কেমন হবে তালেবান শাসন?

আলোচনায় আফগান প্রতিনিধি দল - ছবি সংগৃহীত
পাশ্চাত্যের গণমাধ্যমগুলোর সাধারণ আশঙ্কা হলো, তালেবানের হাতে আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ চলে গেলে গত ২০ বছরের সব প্রচেষ্টা বিফলে যাবে এবং দেশটিতে কট্টর ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে। এই ধারণার পাশাপাশি দেশটিতে সঙ্ঘাত ও অস্থিরতা নতুন মাত্রা নেবে বলেও আশঙ্কা তাদের। এই আশঙ্কার কিছু ভিত্তিও রয়েছে।
প্রথমত তালেবান নিজেদের বেশ খানিকটা উদার সহনশীল ও অন্যদের সাথে যোগসূত্র রক্ষাকারী হিসেবে পরিবর্তিত করেছে। তবে তাদের লক্ষ্য বা আদর্শের মধ্যে খুব একটা পরিবর্তন আসেনি। তালেবান নেতারা এখনো বলছেন, তারা আফগানিস্তানে ইসলামী আমিরাত প্রতিষ্ঠা করবেন যার আদর্শগত ভিত্তি দেউবন্দি ধারার মতো। ফলে তালেবানরা ক্ষমতায় গেলে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক স্বার্থ সঙ্ঘাতের পরিস্থিতি যে মাত্রাতেই হোক থেকে যেতে পারে।
দ্বিতীয়ত সোভিয়েতবিরোধী লড়াইয়ে যেভাবে আফগান মুজাহিদরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের সহায়তা লাভ করেছিল একইভাবে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোবিরোধী লড়াইয়ে তালেবানরা রাশিয়া ও চীনের গোপন সহায়তা লাভ করেছে। স্বাভাবিকভাবে মার্কিন আধিপত্যহীন আফগানিস্তানে চীন রাশিয়ার প্রভাব বৃদ্ধি পাবে। আর তালেবানবিরোধী শক্তিকে গোপনে মদদ দিয়ে আবার অস্থির অবস্থা তৈরি করা সহজ হবে।
এসব আশঙ্কার বিপরীতে আশাবাদের জায়গাটি হলো, আফগানিস্তানের সবপক্ষই এখন শান্তি চাইছে। যুক্তরাষ্ট্র অথবা ভারত যদি সেখানে অস্থিরতায় মদদ দেয় তাহলে তাদের অর্থনৈতিক স্বার্থ বিপন্ন হতে পারে। ভারত গত ২০ বছরে সেখানকার অবকাঠামোতে বিপুল বিনিয়োগ করেছে। যেকোনো পক্ষ অস্থিরতায় মদদ দিলে তালেবানরা অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ শান্তি বিনষ্টকারী শক্তিকে মদদ না দেয়ার যে প্রতিশ্রুতিতে আবদ্ধ হয়েছে সেটি রক্ষিত নাও হতে পারে।
এছাড়া আরেকটি দিক হলো চীন-রাশিয়ার অর্থনৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থে যেমন আফগানিস্তানে শান্তি দরকার তেমনিভাবে কয়েকটি শক্তিশালী মুসলিম দেশ বিশেষত পাকিস্তান তুরস্ক ইরান সৌদি আরব আফগানিস্তানে শান্তি ও স্থিতি ফিরিয়ে আনতে আন্তরিকভাবে চাইছে বলে মনে হয়। ন্যাটো সৈন্য প্রত্যাহারের পর কাবুল বিমানবন্দরের নিরাপত্তা বিধানের দায়িত্ব তুরস্ককে গ্রহণের একটি বিষয় নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। ন্যাটোর অংশ হিসেবে তুরস্কের এই ভূমিকা তালেবানরা গ্রহণ করবে না বলে জানিয়েছে। তুরস্ক এই ভূমিকা অবশ্য শর্তসাপেক্ষে পালনের কথা জানিয়েছে যা ন্যাটোর অংশ হিসেবে না রেখে আফগানিস্তানের কূটনৈতিক অংশীদার দেশ হিসেবে রাখতে চাইতে পারে। তুরস্ক এ ব্যাপারে নতুন যে প্রস্তাব দিয়েছে সেটি হলো আফগানিস্তানে তারা বাড়তি কোনো সেনা পাঠাবে না। আর বিমানবন্দরের নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করবে পাকিস্তান হাঙ্গেরির সাথে যৌথভাবে। এ মাসের গোড়ার দিকে সৌদি আরব, আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের শীর্ষ আলেমদের সাথে এক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে মিলিত হয়েছিল। প্রথমে বিষয়টি গোপন রাখা হলেও পরে তা রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রকাশ করা হয়। ইরানের সাথে তালেবানের যোগাযোগও বেশ কয়েক বছর আগে থেকে চলে আসছে।
