কী হতে যাচ্ছে কাশ্মিরে?

ইকতেদার আহমেদ | Jun 28, 2021 05:11 pm
কাশ্মির

কাশ্মির - ছবি সংগৃহীত

 

১৯৪৭ সালে ১৪ ও ১৫ আগস্ট যখন পাকিস্তান ও ভারত নামক দুটি পৃথক রাষ্ট্রের জন্ম হয় তখন ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতবর্ষের অন্তর্ভুক্ত ৬৫০টি দেশীয় রাজ্যকে পাকিস্তান অথবা ভারত এ দুটি রাষ্ট্রের যে কোনো একটির অধীন যোগ দেয়ার অথবা স্বাধীনভাবে থাকার সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা দেয়া হয়। সে সময় জম্মু ও কাশ্মির একটি দেশীয় রাজ্য ছিল। ভারতবর্ষ বিভাজনকালীন জম্মু ও কাশ্মিরের মহারাজা ছিলেন হরি সিং। ব্রিটিশ শাসকরা হরি সিং-এর পিতামহ গোলাব সিং-এর কাছে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জম্মু ও কাশ্মির ১৮৪৬ সালে বিক্রি করে। হরি সিং পাকিস্তান নাকি ভারতের অধীন যোগ দেবেন এ বিষয়ে মনস্থির করতে না পেরে স্বাধীন থাকার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।

ভারতবর্ষের স্বাধীনতার অব্যবহিত পর অযৌক্তিক করারোপের কারণে প্রজা অসন্তোষ থেকে কাশ্মিরের বিভিন্ন অঞ্চলে বিদ্রোহের সূত্রপাত হয়। বিদ্রোহীরা রাজার অত্যাচার থেকে নিজেদের বাঁচাতে পাকিস্তানের পাঠান গোত্র প্রধানদের সাহায্য প্রার্থনা করেন। পাঠান গোত্র প্রধানদের সৈন্যবাহিনী মুসলিম প্রজাদের দ্বারা সমর্থনপুষ্ট হয়ে শ্রীনগর অবধি পৌঁছে গেলে হরি সিং দিল্লিতে পালিয়ে গিয়ে ভারতের সামরিক সাহায্য প্রার্থনা করেন। তৎকালীন ভারত সরকার ভারতে যোগ দেয়ার শর্তসাপেক্ষে সামরিক সাহায্য প্রদানে সম্মত হন এবং এর ফলে মহারাজা হরি সিং ২৬ অক্টোবর, ১৯৪৭ সালে কাশ্মিরের ভারতের অন্তর্ভুক্ত হওয়া বিষয়ক দলিলে স্বাক্ষর করেন। তারপর ১৯৪৭-৪৮ সালে পাকিস্তান ও ভারতীয় সৈন্যদের কাশ্মিরের ভূখ-ে প্রথম যুদ্ধ সংঘটিত হয়। ভারত ০১ জানুয়ারি, ১৯৪৮ কাশ্মির বিবাদটি জাতিসঙ্ঘে উত্থাপন করে। জাতিসঙ্ঘ ১৩ আগস্ট, ১৯৪৮ পাকিস্তানকে তাদের সৈন্য অপসারণের প্রস্তাব গ্রহণ করে এবং প্রস্তাবে উল্লেখ করে যে তাদের সৈন্য অপসারণ পরবর্তী ভারতও রাজ্যটি হতে তাদের অধিকাংশ সৈন্য প্রত্যাহার করবে। প্রস্তাবে সৈন্য অপসারণ পরবর্তী গণভোটের কথা বলা হয়। সৈন্য অপসারণ কার্যকর না হওয়ায় গণভোট অনুষ্ঠান সম্ভব হয়নি। ইত্যবসরে ৩০ অক্টোবর, ১৯৪৮ ভারতের মদদে কাশ্মিরে শেখ আব্দুল্লাহর নেতৃত্বে একটি জরুরি সরকার গঠিত হয়। ০১ জানুয়ারি, ১৯৪৯ যখন পাকিস্তান ও ভারত উভয় দেশ যুদ্ধ বিরতিতে সম্মত হয় সে সময় রাজ্যটির ৩৭ শতাংশ পাকিস্তানের দখলে এবং ৬৩ শতাংশ ভারতের দখলে ছিল। যুদ্ধবিরতি পরবর্তী যে নিয়ন্ত্রণ রেখা টানা হয় তা পরবর্তীতে দুটি দেশের প্রকৃত সীমানা হিসেবে স্বীকৃত হয়।

