তুরস্কের মিশন আফ্রিকা

মাসুম খলিলী | Jul 06, 2021 05:03 pm
তুরস্কের মিশন আফ্রিকা

তুরস্কের মিশন আফ্রিকা - ছবি : সংগৃহীত

 

উত্তর আফ্রিকার ‘মাগরেব’ বা পশ্চিম অঞ্চলকে আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতির জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচনা করা হয়। এই অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে আলজেরিয়া, মরক্কো, তিউনিসিয়া, লিবিয়া ও মৌরিতানিয়া। অস্থিরতার নানা বাঁক পেরিয়ে এসব দেশে সাবেক ঔপনিবেশিক শক্তি ফ্রান্স, ইতালি বা স্পেনের প্রভাব ধীরে ধীরে কমে আসছে। আর প্রভাব বাড়ছে তুরস্ক, রাশিয়া ও চীনের মতো দেশের। একসময় তুর্কি উসমানীয় খেলাফতের অধীনে থাকা এসব দেশের সাথে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান প্রশাসন গঠনমূলক অর্থনৈতিক ও সামরিক সহযোগিতার সম্পর্ককে এগিয়ে নিচ্ছেন।

এ নিয়ে মাঝে মধ্যে উত্তাপ সৃষ্টির চেষ্টাও লক্ষ করা যায়। আলজেরিয়ার কিছু সংবাদমাধ্যম একটি আলজেরীয় ইসলামপন্থী দলকে তুরস্ক সমর্থন দিয়েছে বলে উল্লেখ করে এ নিয়ে আলজেরিয়া ও তুরস্কের মধ্যে উত্তাপ সৃষ্টি হয়েছে বলে সংবাদ প্রকাশ করেছে। দলটি ইসলামপন্থী ইসলামিক স্যালভেশন ফ্রন্টের সাবেক সদস্যদের নিয়ে গঠিত। তুর্কি দূতাবাস একটি বিবৃতি প্রকাশ করে বলে, এসব একেবারে ভিত্তিহীন অভিযোগ ও মিথ্যা গুজব। আলজেরীয় কর্তৃপক্ষ অবশ্য এ বিষয়ে কোনো আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দেয়নি। আলজিয়ার্স ও আঙ্কারা উভয়েরই অনানুষ্ঠানিক কূটনৈতিক সূত্র এ জাতীয় প্রতিবেদনের সত্যতা অস্বীকার করে।

সত্য যাই হোক না কেন, উভয় পক্ষের মধ্যে সঙ্ঘাতের কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। দেড় দশক ধরে তুরস্ক সাধারণভাবে উত্তর আফ্রিকা এবং বিশেষত আলজেরিয়াতে সম্পর্ক বিনির্মাণে ব্যাপক অগ্রগতি অর্জন করেছে। সাব-সাহারান আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ ইউরোপ এবং ভূমধ্যসাগরের চৌমাথায় অবস্থিত মাগরেব দেশগুলো এখন তুরস্কের প্রভাবের অঞ্চল হয়ে উঠছে। তুরস্ক আফ্রিকা ও ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে বৃহত্তর ভূমিকার জন্য তার অর্থনৈতিক শক্তি এবং সামরিক লক্ষ্যকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দিকে মনোনিবেশ করেছে।

অর্থনৈতিক কর্মসূচির কথা যখন আসে তখন তুরস্ক মাগরেবকে আফ্রিকার নতুন বাজারে প্রবেশের পয়েন্ট হিসাবে দেখে আর ‘সাহেল’ দেশগুলোর সাথে বাণিজ্য শুরু করে। সার্বিকভাবেই আফ্রিকাতে তুরস্কের বিনিয়োগ ক্রমাগতভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২০ সালে আফ্রিকার সাথে তুরস্কের বাণিজ্যের অঙ্ক অনুমান করা হয় ২৫.৩ বিলিয়ন ডলার। তুরস্ক-আফ্রিকা অর্থনৈতিক ও ব্যবসায় ফোরাম বাণিজ্যকে বাড়িয়ে তুলতে সহায়তা করে গেছে। দেড় দশকেরও বেশি সময়ের উন্নত অর্থনৈতিক সম্পর্কের পরে তুর্কি পণ্যগুলো মাগরেব দেশগুলোতে বাণিজ্য সফল হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। ২০০৫ সালে তুরস্ক তিউনিসিয়ার সাথে একটি অ্যাসোসিয়েশন চুক্তি স্বাক্ষর করে এবং এক বছর পরে মরক্কোর সাথে বাণিজ্য চুক্তি আর আলজেরিয়ার সাথে বন্ধুত্ব ও সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষর করেছে।

