সাদ্দামের প্রতি কেন ক্ষ্যাপে গিয়েছিলেন রামসফেল্ড

আবু রূশ্দ | Jul 02, 2021 04:05 pm
রামসফেল্ড ও সাদ্দাম

রামসফেল্ড ও সাদ্দাম - ছবি : সংগৃহীত

 

ইরানের কয়েকটি বড় শহরে যখন ইরাকি বাহিনী রাসায়নিক অস্ত্র নিক্ষেপ করে হাজার হাজার নিরীহ বেসামরিক মানুষ হত্যা করে তখন ১৯৮৩ সালেই ইরান জাতিসঙ্ঘের কাছে এ নিয়ে বিস্তারিত তথ্য দেয়। কিন্তু তখন প্রায় সব বৃহৎ শক্তির সাথে ইরান কূটনৈতিক পর্যায়ে অনেকটা বিচ্ছিন্ন থাকায় সেসব অভিযোগ খুব একটা পাত্তা পায়নি। এমনকি ১৯৮৩ সালের নভেম্বর মাসে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার এক মেমোতে উল্লেখ করা হয় যে, সাদ্দাম হোসেন তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ কুর্দিদের বিরুদ্ধেও ব্যাপক হারে রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করছেন। মার্কিনিরা এসব ঘটনায় প্রকাশ্যে আনমুভড থাকলেও ভিতরে ভিতরে অনেকটা নার্ভাস হয়ে পড়ে এই ভেবে যে ইরাক যদি এভাবে রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করে তাহলে মধ্যপ্রাচ্যে সঙ্কট আরো বেড়ে যাবে, মার্কিনিদের ইমেজ ক্ষতিগ্রস্ত হবে যা কিনা তখন আফগানিস্তানে চলমান সোভিয়েতবিরোধী যুদ্ধে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এমনও হতে পারে যে মুসলিম বিশ্ব যারা কিনা প্রায় একচেটিয়াভাবে আফগানিস্তান ইস্যুতে মার্কিনিদের পক্ষাবলম্বন করেছে তারা সমর্থন প্রত্যাহার করতে পারে।

এসব বিবেচনায় প্রেসিডেন্ট রিগ্যান সিদ্ধান্ত নেন ইরাকি কর্তৃপক্ষের সাথে উচ্চ পর্যায়ে সরাসরি যোগাযোগ প্রতিষ্ঠার। তখন বেছে নেয়া হয় প্রেসিডেন্ট ফোর্ডের সময়ে ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর দায়িত্ব পালনকারী ডোনাল্ড রাফসফেল্ডকে প্রেসিডেন্টের বিশেষ প্রতিনিধি হিসাবে ইরাকে পাঠানোর জন্য।

রামসফেল্ডকে পাঠানোর উদ্দেশ্য ছিল: ১. সাদ্দাম হোসেন ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী তারিক আজিজের সাথে সরাসরি বৈঠক করা, ২. ইরান ও সিরিয়ার প্রতি দুই দেশের একইরূপ নীতিমালায় সমন্বয় সাধন করা, যৌথভাবে পদক্ষেপ নেয়া, ৩. ইরাকের তেল রফতানিতে বিকল্প পথ নিশ্চিত করা, কারণ ইরান পারস্য উপসাগর দিয়ে ইরাকের তেল রফতানিতে বাধা দিয়ে আসছিল, ৪. ইরাকের রাসায়নিক অস্ত্রের ব্যবহার সীমিত করা। রামসফেল্ড এভাবেই তার ঐতিহাসিক বাগদাদ সফর শুরু করেন ১৯৮৩ সালের ডিসেম্বর মাসে। কিন্তু পরে ডিক্লাসিফাইড মার্কিন ডকুমেন্ট থেকে দেখা যায়, রামসফেল্ড সাদ্দামের সাথে রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার নিয়ে কোনো প্রসঙ্গই উত্থাপন করেননি!

