জায়নবাদী আগ্রাসন

ফিলিস্তিন নামের উৎপত্তি - ছবি সংগৃহীত
অসংখ্য নবী-রাসূলের স্মৃতিবিজড়িত এক ফালি মরূদ্যান ফিলিস্তিন। প্রাচীন এই ভূখণ্ডের কাহিনী লিপিবদ্ধ রয়েছে পৃথিবীর তিনটি প্রধান ধর্মগ্রন্থসহ ইতিহাসের পাতায়। ইতিহাস-সমৃদ্ধ প্রসিদ্ধ জনপদগুলোর মধ্যে ফিলিস্তিন অন্যতম। অতীত যত সমৃদ্ধিই হোক না কেন, বিগত ৭৩ বছরের ইতিহাসে মরু উপত্যকাটিতে সবচেয়ে বেশি রক্ত ঝরেছে এবং এখনো তা অব্যাহত। রক্তস্রোতে ফিলিস্তিনিদের ভাসিয়ে নিয়ে গেছে দুঃখসাগরে। লাখ লাখ ফিলিস্তিনি বসতভিটে থেকে উচ্ছেদ হয়ে বিশ্বের নানা প্রান্তে উদ্বাস্তু ও মানবেতর জীবনযাপন করছে। যে দুঃখগাথার শেষ নেই, কিনারা নেই। সহসাই যে শান্তির সুবাতাস বইবে এবং দুঃখের অবসান হবে; সে লক্ষণও দূরপরাহত। বিশ্বরাজনীতির মারপ্যাঁচে ফিলিস্তিদের জীবন আজ দুর্বিষহ। স্বদেশে পরবাসী। মূলত ফিলিস্তিন এখন বিশ্বের খোলা কারাগারগুলোর একটি। যেখানে প্রতিদিন অসহায় বনি আদমের খুনে রঞ্জিত হচ্ছে ধরিত্রী।
পৃথিবীর তিনটি প্রধান ধর্মের আবির্ভাব পশ্চিম এশিয়ার একেবারে পশ্চিম কোণে। ফিলিস্তিন থেকে ইহুদি ও খ্রিষ্টধর্ম। এরই নিকটবর্তী পবিত্র মক্কা নগরীতে অভ্যুদয় ইসলামের। বিস্ময়ের বিষয় এই যে, আসমানি তিনটি ধর্মের অনুসারীরা ফিলিস্তিনে অবস্থিত বায়তুল মুকাদ্দাসকে শ্রদ্ধা ও ভক্তি করে থাকে। সঙ্গত কারণেই ইহুদি, খ্রিষ্টান ও মুসলিম সবার কাছে ফিলিস্তিন ভূখণ্ড নিয়ে এক ধরনের ধর্মীয় আবেগ প্রবলভাবে বিদ্যমান। উদারতা ও সহিষ্ণুতা যদি বিশ্ববাসীর মধ্যে থাকত, তাহলে এ শহর হতে পারত উল্লিখিত তিন ধর্মনুসারীদের পারস্পারিক সেতুবন্ধন। কিন্তু মানব সভ্যতার কী নির্মম পরিহাস; ফিলিস্তিনই সব সময় হয়ে রয়েছে সঙ্ঘাতের কেন্দ্রবিন্দুতে।
ফিলিস্তিন নিয়ে ইহুদি ও মুসলিমদের বিরোধ অতি পুরনো। এ বিরোধ তুঙ্গে ওঠে গত শতকের মাঝামাঝি ইঙ্গ-মার্কিন মদদে জায়নবাদীদের ইসরাইল নামে ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায়। আরব ফিলিস্তিনিদের সমূলে ধ্বংস করতে নিত্য-নতুন ফন্দি ও কূটকৌশল প্রয়োগ করছে অবৈধ রাষ্ট্রটি। ইহুদিদের ইতিহাসে হলোকাস্ট হয়েছিল কেবলমাত্র একবার। অবশ্য এ নিয়েও রয়েছে প্রতিবয়ান। হলোকাস্টের অতিরঞ্জন নিয়ে চলছে গবেষণা। তবে ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে মুসলিমদের হলোকাস্ট নিত্যদিনের ঘটনা।
