সার্থক জীবনের শর্ত
সার্থক জীবনের শর্ত - ছবি সংগৃহীত
মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন মানব জাতির কল্যাণের জন্য যুগে যুগে আম্বিয়ায়ে কেরামের মাধ্যমে হিদায়াতের বাণী পাঠিয়েছেন। পৃথিবীতে মানুষের জীবন সার্থক ও সফল হওয়ার জন্য প্রকৃত নিয়ামক ও মৌলিক শর্ত কী, সে সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান দান করার জন্যই আল্লাহ পাক তার প্রিয় সৃষ্টির নিকট কিতাব নাজিল করেছেন।
দুনিয়াতে মানুষের জীবন যে একেবারেই অনিত্য, এ সত্য বিশ্বাস করার পরও মানুষ তার প্রকৃত গন্তব্য সম্পর্কে সচেতন হওয়ার পরিবর্তে হেলা-খেলায় আর অকারণে সময় ব্যয় করে চলে নির্দ্বিধায়। জীবনের মূল্যবান সময়কে যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে যে প্রভূত কল্যাণ হাসিলের সুযোগ তার ছিল, নিতান্ত উদাসীনতা আর লক্ষ্যহীনতার কারণে তা নস্যাৎ হয়ে যায়। অথচ ভুল্লাহ পাক মানুষকে বিবেক দিয়েছেন, বুদ্ধি দিয়েছেন, উপলব্ধির ক্ষমতা দিয়েছেন। জগতের অযুত সৃষ্টির মধ্যে আদম সন্তানকে তিনি সবার সেরা বলে ঘোষণা করেছেন। গোটা সৃষ্টি জগৎকে মানুষের অনুগত করে দেয়া হয়েছে। মানুষই পৃথিবীতে আল্লাহর খলিফা। এত উচ্চ মর্যাদার অধিকারী হলেও মানুষ আত্মবিস্মৃত হয়। নিজের কর্তব্যকর্ম ভুলে যায়। সৃষ্টির সেবার পাত্র হয়েও সংঘটিত করে নেহায়েত অমার্জিত কাজ। অশোভনীয় ও অনুচিত কাজও সে করে ফেলে।
মানুষকে সৃষ্টির সেরা করা হলেও তাকে বিপথে চালিত করার জন্য সর্বদা প্রস্তুত রয়েছে অভিশপ্ত শয়তান। আদি মানব হজরত আদম আ:-কে সেজদা না করার কারণেই তার ওপর অভিশাপ নেমে আসে। তাই তার প্রতিজ্ঞা বনি আদমকে বিপথগামী করার কোনো সুযোগই সে হাতছাড়া করবে না। আল্লাহ দুনিয়াতে মানুষকে পাঠিয়েছেন একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য সামনে রেখে। মানুষ শুধু আল্লাহরই ইবাদত করবে, অন্য কারো নয়- এটাই মানুষ সৃষ্টির লক্ষ্য। সুতরাং মানব জীবনে সাফল্যের একমাত্র প্রমাণ হলো, আল্লাহর ইবাদতে নিয়োজিত থাকতে পারা। কুরআন মজিদে আল্লাহ পাক বলেন, ‘নিশ্চয় যারা ঈমান আনে ও সৎকাজ করে তারাই সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ’। (সূরা বাইয়িনা- ৭)
