আফগানিস্তানের ভবিষ্যৎ : গণতান্ত্রিকব্যবস্থা বনাম ইসলামি শরিয়া
আফগান শান্তি আলোচনা - ছবি : সংগৃহীত
কয়েক দিন আগে তালেবান উপপ্রধান মোল্লা বারদার গানি বলেছেন, সত্যিকারের ইসলামি শাসনব্যবস্থার মাধ্যমে আফগানিস্তানের চলমান সমস্যার সহজ উপায়ে নিরসন সম্ভব। তার এই মন্তব্যের ফলে কাবুল সরকারের ভবিষ্যত নিয়ে নতুন করে আলোচনার সৃষ্টি হয়।
আফগানিস্তান যদি ইসলামি শাসনব্যবস্থাই প্রতিষ্ঠিত হয়, তবে বর্তমান কাবুল সরকারের ভবিষ্যত কী হবে? মনে রাখতে হবে, তালেবান শুরু থেকেই কাবুল সরকারকে আফগানিস্তানের বৈধ সরকার বলে অস্বীকার করে আসছে।
অর্থাৎ বিদেশী সেনা প্রত্যাহার করার পর আন্তঃআফগান আলোচনার কথা থাকলেও সেখানে কিন্তু তালেবানের পক্ষ থেকে কাবুল প্রশাসনের জন্য বিশেষ কোনো মর্যাদা বরাদ্দ থাকবে না। অর্থাৎ এ পর্যন্ত যতটুকু আন্তঃআফগান আলোচনার কথা শোনা যায়, সেখানেও কোনো লিখিত দলিলপত্রে কাবুল সরকার লেখাটুকুও তালেবান সহ্য করেনি। যেখানে কাবুল সরকারকেই তালেবান স্বীকৃতি দিতে নারাজ সেখানে প্রশ্ন ওঠতে পারে, আফগানিস্তানে গণতন্ত্রের ভবিষ্যতই বা কী?
তালেবান আন্দোলন গড়ে উঠেছিল আফগানিস্তানে ইসলামি শরিয়াহ আইন বাস্তবায়নকে সামনে রেখেই এবং তালেবানের নেতৃত্বে ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত দেশটিতে শরিয়াহ অনুযায়ী শাসনকাজ পরিচালিত হয়।
অবশ্য, তাদের বিরুদ্ধে নানা ধরনের অভিযোগ শোনা যায়। বিশেষ করে পশ্চিমা মানদণ্ডে নারী স্বাধীনতা আর মানবাধিকার প্রশ্নে। তবে এর মধ্যে যে সামন্য কিছু বাড়াবাড়ি ছিল না, তা কিন্তু নয়। সাম্প্রতিক সময়ে ভারতীয় বংশদ্ভূত ফরিদ জাকারিয়ার জিপিএস অনুষ্ঠানে এ বিষয়টি নিয়ে প্রশ্নের জবাবে তালেবান মুখপাত্র জাবিউল্লাহ মুজাহিদ বলেন, আমরা জানি সৈন্য প্রত্যাহারের পর আরোপিত ইসলামি শরিয়াহ শাসন নিয়ে শুধু বিশ্ববাসীই নয় আফগান জনমানসে নানা বিভ্রান্তি ছড়িয়ে পড়েছে।
তিনি বলেন, নারীদের ইসলামি শরিয়াহ এবং আফগানের নিজস্ব ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক বিষয়কে সমন্বয় করে তাদের অধিকার নিশ্চিত করা হবে। অর্থাৎ তারা যে আগের অবস্থান থেকে যতটা সম্ভব নমনীয়তা অবলম্বন করে নারীনীতি প্রণয়নে আগ্রহী, তা পরিষ্কার ।
৯০-এর দশকে নারী শিক্ষার বিষয়ে বিধিনিষেধ আরোপ সম্পর্কে তখনকার পরিস্থিতিকে দায়ী করে বলেন, ওই সময়ে বিশেষ পরিবেশের কারণে এমনটা করা হয়েছিল অর্থাৎ তিনি বিদ্যমান পরিস্থিতিকেই দায়ী করেন। মানবাধিকার ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অধিকার প্রশ্নে বলেন, ইসলাম এই দুটি সমস্যার চমৎকার সমাধান দিয়েছে এবং আমরা ইসলামি শরিয়াহ অনুযায়ী তা সমাধান করতে আগ্রহী।
এখন প্রশ্ন হলো গণতন্ত্রের বিরোধিতার কারণ কী?