১৯৫৭ সালে কাশ্মির আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয় এবং দেশটির সংবিধানের অনুচ্ছেদ নং ৩৭০ এ অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি অকাশ্মিরি ভারতীয়দের এ রাজ্যে ভূমি ক্রয়ের অধিকার হরণ করা হয়। কাশ্মির সঙ্কটকে কেন্দ্র করে ১৯৬৫ সালের সেপ্টেম্বরে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে আবারও যুদ্ধ হয়। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর মধ্যে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের তাসখন্দে ০১ জানুয়ারি, ১৯৬৬ একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তিটিতে বিরোধ নিরসনের কথা বলা হলেও শাস্ত্রীর মৃত্যু এবং আইয়ুব খানের ক্ষমতাচ্যুতি অচলাবস্থার জন্ম দেয়। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে তৃতীয় যুদ্ধ সংঘটনের ফলে পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ নামে আলাদা হয়ে যায়।

১৯৭২ সালে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে সিমলায় স্বাক্ষরিত চুক্তিতে তাসখন্দ চুক্তির ভিত্তিতে কাশ্মির সমস্যা সমাধানের বিষয়টি পুনর্ব্যক্ত করা হয়। পাকিস্তান ও ভারতের অন্যান্য অভ্যন্তরীণ সমস্যার কারণে কাশ্মির সমস্যা সাময়িক চাপা থাকাকালীন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো ১৯৭৭ সালে সামরিক শাসক জিয়াউল হক দ্বারা ক্ষমতাচ্যুত হন এবং একই বছর তার ফাঁসির দন্ডাদেশ কার্যকর করা হয়। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী অভ্যন্তরীণ সমস্যা সামাল দিতে ব্যর্থ হয়ে ১৯৭৫ সালে দেশটিতে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন। ভারতের বিভিন্ন আইন প্রয়োগকারী সংস্থা জরুরি অবস্থাকালীন ক্ষমতার অপপ্রয়োগে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর জনপ্রিয়তায় বিপুল ধস নামে এবং ১৯৭৮ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে তার দল কংগ্রেসের শোচনীয় পরাজয় ঘটে।

ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের মদদে বিভিন্ন সময়ে কাশ্মিরে যেসব সরকার গঠিত হয় এর অধিকাংশের পেছনেই জনসমর্থন ছিল না। ভারতভুক্ত কাশ্মিরে জনসাধারণের মধ্যে ১৯৮০ পরবর্তী ক্রমঅসন্তোষ পুঞ্জীভূত হতে থাকলে সেখানকার জনমানুষ স্বাধীনতার দাবিতে সোচ্চার হতে থাকে। এ সময় নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর উভয় দেশের সৈন্যদের মধ্যে নিত্য গুলি বিনিময় একটি স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়।