অর্থাৎ মর্যাদার প্রকৃত অধিকারী হতে হলে ঈমানদার হওয়া জরুরি। মানুষের প্রথম ও প্রধান কর্তব্য মহান স্রষ্টার প্রতি ঈমান আনা। অন্য সব কাজ মূল্যায়িত হওয়ার জন্য পূর্বশর্ত ঈমান থাকা। আল্লাহর প্রতি যার বিশ্বাস নেই, সে শত সৎকাজ করলেও সেজন্য কোনো প্রতিদান সে পাবে না। তবে শুধু বিশ্বাসের নাম ঈমান নয়। হজরত নবী করিম সা: সম্পর্কে ইহুদি ও নাসারা জাতি অনেক আগে থেকেই জানত। তাওরাত ও ইঞ্জিলে শেষ নবীর সব ধরনের বর্ণনা দেয়া হয়েছে। তাই মহানবীর আবির্ভাবের পরে তাদের বিন্দুমাত্র সন্দেহ ছিল না যে, ইনিই শেষ নবী। এ প্রসঙ্গে কুরআন মজিদে বলা হয়েছে, তারা তাঁকে (শেষ নবী) এমনভাবে চিনতে পারে যেমন চেনে তাদের পুত্রদের। (সূরা বাকারা -১৪৬)
নিজের পুত্র কন্যা চিনতে যেমন কারো কোনো প্রকার সন্দেহের লেশমাত্র থাকে না, তেমনি নবী করিম সা: সম্পর্কেও তারা নিশ্চিত ছিল। তা সত্ত্বেও তাদেরকে মুমিন বলা হয়নি। কেননা তাদের কাছে ছিল শুধু পরিচয়। নিশ্চিত পরিচয় যদিও বিশ্বাসের পক্ষে কাজ করে। কিন্তু এর সাথে আরো প্রয়োজন আনুগত্যের প্রতিজ্ঞা। ঈমান আনার অর্থ শুধু বিশ্বাস করা নয়, বরং আনুগত্য ও অনুসরণের প্রত্যয় ঘোষণা করার নামই ঈমান। আল্লাহ তায়ালাকে একমাত্র স্রষ্টা ও জগৎনিয়ন্তা জেনেও তার বিধান অনুসরণের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত না থাকলে মুমিন হওয়া যায় না। ঈমান না থাকলে সে জীবনের কোনো মূল্য নেই। আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের প্রতি ঈমান না এনে যা কিছুই করা হোক না কেন তা হবে বাতুলতা মাত্র। কুরআন মজিদে আল্লাহ তায়ালা বলেন,
‘যারা অসত্যের প্রতি ঈমান এনেছে এবং আল্লাহর সাথে কুফরি করেছে প্রকৃতপক্ষে তারাই হচ্ছে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত’। (সূরা আনকাবুত-৫২)
অন্য আয়াতে তিনি বলেন, তোমাদের মধ্য থেকে যে নিজের দ্বীন থেকে সরে যায় এবং কাফের অবস্থায় মারা যায়, এমন লোকদের আমল দুনিয়া ও আখেরাতে বরবাদ হয়ে যায়। (সূরা বাকারা-২১৭)
সুতরাং অসাড় কোনা বস্তু বা শক্তির প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে জীবন অতিবাহিত করার অর্থ হবে অহেতুক সময় কাটানো। এর যেমন কোনো প্রতিদান পাওয়া যাবে না, তেমনি জবাবদিহিতার সম্মুখীন হতে হবে কিয়ামতের দিনে। দুনিয়াতে আল্লাহর নিয়ামতরাজি ও বস্তুসামগ্রী উপভোগ করে যদি তার সাথে কুফরি করা হয়, তাহলে তা হবে বিদ্রোহের নামান্তর, যা অতিশয় গর্হিত ও অন্যায় কাজ। অকৃতজ্ঞতার জন্য শাস্তি প্রদানে কেউই দ্বিমত পোষণ করতে পারে না। প্রতিনিয়ত অপরিমেয় অনুগ্রহ ও দয়ায় ডুবে থেকে আদম সন্তানেরা আপন প্রভুর আদেশ-নিষেধের তোয়াক্কা না করে চলতে থাকলে আল্লাহ তার ওপর অসন্তুষ্ট হবেন- এটাই স্বাভাবিক। কিয়ামতের দিন আল্লাহ তায়ালা যখন বান্দাদের হিসেব নেবেন তখন তাদের এই প্রধান অন্যায়ের জন্য শাস্তি দেবেন।
