এরদোগানের ইস্তাম্বুল খান ও বিশ্ব রাজনীতির খেলা
ইস্তাম্বুল খাল - ছবি সংগৃহীত
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়্যেব এরদোগান সে দেশের বৃহত্তম শহর ইস্তাম্বুলের ইউরোপীয় অংশকে দু'টুকরা করে একটি খাল খনন প্রকল্পের উদ্বোধন করেছেন যার লক্ষ্য হচ্ছে কৃষ্ণ সাগর এবং মারমার ও ভূমধ্যসাগরের মধ্যে সংযোগ তৈরি করা।
সুয়েজ বা পানামা খালের আদলে কৃত্রিমভাবে খনন করা এই ‘ক্যানাল ইস্তাম্বুল’ বা ইস্তাম্বুল খালের লক্ষ্য হচ্ছে বসফরাস প্রণালীর বিকল্প তৈরি করে ওই দুই সাগরের মধ্যে আরো বেশি সংখ্যক জাহাজ চলাচলের পথ সুগম করা।
কিন্তু তুরস্কের অনেক রাজনীতিবিদ, বিজ্ঞানী এবং পরিবেশবাদী এই খাল খনন প্রকল্পকে এরদোগান সরকারের একটি ‘পাগলামি’ বলে বর্ণনা করছেন।
তাদের মতে, এর মাধ্যমে ইস্তাম্বুল শহরের বিপদ বাড়বে, এবং ওই অঞ্চলের পরিবেশের অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যাবে।
কিন্তু এরদোগানের যুক্তি হচ্ছে - এই খাল তার দেশের উন্নয়নে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করবে।
শনিবার এই প্রকল্পের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তুর্কি প্রেসিডেন্ট বলেন, বসফরাস প্রণালী দিয়ে ১৯৩০-এর দশকে প্রতিবছর ৩ হাজার জাহাজ পারাপার হতো, আর এখন প্রতি বছর ৪৫ হাজার জাহাজ এই প্রণালী অতিক্রম করে।
এই শতকের মাঝামাঝি নাগাদ, অর্থাৎ ২০৫০ সালের দিকে এই সংখ্যা ৭৮ হাজার দাঁড়াবে বলে তিনি জানান।
এত বিপুল সংখ্যক জাহাজের চলাচল ইস্তাম্বুল শহরের জন্য চরম ঝুঁকি তৈরি করবে বলে এরদোগান তার বক্তব্যে উল্লেখ করেন।
এরদোগানের খালে যা থাকছে
ক্যানাল ইস্তাম্বুলের প্রকল্পের ওয়েবসাইটে দেয়া তথ্য অনুযায়ী, খালটি ওই শহরের ইউরোপীয় অংশের মধ্য দিয়ে খনন করা হবে। ৪৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এই খালের প্রস্থ হবে ২৭৫ মিটার। আর গভীরতা হবে ২০.৭৫ মিটার।
ইস্তাম্বুল শহরের যে অংশটি ইউরোপ মহাদেশের অংশ, সেখান দিয়ে খালটি কৃষ্ণ সাগর এবং মারমার ও ভূমধ্যসাগরের মধ্যে সংযোগ তৈরি করবে।
তুর্কি সরকারের বিভিন্ন সময়ে দেয়া হিসাব অনুযায়ী, পুরো প্রকল্পটিতে ব্যয় হবে দেড় থেকে আড়াই হাজার কোটি ডলার।
এই খালটির উদ্বোধন হওয়ার কথা রয়েছে ২০২৩ সালে। তুর্কি প্রজাতন্ত্র স্থাপনের শতবর্ষ পালিত হবে ওই বছরই।
তবে শুধু খাল খননই নয়, বরং কথা রয়েছে, এই প্রকল্পের আওতায় তৈরি হবে নতুন একটি আন্তর্জাতিক সমুদ্রবন্দর, কন্টেইনার টার্মিনাল, কিছু কৃত্রিম দ্বীপ এবং খালের দুই পাশ বরাবর বেশ কয়েকটি আধুনিক শহর।
এরদোগানের নেতৃত্বাধীন ‘একে পার্টি’ ক্ষমতায় বসার পর ২০১১ সালে এক জনসভায় তিনি এই খাল খনন করার ঘোষণা দেন।
সে সময় অনেকেই ‘একে রাজনীতির চমক এবং কিছুদিন পর লোকে এর কথা ভুলে যাবে’ বলে মনে করলেও একেপি সরকার ২০১১ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত এই খাল খননের সম্ভাব্যতা নিয়ে নানা রকম সমীক্ষা চালায়।
