চীনের সাথে আপস করতে বাধ্য হবে পাশ্চাত্য?
বাইডেন ও শি - ছবি সংগৃহীত
মালাক্কা প্রণালী হয়ে চীনের একমাত্র উত্তর-পূর্ব সমুদ্র প্রবেশপথেই মধ্যপ্রাচ্য থেকে চীনের সব জ্বালানি আসে। তাই এই পথ ও এর বিকল্প পোর্টও চীন খুঁজবে, সেটাই স্বাভাবিক। সে কারণে পাকিস্তান, বাংলাদেশ (প্রস্তাবিত), মিয়ানমার, শ্রীলঙ্কায় গভীর সমুদ্রবন্দর বানানো চীনের নিজের স্বার্থেই জরুরি। অথচ এই বন্দরগুলো বানাতে গেলে এবার ভারতকে দিয়ে আমেরিকা কান্নার রোল উঠাবে যে, আমাকে চীন চার দিকে ‘মুক্তামালা’র মতো ঘিরে ফেলল! মানে চোর উলটা পুলিশ ডাকে! এমনকি থাইল্যান্ডের ভূখণ্ড কেটে সুয়েজ খালের মতো আরেকটা মালাক্কা বাইপাস তৈরির আলাপ চলছে চীনের থাইল্যান্ডের সাথে।
আমেরিকা ভূখণ্ড এশিয়াতে নয়। তাহলে, ইন্দো-প্যাসিফিক বা কোয়াডে আমেরিকার এই নেতাগিরি কেন? আমেরিকা বলবে আমার বন্ধুরা এখানে আছে তাদের রক্ষা করতে। এই অজুহাতও না হয় মেনে নেয়া যাক।
প্রেসিডেন্ট ওবামা হলেন সেই লোক যিনি এশিয়া পিভোট পলিসি চালু করতে গিয়েছিলেন ২০১১ সালে এবং শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হন। কিন্তু কী ছিল সেটা?
উপরে যেটা বলেছিলাম চীনের প্রবেশপথের দুদিকেসহ চার দিকে প্রায় ১০টা দেশ আছে (যাদের বেশির ভাগই আবার আসিয়ান জোটের সদস্য) এবং যাদের সাথে চীনের সমুদ্রসীমা মীমাংসিত নয়। আমেরিকার সব প্রশাসনের খুবই মন-কামনা যে, সমুদ্রসীমা নিয়ে এরা সবাই চীনের সাথে সামরিক বিরোধে জড়াক। আর তাতে আমেরিকা তাদের সবাইকে নিজের কোলে বা কোনো জোটে তুলে নিয়ে এবার তাদের পক্ষ হয়ে চীনের সাথে বিরোধে আমেরিকা সামরিক নেতা হিসেবে হাজির হোক। এটাই ছিল আমেরিকার কথিত স্বপ্ন বা আমেরিকার পিভোট বা ভরকেন্দ্র-ভূমিকা; চীনের বিরুদ্ধে এক আলগা মাতবর আমেরিকা।
আলগা বললাম কেন? বললাম এজন্য যে, বাস্তবে অমন ১০ দেশের কেউ আমেরিকার প্ররোচনায় পা দেয়নি। তাদের অবস্থান বুদ্ধিমানের। সেটা হলো, তারা মনে করে, চীনের সাথে সমুদ্রসীমা অমীমাংসিত বলে বিতর্ক আছে সত্য। কিন্তু সেজন্য আমেরিকার সামরিক জোটে যাওয়া বিপজ্জনক। তারা মনে করে, চীন বিরোধিতার স্বার্থে আমেরিকার কোলে উঠে বসার মানে হয় না। আর সমুদ্রবিরোধে চীনের সাথে আপসে না গেলে তো তাদের দাবি লোপাট হবে না।
