বোট ক্লাব : নাটকীয় তথ্য বের হয়ে আসছে!
পরীমনি - ছবি : সংগৃহীত
ঢাকা বোট ক্লাবে চলচ্চিত্র নায়িকা পরীমণিকে ধর্ষণ ও হত্যাচেষ্টার অভিযোগের রেশ কাটতে না কাটতেই আলোচনায় উঠে এসেছে গুলশানের অল কমিউনিটি ক্লাবের আরেক ঘটনা। ক্লাব কর্তৃপক্ষের অভিযোগ পরীমণি ওই ক্লাবে ভাঙচুর করেছেন। এমনকি গত ৮ জুন রাতে পরীমণির ওই ক্লাবে যাওয়া নিয়ে বুধবার রাত থেকে একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে।
পরীমণিও গুলশানের ওই ক্লাবে যাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেছেন। তবে তার দাবি ওই ক্লাবে গিয়ে তিনি কোনো ভাঙচুর চালাননি।
অপর দিকে ঢাকা বোট ক্লাবে পরীমণিকে ধর্ষণ ও হত্যাচেষ্টার ঘটনায় দায়ের করা মামলার তদন্ত করতে গিয়ে পুলিশ অনেকটা বেকায়দায়। পরীমণির অভিযোগের সাথে ঘটনার মিল পাচ্ছে না পুলিশ।
তবে পুলিশ গুরুত্বের সাথে বিষয়গুলো পর্যবেক্ষণ করছে। অল কমিউনিটি ক্লাবে পরীমণির ভাঙচুর চালানোর বিষয়ে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানিয়েছেন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) অতিরিক্ত কমিশনার এ কে এম হাফিজ আক্তার। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ কথা বলেন তিনি।
পরীমণিকে অল কমিউনিটি ক্লাবের বিষয়ে আলাদাভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে হাফিজ আক্তার বলেন, আমরা উত্তরার ডিসির সাথে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করছি। পরে এ বিষয়ে জানানো হবে। পরীমণির অভিযোগের সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে তদন্তে এগুলো আমলে নেয়া হবে কি না, এ বিষয়ে হাফিজ আক্তার বলেন, যেহেতু মামলাটি চলমান, এ ক্ষেত্রে সবকিছু জিজ্ঞাসাবাদের আওতায় আসবে। তদন্তে বারবার জিজ্ঞাসাবাদ হবে। জিজ্ঞাসাবাদ করে তদন্ত শেষে বিষয়গুলো পাওয়া যাবে।
গুলশানের ক্লাবে গিয়েছিলাম কিন্তু অপ্রীতিকর কিছু ঘটাইনি : অল কমিউনিটি ক্লাবে ভাঙচুরের ঘটনা পুরোপুরি অস্বীকার করেছেন নায়িকা পরীমণি। বুধবার সন্ধ্যায় ওই ক্লাব কর্তৃপক্ষ আনুষ্ঠানিকভাবে সংবাদ সম্মেলনে পরীমণির বিরুদ্ধে ভাঙচুরের অভিযোগ আনেন। এর পরপরই রাত ১০টার দিকে বনানীর বাসায় সাংবাদিকদের সাথে কথা বলেন পরীমণি।
আসলেই কি আপনি ওখানে গিয়েছিলেন- এমন প্রশ্নে পরীমণি বলেন, আমি গিয়েছিলাম, কিন্তু অপ্রীতিকর কিছু ঘটাইনি। গিয়েছি যে, সেটা কিন্তু সিসি ফুটেজেই দেখা যাচ্ছে। তিনি বলেন, আমি যদি অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটিয়েই থাকি, তাহলে এত দিন (৮ দিন) পরে কেন সেটি মিডিয়ায় এলো। যদি ঘটাতাম, এত দিন কি কোনোভাবেই মিডিয়ায় আসত না? আমি চাই, এটা নিয়েও তদন্ত হোক। ঢাকা বোট ক্লাবের ঘটনা প্রসঙ্গ তুলে ধরে পরীমণি বলেন, আমার সাথে যা হয়েছে, এরপর পরের চার দিন কিন্তু আমি বসে থাকিনি। সবাইকে জানানোর চেষ্টা করেছি। কিন্তু ওরা কী করেছেন? আমি যদি কোনো অপরাধ করে থাকি, তাহলে তারা কেন এত দিন চুপ করে ছিলেন? আমি যখন অভিযোগ করলাম, তাদের (ঢাকা বোট ক্লাবে নির্যাতনে অভিযুক্ত নাসির ইউ মাহমুদ) বিষয়টি সামনে আনলাম তখন তারা (অল কমিউনিটি ক্লাব) এটি নিয়ে কথা বলছে। বোঝাই যাচ্ছে, আসল ঘটনার ফোকাস ঘোরানোর চেষ্টা। পরীমণি জানান, তিনি শারীরিক ও মানসিকভাবে ভালো নেই। গত কয়েক দিন ধরেই নানা ধরনের চাপে আছেন। বলেন, এমন কিছু করা হবে বলে মনে হচ্ছিল। চার দিন ধরে অনেকেই তা আমাকে বলেছেন। আমিও সেটা বুঝেছিলাম। সত্যি, এবার মনে হচ্ছে আমি ক্লান্ত। আর পারছি না।