কিন্তু বসফরাসের বিকল্প একটি খাল খনন নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু হয়েছিল বেশ অনেক আগে - সেই ওসমান বংশীয় সুলতান সুলেমান দ্য ম্যাগনিফিসেন্টের আমলে।
তুর্কি পত্রিকা হুরিয়াতের খবর অনুযায়ী, তার আর্কিটেক্ট মিমার সিনান এই পরিকল্পনাটি তৈরি করলেও অজ্ঞাত কারণে তা বাতিল করা হয়।
সুলতান তৃতীয় মুরাদের আমলে ১৬৯১ সালের ৬ মার্চ এই খাল খননের জন্য একটি রাজকীয় ফরমান জারি করা হয়, কিন্তু সেটিও পরে বাদ হয়ে যায়।
এভাবে মোট সাতবার খাল খননের উদ্যোগ নেয়া হলেও তা কখনোই বাস্তবে পরিণত হয়নি বলে তুর্কী হুরিয়াত জানাচ্ছে।
বিশ্ব রাজনীতির খেলা
শহর হিসেবে ইস্তাম্বুলের ভূ-রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক গুরুত্ব এতটাই বেশি যে ফরাসী সম্রাট নেপোলিয়ন একবার বলেছিলেন, সারা বিশ্ব যদি একটিমাত্র ভূখণ্ড হতো তাহলে ইস্তাম্বুল বা তৎকালীন কনস্টানটিনোপলিস হতো তার রাজধানী।
এই গুরুত্বের অনেকখানি তৈরি হয়েছে বসফরাস এবং দার্দানেলেস - এই দুটি প্রণালীর জন্য।
কারণ কৃষ্ণ সাগরের তীরবর্তী সবগুলো দেশকে নৌপথে বাইরের বিশ্বের যোগাযোগ করতে হলে বসফরাস ও দার্দানেলেস ছাড়া তাদের কোনো গতি নেই। তুরস্ক ছাড়াও এই দেশগুলো হচ্ছে- রাশিয়া, ইউক্রেন, বুলগেরিয়া, রোমানিয়া এবং জর্জিয়া।
বসফরাস প্রণালী সামরিক এবং বাণিজ্যিক দিক থেকে বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্র পথগুলোর অন্যতম। এই প্রণালী কে, কীভাবে ব্যবহার করতে পারবে, তার জন্য রয়েছে একটি আন্তর্জাতিক চুক্তি, যাকে মন্ট্রো চুক্তি বলা হয়।
মন্ট্রো চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, শান্তির সময় যেকোনো বাণিজ্যিক জাহাজ অবাধে ওই দুটি প্রণালী ব্যবহার করতে পারবে।
যুদ্ধজাহাজের ব্যাপারে শর্তাবলীতে বলা হয়েছে- কৃষ্ণ সাগরের তীরবর্তী নয় এমন দেশের ৯টির বেশি যুদ্ধজাহাজ একসাথে এই প্রণালী দুটি পার হতে পারবে না, এবং এগুলো ২১ দিনের বেশি কৃষ্ণ সাগরে অবস্থানও করতে পারবে না।
এসব জাহাজ সম্মিলিতভাবে ১৫ হাজার টনের বেশি হবে না এবং কোনো একটি জাহাজ ১০ হাজার টনের চেয়ে বেশি হতে পারবে না বলে শর্তাবলীতে আরো উল্লেখ করা হয়।
কিন্তু কৃষ্ণ সাগরের দেশগুলোর রণতরী তুরস্ককে জানিয়ে প্রণালী দুটি ব্যবহার করতে পারবে।
এই চুক্তির মূল উদ্দেশ্য ছিল কৃষ্ণ সাগর এলাকায় যুদ্ধের সম্ভাবনা কমিয়ে আনা। কিন্তু এতে যুক্তরাষ্ট্র এবং ন্যাটোর মতো পশ্চিমা দেশের সামরিক জোট দারুণ সমস্যায় পড়ে গিয়েছিল। কারণ তাদের বিমানবাহী রণতরীগুলোর ওজন ছিল অনেক বেশি।
কিন্তু এরপর থেকে বিশ্ব নিরাপত্তা পরিস্থিতি অনেকটাই বদলে গেছে। তুরস্ক এখন মনে করছে, এই চুক্তির প্রধান সুবিধাভোগী সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের (বর্তমানের রাশিয়ার) কৃষ্ণ সাগরে এখন আর একক প্রভূত্ব নেই।