কাশ্মিরের যে অংশটি পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত এটি আজাদ কাশ্মির ও গিলগিট- বালতিস্থান সমন্বয়ে গঠিত। এ অঞ্চলটির আয়তন ৮৫ হাজার ৭৯৩ বর্গকিলোমিটার যা জম্মু ও কাশ্মিরের মোট দুই লাখ ২২ হাজার ২৩৬ বর্গকিলোমিটার আয়তনের ৩৭ শতাংশ। কাশ্মিরের অন্তর্ভুক্ত লাদাখ অঞ্চলকে চীন বরাবর তিব্বতের অংশ হিসেবে দাবি করে আসছিল। ব্রিটিশরা ভারত বিভাজনের সময় এ অঞ্চলসহ ভারতের পূর্বাঞ্চলের অরুণাচল প্রদেশকে ভারতভুক্ত দেখালেও চীন কখনো এ দুটি অঞ্চলের ওপর ভারতের সার্বভৌমত্ব মেনে নেয়নি। ১৯৬২ সালে ভারত ও চীনের মধ্যে যে সীমান্ত যুদ্ধ সংঘটিত হয় তাতে চীন লাদাখ অঞ্চলের প্রায় ১৫ হাজার কিলোমিটার ভূমি নিজ দখলে নিয়ে এ অঞ্চলটিকে আকসাই চীন নামে অভিহিত করে। সে সময় অরুণাচল রাজ্যটিকেও চীন নিজ দখলে নিয়েছিল কিন্তু চীন কর্তৃক একতরফা যুদ্ধ বিরতিকালীন চীন অরুণাচলের দখল ত্যাগ করলেও আকসাই চীন দখল অব্যাহত রাখে।

চীন ও পাকিস্তানের মধ্যে স্বাক্ষরিত ১৯৬৩ সালে সীমান্ত চুক্তি অনুযায়ী পাকিস্তান গিলগিট বালতিস্থানভুক্ত পাঁচ হাজার ১৮০ বর্গকিলোমিটার ভূমি চীনের বরাবরে ভারতের সাথে কাশ্মির বিরোধের স্থায়ী সমাধান না হওয়া সাপেক্ষে ছেড়ে দেয়। পাকিস্তানের ছেড়ে দেয়া এ অঞ্চলটি বর্তমানে চীনের জিনজিয়ান উইঘুর স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের অংশ।

১৯৯৯ সালে নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর কারগিল সীমান্তে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে আরেকটি সীমিত যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এ যুদ্ধে উভয় দেশের সেনাবাহিনীর সদস্যসহ স্বাধীনতাকামী কাশ্মিরি অনেক মুক্তিযোদ্ধা নিহত হয়। যুদ্ধবিরতি পরবর্তী উভয় দেশের সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর ফিরে যায়।

ভারত বিভাজনের সময় যে জম্মু ও কাশ্মির একটি অখণ্ড অঞ্চল ছিল এ অঞ্চলটির তৎকালীন মহারাজার জনমানুষের স্বার্থের পরিপন্থী সিদ্ধান্ত গ্রহণের কারণে আজ ত্রিধাবিভক্ত হয়ে এর ৪৩, ৩৭ ও ২০ শতাংশ যথাক্রমে ভারত, পাকিস্তান ও চীনের নিয়ন্ত্রণে। বর্তমানে তিনটি দেশের অন্তর্ভুক্ত কাশ্মিরের জনমানুষের মধ্যে তিন ধরনের মতাবলম্বী রয়েছে। এর একটি বড় অংশ পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়ে থাকতে চায়। এর চেয়ে অপেক্ষাকৃত একটি ছোট অংশ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে থাকতে চায় আর ভারতের অংশ হিসেবে থাকতে চায় এ সংখ্যাটি ক্রমহ্রাসমান। চীনের দখলবহির্ভূত অঞ্চলের জনমানুষ যেমন চীনের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার বিষয়ে আগ্রহী নয় অনুরূপ চীনের দখলকৃত অংশের জনমানুষও যে চীনের দখলে থাকতে চায় সেটিও স্পষ্ট নয়।