ফিলিস্তিন ঘিরে ইহুদি ও মুসলিমের যে বিরোধ চলে আসছে, প্রকৃতপক্ষে তা এই দুই জাতির চিরন্তন দ্বন্দ্বের ধারাবাহিকতা। ফলে জানা জরুরি ইহুদি কারা? তাদের মানসিকতা কেমন? এদের উত্থান-পতনের কারণ কী? মুসলমানদের সাথে বিরোধের আসল কারণ কী? এসব প্রশ্নের উত্তরে লুকিয়ে আছে ফিলিস্তিন তথা জেরুসালেমের বর্তমান সঙ্কটের কার্যকারণ। এ প্রশ্নগুলোর জবাব জানলেই কেবল ইসরাইলি নিষ্ঠুরতার প্রতিকারে মুসলিম উম্মার কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব। মুসলিম জাহানের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে বাংলাদেশীদেরও ফিলিস্তিন সঙ্ঘাতের পেছনের কারণ জানা দরকার বৈকি। তা না হলে ঐতিহাসিক মুহূর্তে হাজির থাকা সম্ভব নয়। মুক্তি সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে আমরা বর্তমান দুনিয়ার ফিলিস্তিন নিয়ে গাফেল থাকতে পারি না।
ফিলিস্তিনে মানব বসতি
নুহের আ: এক ছেলে হ্যাম। তাঁর ছেলে কেনান। কেনানের বংশধরদের বলা হয় কেনানাইট। কেনানাইটরা খ্রিষ্টপূর্ব ৪০০০ সালের দিকে ফিলিস্তিনে প্রথম বসতি স্থাপন করে। কেনানের নাম অনুসারেই ফিলিস্তিনের প্রাচীন নাম ছিল কেনান। তৎকালে ভূমধ্যসাগরের ওই অঞ্চলে বাসকারী বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে কেনানরা ছিল প্রধান। এ ইতিহাসের সাথে মিশে আছে সেমিটিক জাতি থেকে আলাদা হয়ে হিব্রুদের নিজস্ব রাজ্য গড়ে তোলার কাহিনী।
ইহুদিদের ওই সব পূর্বপুরুষ, যাদের তারা ইজরাইলাটাই বলে পরিচয় দেয়, তারা মিসর থেকে ফিলিস্তিনে ফেরার পথে জুডা ও বেনিয়ামিন নামে দুই প্রধান গোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়ে যায়। ইয়াকুব আ:-এর এক পুত্র ছিলেন নবী ইউসুফ আ:। তাঁর পুত্র জুডা। কেনানের যে অংশে জুডার অনুসারীদের বসবাস; সেই এলাকাকে জুডিয়া বলা হতো।
ফিলিস্তিন নামের উৎপত্তি
ফিলিস্তিন শব্দের উৎপত্তি হিব্রু পেলেসেতে থেকে। যার অর্থ সাগরের কোলঘেঁষা লম্বা-চওড়া এক ফালি কাপড়ের টুকরোসদৃশ ছোট উপত্যকা। শব্দটির ভাবগত ব্যাখ্যা- রাজার প্রাসাদ। প্যালেস শব্দটি সম্প্রসারিত হয়ে পেলেসেত বা প্যালেস্টাইন হয়। আরবি ফিলিস্তিনের গ্রিক নাম প্যালেস্টাইন। ফিলিস্তিন নামকরণ নিয়ে ঐতিহাসিক সূত্রে আরো একটি ঘটনা পাওয়া যায়, আজাই নামের এক ব্যক্তির ছেলের নাম প্যালাল। জেরুসালেমের দেয়াল মেরামতের কাজে প্যালাল অর্থ ও জনবল দিয়ে নেহেমিয়া নামে জুডাগোষ্ঠীর এক নেতাকে সহায়তা করেন। কালের পরিক্রমায় প্যালাল শক্তিশালী হয়ে ওঠেন। ইতিহাসবিদের কেউ কেউ মনে করেন, তার নামানুসারে ফিলিস্তিন শব্দের উৎপত্তি।
ইহুদি বা বনি ইসরাইলের পরিচয়
