টেস্টটিউবে গর্ভ সঞ্চার : ইসলাম কী বলে
টেস্টটিউবে গর্ভ সঞ্চার - প্রতীকী ছবি
সন্তান নারী-পুরুষের যৌন মিলনের ফসল। আর এই যৌন মিলনের একমাত্র বৈধ পথ হলো বিয়ে। ইসলাম সন্তানের পিতৃ পরিচয়ের ব্যাপারটিকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেয়। এ কারণেই ইসলাম নারী-পুরুষের জন্য বিয়ে শরিয়তসম্মত করেছে। আর বিয়েবিহীন যৌন মিলনকে অত্যন্ত ঘৃণার চোখে দেখে। তাই যারা বিয়েবিহীন যৌন মিলনে লিপ্ত হয় তাদের জন্য ইসলাম কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করেছে। মানুষকে বিয়েবিহীন যৌন মিলন থেকে বিরত থাকার আদেশ দিতে গিয়ে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আর তোমরা ব্যভিচারের কাছে যেয়ো না, নিশ্চয় তা অশ্লীল কাজ ও মন্দ পথ। (সূরা ইসরা : ৩২)
ইসলামের দৃষ্টিতে সন্তান বৈধ হওয়ার জন্য শর্ত হলো বৈধ বিবাহের মাধ্যমে যৌন মিলন থেকে সন্তানের জন্ম গ্রহণ। এ প্রসঙ্গে নবী সা: বলেন, ‘সন্তান তারই যার সাথে (বৈবাহিক সম্পর্কের ভিত্তিতে) ‘ফিরাশ’ বা শয্যাযাপন হয়। আর ব্যভিচারকারীর জন্য রয়েছে পাথর।’ (বুখারি : ২০৫৩, মুসলিম : ৩৬৮৬)
এ হাদিস থেকে সন্তানের পিতৃ পরিচয়ের একটি মূলনীতি বেরিয়ে এসেছে, আর তা হলো, সন্তান তার পিতৃ পরিচয় লাভের জন্য অবশ্যই তার মা-বাবার মধ্যে বৈধ বিয়ে সঙ্ঘটিত হতে হবে। এই বৈধ বিবাহের ভিত্তিতে যে যৌন মিলন তাদের মধ্যে সঙ্ঘটিত হবে তার ফসল হিসেবে যে সন্তান জন্ম নিবে তা হবে সে পুরুষের সন্তান। কারণ, যৌন মিলনের মাধ্যমে সাধারণত: পুরুষের বীর্য স্ত্রীর জরায়ুতে প্রবিষ্ট হয়। আর তা থেকেই জন্ম নেয় সন্তান। এটাই ছিল প্রাচীনকাল থেকে সন্তান জন্মদানের রীতি। আধুনিককালে অবশ্য যৌন মিলন ছাড়াও স্বামীর বীর্য স্ত্রীর জরায়ুতে পৌঁছাবার কৃত্রিম ব্যবস্থা মানুষ আবিষ্কার করেছে। বর্তমান যুগে এ কারণে যৌন মিলন ছাড়াও সন্তান জন্ম নিচ্ছে। কৃত্রিম গর্ভ সঞ্চারের নব আবিষ্কৃত এ পদ্ধতির নাম টেস্টটিউব। আমরা এখানে টেস্টটিউব সন্তান সম্পর্কে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি পাঠকদের সামনে পেশ করছি।
টেস্টটিউবে গর্ভ সঞ্চার করে তা মানব জরায়ুতে স্থাপন করা ইসলাম অবৈধ মনে করে না। তবে ইসলাম এ ক্ষেত্রে সে সন্তানকে বৈধ সন্তান বলে স্বীকৃতি দানের জন্য নিম্নোক্ত শর্তসমূহ আরোপ করে।
১. বীর্য ও ডিম্বাণু অবশ্যই স্বামী এবং স্ত্রীর কাছ থেকে সংগ্রহ করতে হবে, অন্য কোনো পুরুষ ও নারীর কাছ থেকে বীর্য ও ডিম্বাণু সংগ্রহ করে তা দ্বারা গর্ভ সঞ্চার করা যাবে না।
২. টেস্টটিউবে সঞ্চারিত ভ্রূণ অবশ্যই স্ত্রীর জরায়ুতে স্থাপন করতে হবে, অপর কোনো মহিলার জরায়ুতে তা স্থাপন করা যাবে না।
৩. স্বামীর বীর্য এবং স্ত্রীর ডিম্বাণু নিয়ে টেস্টটিউবে গর্ভ সঞ্চারের বিষয়টি অবশ্যই স্বামীর জীবদ্দশায় হতে হবে। স্বামীর মৃত্যুর পর বীর্য ব্যাংকে রক্ষিত তার বীর্য দ্বারা কিছুতেই গর্ভ সঞ্চার করা যাবে না।
