ভারত : মহামারী ও সমুদ্রের তরঙ্গ
ভারত : মহামারী ও সমুদ্রের তরঙ্গ - ছবি সংগৃহীত
ভারতে করোনা মহামারীর ভয়াবহ দ্বিতীয় ঢেউয়ের পাশাপাশি একের পর এক ঘূর্ণিঝড় ‘তকতে’ ও ‘যশ’-এর তরঙ্গের যথাক্রমে দেশের পশ্চিম উপকূলে ও পূর্ব উপকূলে আঘাত ও এর শঙ্কা সে দেশের জনজীবনকে বিপর্যস্ত করে তুলেছিল মে মাসের শেষ দিকে। মহামারীর দ্বিতীয় তরঙ্গের মাঝে কালো ও সাদা ছত্রাকজনিত মহামারীও ভারতের কোনো কোনো রাজ্যে আতঙ্কের মহাকারণ হয়ে উঠেছে। এর প্রকোপ দিন দিন বাড়ছে।
একে তো মে মাসের সূচনার আগে থেকেই ভারতে করোনার ছোবল আবার ভয়াবহ, তদুপরি সামুদ্রিক ঝড়ের পুনঃপুনঃ আঘাত যেন ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’। মাত্র কয়েকদিন আগে পশ্চিমে গুজরাট উপকূলে ও মহারাষ্ট্রে ‘তকতে’ নামধারী ঘূর্ণির হামলায় বহুলোক হতাহত ও নিখোঁজ এবং বাড়িঘর ও বৃক্ষসহ বিপুল সম্পদ নাশের সংবাদ পাওয়া গেছে। গুজরাট হচ্ছে কেন্দ্রীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির এলাকা এবং তিনি দীর্ঘ দিন এ প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। আর মহারাষ্ট্রের রাজধানী মুম্বাই নগর গোটা দেশের অর্থনীতি ও সিনেমার রাজধানীরূপে পরিস্থিতি। এবার ২৬ মে ঝড়ের হানা দিয়েছে পূর্বের উড়িষ্যায় ও পশ্চিমে বাংলায়।
ভারতে মহামারীর পুনরায় হানা যখন উন্মত্ততার ক্ষতির ক্ষেত্রে রেকর্ড ভাঙছে, তখন ১৪ মে সোমবার টিভিতে দেখা গেল, বাংলাদেশের পাশের পশ্চিমবঙ্গে (কলকাতা মহানগরীসহ) ঘূর্ণিঝড়ের জন্য সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থা জারি করা হয়েছে। তাই সবাই মহামারী ফেলে আপাতত ঝড়ের ক্ষতি ঠেকাতে ব্যস্ত। টিভি চ্যানেলের খবরে সকালে দেখা গেছে, ঘূর্ণিঝড় প্রতিরক্ষাসেবীরা মাইকে জরুরি প্রচার করছেন পিপিই পরিধান করে। তাই তাদের চোখ দুটোও ঠিকমতো দেখা যাচ্ছিল না। একই সাথে খবর, ঝড়ের প্রস্তুতির মধ্যে ভারতের রেল শিডিউলের লণ্ডভণ্ড দশা এবং কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার প্রস্তুতি বৈঠকের পাশাপাশি উড়িষ্যার ২০ হাজার মানুষকে আগেই সরিয়ে নেয়া হয়েছে ঝড় থেকে বাঁচাতে।
ভারতে ভাইরাসবাহী কোভিড-মহামারীর দ্বিতীয় ঢেউ ওঠার পর পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার নেয় বিশেষত এপ্রিল মাসে এবং মে মাসের পুরো প্রথমার্ধে। এরপর এটা রাজ্যভেদে দেশটিতে ওঠানামা করেছে। যেমন, ২৪ মে সকালে এনডিটিভি চ্যানেল জানায়, করোনাভাইরাসজনিত মহামারী, অর্থাৎ কোভিড সংক্রমণের সংখ্যার দিক দিয়ে ‘বাংলা’ বা পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশ একটানা ৯ দিন পার করেছে ২০ হাজারের কম মানুষ আক্রান্ত হয়ে। মে মাসে এ প্রদেশে মমতা ব্যানার্জির তৃণমূল কংগ্রেস দল পরপর তিনবার বিধানসভা নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পরই খবর আসে, মুখ্যমন্ত্রী মমতার এক ভাই করোনায় মারা গেছেন। এদিকে, রাজ্যটিতে কড়া লকডাউন চলে মাস শেষ হওয়ার পরও যখন সরকারি পরিবহন এবং গণপরিবহন পর্যন্ত বন্ধ থাকে। রাতের বেলায় ই-কমার্সও ছিল বন্ধ। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তো দীর্ঘদিন চলছে না। খুব জরুরি দোকানপাট দিনে খোলার অনুমতি মেলে। এর মধ্যেই প্রচণ্ড ঘূর্ণিঝড় যশ মোকাবেলার প্রস্তুতি নিতে হয়। অনেক গণমাধ্যম অবশ্য ‘যশ’কে ‘ইয়াস’ বলে অভিহিত করেছে। বাংলাদেশেও ঝড় মোকাবেলায় ব্যাপক প্রস্তুতি নেয়া হয়েছিল।