আবার ওই ১০ দেশের সবার বাণিজ্য স্বার্থের দিক থেকে চীন তাদের কাম্য। কারণ চীন অবকাঠামো-ঋণ দেয়ার উত্থিত দেশ। এ ছাড়া চীনে রফতানির বাজার পাওয়াও সম্ভব। কাজেই এই স্বার্থকে মেরে ফেলাও তো বোকামি। এ কারণে ওইসব দেশের (এমনকি চীনের বিরুদ্ধে জেতা ফিলিপাইনও) কেউ আমেরিকার কোলে ওঠেনি। উল্টা, চীনের সাথে বাণিজ্য সম্পর্ক চালিয়ে যাচ্ছে। এমনকি সাম্প্রতিককালের ইন্দোনেশিয়া যার সাথে চীনের ঠিক সমুদ্রসীমা বিতর্ক নেই তবে জেলেদের মাছ ধরার রাইট নিয়ে বিরোধ আছে, সেও এই টিকা পাবার কালে চীনা টিকার টেস্টে অংশগ্রহণ ও টিকা কেনার সম্পর্কে জড়িয়েছে। আর প্রকাশ্যে বলছে, দুটা আলাদা ইস্যু, আমরা আমাদের মাছ ধরার রাইট ছাড়িনি।
এক কথায় বললে এটা ওবামার পিভোট শুধু পাত্তা না পাওয়া নয়, এশিয়াতেই আমেরিকার পা ফেলার জায়গাও কেউ দিতে, যুদ্ধে জড়াতে কেউ রাজি না হওয়া।
এখন ওবামার আমেরিকার এতবড় ব্যর্থতার পরও বাইডেন একই ফর্মুলা নিয়ে আবার এসেছেন কেন? যারা কেউ পিভোটে যোগ দেয়নি তারা কেন আবার ইন্দো-প্যাসিফিক না কোভিডে যোগ দেবে বলে বাইডেনের আশাবাদ? তাহলে কিসের ভরসায় তিনি জি-৭ বা ন্যাটোকে দিয়ে চীনের বিরুদ্ধে যুদ্ধের হুমকি দিতে ও ঢোল বাজাতে এলেন?
চীনের সাথে আমেরিকার গ্লোবাল নেতৃত্ব নেয়া বা দেয়া নিয়ে বিরোধ আছে, যেটাকে ‘বাণিজ্যযুদ্ধ’ বলা হচ্ছে। কিন্তু সেটাকে ফয়সালার জন্য বাইডেন যুদ্ধের দিকে এটাকে ঠেলে দেবেন আর এশিয়ার দেশগুলো আমেরিকার পক্ষে যুদ্ধে যেতে পোলারাইজড্ হতে যাবে কেন? ইতোমধ্যেই এটা পরীক্ষিত যে তারা কেউ যাবে না এবং পিভোট প্রকল্প আজ মৃত!
তাহলে এবার ইউরোপ অনেক সাড়া দিচ্ছে মনে হচ্ছে; সেটা কেন? খুব সম্ভবত এটা এক ‘সাদা’-বাদী শঙ্কা ও তা থেকে একাত্মবোধ। বাইডেন এই ভয়টাই ইউরোপে বিক্রি করেছেন। কথাটাকে প্রতীকীভাবে অনেক সময় বলা হয়, এশিয়া বা চীন গ্লোবাল নেতৃত্বে শক্ত হয়ে বসে যাওয়ার মানে কী? মানে হলো, আমরা দেখব, গুলিস্তানের কামানের পাশ দিয়ে সাদা পশ্চিমা তরুণেরা ক্লান্ত হলে ফাইল হাতে হেঁটে বেড়াচ্ছে, চাকরি খুঁজছে। ঠিক যেমন এখন আমেরিকার কুইন্সে বা পশ্চিমের কোনো শহরের বাঙালি পাড়ায় আমরা ভিড় করি- কখনো চাকরি কখনো স্কলারশিপের লোভে! এই ভয়টাই বাইডেন ইউরোপে বিক্রি করে তাদের তিনি নিজের পেছনে জড়ো করেছেন যে, দেখি না চীনের নেতা হয়ে যাওয়াকে ১০ বছর ঠেকিয়ে রাখতে পারি কিনা!
