উত্তর কোরিয়ায় যেভাবে গড়ে তোলা হয় দুর্ধর্ষ হ্যাকার গড়ে তোলা হয়
উত্তর কোরিয়ার নেতা ও তার বোন - ছবি সংগৃহীত
রাতের দিকে নাসার মহাকাশ ক্যামেরায় তোলা ছবিতে উত্তর কোরিয়াকে একটি ব্ল্যাক হোলের মতো মনে হয়, কারণ দেশটির বেশিরভাগ এলাকায় বিদ্যুৎ থাকে না, যা দক্ষিণ কোরিয়ার ঠিক বিপরীত। দক্ষিণ কোরিয়া সারাদিন-সারারাত ধরে বাতি জ্বলে থাকে।
সিআইএ-র তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের সবচেয়ে দরিদ্র ১২টি দেশের মধ্যে উত্তর কোরিয়া রয়েছে, যাদের মাথাপিছু আয় বছরে ১৭০০ ডলার, যা সিয়েরা লিওন ও আফগানিস্তানের চেয়েও কম। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, উত্তর কোরিয়া বিশ্বের সবচেয়ে সাহসী ও সূক্ষ্মবুদ্ধির হ্যাকারের জন্ম দিয়েছে।
১৯৪৮ সাল উত্তর কোরিয়ার শাসক কিম পরিবারের দিকে তাকালে বুঝতে পারা যায়, কেন তারা অভিজাত সাইবার-যোদ্ধা ইউনিট গড়ে তুলতে শুরু করেছে।
প্রতিষ্ঠাতা কিম ইল-সাঙ আনুষ্ঠানিকভাবে ডেমোক্রেটিক পিপলস রিপাবলিক অব কোরিয়া নামের এই দেশটির রাজনৈতিক মতাদর্শ সমাজতন্ত্র বললেও, আসলে এটি রাজতন্ত্রের মতো চলে।
তার পুত্র কিম জং-ইল তার ক্ষমতা কেন্দ্র হিসাবে সামরিক বাহিনীর ওপর নির্ভর করে আসছেন আর সেজন্য ব্যালেস্টিক মিসাইল আর নিউক্লিয়ার অস্ত্র দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে উস্কানি দিয়ে এসেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, এসব কর্মসূচী চালিয়ে নিতে এই শাসক যন্ত্র অবৈধ পদ্ধতির আশ্রয় নিয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে অত্যন্ত সূক্ষ্ম সুপার ডলার জালিয়াতি।
কিম জং-ইল একই সাথে দেশটির কৌশলের মধ্যে সাইবার প্রযুক্তি অন্তর্ভুক্ত করে নেন। দেশটিতে ১৯৯০ সালে কোরিয়া কম্পিউটার সেন্টার চালু করা হয়। এটি দেশটির তথ্যপ্রযুক্তি কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রে অবস্থান করছে।
২০১০ সালে যখন কিম জং-আন, কিম জং-ইলের তৃতীয় পুত্র, ক্ষমতার উত্তরসূরি পরিচিতি পেতে শুরু করেন, এই শাসক যন্ত্র তাদের ভবিষ্যৎ নেতাকে পরিচিত করিয়ে দিতে শুরু করেন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির একজন চ্যাম্পিয়ন হিসাবে। এই প্রচারণার লক্ষ্য ছিল, নতুন প্রজন্মের তরুণদের আনুগত্য অর্জন এবং নতুন সরঞ্জাম নিয়ে তাদেরকে যোদ্ধা হিসেবে কাজ করতে অনুপ্রাণিত করা।
২০১১ সালে ক্ষমতায় আসার পর তরুণ কিম পারমাণবিক অস্ত্রকে মূল্যবান তলোয়ার বলে বর্ণনা করেন, কিন্তু তারও এই কর্মসূচী চালিয়ে নিতে তহবিল দরকার। কিন্তু ২০০৬ সালে প্রথম পারমাণবিক অস্ত্রের প্রথম পরীক্ষা আর দূরপাল্লার মিসাইলের পরীক্ষা করার পর জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদের কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপের ফলে সেটি তার জন্যে আরো কঠিন হয়ে উঠেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা মনে করেন, তার এই তহবিল সমস্যা দূর করতে যে উপায় রয়েছে, সাইবার হ্যাকিং হচ্ছে তার একটি।
কিন্তু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির আশ্রয় নিলেও উত্তর কোরিয়ার নাগরিকদের জন্য বিশ্বের ইন্টারনেট ব্যবস্থায় সরাসরি যুক্ত হবার সুযোগ নেই। কারণ তা হলে দেশের জনগণ দেখতে পাবে যে তাদের দেশের সীমান্তের বাইরের দুনিয়াটা আসলে কেমন এবং তাদের সরকার সম্পর্কে সরকারি বক্তব্যের বাইরে পুরো ভিন্ন রকম তথ্য জানার সুযোগ পাবে।