তিনটি দেশের মধ্যে সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য বাণিজ্য সম্পর্ক তৈরি হয়েছে আলজেরিয়ার সাথে। মিসরের পরে, তুরস্কের দ্বিতীয় বৃহত্তম আফ্রো-বাণিজ্য অংশীদার এখন আলজেরিয়া। দু’দেশের মধ্যে ২০২০ সালে ৪.২ বিলিয়ন ডলারের পণ্য বিনিময় হয়েছে। উভয় পক্ষই ২০২১ সালে মিসরকে ছাড়িয়ে বাণিজ্য ৫ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করতে চাইছে। আলজেরিয়ায় হাইড্রোকার্বন খাতের বাইরে সাড়ে ৩ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে তুরস্ক। তুরস্ক এখন দেশটিতে শীর্ষস্থানীয় বিদেশী বিনিয়োগকারী হয়ে উঠেছে, যা ফ্রান্সের চেয়েও বেশি। দেশটি নির্মাণ, টেক্সটাইল, ইস্পাত, খাদ্য এবং জ্বালানি খাতেও যুক্ত রয়েছে। আলজেরিয়ায় এক হাজার ২০০টিরও বেশি তুর্কি কোম্পানি কাজ করছে এবং ১০ হাজারের বেশি লোককে তারা নিয়োগ দিয়েছে। গত জানুয়ারিতে তিনটি তুর্কি নির্মাণ গ্রুপ, অ্যাটলাস গ্রুপ, ওজগুর সান এবং ডরুক কনস্ট্রাকশন আলজেরিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে চার হাজার ৪০০টি সামাজিক আবাসন ইউনিট নির্মাণের জন্য ১.২ বিলিয়ন ডলারের কাজ পেয়েছে।

আলজেরিয়ায় তুরস্কের এই বিশিষ্ট অবস্থান টিকে থাকবে বলেই মনে করা হচ্ছে। জ্বালানি, কৃষি এবং পর্যটন বিষয়ে সম্প্রতি সাতটি সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে এই সম্পর্ক আরো জোরদার হয়েছে। আলজেরিয়ার জ্বালানি খাতের ব্যাপারে তুরস্কের উল্লেখযোগ্য আগ্রহ ছিল। আলজিরিয়া হলো তুরস্কের চতুর্থ বৃহত্তম গ্যাস সরবরাহকারী দেশ। আলজেরিয়ার রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সোনাত্রাচ এবং তুর্কি পেট্রোলিয়াম পাইপলাইন কর্পোরেশন প্রাকৃতিক গ্যাস চুক্তিকে ২০২৪ সাল নাগাদ সম্প্রসারণ করেছে, যার আওতায় আলজিয়ার্স তুরস্ককে বছরে ৫.৪ বিলিয়ন ঘনমিটার গ্যাস সরবরাহ করবে। সোনাত্রাচ দক্ষিণ তুরস্কের আদানা প্রদেশের সিহান শহরে পেট্রোকেমিক্যাল কমপ্লেক্স নির্মাণে রোনসানস হোল্ডিংয়ের সাথেও কাজ করছে। বিনিয়োগটির পরিমাণ ১.২ বিলিয়ন ডলার।