ইহুদি, খ্রিষ্টান ও মুসলমানরা ইব্রাহিমীয় সিলসিলার উত্তরাধিকারী। কিন্তু ইহুদিরা তা মানতে নারাজ। তারা নিজেদের ইব্রাহিমের আ: একমাত্র বৈধ উত্তরাধিকারী দাবি করে। কিন্তু পবিত্র কুরআন অনুসারে তাদের ওই দাবি নাকচ হয়ে যায়। উপরন্তু কুরআনে উল্লিখিত অভিশপ্ত জাতিগুলোর একটি বনি ইসরাইল; পরে যারা ইহুদি বলে পরিচিতি পায়। তারা কেতাবের দাবিদার হয়েও নিজেদের কেতাবের বিন্দুবিসর্গ মানেনি। উল্টো আল্লাহর নামে মিথ্যাচার করে।
এমন জঘন্য স্বভাবের হওয়ায় বনি ইসরাইল বা ইহুদিরা অভিশপ্ত। ঐশী কেতাবগুলোর অনুসারীদের মধ্যে ইহুদিরাই প্রথম ধর্মব্যবসায়ী। যারা ধর্মের আশ্রয়ে থেকে কেতাবকে পরলৌকিক মুক্তির বাহন না বানিয়ে ইহলৌকিক স্বার্থ হাসিলের হাতিয়ার বানায় তারাই ধর্মব্যবসায়ী। ইসরাইলের বংশধরেরা দুনিয়াবি স্বার্থে কেতাবকে ব্যবহার করেছে। এখনো সেই বদখাসলত বদলায়নি। সমকালীন বিশ্বেও খেয়াল করলে দেখা যাবে, প্রায় সব ইহুদির কাছে নীতি-নৈতিকতার কোনো দাম নেই। তাদের ধান্দা শুধু ছলে বলে কৌশলে বৈষয়িক স্বার্থ হাসিল করা। ফলে তারা পাপিষ্ঠ এক জনগোষ্ঠী হিসেবে এখনো বিশ্বের বেশির ভাগ মানুষের কাছে ঘৃণিত।
আগেই বলা হয়েছে, পবিত্র ধর্মগ্রন্থগুলোর বর্ণনা মতে, নবী ইব্রাহিমের আ:-সিলসিলায় উদ্ভব ইহুদি, খ্রিষ্টান ও ইসলামের। ইব্রাহিম আ:-এর দুই পুত্র ইসমাইল ও ইসহাক আ:। নবী ইসহাকের আ: পুত্র ইয়াকুব আ:। তাঁর আরেক নাম ইসরাইল। ইসরাইলের হিব্রু প্রতিশব্দ ইজরুল্লাহ। আরবিতে বলা হয় আবদুল্লাহ। বাংলা মানে আল্লাহর বান্দা। সেই ইয়াকুবের আ: ছিল ১২ ছেলে। হিব্রু বাইবেলের বর্ণনা মতে, ১২ ছেলে হলেন রেইবেন, সিমোন, লেভি, জুদাহ, দান, নাফতালি, গাদ, আশের, ইসাচার বা ইয়াহুদা, জেবুলুন, জোসেফ (ইউসুফ আ:) ও বেনিয়ামিন। ১২ ছেলে থেকে বৃদ্ধি পাওয়া ১২টি পরিবারই বনি ইসরাইল নামে খ্যাত। ১২ গোত্রের সবাই বনি ইসরাইল নামে পরিচিত ছিল। কিন্তু পরে ইয়াহুদার নামানুসারে ইহুদি নামের উদ্ভব। বনি ইসরাইলের সবাই এখন ইহুদি নামে পরিচিত। তবে বর্তমান দুনিয়ায় যারা ইহুদি তাদের সবাই এক মানবধারণ নয় বলে অনেক নৃতাত্ত্বিকের মত। এ প্রসঙ্গে তাদের বক্তব্য, পৃথিবীতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সব ইহুদির চেহারা ও শারীরিক গঠনে সাদৃশ্য নেই। ভিন্ন ভিন্ন। তাই তাদের এক মানবধারার বলা যায় না।
ফিলিস্তিন সঙ্কটের পেছনে