ফলে সাইবার যোদ্ধাদের প্রশিক্ষিত করার জন্য ক্ষমতাসীনরা বেশিরভাগ প্রতিভাবান কম্পিউটার প্রোগ্রামারদের বিদেশে পাঠায়, বিশেষ করে চীনে।
সেখানে তারা শেখে কীভাবে সারা বিশ্ব কেনাকাটা, জুয়া, নেটওয়ার্কিং এবং বিনোদনে কম্পিউটার ও ইন্টারনেট ব্যবহার করে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সেখানেই তারা গণিতের মেধাবী তরুণ থেকে হ্যাকারে রূপান্তরিত হয়।
ধারণা করা হয়, এই তরুণদের বড় একটি অংশ চীনের ভেতরে উত্তর কোরিয়া পরিচালিত কেন্দ্রগুলোয় বসবাস এবং কাজ করে।
‘তাদের পদচিহ্ন ঢেকে রাখার ব্যাপার তারা খুবই দক্ষ, কিন্তু কখনো কখনো অন্য যেকোনো অপরাধীর মতো, তারা পেছনে কিছু ছাপ বা প্রমাণ রেখে যায়,’ বলছেন এফবিআইয়ের সাবেক কোরিয়া প্রধান কাইয়ুং-জিন কিম, যিনি বর্তমানে সোলে একটি প্রাইভেট তদন্তকারী হিসাবে কাজ করেন। ‘আমরা তাদের আইপি অ্যাড্রেস শনাক্ত করে তাদের অবস্থান বের করতে পারি।’
এই ছাপ তদন্তকারীদের নিয়ে যায় চীনের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের শেনইয়াংয়ের একটি সাদাসিধে ধরনের হোটেলের দিকে, যার সামনে এক জোড়া পাথরের বাঘ খোদিত রয়েছে। এটি কোরিয়ার ঐতিহ্যগত একটি প্রতীক। এই হোটেলের নাম চিলবোসান, উত্তর কোরিয়ার একটি সুপরিচিত পাহাড়ি এলাকার নামে এই নামকরণ।
হোটেল পর্যালোচনা ওয়েবসাইট অ্যাগোডায় দেয়া এই হোটেলের ছবিতে কোরিয়ান স্থাপত্য, রঙিন বিছানা, উত্তর কোরিয়ান ধরনের খাবার-দাবার দেখা যায়, যেখানে ওয়েট্রেসরা তাদের গ্রাহকদের জন্য গান গাইছেন এবং নৃত্য করছেন।
গোয়েন্দাদের কাছে এটি খুবই পরিচিত একটি জায়গা, বলছেন কাইয়ুং-জিন কিম। তারা সন্দেহ করেন, চিলবোসানে বসেই উত্তর কোরিয়ার হ্যাকাররা নিজেদের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেছিল যখন ২০১৪ সালে তার প্রথমবার বিশ্ব দরবারে নিজেদের প্রকাশ করে।
পাশাপাশি চীনের আরেকটি শহর দালিয়ানে, যেখানে পার্ক জিন-হয়োক প্রায় এক দশক ধরে বসবাস করেছেন বলে ধারণা করা হয়, সেখানে কম্পিউটার প্রোগ্রামারদের একটি সম্প্রদায় রয়েছে যারা সেখানে উত্তর কোরিয়ানদের ধরনে বসবাস এবং কাজ করেন, বলছেন কোরিয়া থেকে পালিয়ে আসা হাইয়ুন-সেয়ুং লি।
লির জন্ম এবং বড় হয়ে ওঠা পিয়ংইয়ংয়ে কিন্তু তিনি বহু বছর দালিয়ানে বসবাস করেছেন, যেখানে তার পিতা উত্তর কোরিয়া সরকারের জন্য ব্যবসা করতেন এবং তার অনেক যোগাযোগ ছিল। তবে ২০১৪ সালে এই পরিবারটি পক্ষ বদল করে। যখন তিনি সেখানে থাকতেন, সেই সময় ইয়োলো সীর পাশের ওই বন্দর নগরীতে পাঁচ শ’ জনের বেশি উত্তর কোরিয়ান বসবাস করত।
তাদের মধ্যে অন্তত ৬০ জন কম্পিউটার প্রোগ্রামার-বেশিরভাগই তরুণ। লি বলছেন, যখন জাতীয় ছুটিতে উত্তর কোরিয়ানরা সমবেত হয়, যেমন কিম ইল-সাংয়ের জন্মদিনে-একজন লিকে তাদের থাকার স্থানে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। সেখানে লি অন্তত ২০ জন তরুণকে এক স্থানে দেখতে পান। একেকটি রুমে চার-ছয়জন করে বসবাস করেন। সামনের বসার কক্ষকে তারা অফিসের মতো বানিয়েছেন, যেখানে অসংখ্য কম্পিউটার রয়েছে।
তারা লিকে দেখিয়েছিল যে, তারা কী করছে- মোবাইল ফোনের গেমস- যা দালালের মাধ্যমে দক্ষিণ কোরিয়া আর জাপানের কাছে বিক্রি করা হয়, যার মাধ্যমে বছরে তারা এক মিলিয়ন ডলার আয় করে।
যদিও উত্তর কোরিয়ার নিরাপত্তা কর্মকর্তারা তাদের ওপর নজরদারি করে থাকে, কিন্তু এই তরুণরা তুলনামূলক স্বাধীন জীবনযাপন করে। ‘যদিও কড়াকড়ি আছে, কিন্তু উত্তর কোরিয়ার তুলনায় তারা অনেক স্বাধীনতা পায়, তারা ইন্টারনেটের সুবিধা পায় এবং কিছু সিনেমাও দেখতে পারে।
সূত্র : বিবিসি