আলজেরিয়ার প্রতিবেশী ও আফ্রিকার বৃহত্তম তেল মজুদের দেশ লিবিয়ায় তুরস্ক ও ত্রিপোলিভিত্তিক জাতীয় সরকার (জিএনএ) উপকূলে এবং স্থলভাগের ব্লকগুলোতে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান নিয়ে আলোচনা করেছে। গত সেপ্টেম্বর মাসে তুর্কি কর্মকর্তারা লিবিয়ার জাতীয় তেল করপোরেশনের সাথে বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং পাইপলাইন পরিচালনার বিষয়ে আলোচনা করেন। অতি সম্প্রতি, তুরস্কের রাষ্ট্রপতি এরদোগান লিবিয়ার প্রধানমন্ত্রী আবদুল হামিদ দেবিবাহকে নিজ দেশে স্বাগত জানান এবং উভয় পক্ষ তেল ও গ্যাস খাতে সহযোগিতা জোরদার করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হন। এর আগে তুরস্ক এবং জিএনএ যে সমুদ্র চুক্তি স্বাক্ষর করে তা সমুদ্রসীমা নির্ধারণে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। তাত্ত্বিকভাবে এই চুক্তিতে তাদের দক্ষিণ-পশ্চিম তুরস্ক থেকে উত্তর-পূর্ব লিবিয়ায় একটি করিডোর স্থাপনের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে এবং এর দ্বারা একান্ত অর্থনৈতিক অঞ্চলে (ইইজেড) ড্রিলিংয়ের অধিকার দাবি করা যাবে।

তুরস্কের তৃতীয় অগ্রাধিকার হলো, আফ্রিকাজুড়ে সামরিক প্রভাবকে এগিয়ে নেয়া। লিবিয়াকে এ ক্ষেত্রে একটি পরীক্ষা ক্ষেত্র বলে মনে করা হয়। ২০২০ সালের জানুয়ারিতে, সেখানে তুরস্ক সামরিক সদস্য মোতায়েন করে এবং জিএনএ অঞ্চলগুলোর বিরুদ্ধে জেনারেল খলিফা হাফতারের লিবিয়ান ন্যাশনাল আর্মির অগ্রযাত্রাকে থামাতে, টিবি ২ ড্রোন দিয়ে তাকে পশ্চাদপসরণ করতে বাধ্য করে। তুরস্ক জিএনএর সাথে সমুদ্র চুক্তি করার পর এর অর্থনৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থকে সুরক্ষিত করতে চায়। আর এ জন্য অর্থনৈতিক ও সামরিক উভয় ক্ষেত্রে লিবিয়াকে আত্মনির্ভরশীল হবার ক্ষেত্রে তুরস্ক ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে।

লিবিয়ার সাথে প্রায় এক হাজার কিলোমিটার সীমান্ত থাকা আলজেরিয়া তুরস্কের দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপারে সচেতন আর এই দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ্যে কোনো বিরোধিতা করে না। অবশ্য আলজেরিয়া কর্তৃপক্ষ জিএনএকে সমর্থন করলেও এই সঙ্ঘাতে নিজে জড়িত হতে চায় না। দেশটির ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি লিবিয়ায় তাদের তুরস্কের কার্যকর সহযোগী করে তুলেছে। আলজেরিয়া অনুভব করে যে, এই অঞ্চলে তুরস্ককে বাদ দিয়ে কিছু করতে গেলে চতুর্মুখী সংঘাতে দেশটি প্রান্তিক হয়ে পড়বে। তবে তুরস্কেরও আলজেরিয়া ও তিউনিসিয়ার ওপর এক ধরনের নির্ভরশীলতা রয়েছে। লিবিয়ার সাথে এই দেশগুলোর দীর্ঘ স্থলসীমানা রয়েছে। আলজিয়ার্স অবশ্য কূটনৈতিক ফ্রন্টে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে লিবিয়ার দ্বন্দ্বের রাজনৈতিক সমাধানের জন্য, যা সব অভিনেতাকে জড়িত করবে এবং বৈদেশিক হস্তক্ষেপ এড়াতে সাহায্য করবে।