গণতন্ত্রের গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞাগুলোর মধ্যে আধুনিক কালের সবার কাছে বোধগম্যটি আমেরিকার ষোড়শ প্রসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন থেকে পাওয়া যায় : গণতন্ত্র হলো জনগণের, জনগণের জন্য, জনগণের নির্বাচিত সরকারব্যবস্থা।
সহজ অর্থে দাঁড়ায়, জনগণের মতামতের ভিত্তিতে নির্বাচিত শাসক ও শাসনব্যবস্থা। যার সার্বভৌমত্বের মালিক জনগণ।
এখন দেখা যাক কোরআন কী বলে এই বেশির ভাগ মানুষ সম্পর্কে
১. কিন্তু অধিকাংশ লোক বিশ্বাস স্থাপন করে না। [সূত্র : সূরা মু‘মিন, আয়াত-৫৯]
২. তাদের অধিকাংশেরই বিবেক-বুদ্ধি নেই। [সূত্র : সূরা মায়িদা]
৩. কিন্তু অধিকাংশ মানুষই জ্ঞান রাখে না। [সূত্র : সূরা ইউসুফ, আয়াত-৫৮]
৪. কিন্তু তাদের অধিকাংশই মূর্খ। [সূত্র : সূরা আন‘আম, আয়াত-১১১]
৪. কিন্তু তোমাদের অধিকাংশই সত্য দ্বীনে নিঃস্পৃহ। [সূত্র : সূরা যুখরুফ, আয়াত-৭৮]
৬. তোমাদের অধিকাংশই নাফরমান। [সূত্র : সূরা মায়িদা, আয়াত-৫৯]
৭. তাদের অধিকাংশই শুধু আন্দাজ ও অনুমানের উপর চলে। অথচ আন্দাজ-অনুমান সত্যের বেলায় কোনো কাজেই আসে না। [সূত্র : সূরা ইউনুস, আয়াত-৩৬]
৮. নিশ্চয় বহু লোক আমার মহাশক্তির ব্যাপারে উদাসীন। [সূত্র : সূরা ইউনুস আয়াত-৩৬]
৯. তাদের অধিকাংশ লোককেই আমি প্রতিজ্ঞা বাস্তবায়নকারী পাইনি; বরং তাদের অধিকাংশকেই পেয়েছি হুকুম অমান্যকারী। [সূত্র : সূরা আরাফ, আয়াত-১০]
১০. তাদের পূর্বেও অধিকাংশ লোক বিপথগামী হয়েছিল। [সূত্র : সূরা সাফফাত, আয়াত-৭১]
১১. তাদের অধিকাংশের জন্য শাস্তি অবধারিত হয়েছে। সুতরাং, তারা বিশ্বাস করবে না। [সূত্র : সূরা ইয়াসীন, আয়াত-৭]
১২. অনেকের উপর অবধারিত হয়েছে শাস্তি। [সূত্র : সূরা হজ্জ, আয়াত-১৮]
১৩. যদি আপনি পৃথিবীর অধিকাংশের কথা মেনে নেন, তবে তারা আপনাকে আল্লাহর পথ হতে বিপথগামী করে দিবে। তারা শুধু অলীক কল্পনার অনুসরণ করে এবং সম্পূর্ণ অনুমানভিত্তিক কথা বলে থাকে। [সূত্র : সূরা আন‘আম, আয়াত-১১৬]
উল্লেখিত আয়াতগুলোর মাধ্যমে স্পষ্টই প্রমাণিত হচ্ছে যে অধিকাংশরই শিক্ষা নেই, জ্ঞান নেই, অধিকাংশ লোকই সত্য সন্ধানী নয়; সতর্কতা ও বিবেকবুদ্ধির অধিকারী নয়; প্রতিজ্ঞা বাস্তবায়নকারী নয়; তারা জান্নাতি হওয়া এবং আখিরাতের শান্তি বা আজাবের তোয়াক্কা করে না। দুনিয়ার অধিকাংশ লোকই জাহান্নামের পথে গমনকারী, গুমরাহ, প্রতিশ্রুতি ভঙ্গকারী, উদাসীন, আন্দাজপূজারী, সত্যনিস্পৃহ, নির্বুদ্ধিতা সম্পন্ন, অজ্ঞতা ও মূর্খতার শিকার। আর বাস্তবতা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে তাই দেখিয়ে দেয়।
শাসনব্যবস্থা এবং শাসক নির্বাচনে জনগণের মতামত নিয়ে সীদ্ধান্ত নিতে গেলে ভালো, সৎ, চরিত্রবান, ন্যায়পরায়ণ শাসক নির্বাচিত হওয়া বড়ই দুষ্কর। অথচ রাষ্ট্রের জন্য ন্যায়পরায়ণ শাসক তেমনিভাবে প্রয়োজন মানুষের জন্য যেমন মাথা প্রয়োজন। আর এর জন্য দরকার সঠিক পদ্ধতিতে শাসক নির্বাচন করার ব্যবস্থা। সৎ ও যোগ্য মানুষের মাধ্যমেই সৎ ও যোগ্য ব্যক্তি নির্বাচন করা সম্ভব। সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামত এখানে ততটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় না।
