বাংলাদেশের প্রথম তিন বছর

খুশবন্তু সিং; অনুবাদ : আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু | Jun 30, 2021 02:17 pm
বাংলাদেশের প্রথম তিন বছর

বাংলাদেশের প্রথম তিন বছর - অন্য এক দিগন্ত

 

(গত সংখ্যার পর)

আরো পড়ুন : বাংলাদেশের প্রথম তিন বছর (প্রথম অংশ)

দেশে বিরাজমান অস্থিরতা নিয়ন্ত্রণের পথ খুঁজে বের করা শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে ক্রমেই সাধ্যাতীত হয়ে উঠেছে। গত বছর সংশোধিত বিশেষ ক্ষমতা আইন পুলিশ এবং প্রশাসনকে অধিকার দিয়েছে আইনগত শালীনতা বহির্ভূত এখতিয়ার প্রয়োগ করতে। গত জুন মাস থেকে গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে, শেখ মুজিবুর রহমান সংবিধান পরিবর্তন করে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারব্যবস্থা চালু করার পরিকল্পনা করছেন। ক্রিসমাসের দিনে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা তাকে সংবিধানের গণ্ডির বাইরে সেই ক্ষমতা গ্রহণের অজুহাত সৃষ্টি করে। বাংলাদেশে এর প্রতিক্রিয়া সুখকর ছিল না। জরুরি আইন জারি করা সম্পর্কে বিরোধী দলের প্রভাবশালী সংবাদপত্র ‘গণকণ্ঠ’ কোনো মন্তব্য করেনি বরং পত্রিকাটির সম্পাদকীয় ছিল রেশন নিয়ে সমস্যা ও পাট পরিবহনের ওপর। সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিক ইত্তেফাক আইনবিষয়ক একটি আন্তর্জাতিক সেমিনারের ওপর খবর ছাপে। এই পদক্ষেপের সমর্থকদের মধ্যে সবচেয়ে কট্টর ছিলেন বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন যুবলীগের নেতা শেখ ফজলুল হক মণি। তিনি লেখেন, ‘পৃথিবী যেমন সূর্যের আলো চায়, জনগণও তেমনি শেখ মুজিবুর রহমানের কল্যাণ কামনা করে।’ শেখ মণি ৩৫ বছর বয়সে দু’টি জাতীয় সংবাদপত্র ‘দ্য বাংলাদেশ টাইমস’ ও দৈনিক বাংলার বাণী’ নিয়ন্ত্রণ করতেন। জনগণের বেশির ভাগই তাদের পেছনে শেখ মুজিবুর রহমানের সমর্থকদের ‘চামচা’ অথবা ‘লাল্লু-পাঞ্জু’ বলে ডাকত। উপমহাদেশে উপাধি দু’টির বহুল ব্যবহার রয়েছে ক্ষমতাবানের পিছু পিছু ঘোরা সুযোগ সন্ধানী ও তোষামোদকারীদের বর্ণনা করতে।

ঢাকায় বিরাজমান পরিস্থিতি থেকে কারো পক্ষে বাংলাদেশের প্রকৃত অবস্থা উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। দেশের ৯০ শতাংশ মানুষ গ্রামে বাস করে এবং তারা কৃষির ওপর নির্ভরশীল। একদিন সকালে আমি একটি ট্যাক্সি ভাড়া করে ড্রাইভারকে বলি আমাকে কোনো গ্রামে নিয়ে যেতে। ‘রাজধানী থেকে গরুর গাড়িতে যেতে একদিন লাগে এমন দূরত্বের কোনো গ্রামে।’ শিগগিরই আমরা উন্মুক্ত প্রান্তরে চলে এলাম। দুই পাশের সমতল মাটি থেকে বিশ ফুট উঁচু একটি বাঁধের ওপর দিয়ে নির্মিত হয়েছে রাস্তা। রাস্তার দু’পাশের গ্রামগুলো কাঠের সেতু দ্বারা রাস্তার সাথে যুক্ত। কিছু কিছু গ্রাম ধানক্ষেতের সবুজ সমুদ্রের মাঝে দ্বীপের মতো ভেসে আছে। ‘বর্ষাকালে এসব জায়গা সাগরের মতো হয়ে যায়,’ ড্রাইভার দু’হাত প্রসারিত করে বলল। ‘গত বর্ষায় অনেক গ্রাম পানিতে ডুবে গিয়েছিল; লোকজন তখন রাস্তার ওপর বসবাস করেছে।’

