মিয়ানমার ও গণতন্ত্রের অসুস্থতা
সু চি ও সেনাপ্রধান - ছবি সংগৃহীত
গত ২৪ মে বার্মা বা মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নেত্রী অং সান সু চিকে প্রথম দেখা যায়, ১ ফেব্রুয়ারির সেনা অভ্যুত্থানের পরে। কিন্তু সে দেশে গণতন্ত্র কখন ফিরবে কিংবা আদৌ ফিরবে কি না, তা পুরো অনিশ্চিত। সু চি যেমন রাজধানীতে আদালতের ‘আসামি’ হিসেবে হাজিরার মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ করলেন, তেমনি মিয়ানমারে আজ গণতন্ত্র যেন আসামি বা অভিযুক্ত। আর এ অভিযোগ করছেন সে দেশে গণতন্ত্র হত্যার হোতারা, তথা সেনাকর্তারা। সুচি গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলন অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়েছেন।
প্রহসনের বিষয় হলো, অং সান সু চিকে আদালতে অসৎ উদ্দেশ্য প্রণোদিত এক মামলায় কাঠগড়ায় তোলার আগে সামরিক জান্তা জানায়, ‘তিনি সুস্থ আছেন এবং তাকে শিগগিরই আদালতে তোলা হবে।’ মিয়ানমারের মূল সঙ্কট গণতন্ত্রের অসুস্থতা বা রুগ্নতা। সে ব্যাপারে ক্ষমতাসীন সামরিক জান্তা কিছু বলছে না। এদিকে, যখন সু চিকে আদালতে তোলা হয়, প্রায় একই সময়ে দু’টি তাৎপরর্যপূর্ণ ঘটনা ঘটে গেছে সে দেশে। প্রথমত উত্তরে চীন সীমান্তের কাছে কাচিন ইন্ডিপেন্ডেন্ট আর্মির সাথে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সংঘর্ষ এবং অপরটি, সোয়া লাখ শিক্ষককে গণতন্ত্র চাওয়ার ‘অপরাধে’ কর্মচ্যুত করা। মিয়ানমারে গণতন্ত্রের জন্য চলমান আন্দোলন কত ব্যাপক ও সফল, তার একটি বড় প্রমাণ শিক্ষকদের বিপুল সংখ্যায় বহিষ্কার।
সাধারণত এ ধরনের গণতান্ত্রিক সংগ্রামে ছাত্র-ছাত্রী বা শিক্ষার্থীরা অংশ নিয়ে থাকে। এখন সেখানে ছাত্র, শিক্ষক, ডাক্তার, নার্স, ধনী-গরিব, পেশাজীবী, শ্রমজীবী, শিক্ষিত-অশিক্ষিত নির্বিশেষে সব মানুষ গণতন্ত্রের দাবিতে সোচ্চার। তারা সেনাবাহিনীর রাজনীতি করার বিরোধী এবং নির্বাচিত ও সুচির নেতৃত্বাধীন সরকারের হাতে ক্ষমতা ফিরিয়ে দেয়ার সপক্ষে।
ক্ষমতা জবরদখলদার সেনাজান্তার প্রধান জেনারেল মিন অং হ্লাইং হংকংয়ের চীনাভাষার ফনিক্স টিভিকে জানিয়েছিলেন অং সান সু চি সম্পর্কে। ২৩ মে এ খবর প্রকাশ পেয়েছে। হ্লাইং বলেন, সু চির শরীর ভালো আছে এবং তাকে আদালতে তোলা হবে। সাক্ষাৎকারে তিনি আরো বলেছেন, সু চি নিজের বাড়িতেই আছেন। ২২ মে এই সাক্ষাৎকারের কিয়দংশ প্রচারিত হয়। উল্লেøখ্য, প্রায় তিন মাস আগে ১ ফেব্রুয়ারি ক্যু করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল এবং সু চিদের নির্বাচিত সরকারকে হটানো ও তাদের বন্দী করার পর হ্লাইং এবারই প্রথমবারের মতো সাক্ষাৎকার দেন।
হংকং যে চীনের অন্তর্ভুক্ত, সে দেশের বিপুল বিনিয়োগ ও ব্যাপক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি বেইজিং হ্লাইংদের ক্ষমতা দখলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক বলে মনে করা হয়।
