তালেবানের উত্থান এবং মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের পতন ঘণ্টার কাহিনী
মার্কিনিদের বিদায় - ছবি : সংগৃহীত
মিডিয়া প্রপাগাণ্ডা ভিকটিম আমাদের প্রজন্মের কাছে তালেবান পরিচিত আইএসআই এজেন্ট নয়ত সন্ত্রাসী মৌলবাদী গোষ্ঠী হিসেবে। শতকরা হিসেবে ৯৫ ভাগ সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ধারণাই এই দুই দুষ্ট চক্রের মধ্যে গেঁথে গেছে।
এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় যে ভুল ধারণা তা হলো তালেবান কিন্তু সোভিয়েত আগ্রাসন যুদ্ধ জয়ের পড়ে গঠিত একটি শান্তিকামী সংগঠন তা অনেকেই জানে না।
যাই হোক আসল কথায় ফেরা যাক। দীর্ঘ নয় বছর ২ মাস সোভিয়েত আগ্রাসনের মোকাবিলা করে যখন সবাই আশায় বুক বাঁধছে এবার বুঝি শান্তি ফিরবে আফগানিস্তানের রক্তস্নাত ভূমিতে।
কিন্তু ওই আশা দুরাশা মাত্র যুদ্ধ শেষ হতেই দেখা দেয় অভ্যন্তরীণ নানা কোন্দল আর হিংসাত্মক নৈরাজ্য। ক্ষমতার দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে সব ইসলামপন্থী কমান্ডার। যারা কয়েক দিন আগেও শত্রুর বিরুদ্ধে একসাথে কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন একে ৪৭ রাইফেল। কিন্তু বিধি বাম। এবার শত্রুর অনুপস্থিতিতে সেই অস্ত্র একে অপরের বুকে বিদ্ধ করতে এতটুকুও ভাবছে না। এদিকে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের আতুড়ঘর জাতিসঙ্ঘ চাপ দিয়ে যাচ্ছে পরাজিত নাজিবুল্লাহর সাথে ক্ষমতা ভাগাভাগি করে সরকার ও দেশ পরিচালনার জন্য। কারণ পশ্চিমারাও চায় না একক কোনো সরকার গঠন করতে পারুক মুজাহিদ ইসলামপন্থী গ্রুপগুলো।
অবশেষে বুরহান উদ্দিন রব্বানী রাষ্ট্রপতি, গুলবুদ্দিন হেকমাতিয়ার প্রধানমন্ত্রী, এবং আহমেদ শাহ মাসুদ সেনাবাহিনীর প্রধানের দায়িত্ব নিয়ে ক্ষমতা ভাগবাঁটোয়ারা করে। এতে কোনো সমন্বয় তো ছিলই না, উল্টা একে অপরের বিরুদ্ধে নানা চক্রান্তের খেলা শুরু করে।এদিকে জেনারেল আব্দুর রশিদ দোস্তমের নেতৃত্বে উত্তর আফগানিস্তান ছিল সোভিয়েতপন্থীদের নিয়ন্ত্রণে সেখানে কাবুল সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না।
এই তথাকথিত ইসলামি সরকারের না ছিল কোনো নিয়মশৃঙ্খলা, না ছিল কোনো কর্মপন্থা। এই সুযোগে পশ্চিমাসহ সব বিরোধী পক্ষ মুজাহিদদের নামে নানা ধরনের অপপ্রচার করতে থাকে।
