এস -৪০০ এবং তুরস্ক-যুক্তরাষ্ট্র দ্বন্দ্ব
এস-৪০০ ও এরদোগান - ছবি সংগৃহীত
সাম্প্রতিক বৈশ্বিক ঘটনাবলির একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো ন্যাটো শীর্ষ সম্মেলনের সময় জো বাইডেন ও রজব তৈয়ব এরদোগানের শীর্ষ সম্মেলন। এই শীর্ষ সম্মেলন কতটা সফল বা বিফল তা নিয়ে আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের নানা মন্তব্য রয়েছে। দুই নেতাই আলোচনা ‘গঠনমূলক ও ইতিবাচক’ পরিবেশে অনুষ্ঠিত হয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন। তবে বৃহত্তর ঐকমত্য না হলে কূটনৈতিক ভাষায় এই দুটি শব্দের ব্যবহার প্রায়ই লক্ষ করা যায়।
তুরস্কের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের যেসব ইস্যু রয়েছে সেগুলো একেবারেই এতটা সহজ নয় যে, তা নিয়ে সমঝোতায় পৌঁছা দ্রুত হয়ে যাবে। এই ইস্যুগুলোর মধ্যে একটি হলো, সিরিয়া ও ইরাকের কুর্দি বিচ্ছিন্নতাবাদী গ্রুপ ওয়াইপিজি ও পেশমার্গাকে আমেরিকার সমর্থন দেয়া। তুরস্কের বিচ্ছিন্নতাবাদী কুর্দি গ্রুপ পিকেকের সাথে সংশ্লিষ্ট এ দুটি গ্রুপকে আইএস দমনের অজুহাতে যুক্তরাষ্ট্র সমর্থন করে অথচ তাদের আঙ্কারা সন্ত্রাসী গোষ্ঠী এবং অখণ্ডতার জন্য হুমকি বলে মনে করে। আঙ্কারা এসব সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর প্রতি ওয়াশিংটনের সমর্থনকে কোনোভাবেই স্বাভাবিক মনে করে না। তাদের মধ্যে এ সংশয়ও রয়েছে যে, সিরিয়ার সমস্যা সমাধানে ওয়াশিংটনের আন্তরিকতার অভাব রয়েছে। একসময় বাশার আল আসাদের সরকার পতনের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছলে সিরিয়া দেশটিতে রুশ হস্তক্ষেপে পুরো ভারসাম্য পাল্টে যায়, বোমা হামলায় লক্ষ লক্ষ সিরীয় নিহত হয়। বাশার সরকারকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে আমেরিকান নীরব সম্মতিতে এটি ঘটেছে বলে আঙ্কারার অনেক বিশ্লেষক মনে করেন। এ ঘটনায় মধ্যপ্রাচ্যের দুই প্রভাবশালী ক্রাউন প্রিন্স সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। অথচ তুরস্কে থাকা সিরিয়ার প্রায় চার মিলিয়ন উদ্বাস্তুর জন্য নিরাপদ জোন গঠনের ব্যাপারে ওয়াশিংটনের সমর্থন লাভ তখন অনেক কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। ওবামা-বাইডেন প্রশাসন এ ব্যাপারে একবারেই কোনো সাড়া দেয়নি। ট্রাম্পের সময় এসে এ নিয়ে একটি চুক্তি হয়।
তুরস্ক চাইছে সিরিয়ার অখণ্ডতার কাঠামোর মধ্যে এমন একটি রাজনৈতিক সমাধান নিশ্চিত করতে যাতে সব উদ্বাস্তু নিরাপত্তাসহ সম্মানের সাথে নিজ দেশে ফিরতে পারে । আর সেটি নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত ইদলিব, আফরিন ও উত্তর সিরিয়ায় সিরীয় উদ্বাস্তুদের জন্য নিরাপদ জোন বহাল রাখা। বাইডেন সম্ভবত এখন চাইছেন প্রয়োজনে শক্তি প্রয়োগ করে বাশার আল আসাদকে ক্ষমতা থেকে বিতাড়িত করা। আর এক্ষেত্রে ন্যাটোর অংশ হিসাবে তুরস্কের মুখ্য ভূমিকা নেয়া। কিন্তু বাস্তবতা হলো এটি হওয়া মানে, মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের সাথে তুরস্কের সর্বাত্মক সংঘাত তৈরি হওয়া, একই সাথে রাশিয়ার সাথে বোঝাপড়ার যে সম্পর্ক এর মধ্যে তৈরি হয়েছে সেটিও ভেঙে পড়া। তুরস্কের কৌশলগত ডকট্রিনের সাথে কোনোভাবেই এটি যায় না।
তুরস্কে এটি ব্যাপকভাবে বিশ্বাস করা হয় যে, ২০১৬ সালের যে সামরিক অভ্যুত্থান প্রচেষ্টা তার পেছনে ওবামা-বাইডেন প্রশাসনের প্রচ্ছন্ন সমর্থন ছিল। আর বাইডেন তার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারণার সময় তুরস্কে গণতান্ত্রিকভাবে পরিবর্তন আনতে সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। এ অবস্থায় আমেরিকার হয়ে এমন যুদ্ধে নামা তুরস্কের জন্য আত্মঘাতী হতে পারে যাতে দুই প্রতিবেশী ইরান-রাশিয়া ক্ষুব্ধ প্রতিপক্ষ হবে আর সময় বুঝে ওয়াশিংটনের জন্য এরদোগানকে গাছে তুলে দিয়ে মই সরিয়ে নেয়ার সহজ সুযোগ তৈরি হবে।
