ও নদীরে...

মীর সালমান শামিল | Jun 30, 2021 08:19 am
স্প্রি নদী

স্প্রি নদী - ছবি : সংগৃহীত

 

নদীর পানি, কতদূরে যাওরে তুমি বইয়া

নাই ঠিকানা নাইরে বাড়ি, কত নগর যাওরে ছাড়ি
ও কূলেতে বইয়া...

শিল্পীর খুবই দরদ দিয়ে করা প্রশ্নটা গুরুত্বপূর্ণ। নদী, তুমি কত দূরে বয়ে যাও? তবে আশার কথা হলো উত্তরটা আমরা জানি।

ক্যানেল সাদৃস্য যে জলাশয়ের ছবিটা দেখছেন এর নাম স্প্রি নদী। জার্মানির রাজধানী বার্লিন এই নদীর তীরে অবস্থিত। স্প্রি চেক প্রজাতন্ত্র এবং জার্মানির সীমান্তবর্তী লুজাটিয়ান উচ্চভূমিতে উৎপন্ন হয়ে উত্তরের দিকে এগিয়ে স্পানডুতে গিয়ে হাভেল নদীর সাথে মিশেছে। এই নদীর দৈর্ঘ্য মাত্র ৪০০ কিলোমিটার। জার্মান মুলুকের সবচেয়ে বড় নদী রাইন৷ স্প্রির চেয়ে রাইন দৈর্ঘে তিনগুণ বড়, ১২৩০ কিলোমিটার আর প্রস্তেও বেশি। সুইজারল্যান্ডে উৎপত্তি হয়ে রাইন লিনচেস্টাইন, অস্ট্রিয়া, জার্মানি, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ড হয়ে উত্তর সাগরে গিয়ে মিশেছে৷

ইউরোপের সবচেয়ে বড় নদী ভলগার কাছে আবার রাইন কিছুই না। রাশিয়ার মধ্যাঞ্চলের ভ্যালদাই পাহাড় থেকে উৎপন্ন হয়ে ক্যাস্পিয়ান সাগরে গিয়ে মেশা ভলগার দৈঘ্য ৩,৬৯০ কিলোমিটার। তবে দৈর্ঘ দ্বিতীয় হলেও গুরুত্বে ইউরোপের এক নম্বর নদী সম্ভবত দানিয়ুব। জার্মানির কালো বন বা ব্ল্যাক ফরেস্টে উৎপন্ন হয়ে ১০টি দেশ এবং ভিয়েনা, বুদাপেস্ট, বেলগ্রেডসহ ২৩ টি গুরুত্বপূর্ণ শহরের বুক চিরে দানিয়ুব কৃষ্ণ সাগরে গিয়ে মিশেছে। দানিয়ুবের দৈর্ঘ্য ২৮৫০ কিলোমিটার।

বড় নদী আমার মধ্যে বিস্ময় এবং মুগ্ধতা তৈরি করে, তাকিয়ে থাকি আর ছোট নদীর প্রতি একটা অব্যক্ত ভালোবাসা অনুভব করি। আমার প্রিয় নদী ইছামতি। গ্রামের বাড়ি থেকে কয়েক কিলোমিটারে দূরে। পরিস্কার পানি, শান্ত স্রোত আর পাড়ের বাতাস একটা মোহময় পরিবেশ তৈরি করে। কিন্ত এখন... এছাড়া বড়াল ও যমুনাও আমার প্রিয়।

বাংলাদেশ বয়ে চলা দীর্ঘতম নদী হলো ব্রহ্মপুত্র। তিব্বতের মানস সরোবরে উৎপত্তি হয়ে তিব্বত, চীন, ভারত, বাংলাদেশ হয়ে বঙ্গোপসাগরে পতিত হওয়া ব্রহ্মপুত্র নদীর দৈর্ঘ ৩৯৬৫ কি.মি. (বিশ্বের ১৫তম)।

ব্রহ্মপুত্র নদীর নাম করনের ইতিহাসটা দারুণ। মহর্ষি শান্তনুর স্ত্রী ছিলেন আমাঘাটা । দুধে স্নান করে তিনি গর্ভবতী হন। আমাঘাটা সন্তান প্রসব করতে গিয়ে তিনি একগাদা পানি প্রসব করলেন। মহর্ষি শান্তনু ওই পানিকেই পুত্র হিসাবে গ্রহণ করলেন। পুত্রের নাম দিলেন ব্রহ্মপুত্র। আমাদের ব্রহ্মপুত্র নদী।

চীনের দুঃখ বলা হয় হোয়াং হো নদীকে আর বাংলাদেশের দুঃখ ফারাক্কা বাঁধ। হোয়াংহো শব্দের অর্থ হলুদ। ইতিহাসে এই হলুদ নদী অতি প্রচণ্ডভাবে ২৬বার নিজের গতিপথ বদলেছে। আর আছে বন্যা। এর ফলে চীনের জনগণ ভোগ করেছে অবর্ণনীয় দুঃখ-দুর্দশা। আর এই কারণেই হোয়াংহো নদীকে চীনের দুঃখ বলা হয়।

নয়া চীনে সরকারি উদ্যোগে হোয়াংহো নদীর উজানের দিকে ও মধ্য এলাকা বরাবর কতগুলো জল সংরক্ষণ প্রকল্প নির্মাণ করায় এবং ভাটির দিকে নদীর পাড়ের বেড়িগুলোকে আরো মজবুত করায় বিশ শতকে এসে নদীর তীরবর্তী জনসাধারণের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত হয়েছে। তাই হোয়াংহো আর দুঃখের কারণ না বরং সমৃদ্ধির নিয়ামক। তবে আমরা বাংলাদেশীরা ফারাক্কা বাঁধের ব্যাপারে এখনো কিছু করতে পারিনি।

