যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে বিশ্বের নেতা হয়েছিল
যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে বিশ্বের নেতা হয়েছিল - ছবি সংগৃহীত
কলোনি যুগের আমেরিকা উদ্বৃত্ত সঞ্চিত সম্পদের জোরে বড় অর্থনীতি হিসাবে সবাইকে ছাড়িয়ে গেলেই তাকে দুনিয়ার ‘গ্লোবাল অর্থনীতিতে নেতা’ বলে সবাই মেনে নিয়েছিল। এককালে আমেরিকা নেতা হয়নি। তাকে প্রায় ৫০ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছিল দুই দুইটা বিশ্বযুদ্ধের জন্য। মূল কারণ দুনিয়া তখন কলোনি দখলের রামরাজত্বে ডুবেছিল, যার অবসান দরকার ছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ (১৯১৪-১৮) ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে (১৯৩৯-৪৫) দুনিয়ার কলোনি দখলদার শক্তিগুলা যারা দুনিয়ার উপর একচ্ছত্র খবরদারি চালিয়ে বেড়াত তারা যুদ্ধের মাঝপথে- সবাই দেউলিয়া হয়ে গেছিল। ফলে নেতা হিটলার (সাথে মুসোলিনির ইতালি আর মার্শাল তেজো জাপানসহ অন্যেরা) একদিকে আর অন্যদিকে আমেরিকার নেতৃত্বে বাকিরা এভাবে এক পোলারাইজেশন ঘটতে পেরেছিল বলে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আমেরিকার নেতৃত্বের অংশ জয়লাভ করেছিল।
এই যুদ্ধের আসল ফ্যাক্টর যে যুদ্ধের পোলারাইজেশন এবং তা এমন কেন হয়েছিল এবং কিসের ভিত্তিতে তা আমাদেরকে তখন পরিষ্কার জানতে দেয়া হয় নাই। তবে দুটা শক্তি ঘটনা যেভাবে ব্যাখ্যা করে দিয়েছিল আমরা খাপছাড়াভাবে তাই জানতাম।
এরই একটা হলো, ইউরোপ যেন ব্রিটিশদের মতো ভালো মানুষদের নেতৃত্বে মানে প্রধানমন্ত্রী চার্চিলের নেতৃত্বে খারাপ মানুষ হিটলার আর তার বন্ধুদের পরাজিত করেছিল। এই ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের গল্প। এছাড়া ওদিকে আরেক ব্যাখ্যা চালু ছিল কমিউনিস্টদের। এটাও আরেক ভালভালাইয়া; মানে চারিদিকে সব খালি ভালো আর ভালো। ভালো মানুষ সোভিয়েত ইউনিয়নের স্টালিনের হাতে জর্মানির হিটলারের পরাজয়, এটাই নাকি ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মূল গল্প। কিন্তু আমরা খুবই সরি, এদুটার একটাও বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাস, পোলারেইজেশন ও মুখ্য ফ্যাক্টর ছিল না। কেন?
আমরা চার্চিলকে দিয়ে বিশ্বযুদ্ধ বুঝতে গেছিলাম আর সেটা এজন্য যে তারাই তো আমাদেরকে ইউরোপ চিনিয়েছিল। তারাই আমাদের প্রভু ছিল। ইউরোপের ভাষাগুলোর মধ্যে একমাত্র ইংরাজি আমাদের এলিটরা বুঝত আর তারা কেবল ব্রিটিশ মিডিয়া পড়ে সেগুলো অনুবাদ করত। এভাবে গ্লোবাল কাহিনীর যতটুকু নাগালে আসত তা দিয়েই কেবল আমরা বিশ্বযুদ্ধ যতটুকু যা বুঝতাম। তাই আমেরিকা বলে কোনো দেশ আছে কি না ঠিকমতো বুঝতাম না। অর্থাৎ চার্চিলের চোখ দিয়েই আমরা বিশ্বযুদ্ধ বুঝেছিলাম।
অথচ হার্ডকোর সত্য এই যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ আমাদের মতো কলোনি হয়ে থাকা দেশগুলো আর ইউরোপের কারো না কারো কলোনি শাসন হয়ে থাকবে কিনা এটাই ফয়সালা করে দিয়েছিল। কঠিন সত্যটা ছিল, চার্চিল আমাদের ত্রাতা বা মুক্তিদাতা ছিলেন না। কলোনি থেকে আমাদের আসল মুক্তিদাতা হয়েছিল আমেরিকা। যদিও তা আমেরিকার নিজ স্বার্থেই। আমেরিকান প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট দুনিয়ার সকল কলোনি দখলদার চার্চিলসহ সকল কুতুবকে দাসখত দিতে বাধ্য করেছিল যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ বিজয়ে শেষ হলে পরে তাদের সকলকে দুনিয়া থেকে কলোনি ব্যবস্থা উঠায়ে ফেলতেই হবে। যাতে দুনিয়া কলোনিমুক্ত প্রায় শ দুয়েক স্বাধীন রাষ্ট্রের এক দুনিয়া হয়। মূল কথাটা হলো, আমাদের স্বার্থের দিক থেকে দেখলে চার্চিলও আসলে আমাদের ভিলেন ছিল। কিন্তু হিটলারের মারের মুখে নিজের যুদ্ধের খরচ চালানোর মুরোদ ছিল না বলে আমেরিকান শর্ত মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিল। অতএব যুদ্ধ শেষে এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকায় ১৯৬৫ সালের মধ্যে সবচেয়ে অসংখ্য দেশের কলোনিমুক্তি ঘটে গিয়েছিল।