ইহুদি ও মুসলমানদের বিরোধের সূচনা মক্কায় শেষ নবী ও রাসূল হজরত মুহাম্মদ সা:-এর ওপর পবিত্র কুরআন নাজিলের পর থেকেই। কারণ ইহুদিদের ধর্মবিশ্বাস অনুসারে শেষ নবী হজরত মুহাম্মদ সা: হচ্ছেন ইবরাহিম আ:-এর বাঁদীস্ত্রী বিবি হাজেরার গর্ভজাত সন্তান ইসমাইলের আ: বংশের। অন্যদিকে ইহুদিরা ইব্রাহিমের আ: প্রথম স্ত্রী শাহজাদী বিবি সারাহর সন্তান ইসহাকের আ: বংশধর। ইহুদিরা মনে করে, তারা সম্ভ্রান্ত ও উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন। মুসলিমরা নিম্ন শ্রেণীর। ফলে ইহুদি-মুসলিম দ্বন্দ্ব আশরাফ-আতরাফের বিরোধ। অথচ মানবতার চূড়ান্ত মর্মবাণী, সব মানুষ আদমের সন্তান। মানুষে মানুষে কোনো ভেদাভেদ নেই। এ দিক বিবেচনায় নিলে বলা যায়, ইহুদিরা চূড়ান্ত বর্ণবাদী একটি জাতিগোষ্ঠী। তবে তাদের মধ্যেও যে কিছু ভালো লোক নেই, তা বলা যাবে না। বিশিষ্ট আরব বুদ্ধিজীবী মোহাম্মদ রাবির কথায়, ‘এই দ্বন্দ্ব ধর্মীয় বিশ্বাস এবং জাতীয় অভিজ্ঞতার গভীরে প্রোথিত দুটি স্বতন্ত্র জনগোষ্ঠীর নৈতিক ও ঐতিহাসিক দাবির সঙ্ঘাত’।
সংঘর্ষের কেন্দ্রবিন্দু মসজিদুল আকসা
প্রাচীনকাল থেকেই ফিলিস্তিন তথা জেরুসালেম একটি মরুশহর। জেরুসালেম নামটির মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে হাজারো ইতিহাস, ঐতিহ্য, বীরত্ব ও উত্থান-পতনের প্রতিচ্ছবি। লুকিয়ে রয়েছে ধর্মীয় আবেদনে ভরপুর প্রাচীন জনপদের হাজার হাজার বছরের গল্পগাথা। এ মরুশহর ঘিরে গড়ে উঠেছিল পৃথিবীর তিন ধর্মবিশ্বাস ইহুদি, খ্রিষ্টান ও ইসলামের।
ইব্রাহিম আ: কাবাঘর নির্মাণের ৪০ বছর পর তাঁর পুত্র ইসহাকের আ: সন্তান ইয়াকুব আ: মসজিদটি নির্মাণ করেছিলেন। তাঁদের বংশধর সোলাইমান আ: এটি পুনর্নির্মাণ করেছিলেন। পবিত্র কাবা প্রথম কিবলা হলেও মসজিদুল আকসা পরবর্তীতে কিবলার সম্মান পায়। হজরত মুহাম্মদ সা:-এর সময় ফের পরিবর্তিত হয়ে কিবলা কাবাঘরে চলে আসে। খলিফা ওমরের শাসনকালে বায়তুল মোকাদ্দাস ও জেরুসালেম মুসলমানদের অধীনে আসে। ১০৯৬ সালে খ্রিষ্টান ক্রসেডাররা এক রক্তক্ষয়ী আক্রমণের মাধ্যমে সিরিয়া ও ফিলিস্তিন জবরদখল করে। ১১৮৭ সালে সুলতান সালাহুদ্দীন আইয়ুবী জেরুসালেম পুনরুদ্ধার করেন। পরবর্তীতে ওসমানীয় সাম্রাজ্যভুক্ত ছিল। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ভূখণ্ডটি ইংরেজদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। ১৯১৭ সালে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক ইংরেজ খ্রিষ্টানরা ফিলিস্তিনে অনুপ্রবেশ করে। এর পর থেকে বিশে^র বিভিন্ন স্থান থেকে ইহুদি সম্প্রদায় ফিলিস্তিনে এসে বসতি স্থাপন শুরু করে।
লুট দিয়ে সূচনা ইসরাইলের