আমরা আমেরিকানদের নির্মিত মিরপুর ব্রিজ অতিক্রম করি এবং একের পর এক ছোট ছোট শহর পেরিয়ে যাই- সর্বত্র মানুষের গাদাগাদি ভিড়, তাদের অধিকাংশই মনে হয় রাস্তার ওপরই থাকে। আমি যে আকারের গ্রাম খুঁজছিলাম, তেমন একটি গ্রাম পেয়ে ড্রাইভারকে গাড়ি থামাতে বলি। বাঁধ থেকে নেমে ছোট ছোট ঝিনুক (কোনো কোনো ঝিনুকে গোলাপি রঙয়ের মুক্তা থাকে) ছড়ানো কর্দমাক্ত রাস্তা ধরে হাঁটতে লাগলাম। কাছমোড়া লুঙ্গি পরনে এক তরুণ খালি হাতে কাদা খুঁড়ছে এবং যা পাচ্ছে তা দু’টি বাঁশের ঝুড়িতে রাখছে। ‘এই কাদার মধ্যে আপনি কী খুঁজছেন?’ আমি তাকে প্রশ্ন করি। সে অবাক হয়ে আমাকে দেখে। ‘আর কী খুঁজবে, টাকি মাছ। এটি ছোট আকারের একটি মাছ, কিন্তু খেতে সুস্বাদু।’ আমরা কথা বলতে থাকি।

মঙ্গল মিয়ার বয়স বিশ বছর। কয়েক মাস আগে সে বিয়ে করলেও মা-বাবা, ছয় ভাই এবং তাদের স্ত্রী ও সন্তানদের সাথেই থাকে। পরিবারে তারা ২০ জন এবং তাদের দশ একর জমি আছে; চান্দলিয়া গ্রামের যে কারো জমির পরিমাণের চেয়ে বেশি। গ্রামে ৩০টি পরিবার বসবাস করে, যাদের মধ্যে অর্ধেক মুসলিম, বাকি অর্ধেক হিন্দু, যারা পৃথকভাবে থাকে। প্রতি পরিবারে জমির পরিমাণ দুই একরের বেশি নয়। কিছু মুসলিম পরিবারের জমির পরিমাণ একটু বেশি, যেসব হিন্দু ভারতে চলে গেছে তাদের কাছ থেকে তারা জমি কিনে নিয়েছে। হিন্দুদের জমির পরিমাণ কম; অনেকের নিজের কোনো জমি নেই, তারা কৃষি শ্রমিক হিসেবে কাজ করে। মঙ্গল মিয়া আমাকে বলে যে, যখন তারা জমিতে নতুন ধান রোপণ করে, সঠিক মাত্রায় সার প্রয়োগ করে, তখন তারা প্রতি একরে ২৫-২৬ মণ ধান পায়। ‘এমনকি বছরে তিনটি ফসল ফলিয়েও আমরা কোনোমতে পেট ভরে খাওয়ার ব্যবস্থা করতে পারি না।’