অখ- ভারতের দিক থেকে দেখলে বিশ্বযুদ্ধের এটাই ছিল আসল ইতিহাস, আমাদের কলোনিমুক্তির ইতিহাস। গ্লোবাল ইতিহাসের দিক থেকে বললে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আসল ও একচ্ছত্র নেতৃত্ব ছিল আমেরিকার হাতে আর তাই স্বাভাবিকভাবেই যুদ্ধশেষে প্রথম গ্লোবাল অর্থনীতির নেতা হয়েছিল আমেরিকা।
এই আমেরিকান নেতৃত্ব মানে কি? এর মানে আর আবছা রেখে লাভ নাই যা স্টালিন বা চার্চিল আমাদেরকে সেকালে জানতে দেয় নাই তা হলো, আমেরিকান প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের নেতৃত্বে গঠিত মিত্রবাহিনীর পক্ষে যুদ্ধে খরচের বড় অংশটা একাই বহন করেছিল আমেরিকা। মানে ইউরোপ এমনি এমনি আমেরিকান নেতাগিরি মেনে নেয় নাই।
এমনকি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সম্পর্কে আরেক যে ব্যাখ্যা- আমাদের রাজনীতি ভালো বোঝে এমন ভাবধরা কমিউনিস্টদের মুখ থেকে জানি, সেটাও আসলে সোভিয়েত ভাষ্য। আর সেখানেও যুদ্ধের বড় খরচদাতা ওই একই আমেরিকা হলেও কমিউনিস্টদের ইতিহাস ভাষ্যে সেটা এড়িয়ে যাওয়া হয়ে এসেছে।
তবে ফ্যাক্টস হলো, আমেরিকাও দাসখত বা ‘সহযোগিতা’ চুক্তিতে স্তালিন বা চার্চিলকে অপমানজনকভাবে সামিল হতে বাধ্য করেন নাই। এসব চুক্তিতে অপরপক্ষ হিসাবে প্রথম ও একক স্বাক্ষরদাতা ছিলেন চার্চিল আর সেটার নাম আটলান্টিক চুক্তি, ১৬ আগস্ট ১৯৪১। আর পরে সেই ড্রাফটটাই কিন্তু এবার চার রাষ্ট্র ব্রিটেন,আমিরিকা চীন ও সোভিয়েত মিলে আবার স্বাক্ষরিত হয়েছিল ১ জানুয়ারি ১৯৪২ সালে। তবে এবার ওই চুক্তির নাম দেয়া হয়েছিল ‘জাতিসংঘের জন্ম ঘোষণায়’ স্বাক্ষর এই নামের আড়ালে। সাথে একইদিনে আরো ২৬ দেশ ঐ একই ডকুমেন্টে প্রতি স্বাক্ষর করেছিল। এটাই আমেরিকার নেতৃত্বে হিটলারবিরোধী জোটের দলিল। কিন্তু তবু কোথাও কলোনি ছেড়ে দিতে চলে যেতে হবে - এই ভাষা বা শব্দ কোথাও নাই। তবে ঘুরিয়ে বলা হয়েছে- যেকোনো ভূখ-ের বাসিন্দারাই একমাত্র নির্ধারক হবে যে ওই ভূখ-ের শাসন কিভাবে চলবে। অর্থাৎ কলোনি করা নিষিদ্ধ হলেও এ ভাষায় তা বলা হয় নাই।
এই প্রসঙ্গকথা এবার গুছিয়ে বলে শেষ করা যাক। তাহলে আমেরিকা কিভাবে গ্লোবাল নেতা হয়েছিল সেটা আমাদের মতো দেশের এলিট বা কুতুবেরা কেউ জানত বা টের পেয়েছিল তা মনে হয় না। এর কাহিনী বা ঘটনার দিক এটাই। আর এটাই এখন আমাদের জন্য খুব প্রাসঙ্গিক। কারণ গত ১১-১৬ জুন জুড়ে বাইডেন জি-৭ আর ন্যাটোর মিটিংয়ে গিয়ে চীনের বিরুদ্ধে যুদ্ধের উসকানি বা হুমকি তুলেছিলেন। অথচ আসল কথাটা এই যুদ্ধের খরচ কে দেবে সেটাই বলেন নাই। অথচ আমরা উপরে দেখলাম যুদ্ধের খরচই আসল। এটাই সেকালে ওই পরিস্থিতিতে একমাত্র বহন করতে সক্ষম ছিল রুজভেল্টের আমেরিকা। তাই ইউরোপ হিটলারের হাতে দখল ও বিলীন হবার বদলে আমেরিকান নেতৃত্বকেই বেটার বিকল্প বোধ করেছিল। আর আমেরিকার স্বার্থ শুধু গ্লোবাল নেতা হওয়া ছিল তা নয়, তার হাতে জমা থাকা বিপুল সারপ্লাস বা উদ্বৃত্ত সম্পদ তখন বিনিয়োগযোগ্য সম্পদ হয়ে উঠেছিল কারণ দুনিয়া তখন কলোনি মুক্ত স্বাধীন। ফলে এরা সকলেই তখন আমেরিকার ঋণের সরাসরি অথবা বিশ্ব ব্যাংকের মাধ্যমে খাতক। আমেরিকা এসব স্বাধীন মুক্ত দেশগুকে ঋণের খাতক হিসাবে পেয়েছিল।