সেই ১৭ ভাইরাস সম্পর্কে যা জানা যাচ্ছে
ভাইরাস - ছবি সংগৃহীত
মহামারীর সৃষ্টি কেন হয়? আধ্যাত্মিকবাদীরা দাবি করেন, মানুষের নৈতিকতার অবক্ষয়ের চূড়ান্ত পর্যায়ে এর অভ্যুদয় ঘটে। বিজ্ঞানী-দার্শনিকরা এটা পরোক্ষভাবে স্বীকার করেন এ বলে যে, মানুষ যখন তার ব্যবহারিক জীবনকে সুস্থ-সুন্দর-শৌচ রাখতে ব্যর্থ হয় তখনই মহামারীর আবির্ভাব হয়।
আগেই বলা হয়েছিল যে, ইতিহাস তথ্য অনুসারে করোনাভাইরাস ১৭তম ভাইরাস। এর আগের ভাইরাসগুলো হলো- ১. প্লেগ ভাইরাস; ২. ভ্যারিওয়ালা ভাইরাস; ৩. ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস; ৪. পোলিও ভাইরাস; ৫. আরভিএফ ভাইরাস; (রিফটভ্যালি ফিভার ভাইরাস) ৬. ডেঙ্গু ভাইরাস; ৭. সিসিএইচএফ ভাইরাস; ৮. জিকা ভাইরাস; ৯. মারবুর্গ ভাইরাস; ১০. ইবোলা ভাইরাস; ১১. এইচআইভি ভাইরাস; ১২. হেনিসা ভাইরাস; ১৩. নিপাহ ভাইরাস; ১৪. সার্স ভাইরাস; ১৫. সোয়াইন ভাইরাস; ১৬. মার্স ভাইরাস ও ১৭. করোনাভাইরাস।
এই ভাইরাসগুলো কেমন ভয়ঙ্কর ছিল, তার একটি ছোট্ট বিবরণই যথেষ্ট এটা জানতে। ১. প্লেগের ভাইরাস প্রধানত বহন করে ইঁদুর এবং ১৩৪৬ খিষ্ট্রাব্দে প্রথম চিহ্নিত করা হয় ইউরোপে। ইরসিনিয়া পেস্টিস নামক ব্যাকটেরিয়া এটা বহন করত। এটা এত ভয়ঙ্কর ছিল যে, তখন এর নামকরণ করা হয় কালো মৃত্যু বলে। এর আবিষ্কারক ছিলেন ইয়ারসি। এই মহামারীতে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের ৩০ শতাংশ মানুষ মৃত্যুবরণ করে। ২. ভ্যারিওয়ালা ভাইরাসের উৎপত্তি যিশু খ্রিষ্টের জন্মের আগে। এর আক্রমণে গুটিবসন্ত বা স্মল পক্স রোগ হয়। এটা প্রথম মিসরে খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতে আবির্ভাব হয় বলে ইতিহাসে জানা যায়। এর টিকা ১৭৯৩ সালে আবিষ্কৃত হলেও এর ব্যবহার পরবর্তী ২০০ বছরে হয়নি। ফলে লাখ লাখ মানুষ আক্রান্ত এবং মৃত্যুবরণ করে।
১৯৭০ সালে ভারত উপমহাদেশে এটি ব্যাপক বিস্তৃতি লাভ করলে জাতিসঙ্ঘ ও অন্যান্য দেশ একত্রে এর প্রতিষেধক ব্যবহার শুরু করার পর ১৯৭৫ সালে বিশ্ব এই রোগমুক্ত বলে ঘোষণা দেয়া হয়। ৩. ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস- এই ভাইরাসটিও খ্রিষ্টের জন্মের আগের একটি রোগ বলে বলা হয়। ধারণা করা হয়, এই ভাইরাসটির উপস্থিতি ২০ হাজার বছর আগেও ছিল। মাত্র এক বছরেই এক কোটি মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয় বলে এক বর্ণনায় এসেছে। ৪. পোলিও ভাইরাস- পোলিওমাটিস বা পোলিও প্রথমে ধরা পড়ে ১৯০৯ সালে। প্রথমে নিউ ইয়র্ক শহরে এর বিস্তৃতি শুরু