বিএনপির রাজনীতি কোন পথে

হারুন জামিল | Jun 22, 2021 07:07 pm
বিএনপির রাজনীতি কোন পথে

বিএনপির রাজনীতি কোন পথে - ছবি সংগৃহীত

 

বাংলাদেশে যে দু’টি ধারার রাজনীতি দীর্ঘ সময় ধরে নেতৃত্বের আসনে- বিএনপি তার একটি। বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের চেতনা নিয়ে দলটির যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৯৭৮ সালে। বিএনপি একটি মিশ্র ধারার রাজনৈতিক শক্তি। ডান বাম উদার কিংবা রক্ষণশীল যেকোনো চিন্তাধারার মানুষই দলটির সাথে যুক্ত হওয়ার সুযোগ রয়েছে। র‌্যাডিকাল বা বিপ্লবী চেতনার অনুসারীগণও দলটিতে স্থান করে নিতে কষ্ট হয় না। কিন্তু দলটির মৌলিক চেতনার জায়গা হচ্ছে উদার গণতন্ত্র। ক্ষমতার প্রভাব বলয়ের মধ্যে বিএনপির জন্ম হলেও দীর্ঘ সময় ধরে বাংলাদেশের রাজনীতিতে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে দলটি এগিয়ে গেছে। বলা যায় বাংলাদেশের রাজনীতিতে গণতন্ত্রের যতটুকু প্রাতিষ্ঠানিকতা রয়েছে বিএনপির অবদান এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি। ১৯৯১ সাল থেকে বিএনপি তিনবার ক্ষমতায় এসেছে। ২০০৬ সালের পর থেকে টানা ক্ষমতার বাইরে তাদের অবস্থান।

দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া দুই বছরের অধিক সময় কারাগারে কাটিয়ে সরকারের নির্বাহী আদেশে জামিন লাভ করেছেন। কিন্তু রাজনৈতিক অঙ্গনে আজো মুক্ত হতে পারেননি। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও দণ্ডপ্রাপ্ত হয়ে দেশের বাইরে। এ দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষ বিএনপির রাজনীতির অনুসারী। নির্বাচনে দলটির জনপ্রিয়তা প্রশ্নাতীত। দলের প্রতিষ্ঠাতা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে দেশের অগণিত মানুষ শ্রদ্ধা করে। ভালোবাসে। তার কর্মের কথা স্মরণ করে আজো অশ্রুসিক্ত হয়। মধ্যপন্থী রাজনীতির জনপ্রিয় একটি ধারার প্রতিনিধিত্ব করেও বিএনপি দীর্ঘ সময় ক্ষমতার বাইরে। জনসমর্থন থাকলেও দলটির নেতৃত্ব সেটিকে কাজে লাগিয়ে কার্যকর কোনো রাজনৈতিক চাপ তৈরি করতে পারেনি। বলা যায় বিএনপি নেতৃত্ব বিপুলসংখ্যক মানুষের প্রত্যাশা পূরণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। এ অবস্থায় বিএনপির রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ কি? দলটি কি পারবে জনগণের প্রত্যাশা পূরণে নেতৃত্ব দিতে? কিংবা সব প্রতিকূলতাকে কাটিয়ে উঠে রাষ্ট্রক্ষমতায় যেতে? এ প্রশ্নের তাৎক্ষণিক উত্তর খুবই কঠিন।

ঐতিহাসিক বিচারে বিএনপি কখনোই র‌্যাডিক্যাল কিংবা মিলিট্যান্ট রাজনৈতিক দলের মতো ছিল না। ক্ষমতার অলিন্দে গড়ে উঠলেও এমন একটি রাজনৈতিক শক্তি কিংবা দর্শন বিএনপি গ্রহণ করেছে, যা এ দেশের বিপুল মানুষ সাদরে গ্রহণ করে। বহু মত ও পথের সংমিশ্রণে বিএনপির যে রাজনৈতিক রূপ তার উদারনৈতিকতাই মানুষের পছন্দের। ঘাত প্রতিঘাতের ভেতর দিয়ে বিএনপি তাই এগিয়েছে বহুদূর। তাত্ত্বিকভাবে এ কথা সত্য। কিন্তু বৈশ্বিক রাজনীতির নতুন মেরুকরণে দলটির অবস্থান কোথায়? দলের নেতৃত্বের কথা এ ক্ষেত্রে বারবার ঘুরে ফিরে আসে।

