ইরানকে কোন দিকে নিয়ে যাবেন নতুন প্রেসিডেন্ট?
ইরানের প্রেসিডেন্ট প্রার্থীরা - ছবি : সংগৃহীত
১৮ জুন ইরানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য ৫২৯ জন ইরানি নাগরিক তাদের নাম তালিকাভুক্ত করলেও গার্ডিয়ান কাউন্সিলের পক্ষ থেকে মাত্র সাত ব্যক্তিকে নির্বাচনে অংশ নেয়ার অনুমতি দেয়া হয়েছে।
ইরানের বেশির ভাগ নির্বাচনে কারা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার যোগ্য সেটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার দায়িত্ব দেশটির গার্ডিয়ান কাউন্সিলের হাতে। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা কর্তৃক নিয়োগকৃত ছয়জন ইসলামিক জুরিস্ট এবং বিচার বিভাগের প্রধান কর্তৃক মনোনীত ও পার্লামেন্ট দ্বারা বাছাইকৃত ছয়জন আইনজীবীর সমন্বয়ে কাউন্সিল গঠিত হয়।
গার্ডিয়ান কাউন্সিল যাদেরকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ থেকে নিষিদ্ধ বা বিরত রেখেছে, তাদের মধ্যে ইরানি পার্লামেন্টের সাবেক মুখপাত্র আলী লারিজানি, সাবেক প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আহমাদিনেজাদ ও বর্তমান ভাইস প্রেসিডেন্ট ইসহাক জাহাংগিরিও রয়েছেন। গার্ডিয়ান কাউন্সিল যে সাত ব্যক্তির প্রার্থিতা অনুমোদন করেছে তাদের মধ্যে পাঁচজন হলেন- বিচার বিভাগের প্রধান আয়াতুল্লাহ ইবরাহিম রাইসি, সর্বোচ্চ জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের সাবেক সেক্রেটারি ও পরমাণুবিষয়ক আলোচক সাঈদ জালালি, এক্সপিডিয়েন্সি কাউন্সিলের সেক্রেটারি মোহসেন রেজায়ি, ইসলামিক রেভ্যুলশনারি গার্ড কেরোর (আইআরজিসি) সাবেক প্রধান আলী রেজা জাকানি এবং এমপি আমির হোসেইন কাজিজাদেহ হাশেমি। অন্য দু’জন প্রার্থী হলেন- আবদুল নাসের হিমাতি, তিনি একজন টেকনোক্র্যাট এবং ইরানের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর। অন্যজন হলেন ইরানের জাতীয় ক্রীড়া সংস্থার প্রধান ও ইসপাহানের সাবেক গভর্নর। এই সাতজন প্রতিদ্বন্দ্বীর মধ্যে ইবরাহিম রাইসি হচ্ছেন প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী। ইরানের অনেক পর্যবেক্ষক আশা করেন, তিনি কেবল ইরানের পরবর্তী প্রেসিডেন্টই নির্বাচিত হবেন না, বরং দেশটির পরবর্তী সর্বোচ্চ নেতাও হবেন তিনি।
গার্ডিয়ান কাউন্সিল কয়েক দশক ধরে সতর্কতার সাথে নির্বাচনগুলো পরিচালনা করে আসছে। কাউন্সিল দেশটির সর্বোচ্চ নেতা আলী হোসেইনি খামেনির কাছে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিরা যাতে নির্বাচিত হয়ে আসতে পারেন সে জন্য চেষ্টা চালিয়ে আসছে। তবুও আসন্ন নির্বাচনে বেশ কিছু বিশিষ্ট এবং যোগ্য প্রার্থীকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে না দেয়ার ব্যাপারে গার্ডিয়ান কাউন্সিল যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা নজিরবিহীন।