আল্লাহর প্রিয়পাত্র হতে হলে তার হুকুম পালন করতে হবে। জীবনের সর্বস্তর ও ক্ষেত্রে তিনি মানুষকে যেভাবে চলতে বলেছেন এবং তার নবী যেভাবে জীবনযাপন করে দেখিয়ে গেছেন তা অনুসরণ করাই জীবনের সাফল্য লাভের উপায়।
আল্লাহ তায়ালা দুনিয়াতে বনি আদমকে পাঠিয়েছেন একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সামনে রেখে। এখানে কারো জীবন অনর্থক নয়। কোনোমতে আনন্দ উপভোগ করে জীবনকাল কাটিয়ে দিলেই সবকিছু শেষ হয়ে যাবে না। বরং তাকে এখানকার এ সময়কালের পূর্ণ হিসাব দিতে হবে। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত যে সময়টি তার অতিবাহিত হয়েছে, তাতে সে কী কাজ সম্পাদন করেছে, তার পুরো হিসাব অবশ্যই দিতে হবে। যে ব্যক্তি তাতে উতরে যেতে সক্ষম হবে, তার জন্য রয়েছে অকল্পনীয় সুখভোগের ব্যবস্থা।
মানুষের পার্থিব ক্ষণস্থায়ী জীবন সাঙ্গ হলে পরকালের অনন্ত জীবনে পাড়ি জমানোর সময় একমাত্র পাথেয় হবে ঈমান ও আমলে সালেহ বা নেককাজ। মানুষের প্রথম ও প্রধান কর্তব্য মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা। জগৎ স্রষ্টার প্রতি আনুগত্য ও আত্মসমর্পণের ঘোষণাই ঈমান। সাথে সাথে নবী রাসূল হিসেবে আল্লাহ তায়ালা যখন যাকে দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন, তখনকার জন্য মানুষকে সে নবীর অনুসরণ ও অনুগমনের শপথও করতে হবে। আল্লাহ তায়ালা বনি আদমকে সুপথের সন্ধান দেয়ার জন্য যুগে যুগে আম্বিয়ায়ে কেরামকে জগতের বুকে পাঠিয়েছেন। তারা ছিলেন জগৎবাসীর প্রকৃত হিতাকাক্সক্ষী। আদম সন্তানেরা আল্লাহ পাকের সরল সঠিক পথ ছেড়ে অন্যায় ও অসুন্দর পথে চলার কারণে তাদের যে দুর্ভোগের শিকার হতে হবে, আম্বিয়ায়ে কেরাম সে সম্পর্কে মানুষকে অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে সচেতন করেছেন।
আল্লাহর নবীর দাওয়াত কবুল করার মধ্যেই যে দুনিয়া ও আখেরাতের সাফল্য নিহিত রয়েছে, তা অনুধাবন করতে যারা ব্যর্থ হয়, তাদের মতো হতভাগা আর নেই। আল্লাহ পাক তার বান্দাদের প্রতি অতি দয়ালু বলেই তাদেরকে শয়তানের পথ থেকে ফিরিয়ে নিজের পথে আনার জন্য আম্বিয়ায়ে কেরামকে পাঠিয়ে দেন। মহানবী সা: হলেন সর্বশেষ নবী। অতএব তার অনুসরণেই রয়েছে মানবজাতির শাস্তি ও মুক্তির একমাত্র মানদণ্ড।