আলজেরিয়া এবং লিবিয়ার বাইরে, মাগরেবের অন্যান্য অংশেও আঙ্কারার আঞ্চলিক উপস্থিতিকে প্রসারিত করার উদ্যোগ লক্ষ করা যায়। আফ্রিকার প্রতিরক্ষা বাজারে স্থান করে নেয়া তুরস্কের দীর্ঘমেয়াদী কৌশলের অংশ বলে মনে হয়। ২০২০ সালের ডিসেম্বরে তিউনিসিয়া ও তুরস্ক একটি সামরিক চুক্তিতে স্বাক্ষর করে যার মধ্যে দেশটির সামরিক সরঞ্জাম কেনার জন্য তুরস্ক ১৫০ মিলিয়ন ডলার সুদমুক্ত ঋণ দেয়ার প্রস্তাব করেছে। চুক্তিতে সামরিক শিল্প খাতে সহযোগিতা, গবেষণা, উন্নয়ন, খুচরা যন্ত্রাংশ উৎপাদন এবং সামরিক সামগ্রীর যৌথ রফতানির জন্য সাধারণ প্ল্যাটফর্ম তৈরি করাও অন্তর্ভুক্ত ছিল। এই সহযোগিতার মাধ্যমে আঙ্কারার সামনে তিউনিসিয়ায় একটি সুদৃঢ শিল্প কেন্দ্র স্থাপনের মাধ্যমে মাগরেব অঞ্চলসহ আফ্রিকাজুড়ে তার সামরিক উপাদান রফতানি করার সুযোগ সৃষ্টি করে। আফ্রিকাতে ৩৭টি সামরিক অফিস খোলার পরে, তুরস্ক এমন একটি দেশে পরিণত হয় যার এই মহাদেশে এরকম সর্বাধিক অফিস রয়েছে। বিগত তিন বছরে শাদ (২০১৯), নাইজার (২০২০) এবং সোমালিয়ার (২০২১) সাথে আঙ্কারা সামরিক চুক্তি করেছে এবং সামরিক সহযোগিতার আরো বিস্তৃতির জন্য এখন আফ্রিকার অন্য বাজারগুলোতে নজর রাখছে।

তুরস্ক আফ্রিকা মহাদেশে রাজনৈতিক সমর্থন বাড়াতে চাইছে। তুরস্ককে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য করতে অনীহা দেখে হতাশ এরদোগান ভূমধ্যসাগরে তুরস্কের প্রভাব বিস্তারের জন্য মাগরেব এবং আফ্রিকার অন্যান্য অঞ্চলে তার দেশের কূটনীতিকে পুনর্বিন্যাস করেছেন। তুরস্কের সম্পৃক্ততা এভাবে সামনেও বাড়তে থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। তকে ইউরোপীয় দেশগুলো, বিশেষত ঐতিহ্যগতভাবে ফরাসি প্রভাবের অধীনে থাকা এই অঞ্চলে তুরস্কের জড়িত থাকার বিষয়ে সন্তুষ্ট নয় ফ্রান্স। মাঝে মধ্যে তার প্রকাশও লক্ষ করা যায়। তবে এ ব্যাপারে মানিয়ে নেয়া ছাড়া তাদের সামনে কোনো বিকল্প নেই বলে মনে হয়। ফ্রান্সের বিকল্প হিসাবে নিজেকে উপস্থাপন, ইউরোপীয়দের মোকাবেলা এবং মুসলিম বিশ্বের একজন রক্ষাকারী হিসেবে নিজেকে তুলে ধরার জন্য আঙ্কারার আকাঙ্ক্ষাকে ঔপনিবেশিক শক্তির শোষণমূলক আচরণে ত্যক্ত বিরক্ত এক অঞ্চল স্বাগতই জানাচ্ছে।