যুক্তরাষ্ট্র এবং ন্যাটো এখন কৃষ্ণ সাগর ও বলকান অঞ্চলের ব্যাপারে অনেক বেশি আগ্রহী, বিশেষভাবে রাশিয়া ইউক্রেইনের ক্রাইমিয়া অঞ্চল দখলের পর।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের বরিস টুকাস এক নিবন্ধে লিখেছেন, রাশিয়ার জন্য ‘ইউক্রেন হচ্ছে সামরিক উৎস, তুরস্ক হচ্ছে চাবিকাঠি এবং তুর্কী প্রণালীগুলো হচ্ছে নিয়ন্ত্রক পথ।’
‘এর লক্ষ্য হচ্ছে, ন্যাটো জোটের পূর্বমুখী সম্প্রসারণ ঠেকানোর জন্য ভূমধ্যসাগরের পূর্ব দিকে (রাশিয়ার) একটি শক্ত অবস্থান তৈরি করা।’
আর সেটাই তুরস্কের জন্য তৈরি করেছে একটি অনন্য সুযোগ।
এরদোগান সরকার মনে করছে, পশ্চিমা কিংবা পূর্বাঞ্চলীয় - কোনো পক্ষেরই তল্পিবাহক না হয়ে তুরস্ক এখন নিজের ভূখণ্ড ব্যবহার করে বিশ্ব ভূ-রাজনৈতিক খেলায় একটা বড় ভূমিকা রাখতে পারবে।
সে জন্যেই তারা এমন একটি বিকল্প পানিপথ তৈরি করতে চায়, যা মন্ট্রো চুক্তির শর্তের জালে আবদ্ধ থাকবে না।
পরিবেশ হুমকির মুখে ইস্তাম্বুল
ইস্তাম্বুল খাল খনন পরিকল্পনা নিয়ে তুরস্কের পরিবেশবাদীরা গোড়া থেকেই বেশ সন্দিহান ছিলেন, এর বিরুদ্ধে ছিলেন সোচ্চার।
আর এই সমালোচকদের মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত যিনি, তিনি হলেন একরাম ইমামোগলু - বিরোধীদলের হয়ে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীকে পরাজিত করে যিনি এখন ইস্তাম্বুলের মেয়র।
‘এই সিমেন্ট প্রকল্পের কথা ভাবলে আমি রাতে ঘুমাতে পারি না,’ চলতি সপ্তাহের গোড়াতে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন। ‘এই প্রকল্প শেষ হওয়ার পর প্রথম যে ভাবনা সবাইকে ভাবিয়ে তুলবে তা হলো, স্বাস্থ্যকর পরিবেশে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের বেঁচে থাকার অধিকার। অর্থের মূল্যে এই ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা যাবে না।’
পরিবেশবিজ্ঞানীরা অভিযোগ করছেন, এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে লেক দুরুসু ধ্বংস হয়ে যাবে। ইস্তাম্বুলবাসীদের প্রয়োজনীয় খাবার পানির এক-পঞ্চমাংশ জোগান দেয় এই লেকটি। ধ্বংস হবে আশপাশের জলাভূমি।
এছাড়া কৃত্রিম খাল হলে ইস্তাম্বুলের ভূগর্ভস্থ পানির আধারে পানির উচ্চতা নেমে যাবে, এবং পানির লবণাক্ততা বেড়ে যাবে বলেও তারা মনে করছেন।
এছাড়াও বিরোধীদলীয় নেতারা অভিযোগ করেছেন, সরকার এই প্রকল্পের ব্যাপারে মরীয়া, কারণ প্রকল্প সংক্রান্ত নানা স্বার্থের সাথে দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতা - এমনকি এরদোগানের মেয়ের স্বামীও - জড়িত রয়েছেন।
কিন্তু যতই সমালোচনা হোক না কেন, এরদোগান সরকারকে এই প্রকল্প বাস্তবায়নে দৃশ্যত বদ্ধপরিকরই মনে হচ্ছে।
গত মাসে একে পার্টির এক সভায় এরদোগান জানিয়েছেন, খুব শিগগিরই এই প্রকল্পের জন্য টেন্ডার ডাকা হবে, ‘কেউ (সমালোচকেরা) এটা পছন্দ করুক বা না-ই করুক।’
সূত্র : বিবিসি