ইরানের নির্বাচনের বৈশ্বিক প্রভাব
ইব্রাহিম রাইসি - ছবি সংগৃহীত
মধ্যপ্রাচ্যে স্থিতাবস্থার পরিবর্তনের নানা লক্ষণ সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিশেষভাবে লক্ষ করা যাচ্ছিল। ডোনাল্ড ট্রাম্পের পুরো মেয়াদে আমেরিকান নীতি সবচেয়ে বেশি সক্রিয় ছিল মধ্যপ্রাচ্যে। পররাষ্ট্র কৌশলে ইসরাইলের সাথে একাকার হয়ে যায় আমেরিকা। ফিলিস্তিনি অ্যাজেন্ডাকে এক পাশে সরিয়ে আরব-ইসরাইল সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার নতুন এক প্রবণতা প্রবল হয়ে উঠে মধ্যপ্রাচ্যে। ওআইসি সদস্যভুক্ত বিভিন্ন মুসলিম রাষ্ট্রও একই অবস্থানে নিয়ে আসার চেষ্টা হয়। যেসব আরব রাষ্ট্র ইসরাইলের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে সেসব দেশের নিরাপত্তা কৌশল ও অর্থনৈতিক নীতির ওপর তেলআবিবের প্রভাব প্রকট হয়ে ওঠে।
এ ধরনের এক পরিস্থিতির মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন এবং ক্ষমতা গ্রহণ করেন। বাইডেনের এই ক্ষমতা গ্রহণে সামগ্রিকভাবে আমেরিকান পররাষ্ট্র কৌশল ও বিশেষভাবে মধ্যপ্রাচ্য নীতিতে পরিবর্তন আসবে বলে ধারণা তৈরি হয়। জানুয়ারিতে দায়িত্ব গ্রহণের পর বাইডেন প্রশাসন তার কৌশল ও নীতি পদক্ষেপ সাজাতে কয়েক মাস সময় নেবার পর ন্যাটো শীর্ষ সম্মেলন, জি-৭ সম্মেলন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে বৈঠক এবং সর্বশেষ, রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের সাথে বহুলালোচিত শীর্ষ সম্মেলনের মধ্য দিয়ে বাইডেন প্রশাসন কার্যকর যাত্রা শুরু করল বলে মনে করা হচ্ছে। এসব সম্মেলনে বাইডেন ইউরোপীয় নেতৃবৃন্দের সাথে একাধিক বৈঠকে মিলিত হয়েছেন। তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোগানের সাথেও তিনি বৈঠক করেছেন। বাকি রয়েছেন চীনা নেতা শি জিনপিং। এই বৈঠকও একসময় হতে পারে। এর মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যে নতুন এক যুদ্ধের ডংকা বেজে উঠেছে।
ইরান নির্বাচনের বৈশ্বিক প্রভাব
বিশ্ব নেতাদের সাথে বাইডেন প্রশাসনের সংলাপের সময় মধ্যপ্রাচ্যের দেশে দেশে কিছু তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা ঘটছে। এই সময়েই ইরানে বহুলালোচিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচন সম্পন্ন হয়। এই নির্বাচনে ৬২ শতাংশ ভোট পেয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন সাবেক প্রধান বিচারপতি ইব্রাহিম রাইসি। করোনা বিধ্বস্ত ইরানে যত কম সংখ্যক ভোটার এই নির্বাচনে অংশ নেবে বলে ধারণা করা হয়েছিল বাস্তব সংখ্যাটি তার চেয়ে অনেক বড়। ৫০ শতাংশের কাছাকাছি মানুষ ভোট দিয়েছে করোনা সময়ের এই নির্বাচনে। ইরানের রাজনীতিতে সংস্কারপন্থী ও রক্ষণশীল ধারার মধ্যপন্থী প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন ইব্রাহিম রাইসি। তার মতো এত বেশি সমর্থন নিয়ে সাম্প্রতিক নির্বাচনে কেউ প্রেসিডেন্ট হননি। আশি-ঊর্ধ্ব ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনির সম্ভাব্য উত্তরসূরি হিসাবে তাকে তুলে ধরা হচ্ছে। ৪৫ দিনের মধ্যেই তিনি দায়িত্ব গ্রহণ করবেন বলে বিদায়ী প্রেসিডেন্ট ড. হাসান রুহানি জানিয়েছেন। কিন্তু তার আগেই যুক্তরাষ্ট্র পরমাণু চুক্তির আলোচনা শেষ করে আনার কথা বলা হলেও শেষ মুহূর্তে আলোচনা অনির্দিষ্টকাল পর্যন্ত স্থগিত করা হয়েছে।
ইরানের গভীর সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যে মনে হচ্ছে, দেশটির নীতি প্রণেতারা যুক্তরাষ্ট্রের চুক্তিতে ফিরে আসার বিষয়টি এখন আর প্রবলভাবে কামনা করছেন না। তারা এ কারণেই শর্ত দিয়েছেন, চুক্তির কার্যকারিতার জন্য সব নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করতে হবে। ওয়াশিংটন কতটা নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে চুক্তিতে ফিরতে চাইবে তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। আর চুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্র না ফেরার অর্থ হলো, তেহরানের অচিরেই পারমাণবিক শক্তি অর্জনের ঘোষণা।
তেহরানের কিছু সূত্র মতে, ইরান এর মধ্যে গোপনে গোটা পাঁচেক পরমাণু বোমা বানিয়ে ফেলেছে। যুক্তরাষ্ট্র চুক্তিতে না ফিরলে পরীক্ষা চালিয়ে পারমাণবিক ক্লাবে প্রবেশের ঘোষণা দেবে। আর পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবেলায় মস্কো-বেইজিং সব ধরনের সহযোগিতা দেবে তাকে। বাহ্যিকভাবে বৃহৎ দুটি দেশ যাই বলুক না কেন, যুক্তরাষ্ট্র পরমাণু চুক্তিতে ফিরে আসুক আর এ বিষয়ে বড় কোনো ছাড় তেহরান দিক, তা চীন-রাশিয়া চায় না। আলোচনা স্থগিত ঘোষণার পর পরই ইরানের মিডিয়াতে খবর বেরিয়েছে, বুশেহর পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র শিগগিরই আবার চালু হবে। কারিগরি সমস্যার কারণে ইরানের বুশেহর পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র সাময়িকভাবে বন্ধ রাখা হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়।
ইরানের পরমাণু শক্তি অর্জনের ঘোষণা মধ্যপ্রাচ্যে ক্ষমতার ভারসাম্যে বড় আলোড়ন তোলার সম্ভাবনা রয়েছে। এখন যে পরিস্থিতি অঞ্চলটিতে দেখা যাচ্ছে তার সাথে নানাভাবে এর সম্পর্ক রয়েছে বলে মনে হচ্ছে। নতুন প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি ছিলেন জেনারেল কাশেম সোলাইমানির বেশ ঘনিষ্ঠ, যাকে যুক্তরাষ্ট্র বোমা হামলা চালিয়ে হত্যা করেছে। ফলে রাইসির নির্বাচিত হবার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া খুবই নেতিবাচক। তার চেয়েও নেতিবাচক ছিল ইসরাইলের প্রতিক্রিয়া। ইব্রাহিম রাইসির নির্বাচিত হবার পর যে উত্তেজনা তৈরির চেষ্টা হচ্ছে সেটি পরবর্তী পরিস্থিতির সাথে নানাভাবে সম্পৃক্ত হতে পারে।