পরীমণির অভিযোগের সাথে ঘটনার মিল পাচ্ছে না পুলিশ : পরীমণিকে ধর্ষণ ও হত্যাচেষ্টার ঘটনায় সাভার থানায় যে মামলা হয়েছে, সেই মামলার এজাহারের বর্ণনার সাথে পরীমণির বক্তব্যের মিল পাচ্ছেন না তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। এ কারণে পরীমণির অভিযোগ নিয়ে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা ইতোমধ্যে ঘটনার আদ্যোপান্ত জানতে ঢাকা বোট ক্লাবের সিসিটিভি ফুটেজও সংগ্রহ করেছেন। সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণের পাশাপাশি তদন্ত সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা ঘটনার দিন রাতে ঢাকা বোট ক্লাবে দায়িত্বরত নিরাপত্তাকর্মীদের সাথেও কথা বলেছেন। ঘটনার বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে জানতে চাইবেন পরীমণির কাছেও। তবে প্রাথমিক তদন্তে বোট ক্লাবের ঘটনার সাথে পরীমণির অভিযোগের অনেক কিছু মিলছে না বলে মনে করছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা।
তারা বলছেন, পরীমণি সাভার থানায় দায়ের করা মামলায় বলেছেন, সেই রাতে পূর্ব পরিচিত অমিসহ কয়েকজন পরিকল্পিতভাবে দুই মিনিটের কাজ আছে বলে পরীমণিকে ঢাকা বোট ক্লাবের সামনে নিয়ে যান। সেখানে তারা গাড়িতে অপেক্ষা করেন। ছোট বোন বনির প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেয়ার জন্য তারা বারের পাশের একটি টয়লেট ব্যবহার করতে ভেতরে প্রবেশ করেন। কিন্তু ঢাকা বোট ক্লাবের প্রবেশপথ ও অভ্যর্থনা কক্ষে থাকা সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে, বোট ক্লাবের সামনে গাড়ি এসে থামার সাথে সাথেই স্বাভাবিকভাবেই পরীমণি ও তার সঙ্গীরা ক্লাবের ভেতরে প্রবেশ করেন। পরীমণি ক্লাবে প্রবেশ করেন ১২টা ২২ মিনিটে, আর ক্লাব থেকে তাকে ধরাধরি করে বের করা হয় ১টা ৫৯ মিনিটে। এই এক ঘণ্টা ৩৭ মিনিট ঢাকা বোট ক্লাবের ভেতরে কী করেছেন পরীমণি? এমন প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের একজন কর্মকর্তা বলছেন, আলোচিত এই ঘটনার পর তারা দ্রুত অভিযান চালিয়ে সন্দেহভাজন দুই অভিযুক্ত ও মামলার এজাহারভুক্ত দুই আসামি নাসির ইউ মাহমুদ ও তুহিন সিদ্দিকী অমিকে গ্রেফতার করেছেন। রিমান্ডের জিজ্ঞাসাবাদে অমি বলেছেন, তারা ক্লাবের ভেতরে গিয়ে নাসির ইউ মাহমুদসহ একসাথে মদ পান করেন। শেষে একটি বোতল নেয়া নিয়ে প্রথমে একজন কর্মচারীর সাথে পরীমণি বিতণ্ডা করেন। সেই বিতণ্ডায় যোগ দেন নাসির ইউ মাহমুদসহ আরো কয়েকজন। ঢাকা বোট ক্লাবে যাওয়ার আগে পরীমণির বনানীর বাসায় বসেই এক বোতল মদ পান করেন তারা সবাই। এসময় বাসাতে নাট্যপরিচালক চয়নিকা চৌধুরীও ছিল বলে পুলিশকে জানিয়েছেন অমি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বছর দুয়েক আগের পরিচয় সূত্র ধরে অমির সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক হয়েছে পরীমণির। দক্ষিণখানে তার বিশাল একটি বাগান বাড়িও রয়েছে।
গোয়েন্দা পুলিশের কাছে অমি স্বীকার করেছেন, মদ্যপ অবস্থায় নাসির ইউ মাহমুদ পরীমণিকে কয়েকটি চড় দিয়েছিলেন। এসময় মেঝেতে পড়ে যান পরীমণি। মদ্যপ থাকায় পরীমণিকে তারা ধরাধরি করে গাড়িতে এনে তোলেন। তিনি দুই পক্ষকেই শান্ত করার চেষ্টা করেছেন। ঘটনার পর পরীমণিকে একাধিক খুদেবার্তাও পাঠানো হয়। তবে জিজ্ঞাসাবাদে চড় দেয়ার কথা অস্বীকার করেছেন নাসির ইউ মাহমুদ।
নাসির ও অমিকে একটি মাদক মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে সাত দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। তাদের সাথে তিন দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে তিনজন নারী সঙ্গীকেও। পুলিশ তাদেরকে অমি ও নাসিরের রক্ষিতা বলে জানিয়েছে।
ঢাকা বোট ক্লাবের ওই ঘটনায় পরীমণির সাথে থাকা কস্টিউম ডিজাইনার জিমি বিতণ্ডার ১৫ সেকেন্ডের একটি ভিডিও করেছিলেন। সেই ভিডিওতে চিৎকার-চেঁচামেচির সময়ে নাসির ইউ মাহমুদকে বলতে শোনা যায়, অমি এগুলাকে তুমি আর ক্লাবে আনবা না।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ঢাকা জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সাভার সার্কেল) আব্দুল্লাহিল কাফি সাংবাদিকদের বলেন, আমরা প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটনের জন্য যা যা করণীয় সবই করছি। সেই রাতে ক্লাবে কী ঘটেছিল, নিবিড়ভাবে তদন্ত করে আমরা সেই সত্য তুলে আনতে চাই। তদন্তে প্রাপ্ত তথ্য আমরা আদালতে জমা দেবো।