কঠিন পরিস্থিতিতে পড়তে হতে পারে ইমরান খানকে
ইমরান খান - ছবি : সংগৃহীত
পাকিস্তানের শীর্ষ নেতাদের সম্পর্কে বাইডেনের স্বচ্ছ ধারণা রয়েছে। পাকিস্তান সম্পর্কে বাইডেনের ‘ইনসাইট’ ট্রাম্পের চেয়ে অনেক প্রখর। তিনি ‘কাশ্মির ইস্যু’ এবং আফগানিস্তানের ‘ইনটিগ্রিটি’ নিয়ে আন্তর্জাতিক মজলিসে কথা উঠিয়েছিলেন। এসব কারণে বাইডেনকে পাকিস্তানের সর্বোচ্চ বেসামরিক খেতাব ‘হিলালে পাকিস্তান’ বা ‘পাকিস্তানের চাঁদ’ উপাধি দেয়া হয়। ২০১১ সালে বাইডেনের পাকিস্তান সফরের সময় তিনি বলেছিলেন, ‘পাকিস্তানের সাথে আমাদের সম্পর্ক অতীব গুরুত্বপূর্ণ, আমি মনে করি, পাকিস্তানের জন্যও বিষয়টি তেমন।’ মিডিয়ার সাথে বলতেন, ‘আপনারা মনে করেন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের সার্বভৌম মর্যাদায় আঘাত করে, আপনাদের প্রতি সম্মান ও আস্থা রেখেই বলছি, এসব চরমপন্থীরাই করছে এবং পাকিস্তানের সুনাম নষ্ট করছে। যারা মনে করে আমরা ভারতের স্বার্থই দেখছি, সেটি সঠিক নয়।’
ওয়াশিংটনের পররাষ্ট্রনীতিতে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের কাছে পাকিস্তান ও ভারত উভয় দেশ গুরুত্বপূর্ণ। একদিকে বিশাল চীন অন্য দিকে রাশিয়া ও ইরান। চীনের সাথে ভারতের চিরন্তন বিরোধ থাকায় ওয়াশিংটনের পররাষ্ট্রনীতিতে ভারতের বিশেষ মর্যাদা। ভারত কোয়াডের অন্যতম সদস্য। সম্প্রতি জি-৭ জোটের চীনবিরোধী প্রকল্পে ভারত যোগ দিতে সম্মত হয়েছে। অপর দিকে, পাকিস্তান হাতছাড়া হয়ে গেলে আফগানিস্তান, মধ্য এশিয়ার দেশগুলো এবং ইরানের সাথে পাকিস্তান জোটবদ্ধ হবে যা ওয়াশিংটনের কাছে কৌশলগত দিক দিয়ে লাভজনক হবে না। ট্রাম্প পাকিস্তান সম্পর্ককে যতটুকু ক্ষতি করেছেন বাইডেন সেগুলো কাটিয়ে উঠতে চান। ট্রাম্পের আমলে কাশ্মির পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি। কিন্তু কাশ্মির বিষয়ে বাইডেনের দৃষ্টিভঙ্গি কেমন, ভারত তা বুঝতে পারে। তাই বিশ্লেষকরা মনে করছেন, মোদি কাশ্মির বিষয়ে কিছু একটা ছাড় দিয়ে যুক্তরাষ্টের সাথে সম্পর্ককে সঠিক রাখতে চান।
বাইডেন পাকিস্তানের সাথে বন্ধুত্বের কথা বলেছেন অনেকবার, আঞ্চলিক শান্তি ও অর্থনৈতিক প্রগতির বিষয়েও কথা বলেছেন। ২০০৭ সালে তিনি ঘোষণা দেন, ‘পাকিস্তান দুনিয়ার সবচেয়ে সম্ভাব্য বিপদসঙ্কুল দেশ।’ ২০০৮ সালে বলেন, ‘আমি শপথ করে বলছি, যদি আপনাদের উপর কোনো আক্রমণ হয়, সেটি হবে আফগানিস্তানের পাহাড়ে বসে থাকা আল-কায়েদার কাছ থেকে। কোনো ড্রোনের আক্রমণে নয়।’ ওবামা প্রশাসনের সময় পাক সীমান্তের অভ্যন্তরে ড্রোন আক্রমণ ৬৩১ শতাংশ বেড়ে গিয়েছিল। পাকিস্তানি জনগণ ও সেনাবাহিনী ড্রোন আক্রমণে ত্যক্ত বিরক্ত হয়ে পড়ে। অথচ এই ড্রোন আক্রমণ নির্দেশনা-ব্যবস্থাপনায় ছিলেন জো বাইডেন!