আরো আশঙ্কার কথা যে, ১৯৯৫ সালে রিগ্যান প্রশাসনের ইরাক সংক্রান্ত বিশেষজ্ঞ হাওয়ার্ড তেইচার এক এফিডেভিটে উল্লেখ করেন যে তদানীন্তন সিআইএ পরিচালক উইলিয়াম কেসি কার্দোয়েন নামে চিলির একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে গোপনে ইরাকে ক্লাস্টার বোমা সরবরাহের ব্যবস্থা করেন সেই ১৯৮৩ সালেই। এর আগে ১৯৯৪ সালে মার্কিন কংগ্রেসের এক অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে যে মার্কিন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের লাইসেন্স নিয়ে কয়েকটি আমেরিকান কোম্পানি ইরাকে বিভিন্ন ধরনের অ্যানথ্রাক্সসহ ডজনখানেক জৈব এজেন্ট সরবরাহ করে অতি গোপনে। এসব কিছুই সেসময় মার্কিন আইন প্রণেতাদের অগোচরে রাখা হয়।

বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, নানামুখী চাপে হোক বা বিশ্বে নিজের ভাবমূর্তি ঠিক রাখতেই হোক মার্কিন প্রশাসন ১৯৮৪ সালের মার্চ মাসের ৫ তারিখে ইরাকি বাহিনী দ্বারা রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দেয়। এমনি অবস্থায় ওই একই মাসের শেষে রামসফেল্ড যখন বাগদাদে যান আলোচনার জন্য, তখন তিনি ইরাকি নেতৃবৃন্দের মধ্যে ক্ষোভের প্রকাশ দেখতে পান। তারা মার্কিনিদের ওইভাবে প্রকাশ্যে দেয়া বিবৃতি নিয়ে তীব্র আপত্তি উত্থাপন করেন। কথিত আছে যে, বৈঠককালে সাদ্দাম হোসেন এক পর্যায়ে রামসফেল্ডকে অপমানসূচক কথাও বলেন ও অসৌজন্যমূলকভাবে আলোচনা চালিয়ে যেতে অস্বীকৃতি জানান। অর্থাৎ এক কথায় রামসফেল্ডকে অপমান করেন সাদ্দাম হোসেন। যদিও ওই বছরের নভেম্বরে ইরাকের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনরায় প্রতিষ্ঠিত হয়। রামসফেল্ড ব্যক্তিগতভাবে সাদ্দামের সেই অপমানসূচক ব্যবহারের কথা কখনো ভোলেননি। তবে সাদ্দাম ভুলে গিয়েছিলেন রামসফেল্ড কোনো সাধারণ মানের মানুষ ছিলেন না। তিনি অত্যন্ত মেধাবী, চতুর একজন রাজনীতিবিদ- যিনি ছিলেন দুনিয়া খ্যাত প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাজুয়েট। আর মার্কিনিরা কখনো অপমান ভোলে না। শত বছর পরে হলেও প্রতিশোধ নেয়। অনেকটা পাঠানদের মতো।

আমেরিকার অত্যন্ত অভিজাত প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পাওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। শুধুমাত্র এক্সট্রাঅর্ডিনারি মেধাবীরাই এখানে পড়তে পারেন। বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার দিয়েও যোগ্য নয় এমন কেউ এখানে ভর্তি হতে পারেন না। প্রিন্সটন থেকে যারা গ্রাজুয়েশন করে বের হন তাদের বেশিরভাগই সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে আমেরিকার চালিকাশক্তি হিসেবে পরবর্তী জীবনে আবির্ভূত হন। সদ্য পরলোকগমনকারী সাবেক মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী ডোনাল্ড রাফসফেল্ডও ছিলেন এমনি একজন। প্রিন্সটন থেকে রাষ্ট্র বিজ্ঞানের গ্রাজুয়েট রাফসফেল্ড শুধু বুদ্ধিমানই ছিলেন না, তিনি বিশ্ব ইতিহাস পর্যন্ত পাল্টে দিয়ে গেছেন। এতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বা পৃথিবীর কোনো লাভ হয়েছে কিনা তা বিতর্কের বিষয়। তবে রাফসফেল্ড যেন ঝড়ের গতিতে যুদ্ধের দেবতা হয়ে আবির্ভূত হয়েছিলেন এই শতকের প্রথম দিকে ও গত শতকের আশির দশকে।