এখন যেহেতু তালেবান স্পষ্ট করেই বলছে যে তারা ইসলামিব্যবস্থা শরিয়াহ কায়েম করে আফগানিস্তান পরিচালনা করতে চায়, তাই ইসলামে গণতান্ত্রিক কোনো শাসনব্যবস্থার উল্লেখ নেই এবং রাসূল সা. এবং খোলাফায়ে রাশেদা থেকেও প্রমাণিত কোনো শাসনব্যবস্থা নয়। উপরন্তু এই ব্যবস্থায় এমন কিছু ফাঁক ফোকর আছে যা ইসলামি মৌলকি চিন্তা চেতনার সাথে তীব্র বিরোধ লক্ষ করা যায়।
যদিও আমরা জেনে এসেছি গণতন্ত্র হলো এ যাবত কালের সবচেয়ে উপযুক্ত শাসনব্যবস্থা। যেটা অন্য সব শাসনব্যবস্থা থেকে মূলত জবাবদিহিতা নীতির জন্য এমনটা দাবি করে অর্থাৎ আইনের শাসন। সেইসাথে জনগণ তার শাসককে বেছে নিতে পারে নিজ মর্জিমাফিক। আইন প্রণয়নও হয় মানুষের স্বাধীন বিচারবুদ্ধির মাধ্যমে।
আরো শোনানো হয়, ব্যক্তি স্বাধীনতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও মানবাধিকারের মতো নানা মুখরোচক ফাঁপা বুলি।
প্রথমে আসা যাক আইনের শাসন আর জবাবদিহিতা সম্পর্কে।
যেকোনো রাষ্ট্র মূলত টিকে থাকে ন্যায়বিচার ধারণার ওপর। এবং রাষ্ট্রের ভিত্তিও এই ন্যায়বিচার।
কিন্তু প্রশ্ন হলো ন্যায়বিচার করতে হলে আইন লাগবে। যা সবার সমান সুযোগ সুবিধা সুনিশ্চিত করবে এমন আইন। শুধু আইন হলেই হবে না তা যথাযথ আদর্শের ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। অর্থাৎ এর সার্বজনীনতা আবশ্যক এবং সেইসাথে বৈধ কর্তৃপক্ষ তারা অনুমোদিত হওয়া গুরুত্বপূর্ণ।
কিন্তু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আমরা দেখি, আইন প্রণয়ন করা হয় জনগণের ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির মাধ্যমে। অর্থাৎ তারা যা ভালো মনে করে তাই ভালো তারা যা মন্দ মনে করে তাই মন্দ। এবং এই ভালোমন্দ কখনোই সার্বজনীনতা লাভ করে না। সময়ে পার্থক্যে, তার মধ্যে বিরাট পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। কখনো তা ১৮০ ডিগ্রি উল্টে যায়। আর আইন প্রণয়নে আইন প্রণেতার ব্যক্তিগত খেয়ালখুশির প্রভাব স্পষ্ট।
অথচ ইসলামের এর কোনো সুযোগ নেই। মানুষ আইন প্রণয়ন করার বৈধ কর্তৃপক্ষ নয়। কারণ মানুষ সৃষ্টজীব। তার মধ্যে অনেক মানবীয় দুর্বলতা বিদ্যমান। আইনের মৌলিক বিধিবিধান একমাত্র তার রবের পক্ষ থেকেই নির্ধারিত। যা পরিবর্তন পরিবর্ধনের কোনো সুযোগ ইসলাম কাউকে দেয়নি।
জবাবদিহিতার ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে বলা হয় সরকারের তিনটি বিভাগ একে অপরকে জবাবদিহি করতে পারে বলে এর মাধ্যমে আইনের শাসন কায়েম হয়।
