কী ঘটছে পাহাড়ে?
ওমর ফারুক ত্রিপুরা - ছবি সংগৃহীত
পাহাড়ি নওমুসলিম ওমর ফারুক ত্রিপুরা হত্যার ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রতিবাদ হলেও এখনো পর্যন্ত সরকার কিংবা জাতীয় রাজনীতিবিদদের কারো কোনো প্রতিবাদ বা বক্তব্য চোখে পড়েনি। উপজাতি বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র গোষ্ঠী পাহাড়ের মুসলিম এবং উপজাতিদেরই অপরাংশের লোক হত্যা নতুন কিছু নয়। এই ঘটনা একদমই ব্যতিক্রম। ওমর ফারুকের দাওয়াতে ৩০টি পরিবার ইসলাম ধর্মে দিক্ষিত হয়। ধর্মান্তর নিয়ে কেউ কেউ কথা তুলছেন। বিষয়টি খোলাসা করে বোঝার জন্য পাহাড়ের আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় অবস্থা সম্পর্কে জানতে হবে। সমতলের বেশির ভাগ মানুষ যা জানে, তা বামদের কল্যাণে এবং তা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও একচেটিয়া। ফলে তারা বুঝতেই পারবেন না, সেখানকার উপজাতিরা কেন ইসলাম গ্রহণ করছেন। খ্রিষ্টান মিশনারিরা একই কাজ করে আসছে পাহাড়ে বহু বছর ধরে। তারা অনেক সুবিধাদি দিচ্ছে, কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করছে। তা সত্ত্বেও লোকেরা মুসলিম হবে কেন? বিশেষ করে শান্তি চুক্তির পরও যখন বাঙালিদের সাথে উপজাতিদের একাংশের রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব টিকে আছে এমতাবস্থায় উপজাতিদের মুসলিম হওয়ার বেশ কিছু কারণ রয়েছে।
প্রথমত, উপজাতি নেতাদের স্বেচ্ছাচারী মনোভাব, গরিব শ্রেণীর নাগরিকদের দাস মনে করার প্রবণতা এবং খ্রিষ্টানকরণ প্রকল্প।
২০১২ সালে খাগড়াছড়িতে একজন ধর্মান্তরিত খ্রিষ্টান ত্রিপুরা যুবক আমার (এই লেখকের) কাছে আসে ইসলাম গ্রহণ করবে বলে। সে তার পুরো পরিবারের দুরবস্থার কথা জানায় এবং পুরো ফ্যামিলিসহ ইসলাম গ্রহণ করার আগ্রহ প্রকাশ করে। সে জানায়, তার বাবা-মা-ভাইবোনসহ পুরো ফ্যামিলি ইসলাম গ্রহণ করলে ছোট তিন ভাইবোনকে এতিমখানায় ভর্তি করে দেবে। এই লেখকের সাথে টানা এক মাস সে যোগাযোগ রাখে। পরিবারের দুঃখ-দুর্দশার কথা সে জানায়। কেমন করে সে খ্রিষ্টান হলো তাও বলে। তার গল্প শুনে মনে হয়েছিল, প্রকৃতির মতো সরল, দরিদ্র ও নিরীহ উপজাতিরা তাদের ধূর্ত নেতাদের মাধ্যমে স্রেফ বিক্রি হয়ে গেছে! স্বজাতির নেতাদের কাছেও এরা ক্রীতদাসের বেশি কিছু নয়। মিশনারিদের থেকে বিরাট অঙ্কের সুবিধা পেয়েছে তাদের কথিত নেতারা। ওই যুবক বেশি কিছু বলতে আগ্রহী নয়, কেমন যেন একটা চাপা ভয় তার ভেতরে। তার একটাই কথা নিজে খ্রিষ্টান হলেও, সে চায় না তার পরিবারের আর কেউ খ্রিষ্টান হোক এবং সে নিজেও ইসলাম গ্রহণ করতে আগ্রহী।