১৯৭৮ সালের ১ মে রমনা রেস্তোরাঁয় ৭৬ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি গঠনের মধ্য দিয়ে বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন শহীদ জিয়াউর রহমান। আহ্বায়ক কমিটির প্রধান ছিলেন তিনি। প্রথম মহাসচিব ছিলেন প্রফেসর এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী। সেই আহ্বায়ক কমিটির শতকরা ৪৫ ভাগই ছিলেন বয়সে তরুণ। অবশিষ্ট ৫৫ ভাগেরও বয়স তুলনামূলক কম ছিল। প্রেসিডেন্ট জিয়া রাজনীতিতে নেমে বুঝতে পেরেছিলেন যে লক্ষ্যে তিনি পৌঁছাতে চান তার জন্য অপেক্ষাকৃত তরুণদেরই প্রয়োজন। তিনিও সে সময় তারুণ্যদীপ্ত ছিলেন। ৪৩ বছর আগের সে কাহিনীর যারা ধারক তারা এখন পৌঢ়। অনেকেই পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। এ সময়কালে বিএনপি মুখোমুখি হয়েছে নতুন নতুন চ্যালেঞ্জের। বিএনপির জনপ্রিয়তা না কমলেও এটাই সত্য যে ঐতিহ্যের সে ধারাবাহিকতা বিএনপি ধরে রাখতে পারিনি। সময়ের স্রোতে তাল মেলাতে না পেরে রাজনীতির ময়দানে এখন হাবুডুবু খাচ্ছে। এই কঠিন পরিস্থিতি থেকে নিজেকে উদ্ধার তো দূরের কথা মানুষকে স্বপ্ন দেখাতেও তারা ভুলে গেছে। অথচ রাজনৈতিক ময়দানে নেতৃত্বের শূন্যতার মধ্যে বিএনপিই নতুন ভরসার জায়গা তৈরি করেছিল। বিএনপির ওপরই এ দেশের মানুষ আস্থা রেখেছিল। সে আস্থা এখন ফিকে হয়ে আসছে।

বিশ্ব রাজনীতির বড় উপাদান পুঁজিবাদী ও সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থা এখন নতুন মোড়কে প্রবর্তিত হয়েছে। যার নাম দেয়া হয়েছে বাজার অর্থনীতি। এর এক অংশে ব্যক্তির অর্থনৈতিক মালিকানার অধিকারকে স্বীকার করে নেয়া হয়েছে। নতুন যুগের রাজনীতি হয়ে গেছে বাণিজ্যের আরেক নাম। আধুনিককালে এর আরেক নাম করপোরেট বাণিজ্য। এই করপোরেট অর্থনীতিই এখনকার রাজনীতির মূল চালিকাশক্তি। বিশ্ব রাজনীতির এই দিক পরিবর্তনের ঢেউ এসে লেগেছে বাংলাদেশেও। যাকে আমরা উন্নয়নের রাজনীতি কিংবা সীমিত গণতন্ত্রের মোড়কে বাজারজাত করেছি। এখানে উন্নয়নই বড় কথা। আগে উন্নয়ন পরে গণতন্ত্র- রাজনীতি। বিএনপি নতুন এই থিওরির মাঝখানে পড়ে গেছে। এখানে তাকে প্রতিকূলতা মোকাবেলা করতে হচ্ছে শাসকশ্রেণীর। অন্য দিকে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতেও অনেকটা বন্ধুহীন। যেসব শক্তি বিএনপির রাজনৈতিক শক্তিকে সমীহ করত তারা এখন দিক পাল্টে ফেলেছে। বিএনপিকে তারা অন্যের চশমার ভেতর দিয়ে দেখছে। এখানে জনগণের শক্তিকে দেখার সুযোগও সীমিত হয়ে গেছে। হাজারো জনসমর্থন নিয়েও বিএনপি তাই ঘরের ভেতরেই বন্দী হয়ে গেছে। এই জট কবে খুলবে তা কেউ জানে না।