বিল্ড ব্যাক বেটার ওয়ার্ল্ড
বাইডেন জি-৭ বৈঠকে শুধু চীনের বিরুদ্ধে যুদ্ধের উসকানি তুলেছেন তাই নয়, সাথে আরেক চালচুলাহীন কর্মসূচি চালুর ঘোষণা করেছেন। সেটা বিনা তুলনায় বললে কেউ কিছু বুঝবে না। বলতে হবে এটা চীনের বেল্ট-রোডের বিকল্প এক বাইডেন জোটের কর্মসূচি। এর নাম দেয়া হয়েছে- ‘বিল্ড ব্যাক বেটার ওয়ার্ল্ড (ই৩ড )’। প্রথম তিনটা শব্দ ইংরাজি বি দিয়ে বলে ই৩ আর পরে ওয়ার্ল্ডের ড। এ কারণে সংক্ষিপ্ত ই৩ড। এক কথায় বললে বেল্ট-রোড জাতীয় বিনিয়োগ অবকাঠামো গড়ার খাতের ঋণ, তবে যার পরিমাণ বিশাল। ই৩ড এর কি সেই মুরোদ আছে? আমেরিকার এই দিন শেষের বেলায়? এখানে আমেরিকান বিনিয়োগ বলতে বিশ্বব্যাংক বা এডিবির মাধ্যমে তাদের জন্মকালে যা চাঁদা দিয়েছিল। একালে ইউএসএইডের মতো সরকারি দাতব্য প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিতরণের অর্থ কমে আসা দেখলেই তো বুঝা যায় কিভাবে আমেরিকান সক্ষমতা কমে এসেছে, কী হাল হয়েছে! এর ওপর বাইডেন আশাবাদ রেখেছেন ব্যবসায়ীদের তারা মটিভেট করে এখানে আনবেন! এসব কল্পকাহিনী তুলে রেখে বাইডেনের পরামর্শকদের উচিত বিশ্বব্যাংকের জন্য ফান্ড তুলতে ওর জন্মের সময় কী কষ্ট করতে হয়েছিল তা স্মরণ করা।
আর চীন কিভাবে করেছে? চীন একালে বিপুল সারপ্লাস একুমুলেশনের দেশ। সেই সরকারি ফান্ডটাই পরে কোথায় লাগানো যায় সেই বুদ্ধি করতেই প্রসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের মাথায় কেউ বুদ্ধি দিয়েছিল বলে ২০১৩ সাল থেকে বেল্ট-রোডের জন্ম। এখন ই৩ড হলো অনিশ্চিত আর ফকিরি চাঁদা তোলা এক ফান্ডমাত্র- সে কি করে চীনা সরকারি বিপুল সারপ্লাসের সাথে প্রতিযোগিতা করবে? আমেরিকার হাতে বিপুল সারপ্লাস সম্পদ সঞ্চিত হচ্ছে, সেই আমেরিকা কবেই মরে গেছে। সেই বুড়া বাঘকে এখন নয়া চাবুক দিয়ে চাবকালেই কি সে বাঘ তরুণ হয়ে চীনের সমতুল্য বা প্রতিদ্বন্দ্বী হতে পারবে? না সম্ভব? এগুলো কি স্বপ্ন কল্পনার গল্প দিয়ে পূরণ হওয়ার মতো কাজ?
আবার মনে করিয়ে দেই। বেল্ট-রোডের বেলায় প্রপাগান্ডা চালানো হয়েছিল এটা নাকি ঋণগ্রস্ত করে দিয়ে সে দেশের সম্পদের মালিকানা চীনের নিয়ে নেয়ার ব্যবসা। তাহলে এখন বাইডেন ই৩ড করতে চাচ্ছেন কেন? একই ঋণব্যবসা করতে? এর জবাব কী দিবেন বাইডেন?
ওদিকে আফ্রিকায় চীনা এমন বিনিয়োগ নিয়ে যারা প্রপাগান্ডা চালিয়েছিল তাদের আজকাল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কারণ এক নয়া সার্ভে রিপোর্টে আফ্রিকায় চীনা সাকসেস নিয়ে গবেষণা রিপোর্ট বের হয়েছে।
শেষ কথা হলো, বিনিয়োগ আর গল্প আসলে এক কথা নয়। ‘ট্যাকার মুরোদ’ থাকা লাগে চাচা!
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com