অনেক ভেবেচিন্তে একদিন এই ব্যাপারটা একজন প্রভাবশালী ইসলামী দলের নেতার কাছে উত্থাপন করি। তিনি আমাকে একটা যৌক্তিক জবাব দেন এবং কিছু পরামর্শ দেন। তবে কিছু করার ব্যাপারে নিজের অপারগতার কথাও বলেন। বলেন, এখন আমার উদ্যোগে কিছু হলেই হইচই পড়ে যাবে। কার সাথে কোন সোর্স লাগানো থাকে বলা মুশকিল। তাছাড়া বলা হবে, পাহাড়ে অমুক পার্টির লোকেরা উপজাতিদের ধর্মান্তরিত করছে। তারপর শুরু হবে নতুন ঝামেলা। তিনি আমাকে বললেন, ওই ফ্যামিলিকে তুমি পরামর্শ দাও, যেন কোনো আইনজীবীর কাছে গিয়ে আইনি প্রক্রিয়ায় এভিডেভিড করে মুসলমান হয়ে যায়। তারপর ওর ছোট ভাইবোনদের এতিমখানায় ভর্তি নিয়ে ঝামেলা কিছুই হবে না। বাদবাকি বিষয় চেয়ারম্যান-মেম্বারদের সাথে যোগাযোগ করলেই হবে। এ পরিস্থিতিতে আমরা কিছু করার কথা ভাবতে পারি না।
তার কথা অযৌক্তিক নয়। ’১২ সালে তাদের রাজনৈতিক অবস্থার কথা আমার ভালোই জানা ছিল। ফলে মুসলিম হওয়ায় সহযোগিতা দূরে থাক, জাস্ট মানুষ হিসেবে একটা অসহায় উপজাতি ফ্যামিলির জন্য কিছু না করতে পারার দুঃখ ও হতাশা নিয়েই তার কাছ থেকে আমি চলে আসি।
উপরের অংশটুকু যারা মনোযোগ দিয়ে পড়েছেন তারা নিশ্চয়ই এই ফ্যামিলির ইসলাম গ্রহণ করতে চাওয়ার কারণ বুঝতে পেরেছেন।
পাহাড়ের উপজাতিদের সমাজ না মাতৃতান্ত্রিক, আর না পিতৃতান্ত্রিক। আগের দিনে উপজাতি পুরুষরা বনে শিকার করতে যেত, নারীরা সামলাতো বাসাবাড়ি, বাচ্চাকাচ্চা, বাজারসদাই এবং আরো আরো কাজ। নারীরা পুরুষের তুলনায় এত বেশি কাজ করেও কিন্তু পরিবারের প্রধান ছিল না, মানে পরিবারটি মাতৃতান্ত্রিক ছিল না। এখনকার দিনে জুমচাষের নাম করে শত শত বছরের অরণ্য পুড়িয়ে ধ্বংস করার ফলে শিকারের উন্মুক্ত বনভূমি আর আগের মতো নেই বললেই চলে। বন ধ্বংস হওয়ার সাথে সাথে ধ্বংস হয়েছে বন্যপ্রাণীদের বসবাস ও বংশবিস্তারের জায়গা। হারিয়ে গেছে বুনো হরিণ, বনমোরগ, বনরুই, ভালুক, চিতাবাঘ, সাপ, শুকরসহ হাজারো বন্যপ্রাণী। এখন যেটুকু বন টিকে আছে, তাতেও আগের মতো শিকার পাওয়া প্রায় অসম্ভব। ফলে আজকের সময়ে উপজাতি পুরুষদের শিকারেও যাওয়া হয় না। নারীরা আজীবন যেসব কাজ করে এসেছে তাও এই পুরুষরা করতে পারে না, প্রেস্টিজ ইস্যু! ফলে নারীদের কাজ আগের মতো সমান থাকলেও, কর্মহীন পুরুষরা টইটই করে ঘোরে, মদ-জুয়া নিয়ে পড়ে থাকে আর মাতাল অবস্থায় নারীদের ওপর পাশবিক নির্যাতন চালায়। ইতিহাসের ঠিক কোন যুগে নারীরা এতটা অবমূল্যায়িত ও নির্যাতিত হয়েছে বলা মুশকিল। এ নারীরা এবং এসব পরিবারের তরুণী-যুবতী মেয়েরা বাঙালি এলাকার খোঁজ খবরও অল্পবিস্তর জানে।
