ্চিমের জন্য এটাও বড় আতঙ্কের কথা। পৃথিবীতে আধিপত্য ধরে রাখতে চাইলে এ জযবাকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে হবে!
আফগান প্রসঙ্গে বিখ্যাত মিসরীয় দার্শনিক সাকিব আরসালানের এক মন্তব্য আছে। তিনি বলেছেন, এখানে দুটি পাহাড়সারি আছে। একটি দক্ষিণপূর্ব দিকে চলে যাওয়া হিমালয় পর্বতমালা। অন্যটি হিন্দুকুশের পাহাড়সারি যা দক্ষিণ পশ্চিমের দিকে গেছে। এ দুই পর্বতসারির মাঝে যে ট্রায়াঙ্গেল তৈরী হয়েছে, এ ট্রায়াঙ্গেলে যে জাতি বাস করে, যদি সারা দুনিয়াতে ইসলামের স্পন্দন থেমে যায়, তবুও এ জনপদে ইসলামকে নিশ্চিহ্ন করা সম্ভব হবে না।
ভৌগোলিক দিক থেকে খোরাসানের এ অঞ্চলের গুরুত্ব আশা করি সবাই উপলব্ধি করেছেন। ঠিক এ কারণে খোরাসানের জনপদে একটি মজবুত ঘাঁটি গড়ার খায়েশ বিশ্ব শক্তিগুলোর সবসময় ছিল।
তথ্যসূত্র
শের আলী তালেবান উত্থানের পটভূমি।
Looking for Molla Omor by Steve Cole/Newyorker magazine
উইকিপিডিয়া।
লেখক : শিক্ষার্থী, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
merajislam920@gmail.com