কিন্তু আমরা দেখি এখানেও রয়েছে চাতুর্যতার আশ্রয়। উদাহরণ স্বরূপ বলা যেতে পারে, মার্কিন সরকারব্যবস্থার কথা। এখানে প্রেসিডেন্ট, কংগ্রেস আর বিচার বিভাগ নামক তিনটি প্রশাসনিক বিভাগ বিদ্যমান। অথচ খুব সহজেই এগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে আসছে বিভিন্ন লবিং গ্রুপ, মাল্টি ন্যাশনাল কম্পানি এবং মিডিয়া যারা জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে অবৈধ সুযোগ সুবিধার আদায় করে নেয় ঘুস প্রদানের মাধ্যমে এবং তাদের অনুকূলে সীদ্ধান্তের জন্য মিডিয়া অনেক বড় প্রভাবক হিসবে কাজ করে। ।
এছাড়াও বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসী কার্যক্রমে এই তিন বিভাগের ভূমিকাই মূখ্য। হিরোসিমা নাগাশাকিতে এটম বোমা হামলা, গণতন্ত্র স্বাধীনতা কথা বলে লক্ষ্য লক্ষ্য মানুষকে হত্যা করা সম্ভব হয়েছে এই তিন বিভাগের যোগসাজশে। অথচ তাদের কার্যক্রম হওয়ার কথা ছিল, এক বিভাগ অন্য বিভাগের অন্যায়, অন্যায্য কর্ম পরিকল্পনা ও দাবিকে রুখে দিবে। আর মিডিয়ার ভূমিকা ছিল এসব অন্যায়ের পক্ষে জনমত গঠন করা। চমস্কির ভাষায় তা হলো ম্যানুফ্যাকচারিং অব কন্সেন্ট।
সাম্প্রতিক সময়ে মুসলিম ভুখণ্ডগুলোর উপর অবৈধভাবে জবর দখলে তারা একই সরল রেখায় অবস্থান করছে। নির্বিচারে ইরাক, আফগানিস্তান, সিরিয়া, লিবিয়া, ইয়েমেনে মানুষ হত্যাকে বৈধতা দিচ্ছে। নারী শিশুরাও তাদের থেকে রেহাই পাচ্ছে না।
অন্যদিকে ইসলামি শাসনব্যবস্থায় রয়েছে সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষের কাছে জবাবদিহিতার ব্যবস্থা। এখানে শাসক চাইলেই তার মনমতো কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। আর বিচার বিভাগ তার খেয়ালখুশির অনুসরণ করতে পারে না। প্রশাসণ জনগণের ওপর অন্যায় হস্তক্ষেপ করতে পারে না। কারণ উলামা সমাজ ইসলামি রাষ্ট্রের অন্যায়, অন্যায্য বিষয়ে সোচ্চার থাকে। ইসলামি ইতিহাসে তার নজির যথেষ্ট রয়েছে।
এখন অনেকেই প্রশ্ন করতে পারেন, ইসলামি ইতিহাসে তো জালিম শাসকের নজিরও রয়েছে। হ্যাঁ, অবশ্যই রয়েছে কিন্তু মনে রাখতে হবে কোনো জালিম শাসক অন্যায় করলেও তাকে ন্যায় বলে কোনো আলিমের কাছ থেকে অনুমোদন করিয়ে নিতে পারেনি। হকপন্থী আলেমরা তাদের বিরোধিতা করে গেছেন এবং জীবন দিয়ে কেউ কেউ তার মূল্য পরিশোধ করে গেছে। উদাহরণ হিসেবে চার মাজহাবের মহান ইমামদের আত্মত্যাগের কথা বলা যেতে পারে।
কিন্তু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় অন্যায় তো করা হয়। এমনকি করার আগে তাকে অনুমোদিত করে নেয়া হয়। যা দীর্ঘমেয়াদে সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধের গোড়ায় কুঠারাঘাত করে।
এবার আসা যাক ব্যক্তি স্বাধীনতার বিষয়ে যা গণতন্ত্রের রক্ষা কবচ বলে মনে করা হয়।
অথচ এই ব্যক্তি স্বাধীনতার যে কনসেপ্ট পশ্চিমারা বুঝে আমাদের বোঝায় তা ইসলাম কখনোই অনুমোদন করে না। ব্যক্তি মানুষের মধ্যে যত প্রকার বিকৃতি, অসামাজিক আর অশোভন আচরণ তাকে এই ব্যক্তি স্বাধীনতার মাধ্যমে লেজিটিমাইজ করা হয়। যেমন : LGBTQ.