১৯৮১ সালের ৩০ মে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বিপথগামী একদল সৈনিকের হাতে চট্টগ্রামে শাহাদাতবরণ করেন। বেগম খালেদা জিয়া তখন নিতান্তই গৃহবধূ। দুই সন্তানকে নিয়ে এক অকুল পাথারে পড়ে যান তিনি। বিএনপি সে সময় ক্ষমতায় থাকলেও কিছুদিন পরই ক্ষমতাচ্যুত হয়ে যায়। ১৯৮২ সালের জানুয়ারি মাসে বেগম খালেদা জিয়া বিএনপির রাজনীতিতে আসেন। এরপর এই দীর্ঘ সময়ে বিএনপিকে তিনিই টেনে নিয়ে গেছেন। রাজনীতিতে হাতেখড়ি নেয়ার ১০ বছরের মধ্যেই বিপুল জনপ্রিয়তা নিয়ে তিনি বিএনপি রাষ্ট্রক্ষমতায় এনেছেন। বাংলাদেশের মতো একটি রক্ষণশীল দেশে যা ছিল বিরাট এক অর্জন। শুধু কি তাই? ১৯৯৬ সালে সম্মিলিত রাজনৈতিক আন্দোলনে ক্ষমতা হারিয়েও তিনি আবার দলকে ২০০১ সালে বিজয়ী করে আনেন। বেগম খালেদা জিয়া হয়ে ওঠেন বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ ও ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসীদের ঐক্যের প্রতীক। বিপুল এই জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও এটাও সত্য যে বেগম খালেদা জিয়াকে তার রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে কঠিনতম মুহূর্তগুলো পার করতে হচ্ছে এখন।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে পারস্পরিক সহাবস্থান ও শ্রদ্ধাবোধের সংস্কৃতির অভাব এখন প্রকট। পাকিস্তান আমলে এমনকি বাংলাদেশের স্বাধীনতা-পরবর্তীকালেও এই মূল্যবোধ অটুট ছিল। ভ্রাতৃত্ব শ্রদ্ধাবোধের এই জায়গাটি এখন বড় বেশি নড়বড়ে হয়ে গেছে। এখানে কার দায় কতটুকু সে বিতর্কে না গিয়ে বলা যায় এতে কোনো পক্ষই লাভবান হচ্ছে না। একটা বিদ্বেষ নিয়ে বড় হচ্ছে নতুন প্রজন্ম। যে ব্যবধান পরস্পরের মধ্যে সৃষ্টি করছে যোজন যোজন দূরত্ব। এই দূরত্ব না কমলে অদূর ভবিষ্যতে জাতি হিসেবে আমাদের অনেক মূল্য গুনতে হতে পারে।
বিএনপি রাজনীতির ময়দানে সবচেয়ে দুঃসময় পার করছে। আওয়ামী লীগও এমন দুঃসময় অতিক্রম করেছে। কাজেই কঠিন সময়ের কষ্ট যে কত কঠিন তা আওয়ামী লীগ জানে না এটা ঠিক নয়। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে বিএনপিকে কঠিন এই পথে ঠেলে দিয়েছে আওয়ামী লীগ।

রাজনীতিতে কেউ কাউকে জায়গা করে দেয় না। আবার কেউ স্থায়ী শত্রু কিংবা স্থায়ী মিত্র এমন থিওরিও এখানে চলে না। রাজনীতির ময়দানে প্রতিযোগিতা খুবই স্বাভাবিক। এই প্রতিযোগিতার একটি সৌন্দর্য আছে। সেটি যদি সহাবস্থানমূলক শ্রদ্ধাবোধের হয় তবে তা দৃষ্টান্তমূলক হয়ে ওঠে। বেগম খালেদা জিয়া বিএনপির রাজনীতির মূল স্তম্ভ। তিনি যথেষ্ট জনপ্রিয় ও সম্মানীয় একজন ব্যক্তিত্ব। তিনবারের প্রধানমন্ত্রী। বয়োজ্যেষ্ঠ ও সুনাগরিক। ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ। যেকোনো বিচারেই তিনি বিশেষ নাগরিক অধিকার সংরক্ষণ করেন।