ইরান সরকার মনে করে, ইসলামী প্রজাতন্ত্র বর্তমানে একটি টার্নিং পয়েন্টে রয়েছে তাই গার্ডিয়ান কাউন্সিল প্রার্থী তালিকার ব্যাপারে তাদের নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি করেছে। খামেনির ঘনিষ্ঠ মিত্র মেহেদি তাইয়্যেব সম্প্রতি বলেছেন, বিপ্লবকে ‘বিশুদ্ধ’ করা প্রয়োজন। এ বক্তব্যের মাধ্যমে কী বোঝানো হয়েছে তা উপলব্ধি করতে হলে খামেনির রাজনৈতিক আদর্শের দিকে দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন।
নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকে খামেনি একটি সফল ইসলামী বিপ্লবের পাঁচটি অত্যাবশ্যকীয় পর্যায় রয়েছে বলে জানিয়ে ছিলেন। প্রথম পর্যায় হলো- ইসলামী বিপ্লব ঘটানো। দ্বিতীয় পর্যায়ে একটি ইসলামী সরকার প্রতিষ্ঠা করা সেটি অবশ্যই একটি ইসলামী সরকারব্যবস্থার মাধ্যমে পরিচালিত হবে। চতুর্থ পর্যায় হলো একটি ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠা করা, যেখানে একটি ইসলামী সভ্যতা প্রতিষ্ঠার পথ খুলে যাবে। সেটি একটা মডেল বা আদর্শ হিসেবে কাজ করবে এবং সারা বিশ্বের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোর জন্য আদর্শ এবং নেতৃত্ব হিসেবে কাজ করবে। খামেনির মতে, ‘১৯৭৯ সালের ইসলামী বিপ্লবের মাধ্যমে ইসলামী প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে প্রথম দুই পর্যায় সম্পন্ন করা হয়েছে। কিন্তু ইরান এখনো একটি ‘ইসলামী সরকার প্রতিষ্ঠা করে তৃতীয় পর্যায় শেষ করতে পারেনি।’
সুতরাং বর্তমানে খামেনির প্রধান রাজনৈতিক লক্ষ্য হলো- তার অনুগত ও তার স্বপ্ন অনুযায়ী দেশ গড়ে তোলার জন্যে একটি ‘সত্যিকারের ইসলামী সরকার’ দিয়ে দেশ পরিচালনা করার বিষয়টি নিশ্চিত করা। এ লক্ষ্য অর্জনের জন্যে তিনি ২০১৯ সালে একটি মেনিফেস্টো প্রকাশ করেছিলেন। তিনি এখনো একটি ‘ইসলামী সরকার’ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালিয়ে নবোদ্যমে কাজ করার জন্য পরিবেশ তৈরির চেষ্টা চালাচ্ছেন। তিনি অনুগত ও প্রকৃত ইসলামী যুবকদের (যাদেরকে মিডিয়া কট্টরপন্থী হিসেবে প্রচার করে থাকে) নিয়ে সেনাবাহিনী, বিচার বিভাগ, ধর্মীয় সংগঠনগুলো ও মিডিয়ায় অনির্বাচিত কিন্তু রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী পদ সৃষ্টি করে রেখেছেন। তিনি ২০২০ সালের পার্লামেন্ট নির্বাচনে ইরানি বিপুলসংখ্যক তরুণকে পার্লামেন্টে তার অনুগত ও সমর্থক করে এনেছেন। সুতরাং খামেনির ইসলামী বিপ্লবের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছার জন্য একটি আদর্শ ‘ইসলামী সরকার’ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হতে যাচ্ছে।
খামেনি ১৯৮৯ সালে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা নির্বাচিত হয়েছিলেন। তখন থেকে তিনি চারটি প্রশাসনের সাথে কাজ করেছেন। এগুলো হলো- রাফসানজানি প্রশাসন (১৯৮৯-৯৬), খাতামি প্রশাসন (১৯৯৭-২০০৪), আহমাদিনেজাদের প্রশাসন (২০০৫-১৩) ও রুহানি প্রশাসন (২০১৩-২০)। এ চারটি সরকারের মধ্যে আহমাদিনেজাদের নেতৃত্বাধীন সরকার ছিল খামেনির আদর্শের ‘ইসলামী সরকার’-এর খুব