বিশ শতকে পৃথিবী দুটি বিশ্বযুদ্ধ প্রত্যক্ষ করেছে, সমাজতন্ত্রের ত্রুরতা থেকে মুক্তি পাওয়ার চেষ্টা করেছে। কিন্তু একুশ শতক শুরুই হয়েছে নতুন ধারার ভয়াবহ যুদ্ধ বিগ্রহ, এসিমেট্রিক ওয়ার, আত্মঘাতী বোমা হামলার তাণ্ডব, বিশ্বের এক নম্বর পরাশক্তির হৃদপি-ে নন স্টেট অ্যাক্টর কর্তৃক অকল্পনীয় সন্ত্রাসী হামলার মধ্য দিয়ে।

রামসফেল্ড দ্বিতীয়বার মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী নিযুক্ত হন জর্জ বুশের আমলে। নাইন ইলেভেনের সন্ত্রাসী ঘটনার প্রেক্ষিতে আফগানিস্তানে আগ্রাসনে রামসফেল্ড পালন করেন মুখ্য ভূমিকা। এর মাত্র দুই বছরের মাথায় ২০০৩ সালে ইরাকের কাছে উইপন্স অব মাস ডিস্ট্রাকশনস-ডব্লিউএমডি মজুদ আছে এই অভিযোগ তুলে ইরাকে আগ্রাসনের পথ উন্মুক্ত করেন। মার্কিন জেনারেলদের প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও তিনি ইরাকে আগ্রাসন চালাতে প্রেসিডেন্ট বুশকে রাজি করান। ইরাকে পতন হয় সাদ্দাম হোসেনের। তিনি গ্রেফতার হন মাটির নিচের এক গুহা থেকে। দাড়ি গোঁফ আবৃত, নোংরা কাপড় পরিহিত সাদ্দামকে পৃথিবীর সামনে উপস্থাপন করা হয় গর্তে লুকানো এক ইঁদুরের মতো করে। তার চুল, দাড়ি, দাঁত পরীক্ষার সেই ঐতিহাসিক ছবি দেখানো হয় বিশ্বের সব টিভি চ্যানেলে। এক সময় তাকে ঝুলানো হয় ফাঁসিতে। রামসফেল্ড অবশ্যই তার অপমানের প্রতিশোধ নিয়েছিলেন।

সাদ্দাম হোসেন যেকোনো ভাবে ক্ষমতায় থাকার জন্য, প্রায় দশ লাখ ইরাকিকে হত্যা করেছিলেন নানাভাবে। আরো কয়েক লাখ ইরানি কোনো দোষ না করেও যুদ্ধে ও রাসায়নিক অস্ত্রের আঘাতে মারা যায়। রামসফেল্ড ইরাকে আগ্রাসন চালানোয় ইরাকে নিহত হয় প্রায় চার লাখ মানুষ। এ এক অদ্ভুত পৃথিবী। রামসফেল্ডকে যখন পরে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করেছিল ইরাকের কথিত মানব বিধ্বংসী মারণাস্ত্রের সত্যতা ও ইরাক আগ্রাসনের যৌক্তিকতা নিয়ে তখন তিনি নির্লিপ্তভাবে তার সেই বিখ্যাত উক্তি করেছিলেন :

‘আপনার কাছে কোনো কিছুর অস্তিত্বের পক্ষে প্রমাণ নেই শুধু এই কারণে আপনি বলতে পারেন না আপনার কাছে প্রমাণ আছে যে তার অস্তিত্ব নেই।’
‘প্রমাণের অনুপস্থিতি অনুপস্থিতির প্রমাণ নয়।’
আল্লাহ তাই হয়তো বলেছেন, তিনি এক জালেমকে আরেক জালেম দিয়ে ধ্বংস করেন!


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us