এখন কেউ হয়ত বলবেন, না আমরা ব্যক্তি স্বাধীনতা বলতে তা বুঝি নাদ যা পশ্চিমারা বোঝায়।
তার কাছে প্রশ্ন থাকল, আপনি ব্যক্তি স্বাধীনতা বলতে যা বোঝেন তার একটা লিস্ট করে দেখেন তা কুরআন সুন্নাহভিত্তিক কতটুকু যৌক্তিক।
ইসলাম স্বাধীনতা বলতে বোঝায়, সৃষ্টির দাসত্ব থেকে মুক্ত হয়ে এক আল্লাহর দাসত্ব করা।আর পশ্চিমা ব্যক্তি স্বাধীনতার মূলে আছে আল্লাহর সাথে বিদ্রোহ করে নিজের নফসের ও খেয়াল খুশির দাসত্বকে মেনে নেয়া।
কোনটা প্রকৃত স্বাধীনতা সিদ্ধান্তটা আপনার?
একইভাবে মানবাধিকার বিষয়েও বলা যায়, গণতান্ত্রিক মানবাধিকার হলো ব্যক্তিগত ত্রুটিগুলোর বৈধতার স্বীকৃতি আদায়। এবং সমাজে সার্বজনীনভাবে ছড়িয়ে দেয়ার প্রজেক্ট।
তারা মানবাধিকার বলতে তাই বোঝে, নয়ত মানবাধিকার যদি হতো অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা তাহলে বিশ্বব্যাপী লিবারেল সন্ত্রাসের মাধ্যমে এর সবগুলোকেই প্রতিনিয়ত ভুলুন্ঠিত করত না পশ্চিমারা।
ইয়েমেনে অবরোধ আরোপিত করে লাখ লাখ শিশুকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিত না। ইরাকে, সিরিয়া, লিবিয়ায় নির্বিচারে বোমা হামলা করত না। আফগানিস্তানে শত শত মানুষের মৃত্যুর কারণ তারা হতো না। নারীদের ধর্ষণ, বন্দী করত না। গুয়ান্তানামায় বিনা অপরাধে অমানবিক শাস্তি দিত না শুধু সন্দেহের উপর নির্ভর করে নিরাপরাধ মুসলিদেরদের। অথচ তারা বলে বেড়ায়, ইসলাম মানবাধিকার রক্ষায় সক্ষম না।
দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো গণতান্ত্রিকসহ বর্তমান বিশ্বে এমনকি যেসব দেশ নিজেদের সমাজতান্ত্রিক আদর্শের ধ্বজাধারী বলে দাবি করে, তারাও যে অর্থনৈতিকব্যবস্থায় রাষ্ট্র পরিচালিত করে তা সম্পূর্ণভাবে সুদভিত্তিক অর্থনীতি। অর্থনৈতিক যাবতীয় কাজের সাথে সুদ ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। মূলত এটা এমন একটি গ্লোবাল পলিসি, যে কেউ চাইলেই সুদমুক্ত অর্থনৈতিকব্যবস্থার বাইরে যেতে পারবে না যতক্ষণ না তারা গণতন্ত্র থেকে নিজের সম্পর্ক ছিন্ন করে।
অথচ সুদকে ইসলামে সম্পূর্ণভাবে হারাম ঘোষণা করা হয়েছে এবং এবং যারা সুদের সাথে যেকোনোভাবে নিজেকে সম্পর্কিত করবে তার বিরুদ্ধে আল্লাহ তাআলা যুদ্ধের ঘোষণা দিয়েছেন।
আর এটা এমনই একটা সিস্টেম যেখানে ধনীরা প্রতিনিয়ত ধনী হয়, গরিবেরা হয় গরিব অর্থাৎ সম্পদের একমুখী প্রবাহ বিদ্যমান।
অন্যদিকে ইসলামি অর্থনীতি যাকাতভিত্তিক যেখানে ধনীর সম্পদের একটা নির্দিষ্ট অংশ গরিবকে দিতে ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থা ধনী ব্যক্তিকে বাধ্য করবে।