কাছাকাছি। অন্তত আহমাদিনেজাদের প্রথম মেয়াদের সরকার এই পর্যায়ের ছিল। আহমাদিনেজাদ ২০০৫ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত ইরানের এই সর্বোচ্চ নেতার সাথে হৃদ্যতাপূর্ণভাবে কাজ করেন। তাদের মধ্যে তেমন বৈরিতা ছিল না। কিন্তু প্রেসিডেন্ট হিসেবে দ্বিতীয় মেয়াদের সময় রাজনৈতিক ক্ষমতার দ্বন্দ্বে দু’জনের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হয়। সর্বোচ্চ নেতা এখন আহমাদিনেজাদের সময়কালীন একই ধরনের নীতি ও কৌশল অনুসারে একটি নতুন প্রশাসন প্রতিষ্ঠা নিশ্চিত করার জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি আগামী প্রশাসনকে মেয়াদের শেষ পর্যন্ত তার প্রতি অনুগত ও সহায়ক দেখতে চান।
প্রধান প্রেসিডেন্ট প্রার্থী রাইসির নির্বাচনী প্রচারণার সাথে আহমাদিনেজাদের প্রেসিডেন্ট থাকাকালে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সম্পৃক্ত করা হয়েছে। যেমন- ২০০৯-১১ সালে সাবেক প্রেসিডেন্ট আহমাদিনেজাদের প্রশাসনে গৃহায়ন মন্ত্রীর দায়িত্ব পালনকারী আলী নিকজাদ এবং ২০০৯-১২ সালে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালনকারী রেজা তাঘিপুরকে নির্বাচনী প্রচারণার সাথে যুক্ত করা হয়েছে।
আহমাদিনেজাদের প্রেসিডেন্টের দায়িত্বে থাকাকালে মতোই ভবিষ্যৎ রাইসি প্রশাসনের রাজনৈতিক নিয়োগপ্রাপ্তদের মধ্যে ইরানি সমাজের সবচেয়ে রক্ষণশীলদের নেয়া হবে। বিশেষভাবে আইআরজিসি এবং নির্যাতিত বাসিজ সংস্থা থেকে এসব নিয়োগ দেয়া হবে। বাসিজ সংস্থা হচ্ছে আইআরজিসির জন্য কর্মরত একটি আধাসামরিক গ্রুপ। আইআরজিসি ও বাসিজ কেবল ইসলামী বিপ্লব এবং সেই আদর্শের ঐকান্তিক সমর্থকদেরই আবাসিক স্থল নয়, সাথে সাথে তারা সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতার বৃহত্তর এবং অত্যন্ত প্রভাবশালী সমর্থকদের ঘাঁটি হিসেবেও কাজ করে।
খামেনি যদি কট্টরপন্থী হিসেবে পরিচিত আইআরজিসি সদস্য এবং বাসিজের লোকদের দিয়ে দেশের বেশির ভাগ রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত পদগুলো পূরণ করার মাধ্যমে একটি নতুন প্রশাসন গড়ে তুলতে সফল হওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারেন তা হলে ইরানি সরকার এবং সুপ্রিম লিডার বা শীর্ষ নেতা কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত ‘ডিপ স্টেটের’ মধ্যকার দূরত্ব চূড়ান্তভাবে দূর হয়ে যাবে।
খামেনির চোখে এমন একটি প্রশাসন সত্যিকারের ‘ইসলামী সরকারের প্রতিনিধিত্ব করতে পারবে এবং বিপ্লবের লক্ষ্যে পৌঁছার জন্যে নীতি বাস্তবায়নে আরো সফল হবে।
খামেনির মতে, একবার একটি ইসলামী সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলে ইরানি সমাজকে পরিপূর্ণভাবে ইসলামীকরণের জন্য কাজ করবে। এটি হচ্ছে ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার চতুর্থ পদক্ষেপ।