স্কুল-কলেজ-ইউনিভার্সিটিতে যেসব মেয়ে পড়ে, তারা খুব কাছ থেকে বাঙালি পরিবারের ছেলেমেয়েদের সাথে মেশার সুযোগ পায়। তারা নিজেদের কমিউনিটির নারীদের এবং বাঙালি নারীদের মধ্যে অধিকারের প্রশ্নে আকাশ-পাতাল ফারাক দেখতে পায়। ফলে, স্বাভাবিক কারণেই, উপজাতি তরুণীরা-নারীরা বাঙালি যুবকদের সাথে সম্পর্ক পাতাতে চায় এবং সংসার গড়ার স্বপ্ন দেখতে থাকে। ফলে মুসলিম হয়ে পরিবার গঠন করেছে, বাচ্চাকাচ্চা হয়েছে এবং তাদের নিজেদের বাচ্চাকাচ্চাও কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে এমন খবরও পাহাড়ে এখন বিরল নয়।
উপজাতিদের নিয়ে বাম দলগুলোর রাজনৈতিক প্রকল্প আলাদা এবং উদ্দেশ্য অস্পষ্ট ও সন্দেহজনক। উপজাতীয় আঞ্চলিক সংগঠনের সেন্ট্রাল কোনো মিটিংয়ে আওয়ামী লীগ-বিএনপি নেতাদের দেখা না গেলেও চিফ গেস্ট হিসেবে বাম নেতাদের থাকতে দেখা যায়! উপস্থিত থাকাটা খারাপ কিছু নয়। কিন্তু উপজাতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের হামলায় পাহাড়ের কোনো বাঙালি পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হলেও তাদেরকে উপজাতিদের পক্ষেই সাফাই গাইতে দেখা যায়! আমি খোঁজ নিয়ে জেনেছি, খ্রিষ্টান মিশনারিদের স্বার্থের সাথে বামদের স্বার্থগত একটা মিল আছে। খ্রিষ্টানরা সুবিধাদি দিয়ে উপজাতিদের যেমন খ্রিষ্টান করে নিচ্ছে সহজেই, তেমনি দলীয় দাওয়াতি তৎপরতা চালিয়ে দরিদ্য ও নিরীহ উপজাতিদের ধর্মচ্যুত করে দল শক্তিশালী করার প্রয়াস পাচ্ছে বাংলাদেশের বামরা। বামদের এই কাজের সাথে যেমন উপজাতীয় নেতাদের হাত আছে, তেমনি হাত আছে মিশনারিদের সাথেও। ভেতরকার এই বেচাবিক্রিটা বা মেরুকরণের এই প্রক্রিয়াটা উপজাতীয় সচেতন শ্রেণীর জন্য ভীতিকর। ফলে তারা পারছে না খ্রিষ্টান হতে, আর না পারছে বামদলে গিয়ে নীরিশ্বরবাদী হতে। অন্যদিকে তারা বাঙালি মুসলমানদের জীবনাচরণের সৌন্দযের প্রতি আকৃষ্ট। ফলে তারা ইসলাম গ্রহণ করার ঝুঁকিটাই বেছে নিচ্ছে।
পাহাড়ে ইসলাম গ্রহণ করা কীরকম ঝুঁকিপূর্ণ, সে সম্পর্কেও একটু বলা দরকার। পুরুষ-নারী কেউ ইসলাম গ্রহণ করলে সে তার অবশ্যম্ভাবী পরিণামের কথা আগে থেকেই জানে। ফলে সে মেয়ে হলে স্বামীর সাথে দূরে কোথাও চলে যায়। এলাকায় স্বামীর সাথে থাকলে তাদের তুলে নিয়ে আত্মীয় স্বজন সবার থেকে দূরে আটকে রেখে অমানসিক নির্যাতন করা হয়। উপজাতীয় যুবকদের কর্তৃক নওমুসলিম নারীকে স্বামীর বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গণধর্ষণের ঘটনাও আছে। মুসলিম যদি পুরুষ হয় তাকেও নির্মম কায়দায় নির্যাতন করে পূর্বতন ধর্মে ফেরানোর চেষ্টা চালায় উপজাতি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীটি। শেষ পর্যন্ত হত্যা করা হয়। মুসলিম ক্লাসমেটের সাথে একসাথে হেঁটে আসছে, এমন দৃশ্য কোনো উপজাতীয় যুবকের চোখে পড়লে ওই মেয়েরছেলের আর নিস্তার নেই। সম্প্রতি এরকম একটা ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছিল।