অথচ নিষ্ঠাবান মুজাহিদরা যুদ্ধ শেষে তাদের নিজ নিজ দায়িত্বে ফিরে গিয়েছিল। এবং দ্বীনি শিক্ষার প্রচার প্রসারে আত্মনিয়োগ করেছিল। অপর দিকে ক্ষমতা লোভীরা ব্যস্ত হয়ে পড়ে বিভিন্ন গ্রুপের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করতে।
এই সুযোগে গোটা দেশে ছড়িয়ে পড়ে ভয়াবহ এক গৃহযুদ্ধ। বলা হয়ে থাকে যে সোভিয়েত আগ্রাসনের সময় কাবুল প্রায় অখ্যাত ছিল কিন্তু এই ক্ষমতাকেন্দ্রিক দ্বন্দ্বে তা প্রায় ধ্বংস স্তুপে পরিণত হয়।
সারা দেশে চেকপোস্ট বসে হাইওয়েগুলোতে এবং অবাধে চলে চাঁদাবাজি আর ডাকাতি।
নারীদের না ছিল কোনো আত্মসম্মান, না ছিল কোনো নিরাপত্তা। জানমালের কোনো নিরাপত্তা কাবুল সরকার দিতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছিল।মানুষ এই দূর্বিষহ পরিস্থিতিতে দাউদ শাহকে স্মরণ করতেছিল।
এমন একটি সংকটকালীন সবাই হয়ে পড়েছিল হতাশাগ্রস্ত।তখন পূর্ব আকাশে ঘনকালো মেঘের আড়ালে উঁকি দিয়ে উঠেন আলোকরশ্মি যাকে তামাম দুনিয়া মনে রেখেছে আমীরুল মুমিনিন হিসেবে যাকে তৃতীয় ওমর বলা হলে অতুক্তি হবে না। তিনি হলেন মোল্লা মুহাম্মদ ওমর মুজাহিদ রহ...।
প্রতিদিনের মতো মোল্লা ওমর মাদরাসায় তার ছাত্রদের নিয়ে দারস দিচ্ছিলেন। এমন সময় এলাকাবাসী তার কাছে আসে একটি অভিযোগ নিয়ে। যেখানে বলা হয় যে কিছু হাইওয়ে ডাকাত তাদের উপর আক্রমণ করে সবকিছু লুট করে। সাথে নারীদেরকে তুলে নিয়ে গেছে। তিনি যেন এর একটা সুরাহা করেন।
এই কথা শুনে মোল্লা ওমর তার সামনে পাঠ্যদানের কিতাবটা বন্ধ করে কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে তারপর সামানে উপবিষ্ট তার ছাত্রদের উদ্দেশ বললেন, এইরকম জরুরি অবস্থার মধ্যে শুধু পড়ালেখা নিয়ে ব্যস্ত থাকা সম্ভব না। আর এই সমস্যাগুলো স্লোগান দিয়ে সমাধান করা সম্ভব না, যার পিছনে কোনো সমর্থন নেই।
তোমরা শরিয়তের ছাত্র অথচ আজ গোটা দুনিয়ায় আল্লাহর মনোনীত শরিয়ত/দ্বীন ভূলুণ্ঠিত, মানুষের কোন অধিকার নাই, নেই নারীদের কোনো সম্মান আর মর্যদা। যত্রতত্র চেকপোস্ট বসিয়ে মানুষের জীবন বিষিয়ে তুলেছে বিভিন্ন আঞ্চলিক সন্ত্রাসী দলগুলো।
কেউ কাউকে মান্য করছে না, করছে না ২০ লাখ মানুষের রক্তের বিনিময়ে যেখানে আল্লাহ দ্বীনকে প্রতিষ্ঠিত করার কথা ছিল। উপরন্তু নিজেদের ব্যক্তি স্বার্থের জন্য আফগান জাতির স্বার্থকে নিয়ে তারা তামাশা করছে।
তোমরা কি এইভাবে নিজেকে পড়ালেখার মধ্যেই আবদ্ধ রাখবে? নাকি জাতির প্রয়োজনে আবার জিহাদের জন্য প্রস্তুত হবে মুনাফিকদের বিরুদ্ধে!