আজাদ কাশ্মির এবং গিলগিট ও বালতিস্থানের অধিবাসীদের প্রায় শত ভাগই মুসলিম। আজাদ কাশ্মিরের অধিবাসীরা গুরজার, জাঠ, পাহাড়ি রাজপুত, সুধান, আব্বাসী ও আওয়ান সম্প্রদায়ভুক্ত। অপর দিকে গিলগিট ও বালতিস্থানের অধিবাসীরা ইয়াসকুন, সীন, মোঘল, ওয়াখি, গুযার, বালটি, কাশ্মিরি সদাত ও হুনজা সম্প্রদায়ভুক্ত। উভয় অঞ্চল স্বশাসিত এবং কোনোটি থেকেই পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে সদস্য নির্বাচনের কোনো ব্যবস্থা নেই। অঞ্চল দু’টি পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণে আসার পর পাকিস্তান সরকার উভয় অঞ্চলে বসবাসরত অধিবাসীদের আর্থ-সামাজিক, শিক্ষা ও জীবনমান উন্নয়নে নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করে। এর ফলে উভয় অঞ্চলের মানুষের মধ্যে যেমন শিক্ষার প্রসার ঘটেছে এর পাশাপাশি কর্মসংস্থানেরও সৃষ্টি হয়েছে। উভয় অঞ্চলের অধিবাসীদের মধ্যে স্বাধীনভাবে থাকার চেয়ে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়ে থাকার সংখ্যাই অধিক। উভয় অঞ্চলের জনগণের পক্ষ হতে একাধিকবার পাকিস্তানের সাথে অন্তর্ভুক্তির দাবি উঠলেও এর দ্বারা ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মিরের জনগণের স্বাধীনতার দাবি ক্ষুণœ হবে সে বিবেচনায় পাকিস্তান অন্তর্ভুক্তির পক্ষে অগ্রসর হয়নি।

ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মির ভারতের একমাত্র রাজ্য যেখানে মুসলিম জনগোষ্ঠী সংখ্যাগরিষ্ঠ। কিন্তু ভারতের অন্যান্য রাজ্যের মতো এ রাজ্যের মুসলিম জনগোষ্ঠী গরু জবাইয়ের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হন। এমনকি রাজ্যটির বিধান সভার জনৈক মুসলিম সদস্য কর্তৃক আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে গরুর গোশত দিয়ে আপ্যায়নের ব্যবস্থা থাকায় তিনি বিধান সভা অধিবেশন কক্ষে সহকর্মী হিন্দু সদস্য দ্বারা শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হয়েছিলেন। ভারতবর্ষ বিভাজন পরবর্তী রাজ্যটির মুসলিম জনগোষ্ঠী বিভিন্নভাবে অত্যাচার ও নিষ্পেষণের শিকার হওয়ার কারণে তারা ক্রমেই ভারতবিদ্বেষী হয়ে ওঠে। এ কথা অনস্বীকার্য যে, ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মিরে জাতিসঙ্ঘের গৃহীত প্রস্তাব অনুযায়ী গণভোটের ব্যবস্থা করা হলে রাজ্যটির জনমানুষের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ স্বাধীনতা অথবা পাকিস্তানের সাথে অন্তর্ভুক্তির পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করবে।
বর্তমানে স্বাধীনতার দাবিতে ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মিরের অভ্যন্তরে যে চারটি সংগঠন অধিক সক্রিয় এগুলো হলো লস্করে তৈয়বা; হিজবুল মুজাহিদীন, হরকাতুল মুজাহিদীন এবং জম্মু ও কাশ্মির লিবারেশন ফ্রন্ট (জেকেএলএফ)। এ সংগঠনগুলোর সশস্ত্র সদস্য রয়েছে এবং এরা স্বাধীনতার দাবিতে সোচ্চার। ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মিরের অভ্যন্তরে ভারতের সেনাবাহিনীসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ছয় লক্ষাধিক সদস্য মোতায়েন রয়েছে। এদের দ্বারা প্রতিনিয়ত সেখানে বয়স ও নারীপুরুষ নির্বিশেষে মুসলিম জনগোষ্ঠী অত্যাচার, হয়রানি ও নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন। এদের হাতে রাজ্যের কোনো না কোনো অঞ্চলে প্রতিদিনই এক বা একাধিক হত্যাকা- ঘটছে।