১৯৭৯ সালে ইরানি বিপ্লবের পর থেকে এ পর্যন্ত ইরানি সমাজ ইসলামীকরণের দু’টি ঢেউ দেখার অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে। এর একটি হলো ১৯৮০ সালে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বন্ধ করে দিয়ে এবং দ্বিতীয়টি ছিল ২০০৫, সালে আহমাদিনেজাদ প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার মাধ্যমে।
১৮ জুন অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনের মাধ্যমে ইরানের শীর্ষ ধর্মীয় নেতার আশা, তার অনুগত একটি ‘ইসলামী সরকার’ গঠিত হলে ইরান নিঃসন্দেহে ইসলামীকরণের তৃতীয় ঢেউ দেখতে পাবে। প্রথম দু’টি ঢেউয়ের সময় যেমন দেখা গেছে ইরানে ইসলামীকরণের তৃতীয় ঢেউয়ের সময়ও হয়তো প্রাথমিকভাবে তিনটি বিষয় স্পষ্ট হবে। সেগুলো হলো- দৈনন্দিন এবং রাজনৈতিক জীবনে ইসলামী সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ আরো শক্তিশালী হবে, ইরানি সমাজে পশ্চিমা প্রভাবের বিরুদ্ধে সংগ্রাম আরো জোরদার হবে এবং দেশের সব সামাজিক ও রাজনৈতিক গ্রুপের ওপর সার্বিকভাবে শীর্ষ ধর্মীয় নেতার প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ আরো বৃদ্ধি পাবে।
এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য নতুন প্রশাসনকে হয়তো শক্তি প্রয়োগ করতে হবে। কারণ বর্তমানে ইরানি জনসংখ্যার একটি বড় অংশ ক্ষমতাসীন সরকারের আদর্শ ও উচ্চাকাক্সক্ষা ধারণ করে না। যারা নতুন প্রশাসনের জারি করা বিধিনিষেধ প্রতিরোধ করার চেষ্টা করবে, প্রশাসন তাদের ওপর চাপ প্রয়োগ করবে। যুবসমাজ ও নারীরা প্রশাসনের জন্য ক্রমবর্ধমানভাবে চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারে। প্রশাসন তাদের ব্যাপারেও কঠোর হতে পারে।
পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে নতুন ইসলামী সরকার ওই অঞ্চলে ইরানের প্রভাব বৃদ্ধি এবং অন্য দেশে ইসলামী বিপ্লব ছড়িয়ে দেয়ার মতো ইরানি ইসলামী প্রজাতন্ত্রের দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য অর্জনের জন্য কাজ করবে। খামেনি সমর্থিত যেকোনো ভবিষ্যৎ ইসলামী সরকারের একটি সুস্পষ্ট বৈশিষ্ট্য হবে আমেরিকাবিরোধী অবস্থান। ইরানি সরকার এবং সর্বোচ্চ নেতার পরিচয়ের প্রধান ইস্যু হচ্ছে মার্কিন বিরোধিতা।
সুতরাং শীর্ষ নেতৃত্বের সমর্থিত যেকোনো নতুন সরকার আমেরিকা ও তার মিত্রদের বিরোধিতা অব্যাহত রাখবে এবং রাশিয়া ও চীনের সাথে সম্পর্ককে আরো ঘনিষ্ঠ ও দৃঢ় করবে। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণে নতুন প্রশাসন আফ্রিকান ও দক্ষিণ আমেরিকান দেশগুলোর সাথে আরো ভালো সম্পর্ক গড়ে তোলাকে অগ্রাধিকার দেবে।
আয়াতুল্লাহ খামেনির বয়স এখন ৮২ বছর। তিনি চান তার সরকার আর আদর্শ তাকে বেশি দিন বাঁচিয়ে রাখুক। তিনি কেবল ১৯৭৯ সালের বিপ্লবের চেতনায় বেঁচে থাকতে চান না- তিনি চান ইরান একটি ইসলামী ক্ষমতার কেন্দ্র এবং মুসলিম বিশ্বের নেতা হয়ে উঠুক।
লেখক : টেনেসি চাট্টানুগা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিজ্ঞানের সহকারী অধ্যাপক
আলজাজিরার সৌজন্যে
ভাষান্তর : মুহাম্মদ খায়রুল বাশার