হয়ে ক্রমে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। এতে দেহের অঙ্গগুলো অবশ হয়ে পড়ে। নিউ ইয়র্কের ৯ হাজার আক্রান্তের মধ্যে ছয় হাজার মৃত্যুবরণ করে। সারা বিশ্বে কত মানুষ পোলিওতে মারা গেছে তার সঠিক হিসাব কারো জানা নেই। ১৯৫০ সালে টিকা আবিষ্কারের পর এর নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়। ৫. আরভিএফ (রিফটভ্যালি) ভাইরাস- ১৯৩১ সালে কেনিয়াতে এই রোগটি প্রথমে ধরা পড়ে। সাধারণত রক্তখেকো মশা বা পতঙ্গের মাধ্যমে এটা পশুদের মধ্যে ছড়ায় এবং পরে মানুষকেও আক্রমণ করে। দেখা গেছে, আক্রান্ত গরুর দুধ খেলেও এই রোগে আক্রান্ত হয়। এতে দুই হাজার মানুষ ও শত শত গরু এবং অন্যান্য পশু মারা যায়।
মানুষের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো অবশ হয়ে যায়। ৬. ডেঙ্গু ভাইরাস- এটা ধরা পড়ে ১৯৪৩ সালে যখন সামান্য জ্বরেই মানুষের হৃদপি-, কিডনি, এমনকি মস্তিষ্ক অচল হয়ে মৃত্যুবরণ করছিল। এতে চার হাজার ২১ জনের মৃত্যু রেকর্ড করা হয়। সারা বিশ্বে প্রায় ৩০ কোটি লোক আক্রান্ত হয়েছিল। প্রথম দিকে জ্বর হতো তীব্র এবং সাথে মাথাব্যথা এবং কিডনির প্রদাহ। পরে দেখা গেল, রোগটি নিজেকে পরিবর্তিত করে তখন এসব উপসর্গ মৃদু হচ্ছিল। ৭. সিসিএইচএফ ভাইরাস (ক্রাইমিয়ান কঙ্গো হেমোরেজিক ফিভার) এক প্রকারের এঁটেল পতঙ্গ থেকে আসে আর মানুষের মধ্যে ছড়াতে থাকে। এটা প্রধানত আফ্রিকা, বলকান অঞ্চল, মধ্যপ্রাচ্য এবং এশিয়ার কিছু এলাকায় কিছুকালের জন্য দাপিয়ে বেড়ায়। প্রায় ৫০০ মানুষ মৃত্যুবরণ করে। এর উপসর্গ হলো- মাথাব্যথা, জ্বর, মেরুদন্ডে ব্যথা, পাকস্থলীতে ব্যথা এবং বমি। ৮. জিকা ভাইরাস- উগান্ডার জিকা বনভূমিতে এর উৎপত্তি। ধরা পড়ে ১৯৪৭ সালে। মশার মাধ্যমে ছড়ায় বলে নির্ণয় করা হয়। যৌন সংসর্গেও এটা ছড়িয়ে পড়তে দেখা যায়। এখনো কোনো টিকা আবিষ্কার হয়নি। ৯. মারবুর্গ ভাইরাস- এই রোগ প্রথমে জার্মানির মারবুর্গ শহরে ১৯৬৭ সালে ধরা পড়ার কারণে এই নামকরণ করা হয়। সেখানে প্রায় চারশত লোক মৃত্যুবরণ করে। ইবোলার মতো এটা বাদুড় থেকে সংক্রমিত হয় বলে নির্ণয় করা হয়। ১০. ইবোলা- আফ্রিকায় ১৯৭৬ সালে আবিষ্কৃত হয়। প্রায় এক হাজার মানুষ এতে মৃত্যুবরণ করে। ইবোলায় আক্রান্ত হলে ৫০-৯০ ভাগ লোক মারা যেতে দেখা গেছে। সাধারণত গা গোলানো, বমি, ডায়রিয়া হয় এবং সাথে লিভার ও কিডনির কর্মক্ষমতা হ্রাস পায়। ফলে কারো মধ্যে রক্তপাত হতে থাকে। ১১. এইচআইভি ভাইরাস- এই ভাইরাসের আক্রমণে দেহে এইডস রোগের উৎপত্তি