২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় তিনি পাঁচ বছরের দণ্ড মাথায় নিয়ে কারাগারে যান। ২০২০ সালের ২৫ মার্চ সরকারের এক নির্বাহী আদেশে তিনি জামিন লাভ করেন শর্তসাপেক্ষে। দেশজুড়ে করোনাকালীন এই সময়েই তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। গত ২৭ এপ্রিল এ অবস্থায় তাকে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে তার করোনার চিকিৎসা হয়। চিকিৎসকগণ তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নিয়ে যেতে বলেছেন। এ জন্য বেগম জিয়ার পরিবারের পক্ষ থেকে সরকারের কাছে আবেদনও জানানো হয়। কিন্তু সে আবেদন নাকচ হয়ে গেছে। ধারণা করা হয়েছিল সরকার হয়তো মানবিক কারণে বেগম খালেদা জিয়াকে বিদেশে যেতে দেবেন। সে ধারণা টেকেনি। এটা সত্য যে বেগম খালেদা জিয়া নিজ বাসায় চিকিৎসা গ্রহণ এবং বিদেশে না যাওয়ার শর্তে সরকারের নির্বাহী আদেশে মুক্তি পান। এক বছরের বেশি সময় ধরে তিনি নিজ বাসায় আইন মান্য করেই বসবাস করছেন। এর মধ্যে করোনায় আক্রান্ত হলে সবাই ধারণা করেছিলেন তাকে বিদেশে যাওয়ার সুযোগ দেয়া হবে। সরকারের দায়িত্বশীল মন্ত্রীরাও বিষয়টি মানবিকভাবে বিবেচনা করা হচ্ছে বলে উল্লেখ করেছিলেন। কিন্তু পরে দেখা গেলো সরকার আগেকার অবস্থানেই রয়েছেন।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রধান দু’টি শক্তির মধ্যে সদ্ভাব সম্প্রীতির অভাব দীর্ঘ দিন ধরে চলছে। এর সাথে বৈরিতা বিভাজন পরিস্থিতিকে জটিল জায়গায় নিয়ে গেছে। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ অনুযায়ী পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধের যে জায়গা তা নষ্ট হয়ে গেছে। এখন একে মেরামত রাজনীতিবিদদেরকেই করতে হবে। বিএনপি তার রাজনীতি করবে নিজস্ব জায়গা থেকে নিজস্ব বিবেচনায়। আওয়ামী লীগও তাদের রাজনীতি করবে তার নিজস্ব নীতির আলোকে। কিন্তু এ দেশে এখন রাজনীতির এই সরলপাঠ উঠে গেছে। কেন এমন হয়েছে এই প্রশ্নের জবাব রাজনীতিবিদগণই দেবেন। শ্রদ্ধা সমীহ ও সম্মান সভ্যতার জন্য অনেক বেশি প্রয়োজন।

কাউকে সম্মান দেখালে নিজের সম্মান কমে না। বরং বাড়ে। নীতিকথা মূল্যবোধ আপনার জীবনে হয়তো তেমন মূল্য বহন করে না। কিন্তু যিনি আপনার চেয়ে নিচে অবস্থান করছেন তার প্রাপ্য সম্মানটুকু দেয়াটা সব বিচারে উচিত। বিএনপি হয়তো এখন দুঃসময়ে পড়েছে। কিন্তু তার জনসমর্থন ও রাজনৈতিক শক্তি নিঃশেষ হয়ে গেছে এ কথা ভাবার কোনো কারণ নেই। আজ তাদের প্রতি উদার দৃষ্টিভঙ্গি দেখালে সেটি দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। আর কঠিনতর মনোভাবও হয়ে থাকবে মন্দ দৃষ্টান্ত হিসেবে। বিশ্ব রাজনীতির দিক বদল হয়েছে এ কথা আগেই বলেছি। কিন্তু এটিই যে দিক বদলের স্থায়ীরূপ হয়ে থাকবে তা কিন্তু কেউই বলতে পারবে না। চিরদিন কারো সমান যায় না। যেতে পারে না।

 


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us