এর মাধ্যমে সম্পদের বহুমুখী প্রবাহে অর্থনীতিতে গতিশীলতা বৃদ্ধি পাবে সম্পদের সুষম বণ্টনের মাধ্যমে সমাজের সকলে উপকৃত হবে।
তৃতীয় আরেকটি বিষয় ধর্মনিরপেক্ষতা যাকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রাণভোমরা বলা হলে অত্যুক্তি হবে না। যেখানে ধর্মকে রাষ্ট্র থেকে নির্বাসিত করা হয়েছে একটি দীর্ঘ ঐতিহাসিক ঘটনা প্রবাহের মধ্য দিয়ে।
ধর্ম নিরপেক্ষতা বলতে বলা হয়ে থাকে রাষ্ট্র কোনো নির্দিষ্ট ধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা করবে না। অর্থাৎ রাষ্ট্র হলো ধর্ম মুক্ত একটি সত্তা। ব্যক্তি যে যার মতো ব্যক্তিজীবনে ধর্ম পালন করবে।
অথচ ধর্মনিরপেক্ষতার সে নিজেকেই ব্যক্তির উপর নানা বিধিনিষেধ আরোপ করে নতুন ধর্ম রূপে হাজির হয়েছে। যেখানে অন্যান্য ধর্মের ব্যাপারে সে খুবই অনমনীয়।
তার রয়েছে বিশেষ আচার অনুষ্ঠান, বিধিনিষেধ এবং নিয়মকানুন যা ধর্মের অনুরূপ আচার অনুষ্ঠান এবং বিধিনিষেধকে খারিজ করে দেয়। ব্যক্তি জীবনেও তার প্রভাব লক্ষ করার মতো।
অপরদিকে ইসলাম এমনই এক ধর্ম যা রাষ্ট্রের উপর কর্তৃত্ব বিস্তারের মাধ্যমে রাষ্ট্রের সকল গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে নিজেকে হেজিমনিক শক্তি হিসেবে হাজির করে।
অন্য ধর্মের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য ধর্মনিরপেক্ষতা কোনো সমাধান নয়। ইসলাম অন্য ধর্মকে সত্য ধর্ম হিসেবে স্বীকৃতি দেয় না। তবুও তাকে জোরপূর্বক নির্মূল করা কখনোই সমর্থন করে না।
কিন্তু আমরা আফগানিস্তানের দিকে তাকালে দেখতে পাই, ১৯৭৯ সালে যখন সোভিয়েত ইউনিয়ন সেখানে আগ্রাসন চালায়, তারা আফগানিস্তানের মানুষের উপর নতুন করে বিধিনিষেধ আরোপ করে ধর্ম কর্ম পালনের বাধা সৃষ্টি করে।
জোর করে কমিউনিস্ট আদর্শ গ্রহণ করার জন্য হজার হাজার মানুষকে হত্যা করে। তারা শুধু রাষ্ট্র থেকে নয়, ব্যক্তি জীবনে ধর্ম পালনে বিধিনিষেধ আরোপ করে।
আমেরিকাও একই কাজ করে ২০০১ সালে। তখন তালেবানের অধীনে আফগানিস্তান ইসলামি আমিরাত শরিয়াহ শাসন চলমান। অথচ তালেবানকে উৎখাত করে তারা সেখানে গণতান্ত্রিক শাসন কায়েম করে তাদের পুতুল সরকারের মাধ্যমে জনগণের ওপর এক নতুন জীবনব্যবস্থা চাপিয়ে দেয়, যা আফগান জাতির ধর্ম, ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির বিরোধী। এবং বিশ্বের কাছে তারা প্রচার করে তারা আফগানিস্তানে জনগণের ভোটে নির্বাচিত শাসকের কাছে ক্ষমতা তুলে দিয়ে 'তালেবান জঙ্গিদের' কাছ থেকে আফগান জাতিকে রক্ষা করছে। অথচ এসব নির্বাচনে মানুষ ভোট দানে বিরত ছিল। এবং তা ছিল পাতানো নির্বাচন।