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ইঙ্গ-মার্কিন ষড়যন্ত্রে ইসরাইল রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন। ১৯৪৮ সালের ১৫ জুলাই ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে জোরপূর্বক ইসরাইল রাষ্ট্রের শুরু। তবে প্রতিষ্ঠার বহু বছর আগে থেকেই ইউরোপ ও রাশিয়া হতে দলে দলে ইহুদি এসে ফিলিস্তিনে আবাস গড়েছিল। যদিও ইসরাইলি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা রুখতে ১৯৪৮ সালের মে মাসের মাঝামাঝি মিসর, লেবানন, সিরিয়া, জর্দান ও ইরাকের সম্মিলিত বাহিনী আক্রমণ চালিয়েছিল। কিন্তু ইউরোপীয় ও রুশ আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ইহুদি বাহিনীর সাথে পেরে ওঠেনি। কিছুদিনের মধ্যেই আরব বাহিনীগুলো পিছু হটে। ১৯৪৯ সালের প্রথমভাগে আরবদের সাথে ইসরাইলের সামরিক যুদ্ধবিরতি চুক্তি হয়।
ইসরাইল স্বাধীনতা ঘোষণার পরপরই ফিলিস্তিনের লাখ লাখ আরবের ওপর নেমে আসে অনিঃশেষ বিপর্যয়। ইহুদি সশস্ত্র গোষ্ঠী ও সেনারা ফিলিস্তিনিদের ঘরবাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিতে হত্যা ধর্ষণ লুট ও অগ্নিসংযোগ শুরু করে। প্রাণভয়ে লাখ লাখ ফিলিস্তিনি বাড়িঘর, সহায়-সম্পত্তি ছেড়ে পালাতে থাকে। দলে দলে জর্দান, লেবানন ও সিরিয়ায় গিয়ে উদ্বাস্তু হিসেবে আশ্রয় নেয়। ফিলিন্তিনি আরবদের পরিত্যক্ত ঘরবাড়ি, সহায়-সম্পত্তি নির্বিচারে লুটপাট করা হয়। ইসরাইলি সেনা ও সাধারণ ইহুদিরা যে যেভাবে পেরেছে, লুটপাট করেছে। এই অপকর্মের শুরু ১৯৪৮ সালের ১৪ মের আগ থেকেই। চলে কয়েক মাস। কী লুট করা হয়নি এ সময়ে? ফিলিস্তিনিদের ফেলে যাওয়া হাজার হাজার ঘরবাড়ি, দোকানপাট, গুদাম ও কারখানা। সেখান থেকে যন্ত্রপাতি, কৃষিপণ্য, খাদ্যশস্য, গবাদিপশু, কাপড়চোপড়, অলঙ্কার, আসবাবপত্র, পিয়ানো, ইলেকট্রিক সামগ্রী, গাড়ি, যা পাওয়া গেছে, সবই লুটে নেয় ইহুদিরা। হলোকাস্টের স্মৃতি পুঁজি করে ইউরোপীয় আশেক নাজি ইহুদিদের ষড়যন্ত্র ও কূটচাল সফল হয়।
যুদ্ধকালে লুটপাটের ঘটনা বহু পুরোনো হলেও ইহুদিরা যেভাবে ফিলিস্তিনি আরবদের জিনিসপত্র ও সম্পত্তি লুটেছে, তাকে এ ধারায় ফেলা যায় না। কেননা বেসামরিক ইহুদিরা, যারা অনেকেই শত বছরের বেশি সময় ধরে বংশপরম্পরায় আরবদের সাথে বাস করেছে তারাও লুটপাটে অংশ নেয়। এসব ইহুদি কোনো অপরিচিত শত্রুর ঘরবাড়ি লুট করেনি। লুটেরারা জানত যে তারা অনৈতিক কাজ করছে, তবু নিবৃত্ত হয়নি। আবার বেশির ভাগ ফিলিস্তিনি কোনো সশস্ত্র সঙ্ঘাতে জড়ায়নি। লুটপাটে অনুমোদন ছিল তখনকার ইহুদি নেতৃত্বের। বর্তমান ইসরাইলি নেতৃত্ব যেমন মানবতাবিরোধী, ঠিক একই রকম খাছলত ছিল তখনকার নেতাদের।
