একটি ফিলিস্তিনি পরিবারের কাহিনী
বুশরা - ছবি সংগৃহীত
জামাল আল-তাওয়িলের একমাত্র মেয়ে যখন ১৯৯৩ সালের এপ্রিলে জন্মগ্রহণ করে, তখন নিজের দেশ ছেড়ে দক্ষিণ লেবাননে নির্বাসনে ছিলেন তিনি। অধিকৃত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড পশ্চিম তীরের আল-বিরা মিউনিসিপালিটির সাবেক এই মেয়রের বিরুদ্ধে অভিযোগ, ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসের সদস্য তিনি।
বার্তা সংস্থা আনাদোলু এজেন্সির কাছে তার স্ত্রী মুনতাহা আল-তাওয়িল সাক্ষাতকারে বলেন, ‘আমাদের মেয়ে বুশরার জন্মের পাঁচ মাস আগেই শত শত হামাস নেতার সাথে তাকেও দক্ষিণ লেবাননে নির্বাসনে যেতে হয়।’
তিনি বলেন, মেয়ের বয়স পাঁচ মাস হওয়ার পর ইসরাইলি কর্তৃপক্ষ জামালকে পশ্চিম তীরে ফেরার অনুমতি দেয়।
মুনতাহা বলেন, ‘তিনি তাকে যখন দেখেন, তখন সে পাঁচ মাসের ছিল। কিন্তু বুশরার প্রথম জন্মদিন আসার আগেই তাকে গ্রেফতার করা হয় এবং প্রশাসনিক আটকাদেশের অধীনে বন্দী করে রাখা হয়।’
ইসরাইলি আইনের অধীনে ‘প্রশাসনিক আটকাদেশ’ বিশেষ এক ব্যবস্থাপনা, যার মাধ্যমে কোনো বন্দীকে ইসরাইলি কর্তৃপক্ষ অভিযোগ ছাড়াই নির্দিষ্ট এক মেয়াদে আটক রাখতে পারে।
ইসরাইলি কর্তৃপক্ষের গ্রেফতারির কারণে বাবা ও মেয়ের মধ্যে বিচ্ছেদের এই খেলা চলছে প্রায় ৩০ বছর।
এর মধ্যে ২০১১ সালে প্রথম বুশরা আল-তাওয়িলকে আটক করে ইসরাইলি বাহিনী। ওই সময় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী বুশরা ১৬ মাস কারাগারে ছিলেন।
ফিলিস্তিনি সংবাদমাধ্যম আনিন আল-কায়েদ মিডিয়া নেটওয়ার্কে কর্মরত সাংবাদিক বুশরাকে সর্বশেষ গত বছর নভেম্বরে আটক করা হয়। বর্তমানে সাত মাস তিনি ইসরাইলি কারাগারে আটক রয়েছেন।
এরই মাঝে ইসরাইলি কর্তৃপক্ষের ক্রমাগত আটক ও মুক্তির মধ্য দিয়ে ইসরাইলের বিভিন্ন কারাগারে জামাল আল-তাওয়িলের জীবন থেকে কেটে গেছে ১৭ বছর।
সর্বশেষ এই বছর ১ জুন তাকে নিজ বাড়ি থেকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায় ইসরাইল। পরদিন পশ্চিম তীরে ইসরাইলের ওফের কারাগারের সামরিক আদালত তার বিরুদ্ধে প্রশাসনিক আটকাদেশের নির্দেশ দেয়।
গত নভেম্বরে বুশরাকে আটকের পর নতুন করে মার্চে প্রশাসনিক আটকাদেশের অধীনে আবার তাকে কারাগারে বন্দী রাখার মেয়াদ বাড়ানো হয়।
ইসরাইলের কারাগারে মেয়ের আটকাদেশের প্রতিবাদে অনশন পালন করছেন ৫৯ বছর বয়সী জামাল আল-তাওয়িল।
অনশন শুরুর পর থেকেই হাশারুন কারাগারে ইসরাইলি কর্তৃপক্ষ তাকে নির্জন কারাবাসে ফেলে রেখেছে। পরিবারের কেউ তার সাথে সাক্ষাতের সুযোগ পাচ্ছেন না।
৫৬ বছর বয়সী স্ত্রী মুনতাহা জিজ্ঞেস করেন, ‘ইসরাইলি প্রশাসনিক আটকাদেশের অধীনে কোনো মামলা ছাড়াই বন্দীর সাথে পরিবারের সাক্ষাত করতে না দেয়া কোন ন্যায়ের কথা?’