গোটা বিশ্বমানবতা যখন মুমূর্ষু অবস্থায় পৌঁছে গিয়েছিল, উপায়-উপকরণ ও সাজ-সরঞ্জামের প্রাচুর্য সত্ত্বেও পৃথিবী যখন ভয়াবহ ও গভীর সঙ্কটে নিপতিত ছিল, এমনই এক কঠিন সময়ে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হজরত মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সা:-কে ওহি ও রিসালাতসহ প্রেরণ করেন মরণোম্মুখ মানবজাতিকে নতুন জীবন দান করার জন্য এবং তাদেরকে অন্ধকার থেকে আলোকময় জীবনে ফিরিয়ে আনার জন্য। এ প্রসঙ্গে কুরআন মজিদে আল্লাহ তায়ালা বলেন,
‘এই গ্রন্থ আমি আপনার নিকট নাজিল করেছি এ জন্য যে, আপনি মানুষদেরকে তাদের প্রভুর নির্দেশে অন্ধকার থেকে উদ্ধার করে আলোতে তথা মহাপরাক্রমশালী প্রশংসিত আল্লাহর পথে নিয়ে আসবেন।’ (সূরা ইবরাহিম - ১)
মহানবী সা. এসে মানবজাতিকে এক অদ্বিতীয় আল্লাহর ইবাদতের জন্য আহ্বান জানালেন এবং তাদেরকে পার্থিব সব দেবদেবীর উপাসনা থেকে মুক্তি দেন। তিনি মানব জাতিকে তাদের প্রকৃত মর্যাদায় ভূষিত করেন এবং তারা নিজেরা নিজেদের প্রতি কুসংস্কার ও অসার ধ্যান-ধারণার যেসব অহেতুক বোঝা চাপিয়ে রেখেছিল, তিনি সেসব অপসারিত করেন। কুরআন মজিদে আল্লাহ তায়ালা তাঁর প্রিয় নবীজির কর্মসূচি সম্পর্কে বলেন,
‘তিনি তাদেরকে সৎ কাজের আদেশ দেন, অসৎ কাজে নিষেধ করেন, তাদের জন্য উত্তম বস্তুগুলো হালাল ঘোষণা করেন, অমার্জিত অপছন্দনীয় বস্তুগুলো হারাম সাব্যস্ত করেন এবং তাদের প্রতি যেসব বোঝা ও শৃঙ্খল ছিল তা তাদের থেকে অপসারিত করেন।’ (সূরা আরাফ ঃ ১৫৭)
বস্তুত মহানবী সা: দুনিয়াবাসীকে সন্ধান দিলেন সত্য ও সুন্দর পথের। এত দিন তারা আলোহীন অন্ধকার পথে এগিয়ে চলেছিল ধ্বংস ও সীমাহীন অশান্তির দিকে। তাদের গন্তব্য সম্পর্কে সুস্পষ্ট কোন ধারণা ছিল না। গড্ডলিকা প্রবাহে জাগতিক আপাত সুন্দর ও মোহনীয় পথ ধরে তারা অবচেতন মনে চলেছিল চিরস্থায়ী অশান্তির নিবাসের দিকে। আল্লাহর নবী সা: মানব জাতিকে হুঁশিয়ার করলেন। তাদের সম্মুখের সমূহ সমস্যা সম্পর্কে অবহিত করলেন এবং তাদেরকে আহ্বান জানালেন শাশ্বত কল্যাণ ও স্বাচ্ছন্দ্যের জীবনের প্রতি।
নবী রাসূল আগমনের ধারা সমাপ্ত হয়েছে। আল্লাহর শ্রেষ্ঠ হাবীব মুহাম্মাদ সা:-এর আগমনের মাধ্যমে দুনিয়াতে নবুওয়াত ও রিসালাতের পরিসমাপ্তি টানা হয়েছে। তিনি সাইয়েদুল মুরসালিন খাতেমুন্নাবিয়্যিন। তাঁর পরে আর কোনো নবী আগমন করবেন না। কিয়ামত পর্যন্ত তাঁরই অনুসরণের মধ্যে মানব জাতির মুক্তি ও কল্যাণ নিহিত রয়েছে। অন্য কোনো পথ-মত, আদর্শ কিংবা ভাবধারা অনুসরণ করে কোনোমতেই পরিত্রাণ লাভের সুযোগ নেই।