শাহ্ আব্দুল হান্নান : কিছু কথা
শাহ্ আব্দুল হান্নান - ছবি সংগৃহীত
বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী এক অসাধারণ ব্যক্তিত্ব ছিলেন মরহুম শাহ্ আব্দুল হান্নান। সততার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করে তিনি ৮২ বছরের জীবনকালকে একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে পরিচালনা করেন। তার অভিষ্ট লক্ষ্য ছিল মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন। তিনি রাসূলে পাক সা:-এর জীবন অনুসরণের মাধ্যমে নিজকে পরিচালনা করতে সদা সচেষ্ট ছিলেন। এ প্রসঙ্গে তিনি নিজেই উল্লেøখ করেছেন যে, রাসূল সা:-এর জীবনী অধ্যয়নের মাধ্যমেই তিনি ইসলামের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করতে উদ্বুদ্ধ হন।
তাঁর সাথে আমার পরিচয় ঘটে ১৯৭৩ সালে তারই ছোট ভাই শাহ আব্দুল হালিমের মাধ্যমে। এ ছাড়া তার পরিবারের সাথে আমার আত্মীয়তারও সম্পর্ক রয়েছে। ১৯৭৩ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত আমাদের উভয়ের সম্পর্ক ক্রমান্বয়ে ঘনিষ্ঠতায় রূপ নেয়। তার কাছ থেকে আমি সর্বদা পেয়েছি বড়ভাইসুলভ আন্তরিক আচরণ যা আমাকে তার অনন্য চারিত্রিক গুণাবলির প্রতি আকৃষ্ট করেছিল। ১৯৭৭ সালে আমি সরকারি চাকরিতে যোগ দিই। চাকরি ও অন্যান্য প্রয়োজনে আমি সব সময়ই পেয়েছি তার সুপরামর্শ যা আমার ব্যক্তিজীবনকেও নানাভাবে প্রভাবিত করেছে। ২০০৯ সালে চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের পর মানারাত ট্রাস্টে সচিব হিসেবে যোগ দিই। এখানে সংস্থার চেয়ারম্যান হিসেবে তার মতো একজন উদার, নম্র, সহজ-সরল জীবন যাপনে বিশ্বাসী এক মহৎ হৃদয়ের ব্যক্তিত্বের প্রত্যক্ষ সান্নিধ্যে কাজ করার সুযোগ পাই। দীর্ঘ সময়কালে তাকে খুব কাছ থেকে দেখেছি ও বুঝেছি।
লোভ-লালসার ঊর্ধ্বের এই নির্লোভ মানুষটি তার আমলাজীবন ও অবসর পরবর্তী জীবন একটি সুনির্দিষ্ট ছকে পরিচালনা করেছেন। পার্থিব লোভ-লালসা থেকে মুক্ত ছিলেন বলে আমলা জীবনে একাধিক মন্ত্রণালয়ের সচিব, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান, দুর্নীতি দমন ব্যুরোর মহাপরিচালক এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর হিসেবে দীর্ঘ ৫৭ বছর কাজ করার পরও তিনি জীবন-যাপন করেছেন একজন অতি-নগণ্য সাধারণ মানুষের মতো। তিনি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ভাড়া বাড়ি এবং সর্বশেষ পিতার কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত গোড়ানের এক হাজার ২০০ বর্গফুটের ছোট একটি ফ্ল্যাটে জীবন অতিবাহিত করেছেন। তিনি যেখানে জীবনের লক্ষ্য স্থির করেছিলেন আল্লাহ পাকের সন্তুষ্টি অর্জন, সেখানে পার্থিব এসব লোভ-লালসা তাকে কখনো বিন্দুমাত্র কাবু করতে পারেনি, বরং ‘লোভ’ নামক রিপুকে তিনি সফলতার সাথে পরাভূত করতে পেরেছিলেন। তার সততার বিষয়টি আজ শত্রু-মিত্র, পক্ষ-বিপক্ষ নির্বিশেষে সর্বমহলে প্রশংসিত। সততার এই উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত সবার জন্য অনুকরণীয় হয়ে থাকবে।