মাগরেব অঞ্চলের দেশগুলোতে ইসলাম ও গণতন্ত্রের ব্যাপারে ক্রমবর্ধমান আগ্রহ তুরস্কের জন্য একটি ইতিবাচক পরিবেশ তৈরি করেছে। এই অঞ্চলের মধ্যে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র হলো আলজেরিয়া। গত ১২ জুন দেশটিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই নির্বাচনে আশাতীত সাফল্য লাভ করে ইসলামিক স্যালভেশন ফ্রন্টের উত্তরাধিকার হিসোবে পরিচিত দুটি দল মুভমেন্ট অব সোসাইটি ফর পিস ও ন্যাশনাল কন্সট্রাকশন মুভমেন্ট। ৪০৭ আসনের সংসদে এ দুটি দল যথাক্রমে ৬৫ ও ৩৯টি আসন লাভ করে। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন কোয়ালিশনের দুই শরিক ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট ও ডেমোক্রেটিক ন্যাশনাল র‌্যালি পেয়েছে ৯৮ ও ৫৮ আসন। এ দুটি দল আসন হারিয়েছে ১০৫টি। অন্য দিকে ইসলামী দল দুটি ৭০টি আসন অতিরিক্ত পায়।
করোনা পরিস্থিতির কারণে আলজেরিয়ায় এবারের নির্বাচনে প্রদত্ত ভোট হার ছিল কম। তবে অবাধ ও শান্তিপূর্ণভাবেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। নির্বাচনের ফলাফল এবং সামগ্রিকভাবে আলজেরিয়ার রাজনৈতিক পরিবেশের সাথে আঞ্চলিক উন্নয়নের একটি যোগসূত্র রয়েছে। আলজেরীয় রাজনীতিকে সাবেক ‘ঔপনিবেশিক প্রভু’ ফ্রান্স নিয়ন্ত্রণ করতে থাকুক সেটি আলজেরীয়রা আর চাইছে না। ফলে আলজেরিয়ায় ফ্রান্সকে কথিত সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের কর্মসূচি স্থগিত রাখতে হয়েছে। এমনকি ফ্রান্সের ম্যাক্রোঁ সরকারের ইসলামের প্রতি বিদ্বেষমূলক নীতিপদক্ষেপেরও বিরূপ প্রভাব পড়েছে আলজেরিয়ায়।

অতিসম্প্রতি ফ্রান্স থেকে ২৭ হাজার মেট্রিক টনের একটি গমের চালান আসে। গমের সাথে পাওয়া যায় দুটি শূকরের মৃতদেহ। এতে বিক্ষুব্ধ আলজেরীয় কর্তৃপক্ষ গমের জাহাজ ফিরিয়ে দিয়ে ক্ষতিপূরণ দাবি করেন। একই সাথে রাশিয়া থেকে গমের নতুন সরবরাহের জন্য আদেশ দেয়া হয়। এভাবেই ফ্রান্সের সাথে আলজেরিয়ার সম্পর্কের নানা ক্ষেত্রে নিম্নগামী প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। এই শূন্য স্থানটি পূরণ করছে তুরস্ক, রাশিয়া ও চীন। আলজেরিয়ার উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে তুরস্ক ব্যাপক বিনিয়োগ করছে। জ্বালানি খাতেও দুই দেশ সহযোগিতার একাধিক চুক্তি করেছে। লিবিয়ায় শান্তি প্রতিষ্ঠা ও অখণ্ডতার চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার ক্ষেত্রে দুই দেশ একযোগে কাজ করছে।

মাগরেব অঞ্চলের একসময় সবচেয়ে সমৃদ্ধ অঞ্চল ছিল লিবিয়া। আগামী ডিসেম্বরের নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত দেশটি পরিচালনার জন্য একটি অন্তর্বর্তীকালীন ঐক্য সরকার প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। লিবিয়ার প্রতিদ্বন্দ্বী দুই গ্রুপের দুটি আলাদা সংসদ ছিল। একটি পূর্বের তবরুক ভিত্তিক, অপরটি ত্রিপোলিভিত্তিক আইন সভা। ডিসেম্বরের নির্বাচনের পর একটি একক সংসদ ও সরকার প্রতিষ্ঠা পাবে বলে আশা করা হচ্ছে। এর আগে খলিফা হাফতারের ত্রিপোলি সরকারের পতন ঘটানোর অভিযান তুরস্কের সামরিক সহায়তার ওপর ভিত্তি করে ‘জাতীয় ঐক্য সরকার’ ব্যর্থ করে দেয়। ত্রিপোলিভিত্তিক ঐক্য সরকারের সাথে আঙ্কারার রয়েছে বিশেষ সুসম্পর্ক। তুরস্কের এই প্রভাব অব্যাহত থাকার পথে বড় বাধা ছিল মিসর। ভূ-মধ্যসাগর এবং লিবিয়া ইস্যুতে আঙ্কারা কায়রোর সাথে এক ধরনের সমঝোতায় গেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ফলে এই অঞ্চলের উত্তেজনা অনেকটা কমে এসেছে।