সাথে সাথে এলাকাবাসীর সহযোগিতায় এবং কিছু অনুগত তালেবে ইলমের প্রত্যক্ষ সহায়তায় অপহরণকারীদের ধরে শরিয়ত অনুযায়ী বিচার ফায়সালা করা হয় এবং অপহৃতদের মধ্যে যারা যারা বেঁচে ছিল তাদের উদ্ধার করা হয়।
কাবুল সরকারের পুলিশ ফাঁড়িতে গিয়ে অভিযোগ করা হলেও তারা কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করত না। এতে রুষ্ট এলাকাবাসী পুলিশ ফাঁড়ি অবরোধ করে তাদের বিতাড়িত করে।
এরপর শুরু হয় মোল্লা ওমরের তালেবান আন্দোলন। তিনি মাদরাসায় গিয়ে, তালিমের হালকায় বসে, ছাত্রদের সাথে বসে অদ্ভূত পরিস্থিতিতে করণীয় সম্পর্কে তাদের বোঝাতে থাকে এবং আল্লাহ জমিনে দ্বীন ইসলামকে বিজয়ী করার জন্য নিজেদের আত্মনিয়োগ করার কথা বলতে থাকে।
অবশ্য এতে যে সবাই তাৎক্ষণিকভাবে তৈরি হয়ে গিয়েছিল এমনটা নয়। গুটিকয়েক মাদরাসায় তার দাওয়াতি কার্যক্রমের ফলে ৫৩ জন নিষ্ঠাবান তালেবে ইলম নিজেদেরকে এই আন্দোলনের জন্য তার হাতে বাইয়াতবদ্ধ হয়ে যায়।শুরু হয় বিপ্লবী তালেবান আন্দোলন। প্রথমে তারা সোভিয়েত বিরোধী যুদ্ধে নিষ্ঠাবান যোদ্ধাদের এবং এলাকাবাসীর সহযোগিতায় কিছু সাধারণ অস্ত্র যোগাড় করে। এরপর এক এক এলাকায় গিয়ে গিয়ে অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদের আত্মসমর্পণের আদেশ দিয়ে শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নেয়ার আহবান জানান। যারা তাদের কথা মেনে নেয় এবং প্রকৃতপক্ষেই শান্তি প্রত্যাশী ছিল তারা আত্মসমর্পণ করে তালেবান আন্দোলনে যোগ দেয়। আর যারা বিরোধিতা করে তাদের বিরুদ্ধে তালেবান সামরিক পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হয়। এভাবে অল্প কিছু দিনের মধ্যেই তালেবান তাদের নিয়ন্ত্রিত ভূমিতে শান্তি প্রতিষ্ঠিত করতে সমর্থ হয়। এই খবর আশেপাশের এলাকায় ছড়িয়ে পড়লে লোকজন তালেবানকে নিজেদের এলাকায় আমন্ত্রণ জানায় এবং এখানেও তালেবান যেন শান্তি প্রতিষ্ঠিত করে আহবান জানাতে থাকে। সন্ত্রাসী এবং অযোগ্য কাবুল সরকারের বিরুদ্ধে তালেবানকে সহায়তার প্রস্তাব দিতে থাকে।
এভাবে খুব অল্প সময়ে যখন তালেবান তাদের নিয়ন্ত্রিত এলাকায় শান্তি এবং জনগণের আকাঙ্ক্ষিত ইসলামি খেলাফতের আদলে ইসলামি ইমারাহ শরিয়াহ শাসন প্রবর্তন করে। যা জনগনের মধ্যে ইতিবাচক সাড়া জাগায় এবং এর ফলে দলে দলে তালেবে ইলম মাদরাসার ছাত্ররা এসে তালেবানে যোগ দিতে থাকে।
১৯৯৬ সালের মধ্যেই মোল্লা ওমরের নেতৃত্বে তালেবান আফগানিস্তানের ৯০ ভাগ এলাকায় ইসলামি হুকুমাত কায়েম করে এবং সর্বশেষ কাবুলও অধিকার করে নিতে সক্ষম হয়। আফগানিস্তানকে ইসলামি ইমারাহ ঘোষণা করে। শুধু বাদ থাকে উত্তর পশ্চিমের কমিউনিস্ট-সমর্থিত জেনারেল মুহাম্মদ আব্দুর রশিদ দোস্ত-নিয়ন্ত্রিত অল্প কিছু এলাকা।
এরই মধ্যে তালেবানের এই নতুন সরকারব্যবস্থা পশ্চিমাসহ তাদের সমর্থিত পাপেট মুসলিম শাসকদের কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলে দেয়।তারা আতঙ্কিত হয়ে পড়ে নিজ দেশে ইসলামি শাসন কায়েমের পক্ষে জনমত গড়ে উঠার ভয়ে।