চীনের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে প্রবাহিত হওয়া হোয়াংহো এশিয়ার দ্বিতীয় এবং বিশ্বের ষষ্ঠ বৃহত্তম, দৈর্ঘ ৫৪৬৪ কিলোমিটার। এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তমের পাশাপাশি বৃহত্তম নদীও পুরোটাই চীনে অবস্থিত। ইয়াংজি নদীর দৈর্ঘ্য ৬,৩০০ কি.মি.। বৃহত্তম মহাদেশের বৃহত্তম নদী হলেও সারা দুনিয়ার তালিকায় ইয়াংজির অবস্থান ৩-এ।

বিশ্বের দীর্ঘতম নদী হলো নীল নদ; দৈঘ্য ৬৬০০ কি.মি.। নীল রুয়ান্ডাতে উৎপন্ন হয়ে আফ্রিকার ১১টি দেশের হৃদয় ছুয়ে মিসরে এসে ভুমধ্যসাগরে পতিত হয়েছে। ইউসুফ আ., মুসা আ., ওমর রা., রাজা আমেন হাতেম, ফেরাউন... ইতিহাসের কত রথি-মহারথিদের স্মৃতি বুকে নিয়ে ছুটে চলছে নীল।

দ্বিতীয় বৃহত্তম নদী হলো মহাবন আমাজানের মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া আমাজান নদী। আমাজান পেরুতে উৎপন্ন হয়ে বলিভিয়া, ইকোয়েডোর, গায়ানা, ভেনেজুয়েলা, কলম্বিয়া ও ব্রাজিলের উপর দিয়ে বয়ে গিয়ে দক্ষিণ আটলান্টিক সাগরে পতিত হয়েছে। আমাজানের দৈর্ঘ ৬৫৭৫ কি.মি.। তবে ব্রাজিল সরকার দাবি করে আমাজান বিশ্বের দীর্ঘতম নদী।

চতুর্থ বড় নদী হলো উত্তর আমেরিকার বৃহত্তম বড় নদী, মিসিসিপি-মিজুরি। মিসিসিপির উৎপত্তি হলো ইটাস্কা লেকে আর মিজুরি নদীর উৎস হলো মন্টানার পাথুরে পর্বতমালা। দুই নদী মিলিত হয়ে মিশেছে মেক্সিকো উপসাগরে। আমেরিকার গৃহযুদ্ধের সময় খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল এই মিসিসিপি নদী।

দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া পৃথিবীর সব সভ্যতা, শহর গড়ে উঠেছে নদীকে কেন্দ্র করে। ব্যবসা-বাণিজ্য, যোগাযোগ, সমৃদ্ধি, ধ্বংস, সাহিত্য, যুদ্ধ, প্রেম- সবখানেই ক্ষেত্রেই নদী গুরুত্বপূর্ণ। পানি অপর নাম জীবন আর সেই জীবনের মূল উৎস নদী। অনেক প্রাজ্ঞজন বলেছেন, তৃতীয় মহাযুদ্ধ হতে পারে পানি বা নদীর জন্য। আমাদের পানির উৎস দিন দিন ফুরিয়ে যাচ্ছে তারপরেও পানি ব্যবহারে আমাদের সচেতনতার অভাব যথেষ্ট পরিলক্ষিত। মুহাম্মাদ সা. বলেছিলেন, যদি প্রবাহমান নদীর উপরেও থাকো, এরপরেও পানি অপচয় করো না। আমরা এখনো তার সা. কথার গুরুত্ব আমাদের দের কেজির মগজ দিয়ে বুঝিনি। বুঝতে পারব, যখন ঘরের পাশে বোমা পরবে...

এই হলো নদী নিয়ে কথকথা৷ নদী আমার অনেক প্রিয়। নদীর প্রতি ভালোবাসা আমার ডিঅক্সিরাইবো নিউক্লিয়িক এসিডের মধ্যেই আছে। আমার পূর্ব পুরুষদের জীবিকার বাহক ছিল এই নদী৷ আমার দাদা, তার দাদা, তার দাদা (৯ জন পর্যন্ত হিসাব আছে); সবারই ছিল মালবাহী কার্গো নৌকার ব্যবসা। বড় বড় নৌকায় করে মালামাল পাবনা থেকে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, চাঁদপুর, কোলকাতা যেত। সেই প্রমত্তা পদ্মা, মেঘনা, যমুনার বিশাল স্রোতের মধ্যদিয়ে জাহাজ সাদৃশ্য বিশাল বিশাল রঙিন পাল তোলা নৌকা যাচ্ছে, নানান গন্তব্য ভ্রমণ শেষে বংশের সবার নৌকা একসাথে ফিরছে... ছোট বেলা দাদির মুখে গল্প শুনে রোমাঞ্চিত হতাম। এখনো ভাবলেই রোমাঞ্চিত হয়ে যাই। যদি আল্লাহ আরো কয়েক পুরুষ আগে পাঠাতেন, মন্দ হতো না!

সম্ভবত এ কারণেই প্রাইমারি স্কুলে থাকতে আমার অন্যতম প্রিয় লাইন ছিল-
মা যদি হও রাজি
আমি বড় হয়ে হবো খেয়া ঘাটের মাঝি!


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us