মৌরিতানিয়ার সাথে তুরস্কের সম্পর্ক ভালো হচ্ছে। ১৯৬০ এর দশক জুড়ে, মৌরিতানিয়া ফরাসিপন্থী বিদেশনীতি অনুসরণ করত। এর উদ্দেশ্য ছিল মরক্কোর প্রভাব থেকে তার স্বাধীনতাকে সুরক্ষা করা। ১৯৭০ এর দশকের গোড়ার দিকে, মৌরিতানিয়া মাগরেব এবং সাব-সাহারান আফ্রিকার মধ্যে সেতুবন্ধনের ভূমিকা পালন করেছে। ১৯৮০ এর দশকের শেষের দিক থেকে, মৌরিতানিয়া সম্ভাব্য সহায়তার উৎস হিসাবে তুরস্কের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করে। এর বিনিময়ে তুরস্ক দেশটিকে পর্যাপ্ত অর্থনৈতিক সহায়তা প্রদান করেছে এবং টিআইকিএর মাধ্যমে হাসপাতাল, স্কুল, বিদ্যুৎকেন্দ্র ও রাস্তাঘাট নির্মাণের জন্য অর্থ ব্যয় করেছে।

২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে মৌরিতানিয়ায় সংসদীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। জাতীয় পর্যায়ে ১৫৭টি কেন্দ্রে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। ফলাফলে দেখা যায়, জাতীয়তাবাদী ইউনিয়ন ফর রিপাবলিক (ইউপিআর) জনগণের ভোট এবং আসন উভয় ক্ষেত্রেই জাতীয় পর্যায়ে একক বৃহত্তম দল হিসাবে রয়ে গেছে। আগের মতো দ্বিতীয় প্রধান দল হিসাবে থাকে ইসলামিক দল ‘টেওয়াসাউল’। দলটি পপুলার ভোটের সোয়া ১১ শতাংশ এবং ১৪টি আসন লাভ করে।

তুরস্ক-মরক্কো সম্পর্ক ইতিবাচক ধারায় এগিয়ে যাচ্ছে। ১৬ শতাব্দীর প্রথম দিক থেকে তধানীন্তন অটোমান সাম্রাজ্যের প্রতিবেশী মরক্কোর সাথে আধুনিক সময় পর্যন্ত বহু শতাব্দীকাল ধরে এই সম্পর্ক বিস্তৃত ছিল। অটোমান সাম্রাজ্য এবং মরক্কার মধ্যেকার ইতিহাস বর্তমান দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের দৃঢ ভিত্তি তৈরি করেছে। মরক্কোর দৃষ্টিতে তুরস্ক আধুনিক ও উন্নত দেশ যা তার জাতীয় পরিচয়ও বজায় রেখেছে। তুরস্ক ও মরক্কোর মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করা হয়েছিল ১৯৫৬ সালের এপ্রিলে দু’দেশের সরকারের যৌথ ঘোষণার মাধ্যমে; মরক্কোর স্বাধীনতা ঘোষণার পরে।
২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে মরক্কোতে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। ২০১১ সালের সাংবিধানিক সংস্কারের পরে এটি তৃতীয় নির্বাচন। ২০১২ সালের নির্বাচনের পর থেকে মরক্কোর ইসলামপন্থী শাসক দল জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (পিজেডি) ক্ষমতায়। সায়েদাদাইন ওসমানী হলেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী। বিগত নির্বাচনে দলটি ১২৫ আসনে জয় পেয়ে সরকার গঠন করে। পিএএম ১০২ আসন নিয়ে দ্বিতীয় বৃহত্তম দল হিসাবে স্থান করে নেয়। মরক্কোর বাদশাহ নির্বাচনে হস্তক্ষেপ না করায় জনপ্রতিনিধি হিসাবে যারা অধিক আস্থাভাজন তারাই সরকার গঠন করে থাকেন। ফলে পর পর দুটি সরকারের নেতৃত্ব দেয় ইসলামিস্ট পিজেডি। এ সময়ে তুরস্কের সাথে মরক্কোর সম্পর্ক যথেষ্ট উন্নত হয়।