এখান থেকে একটি বিষয় মনে হয় যে, আফগানিস্তানে শান্তি প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তুরস্ক ও পাকিস্তানের পাশাপাশি সৌদি আরব ও ইরানের সংশ্লিষ্টতা থাকতে পারে। তালেবানের কেন্দ্রীয় শুরার মধ্যে শিয়া আলেমও রয়েছেন। আর আমেরিকান ও ন্যাটো সৈন্য প্রত্যাহারের ব্যাপারে কট্টর অবস্থানে তালেবানের প্রতি ইরানের সব সময় সমর্থন ছিল।
তালেবানের শাসন ব্যবস্থা রূপ নিয়ে জল্পনা
আফগানিস্তানের স্টেকহোল্ডাররা বিশেষত যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র আর শীর্ষ ওআইসি দেশগুলো দীর্ঘস্থায়ী শান্তি নিশ্চিত করার জন্য একটি গণতান্ত্রিক কাঠামো প্রতিষ্ঠা করতে চায় দেশটিতে। সেই কাঠামো পাশ্চাত্যের মুক্ত ভোটের গণতন্ত্রের মতো নাও হতে পারে। আমেরিকার প্রভাবে যে পদ্ধতি আফগানিস্তানে প্রবর্তন করা হয়েছিল সেটিও মুক্ত ধরনের গণতন্ত্র নয়। লয়া জিরগা নামে যে সংসদ তৈরি করা হয়েছে তা আফগানিস্তানের গোত্র ব্যবস্থারই প্রসারিত রূপ। আর নতুন সংবিধানের অধীনে অনুষ্ঠিত হওয়া প্রতিটা প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়েই কমবেশি বিতর্ক হয়েছে। সেই বিতর্কের অবসানের জন্য শেষ দুই মেয়াদে বিজিত প্রার্থীকে ক্ষমতার অংশীদারিত্ব দিতে হয়েছে।
তালেবানরা এ পর্যন্ত যেসব অঞ্চলে নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে সেখানে তারা এক ধরনের প্রশাসন প্রতিষ্ঠা করেছে। তালেবান প্রতিনিধিরা স্থানীয় অভিভাবক তথা গোত্রপতি, ধর্মীয় নেতা ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সমন্বয়ে শুরা প্রতিষ্ঠা করে প্রশাসন পরিচালনা করছে।
এই ধরনের একটি প্রশাসন ব্যবস্থা তারা কেন্দ্রীয়ভাবে চালু করতে চাইতে পারে। এর সাথে নির্বাচন ব্যবস্থার সমন্বয় করা গেলে ইরান ধরনের থিওলজিভিত্তিক একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা তৈরি হতে পারে আফগানিস্তানে।
আমেরিকান সেনামুক্ত আফগানিস্তান অথবা নতুন করে তালেবান শাসনে দেশটির রূপ কী নেবে তা নিয়ে পূর্বানুমান বেশ কঠিন। তবে এখন তালেবানের যে নেতৃত্ব রয়েছে তার সাথে প্রথম দিককার নেতৃত্বের কিছু ব্যবধান রয়েছে। তালেবান আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা মোল্লা ওমরের প্রভাব ও কর্তৃত্ব ছিল অনেকটা একক। তিনি এখন আর জীবিত নেই। মোল্লা আখুনজাদা এখন তালেবান প্রধান। তিনি পরামর্শ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেন। আর তালেবানের যেসব নেতা এখন পক্ষগুলোর সাথে আলোচনা ও সমঝোতার বিষয়ে জড়িত তাদের প্রায় সবাই ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি ইউরোপ আমেরিকার উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করেছেন। ফলে তালেবানের আগের দৃষ্টিভঙ্গির সাথে এখনকার নেতৃত্বের দৃষ্টিভঙ্গির একটি তাৎপর্যপূর্ণ ব্যবধান রয়েছে। তারা আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও ভূ-রাজনীতির বিষয় বেশ ভালো বোঝেন।
তালেবান নেতৃত্ব আদর্শ ছড়িয়ে দেয়ার পুরনো ডকট্রিন এখন সেভাবে লালন করছেন বলে মনে হয় না। এর চেয়ে তারা সংশ্লিষ্ট সবপক্ষ ও প্রতিবেশীদের সাথে বোঝাপড়ার মাধ্যমে দেশ ও জাতির পুনর্গঠনের প্রতি বেশি মনোযোগী হবেন বলে মনে হয়। এটিই বর্তমান আমেরিকান সেনা প্রত্যাহার উত্তর আফগানিস্তানের ভবিষ্যতের ব্যাপারে একটি গুরুত্বপূর্ণ ইতিবাচক দিক।
mrkmmb@gmail.com