কিসিঞ্জার-বাদশাহ ফয়সালের চুক্তিতে যেভাবে জন্ম হলো পেট্রোডলারের
কিসিঞ্জার-বাদশাহ ফয়সালের চুক্তিতে যেভাবে জন্ম হলো পেট্রোডলারের - ছবি সংগৃহীত
বর্তমান সময়ে বহুল আলোচিত একটি পরিভাষা পেট্রো ডলার। কিন্তু জানেন কি পেট্রো ডলার আসলে কী?
১৯৪৪ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিকে জুলাই মাসে নিউ হ্যামপাশায়ারে ব্রেটন উডস সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলন পরবর্তী পৃথিবীর অর্থব্যবস্থার গতিপথ ঠিক করে দেয়। এই সম্মেলনে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
১. আইএমএফ ও আইবিআরডি গঠন।
২. আন্তর্জাতিক মুদ্রা হিসেবে ডলারকে গ্রহণ।
৩. যেকোনো প্রকার লেনদেনে স্বর্ণ ব্যবহার করা যাবে না।
দেশগুলো আমেরিকাকে তাদের মোট মজুদ স্বর্ণের একটা পরিমাণ দেয় (২০%)। বিনিময়ে আমেরিকা তাদেরকে দেয় ডলার। এক আউন্স স্বর্ণের বিপরীতে ৩৫ ডলার দেয়া হয়।
এই ডলার রিডিমেবল অর্থাৎ যেকোনো দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক আমেরিকার কেন্দ্রীয় ব্যাংককে ডলার দিয়ে স্বর্ণ গ্রহণ করতে পারবে। ডলার এবং স্বর্ণের হার একই, ১ আউন্স স্বর্ণ = ৩৫ ডলার। নিয়ম অনুসারে আমেরিকার নতুন ডলার ছাপতে হলে এই হারে স্বর্ণ মজুদ করতে হবে।
কিন্তু আমেরিকা এই শর্ত লঙ্ঘন করে ইচ্ছামতো ডলার ছাপতে শুরু করে। ফলে মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেয়৷ ১৯৬৬ সালে অন্যান্য দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর কাছেই ডলার রিজার্ভের পরিমাণ হয়ে দাঁড়ায় ১৪ বিলিয়ন ডলার। তখন আমেরিকার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে মাত্র ১৩.২ বিলিয়ন ডলারের সম-মূল্যের স্বর্ণ ছিল। ব্রেটন উডস চুক্তি একটা হঠকারী পদ্ধতিতে পরিণত হয়। ক্যালিফোর্নিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ব্যারি আইসেনগ্রিন এই পদ্ধতির সমালোচনা করে বলেছিলেন, 'আমেরিকার ১০০ ডলার ছাপতে মাত্র কয়েক সেন্ট প্রয়োজন হয় কিন্তু অন্য দেশগুলোকে ১০০ ডলার পেতে সমপরিমাণ প্রকৃত সম্পদ দরকার হয়।'
এই মুদ্রাস্ফীতি অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায় যখন ভিয়েতনাম যুদ্ধের খরচ মেটাতে আমেরিকা প্রচুর ডলার ছাপে। (এক আউন্স স্বর্ণের দাম ৭০০ ডলার ছুয়ে যায়। ব্রেটন উডস চুক্তি অনুসারে আমেরিকা ৩৫ ডলারের বিপোরিতে ১ আউন্স স্বর্ণ দিতে বাধ্য)। ফলাফল প্রথমে ফ্রান্স পরে জার্মানি, সুইজারল্যান্ডসহ কয়েকটি দেশ আমেরিকার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে ডলার রিডিম করার জন্য প্রেরণ করে। আমেরিকার অর্থনীতিতে একটা বিশাল ধাক্কা লাগে৷ একটা আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে যে বাকি দেশগুলোও ডলার রিডিম করার জন্য লাইন ধরতে পারে। আমেরিকার কাছে তখন যথেষ্ট পরিমাণে স্বর্ণ ছিল না।
ফলে আমেরিকা একটা দেউলিয়া রাষ্ট্র হবার যোগাড় হয়। প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ভয়াবহ সঙ্কটে পড়েন। জার্মানি ব্রেটন উডস চুক্তি থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে। ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশ জার্মানিকে অনুসরণ শুরু করে।
ঠিক ওই সময়ে আমেরিকার সামনে ত্রাতা হিসেবে অবির্ভূত হয় সৌদি আরব।
আমেরিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার ও সৌদি আরবের বাদশাহ ফয়সালের চুক্তি করেন যে এখন থেকে সৌদি আরব তেল বিক্রি করবে শুধুমাত্র ডলারে৷ সৌদি আরব তার প্রভাবধীন তেল রফতানিকারক দেশগুলোকেও ডলারে তেল বিক্রি করতে রাজি করে ফেলে। তারা সিদ্ধান্ত নেয় যে তেল বিক্রি করবে শুধু মার্কিন ডলারে। অর্থাৎ আপনি আপনি জাহাজ ভরে বাংলাদেশী টাকা, মালেশিয়ান রিনগিট, পাকিস্তানি রুপি বা তুর্কি লিরা নিয়ে গেলেও সৌদি বাদশাহ ফয়সাল আপনাকে এক ছটাক তেলও দেবেন না। শুধুমাত্র ডলার নিয়ে গেলে দেবেন। এবং জন্ম হয় পেট্রো ডলারের৷ এই তেলই স্বর্ণের কাজ করছে। এবার আর আমেরিকার ডলার ছাপতে স্বর্ণ জমা রাখার কোনো বাধ্য বাধকতা নেই।
তেল হলো পৃথিবীর সবচেয়ে প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ পণ্য। সবারই তেল দরকার। তাই তেল কেনার জন্য সব দেশই ডলার রিজার্ভ রাখতে অনেকটা বাধ্য হয়ে যায় এবং ডলার আন্তর্জাতিক মুদ্রা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। আমেরিকা নিজের প্রয়োজন মতো ডলার ছাপতে থাকে এবং মুদ্রাস্ফীতিও চলতে থাকে। বর্তমানে এক আউন্স স্বর্ণের দাম ১,৫৩৩ ডলার।