এ প্রসঙ্গে জর্দানের রাজধানী ওমানে ওআইসি-এর ফিকাহ একাডেমির বিগত ৮-১৩ সফর ১৪০৭ হি: মুতাবিক ১১-১৬ অক্টোবর ১৯৮৬ সালে অনুষ্ঠিত অধিবেশনে গৃহীত সিদ্ধান্তে বলা হয় :
কৃত্রিম গর্ভ সঞ্চার (টেস্টটিউব) প্রসঙ্গে পঠিত প্রবন্ধ এবং এ বিষয়ক বিশেষজ্ঞ ও ডাক্তারদের বক্তব্য শোনা এবং সামগ্রিকভাবে এ বিষয়ে জানার পর সংসদের কাছে প্রতীয়মান হয়েছে যে, বর্তমান যুগে কৃত্রিম গর্ভ সঞ্চারের সাতটি পদ্ধতি রয়েছে। সংসদ এ প্রসঙ্গে নিম্নোক্ত সিদ্ধান্তসমূহ গ্রহণ করছে :
প্রথমত নিম্নোক্ত পাঁচটি পদ্ধতি শরিয়তের দৃষ্টিতে হারাম এবং সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ। কারণ, এর ফলে পিতৃপরিচয় ও মাতৃপরিচয় উভয়টি ক্ষতিগ্রস্ত হবার মতো শরীয়তবিরোধী বিষয় রয়েছে।
এক. স্বামীর কাছ থেকে সংগৃহীত বীর্য ও পরস্ত্রীর কাছ থেকে সংগৃহীত ডিম্বাণুর মাধ্যমে ভ্রূণ সৃষ্টি করে পরে তা স্ত্রীর জরায়ুতে স্থাপন করা।
দুই. কোনো পরপুরুষের বীর্য এবং স্ত্রীর ডিম্বাণু নিয়ে ভ্রূণ সৃষ্টি করে পরে তা স্ত্রীর জরায়ুতে স্থাপন করা।
তিন. স্বামীর বীর্য ও স্ত্রীর ডিম্বাণু নিয়ে ভ্রূণ সৃষ্টি করে পরে তা অন্য কোনো নারীর জরায়ুতে স্থাপন করা।
চার. পর পুরুষের বীর্য ও পর-স্ত্রীর ডিম্বাণু নিয়ে বাইরে (টেস্টটিউবে) ভ্রূণ সৃষ্টি করে পরে তা স্ত্রীর জরায়ুতে স্থাপন করা।
পাঁচ. স্বামীর বীর্য ও স্ত্রীর ডিম্বাণু নিয়ে তা দ্বারা বাইরে (টেস্টটিউবে) ভ্রূণ সৃষ্টি করে পরে তা স্বামীর অপর স্ত্রীর জরায়ুতে স্থাপন করা।
(শেষোক্ত পদ্ধতির গর্ভ সঞ্চারকে ওআইসির ফিকাহ একাডেমি হারাম পদ্ধতি বললেও ড. আব্দুল্লাহ ফকিহ এ পদ্ধতিকে হারাম বলতে রাজি নন। তিনি এ পদ্ধতিকে সন্দেহজনক পদ্ধতি বলে অবহিত করেছেন। এ প্রসঙ্গে তার বক্তব্য নিম্নরূপ। ‘আর যদি লোকটির দু’টি স্ত্রী থাকে তাদের একজন গর্ভধারণে অপারগ হয়, এমতাবস্থায় তার থেকে ডিম্বাণু সংগ্রহ করা হয় অতঃপর তার বীর্য দ্বারা গর্ভ সঞ্চার করা হয়, অতঃপর তা তার অপর স্ত্রীর জরায়ুতে প্রতিস্থাপন করা হয়, তবে এ পদ্ধতিটি সন্দেহজনক। ভাবনা-চিন্তা করে দেখার মতো বিষয়’। (আল ফাতওয়া আল মুআসিরা ফিল হায়াতিয যাওজিয়া, (১/৩০৪) ফাতওয়া নং ৪৩৮০।)
দ্বিতীয়ত ষষ্ঠ ও সপ্তম পদ্ধতি- এ দুটি পদ্ধতি প্রয়োজনে অবলম্বন করা যেতে পারে, অবশ্য এ পদ্ধতি অবলম্বন করার সময় সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে।
ছয়. স্বামীর বীর্য ও স্ত্রীর ডিম্বাণু সংগ্রহ করে বাইরে টেস্টটিউবে তা দ্বারা গর্ভ সঞ্চার করে অতঃপর তা স্ত্রীর জরায়ুতে স্থাপন করা।
সাত. স্বামীর বীর্য সংগ্রহ করে তা ইঞ্জেকশন দ্বারা তার স্ত্রীর জরায়ু বা ডিম্ববাহী নালীতে প্রবিষ্ট করে জরায়ুর অভ্যন্তরে গর্ভ সঞ্চার করা।
চূড়ান্ত বিষয় আল্লাহ তাআলাই ভালো জানেন। (মুজাল্লাতুল মাজমা, সংখ্যা- ৩, খণ্ড১, পৃ-৪২৩, সিদ্ধান্ত নং- ১৬- (৩/৪))
ইসলামিক স্কলার ও অধ্যাপক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া