কেমন হতে পারে লিবিয়া-তুরস্ক সম্পর্ক?
তুরস্ক-লিবিয়া সম্পর্ক - ছবি : সংগৃহীত
মাগরেব অঞ্চলের একসময় সবচেয়ে সমৃদ্ধ অঞ্চল ছিল লিবিয়া। আগামী ডিসেম্বরের নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত দেশটি পরিচালনার জন্য একটি অন্তর্বর্তীকালীন ঐক্য সরকার প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। লিবিয়ার প্রতিদ্বন্দ্বী দুই গ্রুপের দুটি আলাদা সংসদ ছিল। একটি পূর্বের তবরুক ভিত্তিক, অপরটি ত্রিপোলিভিত্তিক আইন সভা। ডিসেম্বরের নির্বাচনের পর একটি একক সংসদ ও সরকার প্রতিষ্ঠা পাবে বলে আশা করা হচ্ছে। এর আগে খলিফা হাফতারের ত্রিপোলি সরকারের পতন ঘটানোর অভিযান তুরস্কের সামরিক সহায়তার ওপর ভিত্তি করে ‘জাতীয় ঐক্য সরকার’ ব্যর্থ করে দেয়। ত্রিপোলিভিত্তিক ঐক্য সরকারের সাথে আঙ্কারার রয়েছে বিশেষ সুসম্পর্ক। তুরস্কের এই প্রভাব অব্যাহত থাকার পথে বড় বাধা ছিল মিসর। ভূ-মধ্যসাগর এবং লিবিয়া ইস্যুতে আঙ্কারা কায়রোর সাথে এক ধরনের সমঝোতায় গেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ফলে এই অঞ্চলের উত্তেজনা অনেকটা কমে এসেছে।
মৌরিতানিয়ার সাথে তুরস্কের সম্পর্ক ভালো হচ্ছে। ১৯৬০ এর দশক জুড়ে, মৌরিতানিয়া ফরাসিপন্থী বিদেশনীতি অনুসরণ করত। এর উদ্দেশ্য ছিল মরক্কোর প্রভাব থেকে তার স্বাধীনতাকে সুরক্ষা করা। ১৯৭০ এর দশকের গোড়ার দিকে, মৌরিতানিয়া মাগরেব এবং সাব-সাহারান আফ্রিকার মধ্যে সেতুবন্ধনের ভূমিকা পালন করেছে। ১৯৮০ এর দশকের শেষের দিক থেকে, মৌরিতানিয়া সম্ভাব্য সহায়তার উৎস হিসাবে তুরস্কের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করে। এর বিনিময়ে তুরস্ক দেশটিকে পর্যাপ্ত অর্থনৈতিক সহায়তা প্রদান করেছে এবং টিআইকিএর মাধ্যমে হাসপাতাল, স্কুল, বিদ্যুৎকেন্দ্র ও রাস্তাঘাট নির্মাণের জন্য অর্থ ব্যয় করেছে।
২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে মৌরিতানিয়ায় সংসদীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। জাতীয় পর্যায়ে ১৫৭টি কেন্দ্রে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। ফলাফলে দেখা যায়, জাতীয়তাবাদী ইউনিয়ন ফর রিপাবলিক (ইউপিআর) জনগণের ভোট এবং আসন উভয় ক্ষেত্রেই জাতীয় পর্যায়ে একক বৃহত্তম দল হিসাবে রয়ে গেছে। আগের মতো দ্বিতীয় প্রধান দল হিসাবে থাকে ইসলামিক দল ‘টেওয়াসাউল’। দলটি পপুলার ভোটের সোয়া ১১ শতাংশ এবং ১৪টি আসন লাভ করে।
তুরস্ক-মরক্কো সম্পর্ক ইতিবাচক ধারায় এগিয়ে যাচ্ছে। ১৬ শতাব্দীর প্রথম দিক থেকে তধানীন্তন অটোমান সাম্রাজ্যের প্রতিবেশী মরক্কোর সাথে আধুনিক সময় পর্যন্ত বহু শতাব্দীকাল ধরে এই সম্পর্ক বিস্তৃত ছিল। অটোমান সাম্রাজ্য এবং মরক্কার মধ্যেকার ইতিহাস বর্তমান দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের দৃঢ ভিত্তি তৈরি করেছে। মরক্কোর দৃষ্টিতে তুরস্ক আধুনিক ও উন্নত দেশ যা তার জাতীয় পরিচয়ও বজায় রেখেছে। তুরস্ক ও মরক্কোর মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করা হয়েছিল ১৯৫৬ সালের এপ্রিলে দু’দেশের সরকারের যৌথ ঘোষণার মাধ্যমে; মরক্কোর স্বাধীনতা ঘোষণার পরে।