লুটপাট সম্পর্কে তৎকালীন ইসরাইলের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড বেনগুরিয়ন এক সভায় ক্ষোভের সাথে ইসরাইলি জনগণের সমালোচনা করেছিলেন এভাবে, ‘দেখা যাচ্ছে, বেশির ভাগ ইহুদি হলো চোর আমি এটা খোলাখুলি বলছি। কেননা দুর্ভাগ্যজনক হলেও এটাই সত্যি। জেজরিল উপত্যকার লোকজন চুরি করছে, নাহালার লোকজন চুরি করছে’। তার এসব কথা লিপিবদ্ধ আছে ইসরাইলের লেবার পার্টির আর্কাইভে।
ফিলিস্তিনিদের ভূমিতে জোরপূর্বক দখলদারি নিয়ে যাত্রা শুরু করে ইসরাইল-হিব্রু বাইবেলের পুরোকথার দোহাই পেড়ে ‘ঈশ্বরের প্রতিশ্রুত ভূমিতে ফিরে আসা’র মধ্য দিয়ে। সেই থেকে এক অনিঃশেষ অনিশ্চয়তার মধ্যে পতিত হয় ফিলিস্তিনিরা, যা আজো চলছে। প্রতিবছর ১৫ মে ফিলিস্তিনিরা নাকবা দিবস হিসেবে দিনটিকে পালন করে। এবারের নাকবা দিবসও এসেছে জায়নবাদী তথা উগ্র ইহুদিবাদী রাষ্ট্র ইসরাইলের ৭৩তম জন্মবার্ষিকীর পাশ ঘেঁষে। এসেছে গাজায় ইসরাইলের বিমান বোমা হামলা নিধনযজ্ঞ আর জেরুসালেমে হারাম আল শরিফ প্রাঙ্গণে ফিলিস্তিনিদের ওপর নির্যাতন দমন পীড়নের মধ্য দিয়ে।
সঙ্কট সমাধান কোন পথে
ফিলিস্তিন নিয়ে আরব ও ইসরাইলিদের সঙ্ঘাত মূলত দু’টি ভিন্নধর্মী জীবনধারার দ্বন্দ্ব। দুটি জীবন ব্যবস্থার স্বতন্ত্রের সঙ্ঘাতময় প্রতিফলন। এ কারণেই জাতীয় নিরাপত্তা এবং জাতীয় আকাক্সক্ষা সুনিশ্চিত করার লক্ষ্যে রাজনৈতিক এখনো বোঝাপড়ার কাছাকাছি আসতে কোনো পক্ষই সক্ষম হয়নি। ঐতিহাসিক বিষাদময় স্মৃতির গভীর গহ্বরে বন্দী।
বিগত ৭৩ বছর ধরে যে সমস্যাটি সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যে রয়েছে জ্বলত অগ্নিকুণ্ডের মতো, যা গ্রাস করেছে অসংখ্য প্রাণ এবং বিপুল সম্পদ, তার কী কোনো সফল এবং সর্বসম্মত সমাধান নেই? বিশ্বের শান্তিকামী মানুষের আশা, পুরো বিষয়টিকে সার্বিকভাবে অনুধাবনের সময় এসেছে এখন। বিশ্ব নেতৃত্বকে অভিজ্ঞতার সঞ্চিত নুড়ির মধ্য থেকে বাস্তবতার মণিমুক্তা সংগ্রহের মাধ্যমে এ সমস্যার সমাধানের পথে এগুতে হবে। দ্বন্দ্বের মধ্যেও শান্তির আবেদন আকর্ষণীয় হতে হবে। আবেগের পরিবর্তে যুক্তির দ্যুতি বিকশিত করাই কর্তব্য। এক্ষেত্রে ইসরাইলকে বুঝতে হবে প্রতিবেশীদের সাথে প্রতিনিয়ত যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া কার্যত অসম্ভব।