শাহ্ আব্দুল হান্নান জীবনের প্রতিটি ক্ষণকে তার আদর্শিক লক্ষ্যে পরিচালনা করেছেন। দৈনিক ২৪ ঘণ্টার মধ্যে খাওয়া-দাওয়া বাদ দিয়ে যে সময়টুকু পেতেন তিনি পড়াশোনা, লেখালেখি, স্টাডি সার্কেল পরিচালনা, কুরআন শিক্ষা কার্যক্রম ইত্যাদি কর্মকা-ে ব্যয় করেছেন। এ লক্ষ্যে তিনি সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর লোকদের নিয়ে যেমন- মসজিদের ইমাম, আলেম-ওলামা, শিক্ষক-ছাত্র, রাজনীতিবিদ, সাংস্কৃতিককর্মী, আইনজীবী-বিচারক, ব্যবসায়ী, সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের তালিকা ও সময়সূচি করে তাদের সাথে মতবিনিময় করতেন, ক্লাস নিতেন এবং সবাইকে তিনি ইসলামের মর্মবাণী অনুধাবন এবং সেভাবে জীবন পরিচালনায় উদ্বুদ্ধ করতেন। আজ তাই আমরা দেখতে পাই- দেশ-বিদেশে তার অসংখ্য ছাত্র-ছাত্রী কিংবা অনুসারী তার শিক্ষায় অনুপ্রাণিত হয়ে নিজ নিজ ক্ষেত্রে একমাত্র আল্লার সন্তুষ্টির লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছেন।
লক্ষণীয় যে, তিনি যা শিখেছিলেন তা তিনি যথাযথভাবে ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন এবং তৈরি করে গেছেন অসংখ্য ধর্মভীরু যোগ্য ব্যক্তিত্ব। অনেক সময় তাকে বলতে শুনেছি, ইসলামের নির্ভীক এবং উপযুক্ত খাদেম হতে হলে জ্ঞানার্জনের মাধ্যমে প্রতিযোগিতায় টিকে থেকে অবদান রাখতে হবে। সে জন্যই তার স্লোগান ছিল ‘Read & Read, Write & Write and Preach’. কথা ও কাজে মিল রেখে জীবন পরিচালনায় দৃষ্টান্ত সৃষ্টিকারী এই মহান ব্যক্তির সাথে অন্যদের তুলনা করলে আমরা অবশ্যই তার চেয়ে আরো জ্ঞানী-গুণী বুদ্ধিজীবীর সাক্ষাত পাই, কিন্তু কথা ও কাজে মিল রেখে জীবন পরিচালনা করেছেন এমন ব্যক্তির সাক্ষাত সত্যিই দুর্লভ।
আমার জানামতে, তিনি কারো সাথে খারাপ আচরণ করেছেন, রেগে কটু কথা বলেছেন এমন নজির নেই। আমি দীর্ঘ সময়কালে ভুলত্রুটি করার পরও তার কাছে স্নেহসুলভ আচরণ পেয়েছি, কখনো রাগতে দেখিনি। তিনি জীবন পরিচালনায় ইসলামের শিক্ষা অনুযায়ী মধ্যপন্থী ছিলেন। এজন্য সরকারি কিংবা সামাজিক কোনো জটিল পরিস্থিতি মোকাবেলায় তিনি সর্বদা মধ্যপন্থা অবলম্বন করে সমস্যার সমাধান কিংবা পরস্পরবিরোধীদের মাঝে সমঝোতার প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। সদাচার, দয়া, সহমর্মিতা প্রকাশের মাধ্যমে তিনি উঁচু-নীচু, সাধারণ সবার কাছে একজন আপন মানুষে পরিণত হয়েছিলেন। তার বাড়ি-অফিসের দরজা সর্বদা দরিদ্র ও অসহায়দের জন্য উন্মুুক্ত ছিল। মানুষের দুঃখ-কষ্টে অতিশয় সংবেদনশীল এই মানুষটি অসহায়-সম্বলহীন মানুষের সেবায় সদা সচেষ্ট থাকতেন।
তার সেবার প্রচেষ্টা সর্ব ক্ষেত্রে-সম্প্রসারিত ছিল। বেকারদের চাকরির ব্যবস্থা, সম্বলহীনদের আর্থিক সচ্ছলতা বৃদ্ধিতে রোজগারের ব্যবস্থা করে দেয়া, এমনকি তার পরিচিত-উপযুক্ত পাত্র-পাত্রীর মধ্যে বিয়ের ব্যবস্থা করে দেয়ার মতো অসংখ্য নীরব উদাহরণ তিনি রেখে গেছেন। এসব কাজে তিনি তার সীমিত আয় থেকে গরিব আত্মীয় ও অসহায়দের আর্থিক সহায়তা দিয়ে গেছেন। তার দৈনন্দিন জীবন-যাপন ছিল নিতান্তই অনাড়ম্বর। তিনি নিজের বাসায় অবস্থানরত কাজের লোক- বুয়া, ব্যক্তিগত সহকারী, ড্রাইভারদের নিয়ে একত্রে খাবার খেতেন যা অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত।