পরিবারটি বাড়তি আয় করে গবাদিপশু লালন, বাড়ির চার পাশে মিষ্টি আলুর চাষ, মজুরির বিনিময়ে অন্যদের কাজ করে অথবা শহরে গিয়ে যেকোনো ধরনের কাজ করার মাধ্যমে। তারা টিকে থাকার চেষ্টা করছে এবং চান্দুলিয়ার অন্য যে কারো চেয়ে মঙ্গল মিয়ার পরিবার বেশ ভালো আছে। মঙ্গল মিয়া আমাকে তার এক জ্ঞাতি ভাই মোহাম্মদ মোস্তফার দায়িত্বে ন্যস্ত করে, সে গ্রামের সবচেয়ে শিক্ষিত ছেলে। স্কুলে সে সপ্তম শ্রেণীতে পড়ে এবং অনর্গল ইংরেজি বলার সুনাম অর্জন করেছে। কিন্তু তার ইংরেজির সম্ভার থেকে ‘ইয়েস’ ও ‘নো’ এর অতিরিক্ত কোনো ইংরেজি শব্দ বের করতে ব্যর্থ হলাম। সে আমাকে বলল যে, এক মাইলের কম দূরত্বে অবস্থিত স্কুলটিতে তাদের গ্রামের মাত্র তিনটি ছেলে যায়। কোনো মেয়ে স্কুলে যায় না। অবশিষ্ট ১৫০টি ছেলেমেয়ে (তাদের মা অথবা বাবা কখনো তাদের পরিবার পরিকল্পনার কথা ভাবেননি) কোনো ধরনের স্কুলের শিক্ষা গ্রহণ করে না। ছেলেরা ফসলের ক্ষেতে তাদের বয়োজ্যেষ্ঠদের সহায়তা করে অথবা মাঠে গরু চড়ায়। মেয়েরা গোবর কুড়ায়, ধান ভানে অথবা রান্না করে। শিশুরা তাদের অধিকাংশ সময় কাটায় রাস্তায় যাতায়াতকারী গাড়ি ও বাসগুলো দেখে। চলতি শতাব্দী শেষ হওয়ার আগে চান্দলিয়া গ্রামে যেকোনো পরিবর্তন ঘটুক না কেন, মাত্র চারজন বয়স্ক লোক লিখতে ও পড়তে সক্ষম হবে।

চান্দলিয়া গ্রামটি মন খারাপ করে দেয়ার জন্য যথেষ্ট। এভাবে সম্পূর্ণ অনিশ্চিত একটি পরিবেশে এভাবে মানুষের জীবনের দায়িত্বহীন অপচয়ের দৃষ্টান্ত আর কী হতে পারে। ঢাকায় ফেরার পথে আমরা উৎসবমুখর জনতার ভিড়ে আটকা পড়লাম। দিনটি ছিল রবিবার এবং গবাদিপশুর মেলা আয়োজিত হয়েছে। গরু-মহিষ এনে জড়ো করা হয়েছে। চরম অভাবের এই দিনগুলোতে কার গরু কেনার সাধ্য আছে এবং কী কারণে? বিশালাকৃতির একটি ষাঁড় সামনে আনা হলো। দ্রুত দর হাঁকা হচ্ছে। পাঁচ মিনিট পরই ষাঁড়টি বিক্রি হয়ে গেল সর্বোচ্চ হাঁকা ১৪,০০০ টাকায় (ওই সময়ের ১,৮৭০ ডলার)। যিনি এই দাম হেঁকেছেন, তিনি নিঃসন্দেহে স্থির করে থাকবেন যে, দাম যাই হোক না কেন, এটি তাকে কিনতেই হবে। ষাঁড়টি সংগ্রহ করার সাথ সাথে তিনি বেচারি পশুটির ওপর লাল রঙের বিরাট একটি চাদর ছড়িয়ে বিজয়ীর মতো জনতার ভিড় ঠেলে বের হয়ে গেলেন। ইব্রাহিমের ছেলে ইসমাইলের স্মরণে ‘বকরি-ঈদ’ এ কোরবানি দেয়ার জন্য ষাঁড়টি কেনা হয়েছে। এই ক্ষুধার্ত ভূখণ্ডেও এমন মানুষ আছে, যারা কোনো ভোজ উৎসবে একটি আস্ত ষাঁড় সাবাড় করার সাধ্য রাখে।

হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে ফিরে এলাম, যেখানে এক বোতল কোমল পানীয়ের মূল্য এক পেগ স্কচ হুইস্কির মূল্যের সমান। আমার রুমে কয়েকজন বাংলাদেশী ঔপন্যাসিক ও কবি বন্ধু জড়ো হয়েছেন। দুই বছর আগে তারা তাদের স্বাধীনতার যুদ্ধকালে রচিত যুদ্ধের আহ্বান ও বীরত্বের কবিতা আবৃত্তি করেছেন। এবার তাদের কবিতার বিষয়বস্তু ভিন্ন। একজন বাংলাদেশের নেতৃস্থানীয় কবি শামসুর রাহমানের একটি কবিতার ইংরেজি অনুবাদ আবৃত্তি করলেন :

'Two pieces of stale bread to eat in solitude,
of the cupping hands in search of water
to quench a terrible thirst; these I had not asked for from the quiet gold patterns of each afternoon. When I walk down the daily road of life I do not ask for the knocked up taste of stale bread nor to search for water to quench my thirst. Even now, when I lie on grass where the timid rabbit runs.
When I see the dusky squirrel wrapped in the shadows and the moon writes a vivid lyric in the winding waters of a dark lake
I watch the scene with calm eyes.
The chorus of crickets stills the departed night.'

 

রুপালি স্নান শুধু দু’টুকরা শুকনো রুটির নিরিবিলি ভোজ অথবা প্রখর ধূ-ধূ পিপাসার আঁজলা ভরানো পানীয়ের খোঁজ শান্ত সোনালি আল্পনাময় অপরাহ্নের কাছে এসে রোজ চাইনি তো আমি, দৈনন্দিন পৃথিবীর পথে চাইনি শুধুই শুকনো রুটির টক স্বাদ আর তৃষ্ণার জল। এখনো যে শুধু ভীরু খরগোশ-ব্যবহৃত ঘাসে বিকেল বেলার কাঠবিড়ালিকে দেখি, ছায়া নিয়ে শরীরে ছুঁয়ে- সন্ধ্যা নদীর আঁকাবাঁকা জলে মেঠো চাঁদ লিখে রেখে যায় কোন গভীর পাঁচালি দেখি চোখ ভরে, ঝিঁ ঝিঁ’র কোরাসে স্তব্ধ, বিগত রাত মনে করে।

আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল দুর্নীতি, মজুদদারি এবং চোরাকারবার। আহমেদ মনসুর রচিত আরেকটি কবিতা আবৃত্তি করা হলো :

'I am hungry their fat flesh brings lust for blood in me ------ I shall murder them I am not a wounded child I will not be she like a dry leaf. The emptiness in my mother’s heart makes me mad with rage.'

(আমি ক্ষুধার্ত তাদের মোটাতাজা মাংস আমার মাঝে আনে রক্তের বাসনা। আমি ওদের খুন করব, আমি আহত শিশু নই আমি শুকনো পাতার মতো ঝরে পড়বো না। আমার মায়ের হৃদয়ের শূন্যতা ক্রোধে আমি উন্মত্ত হয়ে যাই।)

আমরা মধ্যরাত পর্যন্ত পান করলাম এবং দেশের দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনায় কাটালাম। পাশাপাশি কবিতা আবৃত্তিও চলছিল।

প্রধানমন্ত্রীর সাথে আমার সাক্ষাতের নির্ধারিত সময় বেলা ১১টা। হোটেল লাউঞ্জে আমি আমার সঙ্গীর জন্য অপেক্ষা করছিলাম। একদল আমেরিকান বাইরে গিয়ে বাইরের গেটে বহু সংখ্যক ভিক্ষুকের সমাবেশ দেখে হোটেলে ফিরে আসে। টেলিফটো লেন্সযুক্ত ক্যামেরা হাতে তিনজন জাপানিকে একটু দৃঢ় মনে হলো। তারা নগ্ন মাংসের প্রাচীর ডিঙিয়ে সাহসিকতার সাথে রাস্তা ধরে এগিয়ে গেল টোকাই ছেলেগুলোকে সরিয়ে দিয়ে, যারা তাদের কাপড় ধরে টানাটানি করছিল।