কাশ্মিরকে কেন্দ্র করে ভারতের সাথে পাকিস্তানের ১৯৪৭ ও ১৯৬৫ তে যে দু’টি যুদ্ধ এবং ১৯৯৯ তে যে সীমিত যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল এর কোনোটিই কোনো দেশের জন্য চূড়ান্ত বিজয় বয়ে আনেনি বরং তৃতীয় পক্ষের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতির মাধ্যমে বিবাদের অবসান ঘটে। বর্তমানে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যে বৈরিতা এর মূলে রয়েছে কাশ্মির সমস্যা। কাশ্মিরকে কেন্দ্র করে উভয় দেশের মধ্যে আধুনিক সমরাস্ত্র দ্বারা সজ্জিত হওয়ার তীব্র প্রতিযোগিতা বিরাজ করছে। এরই মধ্যে উভয় দেশ পারমাণবিক অস্ত্রধারী দেশে পরিণত হয়েছে। এ প্রতিযোগিতার কারণে উভয় দেশের প্রবৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে এবং উভয় দেশের জনমানুষ যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার আশঙ্কা হতে মুক্ত হতে পারছে না।

ভারতের মতো পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মিরেও দেশটির সেনাবাহিনীর ব্যাপক উপস্থিতি রয়েছে।
ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মির থেকে উদ্ভূত সিন্ধু, ঝিলম, চেনাব, সুতালজ, বিয়াস ও রাভি নামক ছয়টি নদী পাকিস্তানের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে আরব সাগরে পড়েছে। এ ছয়টি নদীর পানির হিস্যা নিয়ে উভয় দেশের মধ্যে যে বিবাদ ছিল তা বিশ্বব্যাংকের মধ্যস্থতায় ১৯৬০ সালে সমাধা হয় এবং এর ফলে উত্তরের তিনটি নদী সিন্ধু, ঝিলম ও চেনাবের পানির বৃহদংশ পাকিস্তান ভোগ করে আসছে; অন্যদিকে দক্ষিণের তিনটি নদী সুতালজ, বিয়াস ও রাভির পানির বৃহদংশ ভারত ভোগ করছে। উভয় দেশের জনমানুষের মধ্যে যারা শান্তি, স্থিতিশীলতা, উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির স্বপক্ষে তাদের প্রশ্ন, পানির হিস্যার ব্যাপারে উভয় দেশ সমঝোতা অনুযায়ী চলতে পারলে অপর সব বিষয়ে সমঝোতা নয় কেন? তাদের অপর একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন, ধর্মীয় জাতিসত্তার ভিত্তিতে বিভাজিত ভারতবর্ষের ব্যাপকভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত প্রদেশ কোন যুক্তিতে ভারতের অন্তর্ভুক্ত হলো। আর অন্তর্ভুক্তিকে যদি মেনে নেয়া হয় সে ক্ষেত্রে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের বিচ্ছেদে জাতিগত জাতিসত্তা যদি মূল কারণ হয়ে দাঁড়িয়ে ভারতের প্রত্যক্ষ সমর্থনের কারণে বাস্তব রূপ পেয়ে থাকে তাহলে জাতিগত জাতিসত্তার ভিত্তিতে জাতিসঙ্ঘের প্রস্তাব মতো গণভোট আয়োজনে কাশ্মিরের জনগণের নিজেদের ভাগ্য নির্ধারণে বাধা কোথায়?

কাশ্মিরের সাথে পৃথিবীর পাঁচটি বৃহৎ শক্তির অন্যতম চীনের সীমানা রয়েছে এবং এ সীমানা ভারত ও পাকিস্তান উভয় দেশব্যাপী বিস্তৃত। তাছাড়া ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মিরের উত্তর-পূর্ব দিকের একটি বড় অংশ এবং পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মিরের উত্তর দিকের ক্ষুদ্র একটি অংশ চীনের নিয়ন্ত্রণাধীন। প্রথমোক্ত অংশটি চীন কর্তৃক ভারত হতে যুদ্ধ বিজয়ের মাধ্যমে প্রাপ্ত অপর দিকে শেষোক্ত অংশটি পাকিস্তান কর্তৃক চীনের বরাবরে সমঝোতার ভিত্তিতে সমর্পণ।