২৪ মে এনডিটিভি দাবি করেছে, রাজধানী দিল্লিতে কোভিড-সংক্রমণ ৩০ মার্চের পর ‘সর্বনিম্ন পর্যায়ে’, এ রোগে আক্রান্ত হয় নতুন করে এক হাজার ৬৪৯ জন। তবে ভারত নামক দেশটির দক্ষিণাঞ্চলের তামিলনাড়–, কর্নাটক, প্রভৃতি রাজ্যে পরিস্থিতি ‘মোটেও ভালো নয়’ বলে জানা যায়। ২৩ মে কর্নাটকে একদিনেই মারা যায় ৬২৬ জন যা একটি রেকর্ড। এ রাজ্যের রাজধানী বেঙ্গালুরুতে একই সময়ে ৩৬২ জনের মৃত্যুও অত্যধিক উদ্বেগজনক। সেখানে তখন নতুন সংক্রমণের সংখ্যা সাত হাজার ৪৯৪। দক্ষিণের তামিলনাড়– রাজ্যেও পরিস্থিতি খুব খারাপ। সে প্রদেশে একদিনে (২৩ মে ২০২১) মহামারীতে প্রাণ হারায় ৪২২ জন।
এ রাজ্যে নয়া সংক্রমণ ২০ হাজার ৪৬টি। এ অবস্থায় ২৪ তারিখে আপাতত এক সপ্তাহের কঠোর লকডাউন শুরু করা হয়েছে। এ রাজ্যের রাজধানী মহানগরী চেন্নাইয়ে একদিনে ৮১ জনের কোভিডে মৃত্যুর পাশাপাশি এর সংক্রমণ বিপজ্জনক মোড় নেয় ২৩ মে। অন্যদিকে, দেশের বাণিজ্যিক রাজধানী মুম্বাই মহানগরে কোভিড পজিটিভ হওয়ার ক্ষেত্রে রেকর্ড সৃষ্টি হয় (৬.১৩ শতাংশ)। যখন ভারতে কোনো কোনো রাজ্যে বা প্রদেশে লকডাউনের কড়াকড়ির ফলে সাইকেল পর্যন্ত চলতে পারে না, তখন অনেক এলাকায় শিশুরাও মহামারীতে আক্রান্ত হওয়া বিরাট দুঃসংবাদ বটে। যেমন- তেলেঙ্গানার রাজধানী হায়দ্রাবাদ সিটিতে একটা দুগ্ধপোষ্য শিশুও কোভিডে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল। অবশ্য সে পরে সুস্থ হয়েছে। অন্যদিকে, শতবর্ষী বৃদ্ধা ঢোলি দেবী টিকা নিয়েছেন উত্তরের জম্মুতে। তিনি সুস্থ থাকার কথা জানালেন।
উল্লেখ্য, কোভিড মহামারীতে বিশ্বে মৃত্যুর দিক দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আর ব্রাজিলের পরই আমাদের পড়শি ভারতের অবস্থান। ভারতে এই ভাইরাসে মৃতের সংখ্যা তিন লাখ ছাড়িয়ে যায় মে মাসের চতুর্থ সপ্তাহের শুরুতে। দেশের স্বাস্থ্যসেবা ও চিকিৎসাব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে বলে জানা যায়। তা ছাড়া, কোভিডে মৃত ও সংক্রমিতের সংখ্যা এবং এ পরীক্ষায় সুস্থতার হার নিয়ে যে সরকারি পরিসংখ্যান দেয়া হয়ে থাকে, তা-ও জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি ‘স্বল্পতার’ অভিযোগে।
উল্লেখ্য, ভারতের গুরুত্বপূর্ণ টিভি চ্যানেল এনডিটিভি দিন-রাত এই মহামারী পরিস্থিতি অনবরত ব্রেকিং নিউজসহ তুলে ধরেও কুলাতে পারছে না। তারা সরকারের প্রাসঙ্গিক নানা ত্রুটিবিচ্যুতির ওপরেও ব্যাপক আলোকপাত করছে। এদিকে, মহারাষ্ট্রে (মুম্বাইসমেত) পরিস্থিতির চরম অবনতি সত্ত্বেও প্রধানত বাণিজ্যিক কারণে প্রচারিত, বিনোদনমূলক ভারতীয় টিভি চ্যানেলের প্রোগ্রাম দেখে মনেই হয় না যে, এ দেশে করোনা মহামারী ‘দ্বিতীয় তরঙ্গ’ তুলে জনজীবন বিপর্যস্ত করে ফেলেছে।