উপরে উপজাতিদের ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার এবং তাদের ইসলাম গ্রহণ করার ক্ষেত্রে (এই লেখকের দৃষ্টিতে) তিনটা প্রধান কারণ খুব সংক্ষেপে বলার চেষ্টা করলাম। আরো অনেক কারণ রয়েছে। এই স্বল্পপরিসরে বিস্তারিত বলা যাচ্ছে না। ওমর ফারুক ত্রিপুরাকে হত্যা করা হয়েছে ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি করতে, যেন নতুন করে কেউ ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলিম হওয়ার সাহস না করে। কিন্তু উপজাতিরা নিজেরাই বহু বছরে নিজেদের অস্তিত্ব বিলুপ্তির পথ ধরে বহুদূর এসে গেছে। ভীতি প্রদর্শনের এ নীতি কাজে আসবে না।
পাহাড়ে বাঙালিরা জমি দখল করছে আর সেনাবাহিনী নারী ধর্ষণ করে- এমন গালগল্প ছাড়নোর বহু চেষ্টা হয়েছে। বাস্তবে বাংলাদেশের যেকোনো জায়গার ভূমি দখলই অনেক সহজ। পাহাড়ের জমি বেচাবিক্রি এবং মালিকানার ব্যাপার প্রায় পুরোটাই উপজাতিদের হাতে। জেলা পরিষদ আইন মোতাবেক সেখানে তারা গর্বিত ‘উপজাতি’! আবার নিজেরাই নানা ক্ষেত্রে নিজেদের ‘আদিবাসী’ও দাবি করে থাকেন যা স্ববিরোধী এবং হাস্যকর।
ধর্মের ব্যাপারে পাহাড়িদের পূর্ণ স্বাধীনতা থাকতে হবে। হোক তা মুসলিম বা উপজাতি, যে কেউ। একই সাথে উপজাতি ছেলেমেয়েরা নিজেদের পছন্দের ভিত্তিতে সম্পর্ক তৈরি সংসার গড়ার অধিকার থাকতে হবে। নিরীহ উপজাতিরা জিম্মিদশা মুক্তি পাক। পাহাড়ে বাঙালিদের সাথে উপজাতিদের সম্পর্ক নিজেদেরই ভাইবোন বা আপনজনদের মতো। আমাদের এলাকায় একটা পরিবার ছিল চাকমাদের। তাদের বাড়ির টিলাটাকে আমরা বলতাম, ‘মোডাই চাকমার টিলা’। মোডাই চাকমার ছেলে এবং নাতিদের আমি শৈশবে দেখেছি। তারা আমাদের বাড়িতে আসত। আম-কাঁঠাল খেতাম আমরা একসাথে। ছেলেটার নাম ছিল দোকালা চাকমা আমাদের সাথে সারাদিন খেলত, এক পুকুরে আমরা গোসল করতাম। মেয়েটার নাম ছিল, মিলাসাবুয়া বা এই জাতীয় কিছু। সে প্রতিদিনই আমার মার কাছে আসত। মায়ের মাথায় বিলি কেটে দিতো, রান্নাবান্নায় সহযোগিতা করত। একসাথে চাকমা-টিপরা বন্ধুদের সাথে আমরা পড়াশোনা করেছি। তাদের সাথে এখনো ওঠাবসা হয়। সবই ঠিক। কিন্তু বেঠিকটা তাহলে কোথায়? তা ওই এক জায়গায়- আর সেটা হলো, উপজাতি নেতৃত্ব। ওরা পুরো উপজাতীয় জনগোষ্ঠীকে জিম্মি করে খেয়ে যাচ্ছে। এই দেশের সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি তারা। সরকার যদি তাদেরকে নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়, তবে বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে চরম খেসারত দেয়ার জন্য তৈরি থাকতে হবে।