পরিস্থিতির পরিহাস, আজ বাইডেনের পালা পাকিস্তানে নিরাপদ ড্রোন ঘাঁটি বানানোর জন্য ইমরানকে অনুরোধ করায়। পাকিস্তান ঘাঁটি বানাতে না দিলে যদি সেটি মধ্য এশিয়ার কোনো দেশে পেন্টাগন বানায় সেটিও আঞ্চলিক সমস্যা ও বিরোধের নতুন দুয়ার খুলে দেবে; ইরান, পাকিস্তান, রাশিয়া ও চীন সবাই বিপক্ষে যুক্ত হয়ে পড়বে। তবে ভারত সীমান্তে ড্রোন ঘাঁটি করা যাবে কি-না এবং কতটুকু সুবিধা হতে পারে সেটি নয়াদিল্লি, কাবুল ও ওয়াশিংটনের রাজনৈতিক পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে। আর কোনোটিই সম্ভব না হলে আমেরিকা সব সেনা কাবুল থেকে উঠিয়ে নেবে বলে মনে হয় না এবং তুরস্কও সেনা প্রত্যাহার করবে না। ২০২০ সালের চুক্তি অনুযায়ী ন্যাটোর সব সেনা প্রত্যাহার করতে চাপ দিচ্ছে তালেবানরা। তুরস্ক প্রস্তাব দিয়েছে, মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের পর কাবুলের বিমানবন্দরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আফগানিস্তানে থেকে যেতে। আফগানিস্তানে কোনো সমুদ্রপথ সংযুক্ত না থাকায় বিমানবন্দর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তুরস্ক বিমানবন্দর পাহারা দিতে পারলে তালেবান ও যুক্তরাষ্ট্র উভয়ের কাছে আরো মর্যাদা পাবে। আফগানিস্তানে সার্বিক শান্তির জন্য তুরস্ক পাকিস্তানের সহায়তাও চেয়েছে। ইরাকেও তুর্কি সেনাদের বড় ঘাঁটি রয়েছে এবং বিদেশী সেনারা চলে গেলেও তুর্কিরা থেকে যাবে।
তালেবান চায় আফগানিস্তানে ‘প্রকৃত ইসলামী ব্যবস্থা’ প্রতিষ্ঠিত হোক। তারা মনে করে, একটি প্রকৃত ইসলামী শাসন আফগানদের সব সমস্যা সমাধানের সর্বোত্তম উপায়। তালেবান নেতা মোল্লা আবদুল গনি বারাদার উল্লেখ করেন, প্রকৃত ইসলামী ব্যবস্থার অধীনে নারী ও সংখ্যালঘুদের সুরক্ষিত করা হবে এবং কূটনীতিক ও এনজিওকর্মীরা নিরাপদে কাজ করতে সক্ষম হবে। সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং ধর্মীয় বিধি অনুসারে নারীদের অধিকারের বিধান তৈরি করা হবে।
এখন তালেবান বুঝে ‘শান্তি’ কী জিনিস। শান্তি আলোচনার ধীরগতি নিয়ে কর্মকর্তারা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন এবং বলছেন, তালেবানরা এখনো কোনো লিখিত শান্তি প্রস্তাব জমা দেয়নি। আফগান সরকার তালেবানের সাথে আলাপ করে সুবিধা করতে পারছে না। সেনা প্রত্যাহারের পর যদি কাবুলে ‘ইসলামী আমিরাত’ প্রতিষ্ঠিত হয় তবে পাকিস্তানি তালেবান রাজনৈতিক অঙ্গন উত্তপ্ত করে তুলবে। ইমরান সরকারের জন্য সেটি আরো একটি বড় ধরনের ঝুঁকি। কয়েক বছর ধরে এমনিতেই পাকিস্তানি তালেবান বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে সরকারকে বিব্রত করে আসছে এবং চীন পাকিস্তান করিডোরের কাজে বাধা দিচ্ছে।
সুপার পাওয়ার আমেরিকা ২০ বছরের যুদ্ধ ফেলে চলে যাওয়াকে পরাজয় বলছে না। তারা বলছে, ‘আরো বড় সমস্যা’ দেখভাল করার প্রয়োজন হচ্ছে; তাছাড়া এই দীর্ঘ সময়ে ধ্বংস ছাড়া কিছু অর্জিত হয়নি। সেনা চলে গেলেও বাইডেন প্রশাসন চায় কোনো না কোনোভাবে কাবুল প্রশাসনের ওপর কর্তৃত্ব রাখতে। প্রসঙ্গত, বেনজির ভুট্টো প্রধানমন্ত্রী থাকার সময় বই লিখেছিলেন ‘ডটার অব দ্য ইস্ট’। সেখানে তিনি বলেছিলেন, ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মদত ছাড়া পাকিস্তানে ক্ষমতার শীর্ষে থাকা সম্ভব নয়।’ তবে এখন অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়েছে। কাছাকাছি কোনো সামরিক ঘাঁটি ছাড়া কাবুলের ওপর ক্ষমতা চালানো সম্ভব নয়। এরকম সেনা ঘাঁটির জন্য সিআইএর প্রথম পছন্দ পাকিস্তান। এমন কি যুক্তরাষ্ট্র যদি মধ্যপ্রাচ্যের কোনো ঘাঁটিও ব্যবহার করে সেগুলোকেও পাকিস্তানের আকাশপথ ব্যবহার করতে হবে। এই জরুরি প্রয়োজনে সিআইএ ডাইরেক্টর উইলিয়াম বার্নসকে পাকিস্তানে পাঠায় বাইডেন প্রশাসন। ইমরানের খান এমন সাহসী যে, তিনি বার্নসকে সাক্ষাৎকার দিতেও অসম্মতি প্রকাশ করেছেন। পাকিস্তান সরকার তাদের মাটিতে সিআইএ কোনো ঘাঁটির অনুমোদন দেবে না।