সাম্প্রতিক সময়ে চীন দেশটির জিনজিয়ান প্রদেশ থেকে পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মির অভিমুখী কারাকোরাম মহাসড়কটি প্রশস্তকরণ ও উন্নীতকরণ এবং বেলচিস্তানস্থ গোয়াদর গভীর সমুদ্রবন্দর অবধি এটির বিস্তৃতি, পাকিস্তানের রেল যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ও গোয়াদর অবধি সম্প্রসারণ এবং গোয়াদর গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে ৪৬ বিলিয়ন ডলারের অধিক অর্থ বিনিয়োগ চলমান রয়েছে। এ বিনিয়োগ যে চীনের অর্থনীতির জন্য বড় ধরনের সফলতা বয়ে আনবে সে বিষয়ে সবাই ওয়াকিবহাল। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে কাশ্মিরকে কেন্দ্র করে বড় ধরনের বৈরিতায় পাকিস্তান ক্ষতিগ্রস্ত হলে তা যে চীনের অর্থনৈতিক স্বার্থের ওপর বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে সে বিবেচনায় যে কোনো বৈরিতায় চীনের অবস্থান যে পাকিস্তানের স্বপক্ষে হবে এটি কারো না বোঝার কথা নয়।

আর সে কারণে বর্তমানে কাশ্মিরকেন্দ্রিক ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যে কোনো যুদ্ধে প্রচলিত অস্ত্রের ব্যবহারে ভারতের জয়ের সম্ভাবনা ক্ষীণ। এমতাবস্থায় যে কোনো দেশ পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করলে তা উভয় দেশের অখণ্ডতাকে বিপন্ন করে এতদঅঞ্চলের জনমানুষের ব্যাপক জীবনহানি ঘটাবে। বিশ্ব এ ধরনের বিপর্যয়ের দিকে ধাবিত হোক এটি এতদঞ্চলের কতিপয় উগ্র জনমানুষ ছাড়া অন্য কারো কাম্য নয়।

ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মিরে যারা জনমানুষের অধিকার আদায়ে সোচ্চার এরা সবাই স্বাধীনতাকামী। অথচ ভারত এদের সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত করতে সদা তৎপর। ভারতের কাশ্মিরের এসব স্বাধীনতাকামীদের সাথে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী এবং ১৯৭১ সালে যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার সপক্ষে ছিল তাদের কোনো পার্থক্য নেই। কাশ্মিরের স্বাধীনতাকামী মানুষের ওপর ভারতীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অত্যাচার ও নিষ্পেষণ এতই বর্বর ও নির্মম যে তা আজ বিশ্ববিবেককে নাড়া দিয়েছে। আর এ কারণে নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর ভারতস্থ কাশ্মিরের উরি সেনাঘাঁটিতে স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র চারজনের আকস্মিক হামলায় ২০ জন ভারতীয় সেনা নিহতের ঘটনায় আন্তর্জাতিক মহলের কোনো বড় দেশ ভারতের পাশে এসে দাঁড়ায়নি। ভারত কখনো দেখা গেছে ধর্মীয় জাতিসত্তার প্রবক্তা আবার কখনো জাতিগত জাতিসত্তার প্রবক্তা। কাশ্মিরের ক্ষেত্রে উভয় অবস্থানের যে কোনোটির ভিত্তিতে জাতিসঙ্ঘের তত্ত্বাবধানে গণভোট আয়োজনে তিনটি দেশের নিয়ন্ত্রণাধীন কাশ্মিরের জনগণের ভাগ্য নির্ধারণের সুযোগ দেয়া হলে তা কাশ্মির সঙ্কটের স্থায়ী সমাধানের ভিত হিসেবে কাজ করবে এ বিশ্বাস এ উপমহাদেশের জনমানুষের মধ্যে গভীরভাবে গ্রথিত।

লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক
E-mail: iktederahmed@yahoo.com


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us