২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে মরক্কোতে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। ২০১১ সালের সাংবিধানিক সংস্কারের পরে এটি তৃতীয় নির্বাচন। ২০১২ সালের নির্বাচনের পর থেকে মরক্কোর ইসলামপন্থী শাসক দল জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (পিজেডি) ক্ষমতায়। সায়েদাদাইন ওসমানী হলেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী। বিগত নির্বাচনে দলটি ১২৫ আসনে জয় পেয়ে সরকার গঠন করে। পিএএম ১০২ আসন নিয়ে দ্বিতীয় বৃহত্তম দল হিসাবে স্থান করে নেয়। মরক্কোর বাদশাহ নির্বাচনে হস্তক্ষেপ না করায় জনপ্রতিনিধি হিসাবে যারা অধিক আস্থাভাজন তারাই সরকার গঠন করে থাকেন। ফলে পর পর দুটি সরকারের নেতৃত্ব দেয় ইসলামিস্ট পিজেডি। এ সময়ে তুরস্কের সাথে মরক্কোর সম্পর্ক যথেষ্ট উন্নত হয়।
তিউনিসিয়া স্বাধীনতা লাভের ঠিক পরেই ১৯৫৬ সালে তুরস্ক ও তিউনিসিয়ার মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়। উভয় দেশ ভূমধ্যসাগরীয় ইউনিয়নের পূর্ণ সদস্য। অটোমান শাসনের শুরু থেকে ১৬তম শতাব্দীর শুরু পর্যন্ত এই অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে তিউনিসিয়ার সাথে জাতিগত ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক ছিল। তিউনিসিয়ায় নামমাত্র অটোমান নিয়ন্ত্রণের কয়েক শতাব্দীর কারণে তুর্কিদের জাতিগত প্রভাবও সৃষ্টি হয়েছে। তিউনিসিয়ানদের প্রায় ২৫ শতাংশ অংশত ক্রেওল তুর্কি বংশোদ্ভূত। উভয় দেশ ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০১১ সালে বন্ধুত্ব ও সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষর করে। তুরস্ক ‘জেসমিন’ বিপ্লবের পরে তিউনিসিয়াকে আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তা দেয়। তিউনিসিয়া ও তুরস্কের মধ্যে অর্থনৈতিক সম্পর্কও যথেষ্ট ভালো। অনেক তিউনিসীয় বণিক তুরস্কের কাছ থেকে পোশাক এবং অন্যান্য পণ্য কিনে থাকেন। তুরস্ক তিউনিসিয়ার একটি খুব জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্র। উভয় দেশের নাগরিকরা একে অপরের দেশে ভিসামুক্ত ভ্রমণ করতে পারেন। তুরস্ক এবং তিউনিসিয়া প্রধান নন-ন্যাটো মিত্র চুক্তির আওতায় মৈত্রী বন্ধনে আবদ্ধ।
তিউনিসিয়া হলো আরব বসন্তের প্রথম দেশ। নির্বাচনে শুরু থেকেই ইসলামিস্ট আন নাহদা দল প্রভাবশালী শক্তি হিসাবে আবির্ভূত হয়। দলটির নেতা ড. রশিদ ঘানুশি বরাবরই সব দলকে সাথে নিয়ে সরকার গঠন করেছেন। সর্বশেষ নির্বাচনে আসন হারানো সত্ত্বেও, নতুন বা কম প্রতিষ্ঠিত দলের মধ্যে ভোট ভাঙার কারণে আন নাহদা সবচেয়ে বড় দল হয়ে ওঠে।
মাগরেব অঞ্চলের ইসলামি দলগুলো আদর্শগতভাবে তুরস্কের সাথে নৈকট্য অনুভব করলেও তুরস্ক বিশেষ দলের সাথে সম্পর্ক রাখার পরিবর্তে সরকারের সাথে কাজ করার কৌশল গ্রহণ করেছে। ফলে এই অঞ্চলে অর্থনৈতিক ও সামরিকসহ বিভিন্ন সহযোগিতার ক্ষেত্রে দেশটির প্রভাব বিস্তৃত হচ্ছে। তুরস্কে ২০২৩ সালে পরবর্তী প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। এই বছরই ‘লুজান চুক্তি’র শত বছর পূর্ণ হবে এবং এর কার্যকারিতার অবসান ঘটবে। এই সময় তুরস্ক অর্থনৈতিক ও অন্যবিধ প্রভাব বিস্তারে নানা সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে উঠবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তুরস্কের এখনকার যে অগ্রগতি সেটি নতুন অভিযাত্রার ভিত তৈরি করছে বলেও অনেকের বিশ্বাস। অবশ্য তুরস্কের এই অগ্রযাত্রাকে সমালোচকরা খেলাফত আমলের প্রভাব ফিরে পাবার প্রচেষ্টা হিসাবেও দেখেন। সার্বিকভাবে তুরস্ককে এগিয়ে নেবার ক্ষেত্রে এরদোগানের নেতৃত্ব খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হয় তুরস্কে।
mrkmmb@gmail.com