মুনতাহা বলেন, ২০১১ সালে যখন প্রথম তাদের মেয়েকে ইসরাইলি বাহিনী আটক করে, তখন জামাল বাড়িতেই ছিলেন।
তিনি জানান, ওই রাতটি ছিল জামালের জন্য কষ্টকর।
আনাদোলু এজেন্সিকে মুনতাহা বলেন, ‘সৈন্যরা যখন তার মেয়েকে হাতকড়া পরাচ্ছিল, তখন তিনি এক মুহূর্তও মেয়ের কাছ থেকে অন্যদিকে চোখ সরাননি।’
এরপর থেকে খুব অল্প সময়ই জামাল ও তার মেয়ে একসাথে বাড়িতে কাটিয়েছেন।
২০১৪ সালে আবার বুশরাকে আটক করে ইসরাইলি বাহিনী। তিনি যখন মুক্তি পান, তার বাবাকে তখন কারারুদ্ধ করে ইসরাইলি কর্তৃপক্ষ। এই সময় মেয়েকে কারাগারে বাবার সাথে দেখা করার অনুমতি দেয়া হয়নি নিরাপত্তার অজুহাতে।
২০১৭ সালে জামাল ইসরাইলি কারাগার থেকে মুক্তির পর ইসরাইলি বাহিনী তার মেয়েকে আবার আটক করে। এই সময় আট মাস কারাগারে তাকে আটক রাখা হয়।
আট মাস পর বুশরা মুক্তি পেলে তার বাবাকে আবার আটক করা হয়।
মুনতাহা বলেন, সর্বশেষ তারা ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে মাত্র সাতদিনের জন্য একত্রে বাড়িতে ছিলেন। এই সময় দুই বছর বন্দী থাকার পর মাত্রই মুক্তি পেয়েছিলেন জামাল আল-তাওয়িল।
তিনি বলেন, ‘ওই সময় আমি অসুস্থ থাকায় তারা আমাকে পালা করে দেখাশোনা করতেন।’
২০১৯ সালের ১১ ডিসেম্বর সকালে ইসরাইলি বাহিনী তাদের বাড়িতে হানা দিয়ে চতুর্থবারের মতো বুশরাকে আটক করে।
এর মাত্র সাতদিন আগেই জামাল কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন। ইসরাইলি সৈন্যদের তিনি অনুরোধ করে বলেছিলেন, ‘আমার মেয়ের বদলে আমাকে গ্রেফতার করো। তাকে ছেড়ে দাও।’
মাঝে গত বছরের জুলাই মাসে বুশরা মুক্তি পেয়েছিলেন। কিন্তু তখন তারা বাবা জামাল ছিলেন ইসরাইলের কারাগারে। আবার এই বছরের জানুয়ারিতে যখন বাবা মুক্তি পান, তার আগেই নভেম্বরে বুশরাকে পঞ্চমবারের মতো আটক করে ইসরাইলি বাহিনী।
কারাগারেই বুশরা জানতে পেরেছেন, তার নতুন আটকাদেশের প্রতিবাদে তার বাবা অনশন করছেন। এতে সমর্থন জানিয়ে মায়ের কাছে কারাগার থেকে একটি চিঠি দিয়েছেন তিনি।
চিঠিতে তিনি লিখেন, ‘প্রথমবারের মতো এক বাবা তার মেয়ের মুক্তির দাবিতে অনশন করছেন। আমার সমস্ত দোয়া তার সাথে।’
তিনি আরো লিখেন, ‘বহু বছর ধরে, আমি বাবাকে মাত্র ৬৮ দিন দেখেছি। ক্রমাগত এই গ্রেফতারি আমাদের পৃথক করে রেখেছে।’
বর্তমানে ইসরাইলি কারাগারে অন্তত পাঁচ হাজার তিন শ’ ফিলিস্তিনি বন্দী রয়েছেন। এর মধ্যে কোনো অভিযোগ ছাড়াই প্রশাসনিক আটকাদেশের অধীনে ৫২০ ফিলিস্তিনিকে বন্দী রাখা হয়েছে।
সূত্র : আনাদোলু এজেন্সি