হয়। এইডস মানুষের রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা কেড়ে নিলে সামান্য জ্বরেও মানুষের মৃত্যু হয়। ১৯৮১ থেকে ২০০৯ সালের মধ্যে দুই কোটি ৫০ লাখ লোক মৃত্যুবরণ করে। বাংলাদেশেও এটা নির্ণয়ের জন্য ৯১টি কেন্দ্র (সরকারি ১৬ ও বেসরকারি ৭৫টি) কাজ করছে। ২০১৫ সাল পর্যন্ত চার হাজার ১৪০ জনকে পজিটিভ নির্ণয় করা হয়। ১২. হেনিসা ভাইরাস- এটা প্রথমে অস্ট্রেলিয়ায় চিহ্নিত হয়। ১৯৯৪ সালে ঘোড়ার মৃত্যু হতে থাকে এবং তার সংস্পর্শে থাকা চারজন মানুষও মারা যায়। এটা বাদুড় দ্বারা সংক্রমিত হচ্ছিল। ৭০টি ঘোড়ার মৃত্যু হয়। ১৩. নিপাহ ভাইরাস- এটার প্রসারও বাদুড়ের মাধ্যমে ঘটতে দেখা যায়। ১৯৯৮ সালে শূকরের মাঝে মালয়েশিয়ায় এটা প্রথমে নির্ণয় করা হয়। নিপাহ শহরে এটা প্রথমে ধরা পড়ে বলে এই নামকরণ। দেড় শতাধিক মানুষ মৃত্যুবরণ করলে এর ভয়াবহতা আন্দাজ করা হয়। বাংলাদেশের লালমনিরহাটে ১৭ জন এ রোগে মারা যায়। ১৪. সার্স ভাইরাস (সিভিয়ার অ্যাকিউট রেসপিরেটরি ভাইরাস)- চীনে এই রোগটির উৎপত্তি হয় বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। ২০০২ সালে এর উৎপত্তির বছরে সে দেশে মারা যায় ৭৭৪ জন। তবে ২০০৪ সালের পর থেকে এই রোগের খবর আর পাওয়া যায়নি। ১৫. সোয়াইন ইনফ্লুয়েজা- শূকরের মাধ্যমে আসে বলে নামকরণ হয়েছে এই রোগটির। ইউরোপ-আমেরিকায় ৭৫টি দেশে এর ভয়াবহ প্রাদুর্ভাব ঘটেছিল। বাংলাদেশে ভারতের মাধ্যমে রোগটি আসে বলে নির্ণীত হয়েছে। ১৬. মার্স ভাইরাস- এটাকে মিডল ইস্ট রেসপিরেটরি সিনড্রোম বলার কারণ, এ রোগ সৌদি আরব ছাড়া আশপাশের মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে একসাথে আবির্ভূত হয়। ২০১২ সালে সৌদি আরবে পরিলক্ষিত হয়। মারা যায় প্রায় ৭০০ মানুষ।
এখন ১৭তম ভাইরাস হিসেবে করোনা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। করোনা প্রথমে মুরগির মধ্যে লক্ষ্য করা যায় ১৯৬০ সালে চীনে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, বাদুড় এবং সাপ প্রথমে এই ভাইরাসটির আমদানি ঘটায়। পরে মুরগির মাধ্যমে মানবদেহে প্রবেশ করে দ্রুত ছড়াতে থাকে এবং এ পর্যন্ত ১৩১টি দেশে এ রোগটি দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। এপর্যন্ত ৩৮ লাখের বেশি মানুষ এ রোগে প্রাণ দিয়েছে বলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার খবর। আবার একটি পক্ষ বলছে, চীনের উহান থেকে এর জন্ম। এখানকার বিখ্যাত ভাইরাস ল্যাবরেটরিতে থেকে জীবাণুটি ছড়িয়ে পড়ে।