রাশিয়ার কাছ থেকে এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র কেনার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র বিশেষত বাইডেন প্রশাসনের অনমনীয় অবস্থান গ্রহণের সাথে ন্যাটোর সিদ্ধান্তের অধীনে থাকতে তুরস্ককে চাপ প্রয়োগের একটি সম্পর্ক রয়েছে। তুরস্ক চেয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র বা ন্যাটো তুরস্ককে বাইরে ঠেলে দিতে চাইলে আঙ্কারার সামনে যাতে বিকল্প বৈশ্বিক বলয়ে যাওয়ার সুযোগ থাকে। এ কারণে ন্যাটো বলয়ে থেকেও রাশিয়া ও চীন উভয়ের সাথে সীমিত পর্যায়ের সম্পর্ক রক্ষা করে গেছে দেশটি। যুক্তরাষ্ট্র যখন প্যাট্রিয়ট ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহে অস্বীকৃতি জানিয়েছে তখন রাশিয়ার সাথে এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে আঙ্কারা চুক্তির দিকে গেছে। এর প্রতিক্রিয়া হিসেবে, এস-৩৫ বিমানের জন্য অর্থ পরিশোধের পরও তা সরবরাহ করেনি আমেরিকা। এ ইস্যুতে এরদোগান বাইডেনের সাথে বৈঠকের সময় কোনো রাখঢাক না রেখেই কথা বলেছেন। তুর্কি প্রেসিডেন্ট জানিয়েছেন, এস-৪০০ নিয়ে ভিন্ন কিছু বিবেচনার অবকাশ নেই।
আমেরিকার জন্য আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হলো আফগানিস্তান। বাইডেন সম্ভবত চাইছেন, তুরস্ক ন্যাটো সদস্য হিসেবে আমেরিকান সেনা প্রত্যাহারের পর কাবুল বিমান বন্দরের নিরাপত্তার দায়িত্ব গ্রহণ করুক। আঙ্কারা এ ব্যাপারে ইতিবাচক সাড়া দিলেও তালেবানদের এতে সম্মত থাকার বিষয় রয়েছে। সব বিদেশী সেনা প্রত্যাহার শেষে দ্বিপাক্ষিকভাবে তুরস্কের সাথে সমঝোতা চায় বলে মনে হয় আফগান তালেবান। তবে বৃহত্তর ইস্যুগুলোতে বিশেষত সিরিয়া ইরাক লিবিয়া ফিলিস্তিন বিষয়ে সমঝোতা ছাড়া ন্যাটো সদস্য হিসেবে তুরস্ক এমন কোনো ভূমিকা নিতে চাইবে বলে মনে হয় না যাতে তালেবান অথবা ইরান রাশিয়ার মুখোমুখি দাঁড়ানোর অবস্থা তৈরি হয়। রাশিয়াও আফগানিস্তানে ন্যাটোর যেকোনো দেশের সেনা রাখার বিপক্ষে।
তুরস্কের কৌশলগত লক্ষ্য হলো মুসলিম দেশগুলোর হানাহানি বন্ধ করে একটি অভিন্ন সহযোগিতার শক্তিবলয় তৈরি করা যা তাদের নিরাপত্তার জন্য ভিন্ন কারো মুখাপেক্ষী হওয়া থেকে নিষ্কৃতি দেবে। একই সাথে পূর্ব ভূ-মধ্যসাগর, লিবিয়া, আজারবাইজানের নাগার্নো-কারাবাখে দেশটির স্বার্থ রক্ষা করেই উত্তেজনার প্রশমন করা। যুক্তরাষ্ট্র সম্ভবত তুরস্কের ন্যাটোর সিদ্ধান্তের অধীন কোনো ভূমিকা প্রত্যাশা করে। এ ধরনের প্রত্যাশা তুরস্ককে দিয়ে পূরণ করার আশা নেই। আর সেটি না পেরে তুরস্কে রাজনৈতিক বা গুলেনিস্ট শক্তিকে কাজে লাগিয়ে একেপি সরকারের পতন ঘটিয়ে ফেলবে, সেই অবস্থাও সম্ভবত এখন আর নেই।
বরং আঞ্চলিক স্বার্থ রক্ষা করতে হলে যুক্তরাষ্ট্রের অবশ্যই প্রয়োজন হবে তুরস্ককে। ইরানের সাথে সমঝোতায় গিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের বিদ্যমান অবস্থাকে উল্টে দেয়ার ব্যাপারে একসময় যে আমেরিকান উদ্যোগের কথা শোনা যাচ্ছিল সেটি এখন আর বাস্তব কোনো বিষয় নেই। যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন ঘাঁটি থেকে তার সেনা প্রত্যাহার করছে। তার মিত্র দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য প্রত্যাহারের বিষয় সামনে রেখে সমান্তরালভাবে বিকল্প বিশ্বশক্তির সাথে সম্পর্ক রাখছে। এই অবস্থায় তুরস্ক তার নিজস্ব ও উম্মাহর স্বার্থ সামনে রেখে সম্পর্কের বিষয় সাজাবে বলে আভাস পাওয়া যাচ্ছে। এই নীতিতে অটল থাকতে পারলে মধ্যপ্রাচ্যের আঞ্চলিক শক্তি হিসাবেই নয়, সে সাথে বৈশ্বিকভাবে প্রভাব সৃষ্টিকারী শক্তি হিসাবে তুরস্কের আবির্ভাব ঘটতে পারে।