এ ধরনের যুদ্ধে বিজয় যে সম্ভব নয়, এমনকি সে বিজয় জীবনের জয়যাত্রা নয়। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের ঐকান্তিক সহযোগিতায় ইসরাইল অর্জন করেছে বিপুল সমরশক্তি। সেই জোরেই মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইল বেপরোয়া। একই সাথে মার্কিনিদের সহায়তায় লাভ করেছে ক্ষিপ্র কর্মতৎপরতা এবং দক্ষতা। যা মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের প্রতিকূল; সে ক্ষেত্রে ইঙ্গিত পাওয়ামাত্রই ইসরাইল উঠে পড়ে লাগে অঘটন ঘটাতে। সেখানে আইন বা নৈতিকতার কোনো বাধাবন্ধন পথ রোধ করতে পারে না। তাই মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইল চিহ্নিত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ‘নষ্ট বালক’। তবে ইসরাইলের অনেক নাগরিকের নতুনভাবে অনুভবে এসেছে; স্বাধীন ফিলিস্তিনের অস্তিত্ব স্বীকার করে নেয়ার বিষয়ে। দেশটির অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরতাই কিন্তু এরই ইঙ্গিতবাহী। নেতানিয়াহুর মতো চরম দক্ষিণপন্থী নেতার ক্ষমতা এখন টলটলায়মান। যদিও এবার গাজায় হামালার পেছনে নেতানিয়াহুর একটি লক্ষ্য ছিল নিজের গদি রক্ষা।
ইসরাইলের দোসর পশ্চিমাশক্তি। স্বাধীন ফিলিস্তিন নিয়ে আমেরিকাসহ পশ্চিমা দেশগুলোর নিষ্ক্রিয়তা এমনকি জাতিসঙ্ঘের ভূমিকা বোধগম্য। কিন্তু ইসরাইলি বর্বরতা রোধে কয়েকটি বাদে বাকি মুসলিম বিশ্ব বিশেষ করে সৌদি আরবের নিষ্ক্রিয় ভূমিকা লক্ষ করার মতো। এ বিষয়গুলো পর্যবেক্ষণে মনে প্রশ্ন জাগে, স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের দাবি কি শুধু মায়াময় এক মরীচিকা? এ রাষ্ট্রের দাবি কি শুধু দাবিই থেকে যাবে?
আশার কথা, এবার গাজায় হামলা চালিয়ে ইসরাইল ভয়াবহ ক্ষয়ক্ষতি করেছে বটে; কিন্তু যুদ্ধে নৈতিক পরাজয় ঘটেছে জায়নবাদীদের। বিশ্বে কোণঠাসা হয়ে পড়েছে ইসরাইল। খোদ যুক্তরাষ্ট্রে ইসরাইল বিরোধী শক্ত পাটাতন পাচ্ছে। এ কারণে নেতানিয়াহু বাধ্য হয়েছেন যুদ্ধবিরতিতে। ফলে নৈতিক জয় হয়েছে ফিলিস্তিনিদের। নাৎসি বর্বরতা একদিন যেমন ইহুদিদের অস্তিত্ব ধ্বংস করতে পারেনি; বরং তাদের একটি রাষ্ট্রের গোড়াপত্তনে শক্তি ও সাহস জুগিয়েছে। ঠিক তেমনি বর্তমানে ইসরাইলি বর্বরতাও ফিলিস্তিনিদের অস্তিত্ব ধ্বংস করতে পারবে না। বরং একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম ফিলিস্তিন রাষ্ট্রর অভ্যুদয় অনিবার্য করে তুলবে। যার রক্তাক্ত উদয় শুরু হয়েছে মাত্র। আরবদের এ অভ্যুদয় শক্তিশালী এবং পাশ্চাত্যের আদরের জামাই জায়নিস্ট রাষ্ট্রটির জন্য খুব শুভ পরিণতি বসে আনবে না।