তিউনিসিয়া স্বাধীনতা লাভের ঠিক পরেই ১৯৫৬ সালে তুরস্ক ও তিউনিসিয়ার মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়। উভয় দেশ ভূমধ্যসাগরীয় ইউনিয়নের পূর্ণ সদস্য। অটোমান শাসনের শুরু থেকে ১৬তম শতাব্দীর শুরু পর্যন্ত এই অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে তিউনিসিয়ার সাথে জাতিগত ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক ছিল। তিউনিসিয়ায় নামমাত্র অটোমান নিয়ন্ত্রণের কয়েক শতাব্দীর কারণে তুর্কিদের জাতিগত প্রভাবও সৃষ্টি হয়েছে। তিউনিসিয়ানদের প্রায় ২৫ শতাংশ অংশত ক্রেওল তুর্কি বংশোদ্ভূত। উভয় দেশ ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০১১ সালে বন্ধুত্ব ও সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষর করে। তুরস্ক ‘জেসমিন’ বিপ্লবের পরে তিউনিসিয়াকে আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তা দেয়। তিউনিসিয়া ও তুরস্কের মধ্যে অর্থনৈতিক সম্পর্কও যথেষ্ট ভালো। অনেক তিউনিসীয় বণিক তুরস্কের কাছ থেকে পোশাক এবং অন্যান্য পণ্য কিনে থাকেন। তুরস্ক তিউনিসিয়ার একটি খুব জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্র। উভয় দেশের নাগরিকরা একে অপরের দেশে ভিসামুক্ত ভ্রমণ করতে পারেন। তুরস্ক এবং তিউনিসিয়া প্রধান নন-ন্যাটো মিত্র চুক্তির আওতায় মৈত্রী বন্ধনে আবদ্ধ।

তিউনিসিয়া হলো আরব বসন্তের প্রথম দেশ। নির্বাচনে শুরু থেকেই ইসলামিস্ট আন নাহদা দল প্রভাবশালী শক্তি হিসাবে আবির্ভূত হয়। দলটির নেতা ড. রশিদ ঘানুশি বরাবরই সব দলকে সাথে নিয়ে সরকার গঠন করেছেন। সর্বশেষ নির্বাচনে আসন হারানো সত্ত্বেও, নতুন বা কম প্রতিষ্ঠিত দলের মধ্যে ভোট ভাঙার কারণে আন নাহদা সবচেয়ে বড় দল হয়ে ওঠে।

মাগরেব অঞ্চলের ইসলামি দলগুলো আদর্শগতভাবে তুরস্কের সাথে নৈকট্য অনুভব করলেও তুরস্ক বিশেষ দলের সাথে সম্পর্ক রাখার পরিবর্তে সরকারের সাথে কাজ করার কৌশল গ্রহণ করেছে। ফলে এই অঞ্চলে অর্থনৈতিক ও সামরিকসহ বিভিন্ন সহযোগিতার ক্ষেত্রে দেশটির প্রভাব বিস্তৃত হচ্ছে। তুরস্কে ২০২৩ সালে পরবর্তী প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। এই বছরই ‘লুজান চুক্তি’র শত বছর পূর্ণ হবে এবং এর কার্যকারিতার অবসান ঘটবে। এই সময় তুরস্ক অর্থনৈতিক ও অন্যবিধ প্রভাব বিস্তারে নানা সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে উঠবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তুরস্কের এখনকার যে অগ্রগতি সেটি নতুন অভিযাত্রার ভিত তৈরি করছে বলেও অনেকের বিশ্বাস। অবশ্য তুরস্কের এই অগ্রযাত্রাকে সমালোচকরা খেলাফত আমলের প্রভাব ফিরে পাবার প্রচেষ্টা হিসাবেও দেখেন। সার্বিকভাবে তুরস্ককে এগিয়ে নেবার ক্ষেত্রে এরদোগানের নেতৃত্ব খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হয় তুরস্কে।

mrkmmb@gmail.com

 


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us