আমলা ও সমাজকর্মী হিসেবে তার সাফল্যের তালিকায় উল্লেখযোগ্য অবদান হচ্ছে- সরকারি-বেসরকারি সবাইকে সৎ জীবন যাপনে উদ্বুদ্ধকরণ, অসংখ্য বইয়ের রচনাকারী হিসেবে ইসলামী সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার উৎকর্ষতা প্রমাণ, যোগ্য ও জ্ঞানী যোদ্ধা তৈরি করে যাওয়া, শিক্ষা ক্ষেত্রে মানারাত কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়, দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রামে ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ইউনির্ভাসিটি প্রতিষ্ঠা, একাধিক গবেষণাধর্মী প্রতিষ্ঠান পরিচালনা, স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নয়নের মাধ্যমে গরিব-দুঃখীদের সুচিকিৎসার লক্ষ্যে ইবনে সিনা হাসপাতাল ও সহযোগী প্রতিষ্ঠান চালু ইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেখ্য। এই কর্মবীর দিগন্ত মিডিয়ার মাধ্যমে দেশে সংবাদপত্র ও প্রকাশনার ক্ষেত্রেও রেখে গেছেন সাফল্যের সাক্ষর।
এ ছাড়া পাশ্চাত্যের সুদভিত্তিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মোকাবেলায় সুদবিহীন ইসলামী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা চালুর ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন অগ্রগামী অন্যতম যোদ্ধা। সমমনাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় প্রতিষ্ঠিত ইসলামী ব্যাংক বর্তমানে অন্যান্য সুদভিত্তিক ব্যাংকের অনুকরণীর দৃষ্টান্ত হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে তার কঠোর পরিশ্রমের ফলে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ‘ভ্যাট’ ব্যবস্থার প্রচলন হয়েছে যার আর্থিক সুফল এদেশ অনাদিকাল পর্যন্ত পেয়ে যাবে।
তিনি সর্বদা ইন্টারনেট এবং বিভিন্ন প্রকাশনী ও বই-পত্রের মাধ্যমে দেশ ও আন্তর্জাতিক সব ঘটনার সর্বশেষ তথ্য অবহিত থাকতে পছন্দ করতেন। তার ‘পাবলিক রিলেশন্স’ ছিল ব্যাপক ও অনুকরণীয়। দলমত নির্বিশেষে তার সাথে যোগাযোগ ছিল সব শ্রেণীর মানুষের। দেশে পরস্পরবিরোধী রাজনৈতিক ব্যক্তি কিংবা বুদ্ধিজীবী এবং দেশের বাইরে ইউসুফ আল কারজাভী, তারিক রমদান, হাসান তারাবি, খুরশিদ আহমদ, উমর চাপরা, ইরানের সাবেক প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আহমাদিনেজাদের মতো অসংখ্য স্বনামধন্য ব্যক্তির সাথে ছিল তার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ।
পরিশেষে বলতে চাই, মরহুম শাহ্ আব্দুল হান্নানের জীবন ছিল বিনয়, সেবা, চারিত্রিক সততা, সরলতা এবং অপরকে সম্মান জানাতে সচেষ্ট এক মর্দে মুজাহিদের জীবন। তিনি এক্ষেত্রে কোনো অবস্থায় আপস না করে রাসূলে পাক সা:-এর জীবন থেকে শিক্ষা নিয়ে জীবন পরিচালনায় সদা সচেষ্ট ছিলেন। আজ আমাদের সবার এই প্রার্থনা হোক- জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত শাহ্ আব্দুল হান্নান ইসলামের একজন খাদেম হিসেবে যেভাবে মুজাহিদের মতো দায়িত্ব পালন করে গেছেন, আল্লাহ পাক তার সেই জীবন ও কর্ম সদকায়ে জারিয়া হিসেবে গ্রহণ করে তাকে বেহেশতের শ্রেষ্ঠতম স্থানে আসীন করুন।
লেখক : সচিব, মানারাত ট্রাস্ট