অথচ যখন তিউনেশিয়ার জনগণ এই একই নির্বাচনীব্যবস্থার মাধ্যমে ৯০-এর দশকে ভোট দিয়ে ইসলামপন্থী দল ইসলামিক স্যালভেশন ফ্রন্টকে বিপুল ভোটে বিজয়ী করল, তখন পশ্চিমারা ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ক্যু করে তাদের দোষর বুদিয়াফকে দিয়ে ক্ষমতা দখল করে বসল।
একই ঘটনা মিসরে ঘটল যখন মুসলিম ব্রাদারহুডের নেতা মুহাম্মদ মুরসি ২০১১ সালে পশ্চিমা নির্বাচনব্যবস্থার মাধ্যমে জয়ী হয়ে ক্ষমতা গ্রহণ করল, তখন জেনারেল সিসিকে পশ্চিমারা ক্যু করতে ইন্ধন দিলে মুরসির পতন হলো। হাজার হাজার নেতাকর্মীদের বিচারে নামে প্রহসন করে হত্যা করা হলো যা এখনো চলমান।
অথচ আজ যখন আমেরিকা আফগান ছাড়ছে তখন আফগানিস্তানকে রেখে যাচ্ছে এক ভয়ংকর গৃহযুদ্ধের মুখোমুখি করে। কিন্তু আফগানিস্তানে সামরিক হস্তক্ষেপ করেছিল শান্তি প্রতিষ্ঠিত করবে এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে।
এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে গণতন্ত্র বা নির্বাচন বিষয় নয়; মূল বিষয় ইসলামের উত্থান ঠেকানো। তাদের দেয়া প্রক্রিয়া অবলম্বন করে কেউ আপাতত জয়ী হলেও তাকে তারা দমন করে দেবে সময় সুযোগ পেলেই।
এখন এ কথা বলা কখনোই অত্যুক্তি নয় যে আফগানের ভৌগোলিক, সমাজিক, রাজনৈতিক ইতিহাস এবং সাংস্কৃতিক অবস্থান গণতন্ত্র নয় ইসলামি শরিয়াহর সবচেয়ে উপযুক্ত আবাসভূমি এবং এর বাস্তবায়নের মাধ্যমে আফগানিস্তানের যেমন ভৌগোলিক অখণ্ডতা রক্ষা পাবে সেই সাথে গণতান্ত্রিক সমাজ কাঠামোয় গণতন্ত্রের চেয়ে শরিয়াব্যবস্থার শাসন পদ্ধতি যথাযথভাবে ফাংশন করবে।
সবদিক বিবেচনা করে এটা নির্দ্বিতায় বলা যায়, আফগান তালেবান ইসলামি শরিয়াহ কায়েমের প্রশ্নে আপসহীন সংগ্রাম প্রমাণ করে, তারা যথেষ্ট মূল্য পরিশোধ করেছে গত প্রায় তিন দশক, সাথে আফগান জনগণ ভুগছে চার দশক ধরে।
তাই তাদের নানাবিধ সীমাবদ্ধতায় বিশ্বব্যাপী বিরোধিতার মুখে কোনো ত্রুটি বিচ্যুতি হলেই সমালোচনার আগে ভেবে দেখতে হবে তাদের ত্যাগ ও নিষ্ঠার সাথে আল্লাহর আনুগত্যের এক অবিরাম, ক্লান্তিহীন সংগ্রামকে। যখন পৃথিবীর ৫৭টি মুসলিম দেশ তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল আমেরিকার বিরাগভাজন হওয়ার ভয়ে।
লেখক : ছাত্র সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
merajislam920@gmail.com