কয়েক মিনিট পর পররাষ্ট্র দফতরের অফিসার মোহসীন আলী খান এসে পৌঁছলেন এবং আমরা প্রধানমন্ত্রীর অফিসের উদ্দেশে রওনা হলাম। পুলিশের একজন সদস্য গেট দিয়ে আমাদের গাড়ি বের হওয়ার জন্য পথ করে দিলেন। ট্রাফিক সিগন্যালে যখনই আমাদের গাড়ি থেমেছে, ভিখারিরা গাড়ি ঘিরে ধরেছে। আমাদের মুখের সামনে এগিয়ে দেয়া কুষ্ঠরোগীর আঙুলবিহীন হাতসহ কয়েক ডজন হাত দূরে রাখতে গাড়ির জানালার কাঁচ তুলে দিতে হলো। এই বাজে পরিস্থিতির কারণে খান ক্ষমা প্রার্থনা করে ব্যাখ্যা করলেন যে, দুই মাস আগে দেশে যে দুর্ভিক্ষ শুরু হয়েছিল তখন হাজার হাজার ক্ষুধার্ত কৃষক গ্রাম থেকে ঢাকায় চলে এসেছে। তাদের বেশির ভাগই নিজ নিজ গ্রামে ফিরে গেছে, কিন্তু অনেকে রয়ে গেছে এবং ভিক্ষাবৃত্তি বেছে নিয়েছে। তাকে আশ্বস্ত করতে আমি বললাম, ‘আমাদের ওখানে দুর্ভিক্ষ না থাকলেও বোম্বে এবং কলকাতায় এ ধরনের বহু লোক আছে।”

রিকশা (ঢাকায় ৪৫,০০০ এর বেশি রিকশা আছে) ও বেবি ট্যাক্সির ভিড়ে রাস্তায় জট বেঁধে গেছে। ট্রাফিক পুলিশ সোজা রাস্তা থেকে আমাদের গতি ঘুরিয়ে দিলো। কারণ তিন দিন পর অনুষ্ঠিতব্য স্বাধীনতা দিবসের কুচকাওয়াজের জন্য সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীর জওয়ানরা মহড়া দিচ্ছে। নির্ধারিত সময়ের ১০ মিনিট পর আমরা পৌঁছলাম।

ধূসর রঙয়ের কার্পেট ও পর্দা এবং বাদামি রঙয়ের ভারি ফার্নিচারসহ সুপরিসর রুম। কাচে ঢাকা বিশাল এক টেবিলের পেছনে যে চেয়ারে প্রধানমন্ত্রী বসেন সেটির পেছনের অংশ উঁচু এবং চেয়ারটি সামনে-পেছনে দোলানোর ব্যবস্থা আছে। চেয়ারের পাশে তার কনুইয়ের উচ্চতায় আরেকটি টেবিলে বিভিন্ন রঙের ছয়টি টেলিফোন সেট। আমি রুমে প্রবেশ করতেই তিনি তার চেয়ার থেকে ওঠে দাঁড়ালেন এবং আমাকে স্বাগত জানাতে এগিয়ে এলেন। আমি তার দিকে আমার ডান হাত বাড়িয়ে দিয়ে শুভেচ্ছা জানালাম, ‘আস্সালামু আলাইকুম।’ আমার প্রসারিত হাত অগ্রাহ্য করে তিনি আমাকে আলিঙ্গনে আবদ্ধ করে উত্তর দিলেন, ‘ওয়ালাইকুম আস্সালাম। বাংলাদেশে আপনাকে স্বাগতম।’