তবে সেনাবাহিনীর এই আকস্মিক অভ্যুত্থানের পর থেকেই দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় রাষ্ট্রটিতে উত্তেজনা, বিশৃঙ্খলা, দেশব্যাপী অভূতপূর্ব গণআন্দোলন ও বিক্ষোভ এবং ভয়াবহ গৃহযুদ্ধ মিলে চরম অস্বাভাবিকতা বিরাজ করছে। ইতোমধ্যেই শত শত বেসামরিক লোক নিহত ও আহত এবং কয়েক হাজার মানুষ উদ্বাস্তু ও প্রবাসী হতে বাধ্য হয়েছেন। যুবা-বৃদ্ধ, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে বন্দীর সংখ্যা অজস্র। সর্বশ্রেণীর ও সব পেশার সাধারণ মানুষ দেশের সর্বত্র রাজপথে নেমে নব নব উপায়ে জান্তাবিরোধী এবং গণতন্ত্রপন্থী বিক্ষোভে রত। স্বাধীন মিয়ানমারের ৭৩ বছরের আধুনিক ইতিহাসে এমন পরিস্থিতি আর কখনো দেখা যায়নি।
ফনিক্স টিভির পক্ষ থেকে প্রশ্ন : দেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে অং সান সু চির অবদানকে কোন দৃষ্টিতে দেখছেন? জেনারেল মিন অং হ্লাইং : ‘তিনি (সুচি) সাধ্যমতো চেষ্টা করছেন’। অথচ এই সেনানায়ক অবসরে যাওয়ার প্রাক্কালে, এবং অবসরে গেলে রোহিঙ্গা নিপীড়নের দায়ে আন্তর্জাতিকভাবে যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত হওয়ার সম্ভাবনার মাঝে বিগত পয়লা ফেব্রুয়ারি জোরপূর্বক ক্ষমতা হাতে নিয়েছেন অং সান সু চিসহ অনেক নেতা-নেত্রীকে বন্দী করে। সু চির নামে একাধিক রাজনৈতিক মামলাও দায়ের করা হয়েছে। এখন সুচির বহুল পরিচিত রাজনৈতিক দল, ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্র্যাসিকে (এনএলডি) নির্বাচন থেকে বাইরে রাখার জন্য এর বিলুপ্তি সাধনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে।
২৪ মের আগের শুনানিগুলোতে সু চিকে অনলাইনে ভিডিও লিংক দিয়ে ভার্চুয়ালি উপস্থাপন করা হয়েছিল। অপরদিকে তার আইনজীবীদের সাথে তিনি সরাসরি কথা বলতে কিংবা দেখা করতে পারেন না। তাকে সেনাসদস্যদের সামনে ভিডিও লিঙ্কের সাহায্যে কথাবার্তা সারতে হয়। সরকারের বক্তব্য, চলমান বিক্ষোভ বিশৃঙ্খল বিধায় সরকার পূর্ণ কর্তৃত্ব কায়েম করতে পারেনি, তাই সু চির সাথে আইনজীবীরা ব্যক্তিগতভাবে দেখা করতে পারছেন না।
এবার দুর্ধর্ষ বিদ্রোহী জাতিসত্তা, কাচিনদের হামলা ও সংঘর্ষ প্রসঙ্গ। তারা দীর্ঘদিন অধিকারের জন্য লড়ছে মিয়ানমার সরকারের কেন্দ্রীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে। মিয়ানমার এমনিতেই আর্থ-রাজনৈতিক সঙ্কটে রয়েছে। এর মধ্যে কাচিন আর্মি কর্তৃক রাষ্ট্রীয় আর্মির বিরুদ্ধে হামলা জান্তার উদ্বেগ বাড়িয়ে দিয়েছে। তারা মূল্যবান খনির শহর কামটিতে এ আক্রমণ চালিয়েছে এবং পাল্টা বিমান হামলার শিকার। সামাজিক মাধ্যমে দেখা যায়, হামলাস্থলে ঘন ধোঁয়া উড়ছে। সামরিক বাহিনীর একটি প্রতিষ্ঠানের খনি প্রকল্পের কাছে এবং ভারত থেকে ৩০ মাইল দূরে এ ঘটনা ঘটেছে। সম্প্রতি বিরোধী দল কর্তৃক গঠিত, জাতীয় ঐক্যের সরকারে (এনইউজি) গুরুত্ববহ পদ পেয়েছে কাচিনরা। তারা বহু বছর যাবত লড়ছেন কারেন জাতিসত্তার মতো এবং আত্ম নিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে।
আগামী দিনে ক্ষমতাসীন সরকারের অবস্থান ক্রমবর্ধমানহারে দুর্বল হয়ে পড়ার ফলে কারেন-কাচিন বিদ্রোহী বাহিনীর হামলা ও সরকারের ক্ষয়ক্ষতি বাড়তে থাকবে বলে অনুমিত হচ্ছে। সেই সাথে বাড়বে অভ্যন্তরীণভাবে এবং থাইল্যান্ডসহ প্রতিবেশী দেশগুলোতে উদ্বাস্তুর ভিড়। চীন সরকার কোনো কোনো জাতিসত্তার বিদ্রোহী বাহিনীকে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে তাদেরকে মিয়ানমারে প্রেশার গ্রুপ হিসেবে ব্যবহার করছে বলে ধারণা করা হয়।