অনন্য প্রতিভার অধিকারী শেখ মুজিবুর রহমান অত্যন্ত আন্তরিক হৃদয়ের মানুষ। দুই বছর আগে তার সাথে আমার সাক্ষাতের পর তার ওজন কিছুটা বেড়েছে বলে মনে হলো। তার গোঁফ ও চুল আরো বেশি পেকেছে। পরনে ধবধবে সাদা দীর্ঘ পাঞ্জাবি ও ঢিলেঢালা পাজামা। ঢাকার মৃদু শীতে তিনি একটি কালো রঙের পশমি ওয়েস্ট কোট (মুজিব কোট) পরেছেন। তিনি তার রকিং চেয়ারে বসলেন এবং আলতোভাবে সামনে পেছনে দুলতে দুলতে আবারো বললেন, ‘বাংলাদেশে আপনাকে স্বাগতম এবং প্রশ্ন করলেন, ‘বলুন, আপনার জন্য আমি কী করতে পারি?’

আমি আমার আগের অভ্যাস মতো তাকে সম্বোধন করলাম, ‘বঙ্গবন্ধু, আমি আপনার কাছে আপনার তিন বছরের শাসনামলের একটি ব্যালেন্স-শিট চাই; জমা এবং খরচ; আপনার সাফল্য ও ব্যর্থতা। তা ছাড়া এখন আপনি যে সমস্যাগুলোর বিরুদ্ধে লড়ছেন সেগুলো।’ একটু দ্বিধান্বিত মনে হলো তাকে। আমি তাকে সূত্র ধরিয়ে দিলাম, ‘শেষ বার যখন আপনার সাথে সাক্ষাৎ করি তখন আপনি আমাকে যোগাযোগব্যবস্থা পুনরায় চালু করা এবং পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক ধ্বংস করে দেয়া ব্রিজগুলো পুনর্নির্মাণের কথা বলেছিলেন।’

‘ওহ, হ্যাঁ। বাইরের লোকজন উপলব্ধি করতে পারে না যে, আমি একটি কানাকড়ি নিয়েও শুরু করিনি, বরং ঠাণ্ডায় জমাটবদ্ধ হয়ে যাওয়া একটি অবস্থা থেকে শুরু করেছি। তখন আমার কোনো প্রশাসন ছিল না; যা এখন আমার আছে। আমি দেশকে একটি সংবিধান দিয়েছি, একটি সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আমার একটি পরিকল্পনা কমিশন আছে এবং আমার সম্পদ ও আমাদের প্রয়োজন নিয়ে আমি একটি অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছি।”

“আপনি অত্যন্ত সংকটকালের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করছেন। আমার বিশ্বাস, আপনি কোনোভাবে একটি ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ সবেমাত্র কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছেন।’
‘জি, হ্যাঁ,’ তিনি স্বীকার করেন। ‘বন্যা আমাদের হতচকিত করে ফেলেছিল। আমার দুই কোটি মানুষ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আমি ৫,৭০০ লঙ্গরখানা স্থাপন করে ৪৪ লাখ লোককে বিনামূল্যে খাবার সরবরাহ করেছি। অনেক জায়গায় আমাকে আকাশ থেকে খাবার ফেলতে হয়েছে। ২৭,০০০ লোক মারা গেছে। বাইরের দেশ থেকে আমি খুব কম সাহায্য পেয়েছি। আমার সামান্য সম্পদ নিয়ে দুর্ভিক্ষের সাথে লড়েছি।’

পাশ্চাত্যের অর্থনীতিবিদ ও সাংবাদিকরা বলছেন যে, আপনি হয়তো বড় ধরনের সঙ্কটের মধ্যে পড়েছেন। আপনার শীতকালীন ফসল হয়তো আপনার জনগণের চাহিদা, খাদ্যের চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম হবে না। তারা আরো বলছেন, আগামী ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যেই লাখ লাখ লোক খাদ্যাভাবে মারা যেতে পারে। তারা আশঙ্কা করছেন বাংলাদেশ থেকে দলে দলে মানুষ ভারতে ঢুকে পড়বে। আমি তাকে ব্রিটেনের ‘দ্য নিউ স্টেটসম্যান’ এ প্রকাশিত জনাথন ডিম্বলবি (২৭ সেপ্টেম্বর, ১৯৭৪), ‘ইমপ্রিন্ট’ এ প্রকাশিত আরনল্ড আর আইজাকস (ডিসেম্বর ১৯৭৪) এবং ‘আটলান্টিক মান্থলি’তে প্রকাশিত ক্লেয়ার স্টার্লিং (ডিসেম্বর ১৯৭৪) এর নিবন্ধগুলোর ক্লিপিংস প্রদর্শন করি।

প্রধানমন্ত্রীর রাগত কণ্ঠে বলেন, ‘পাশ্চাত্যের সব পত্র-পত্রিকা আমার প্রশাসনের সমালোচনা করতে এবং আমাকে তাদের বাণী শোনাতে এসব করে। ১৯৭১ সালেও তারা এটাই করেছে; এখনো তারা তাই করছে। এসব করার পেছনে তাদের উদ্দেশ্য রয়েছে- আপনি ওদেরকে জানেন, আমিও ওদেরকে জানি। হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে আপনি এসব বস্তাপচা জিনিস শুনতে পাবেন। আপনি আমার নিকট থেকে এ বক্তব্য নিতে পারেন যে, কোনো দুর্ভিক্ষ হবে না; কারণ এখন থেকে আমি এ ব্যাপারে কিছু উদ্যোগ নিতে শুরু করেছি। আমি বাধ্যতামূলক খাদ্য সংগ্রহ অভিযান শুরু করেছি; যেখান থেকে পারি সেখান থেকেই খাদ্য ক্রয় করছি। ন্যায্য মূল্যের দোকানের মাধ্যমে আমি খাদ্য বিতরণের ব্যবস্থা গ্রহণ করব।’

‘আপনার প্রশাসন কি এ ধরনের বিশাল একটি সমস্যা মোকাবেলা করতে সক্ষম হবে? পাশ্চাত্যের পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, এই সমস্যার চাপে প্রশাসন ভেঙে পড়তে পারে।’
তিনি চাপড়ে বলেন, ‘ওদের জাহান্নামে যেতে বলুন। আপনি দেখবেন যে আমার প্রশাসন কিছুতেই ভেঙে পড়বে না; বরং তাদের মনে যে কুটিলতা রয়েছে তা ধ্বংস হবে।’ তিনি আবার বলেন, ‘তাদের মনে অসদুদ্দেশ্য রয়েছে। অতীতে তারা ব্যর্থ হয়েছে, এবার তারা ব্যর্থ হবে। শুধু অপেক্ষা করুন এবং দেখুন কী হয়!’

আমি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির দিকে ফিরি। তিনি স্বীকার করেন দেশে সহিংসতা রয়েছে, কিন্তু তা যেভাবে বলা হচ্ছে তেমন নয়। ‘আপনি রাতের বেলায় ঢাকায় ঘোরাফেরা করুন। আপনি শহরকে নিরাপদ দেখতে পাবেন,’ তিনি বলেন।

তার কাছে বাংলাদেশের সাথে অন্যান্য দেশের সম্পর্কের কথা জানতে চাই। শুধু পাকিস্তান ছাড়া অন্যান্য দেশের সাথে সম্পর্কের ব্যাপারে তিনি সন্তোষ প্রকাশ করেন। ‘আমি আমার সাধ্যমতো চেষ্টা করেছি তাদের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে। আমি সব যুদ্ধবন্দীকে ছেড়ে দিয়েছি। আমি আশা করি যে, পাকিস্তান আমার সম্পদের ভাগ আমাকে দেবে এবং যারা পাকিস্তানে যাওয়ার জন্য ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন তাদের ফিরিয়ে নেবে। কিন্তু পাকিস্তান সরকার এ ব্যাপারে কোনোকিছুই করেনি। তারা আমাকে আমার স্বর্ণ অথবা বৈদেশিক মুদ্রার ভাগ দেয়নি; এমনকি জাহাজ পর্যন্ত দেয়নি, অথবা অন্য কোনোকিছু দেয়নি। অথচ আমরাই ছিলাম দেশের বৃহৎ অংশ।’


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us