সাকিবের লাথি এবং অতঃপর
সাকিবের লাথি এবং অতঃপর - ছবি : সংগৃহীত
নদীতে বাস করে কুমিরের সাথে ঝগড়া করা যায় না কিংবা বনে বাস করে বাঘের সাথে। সবাই যখন একটা খ্যাতিমান ক্লাবের তাঁবেদার তখন মনের দুঃখ মনেই চাপা রাখা দরকার। কিন্তু কতক্ষণ। দুর্বল মনের পাশাপাশি যারা সবল তারাও মনে কষ্ট নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকেন বছরের পর বছর। ব্যতিক্রম সাকিব আল হাসান। তবে প্রতিবাদের ভাষা যে ঠিক হয়নি সেটি এ মুহূর্তে বুঝতে না চাইলেও জীবনের একটা সময় ঠিকই বুঝবেন। আম্পায়ারের পক্ষপাতমূলক আচরণ আড়ালেই থেকে গেল। সাকিবের তিন ম্যাচ বহিষ্কারাদেশের মাঝে গতকাল একটি পেরিয়ে গেছে। বাকি দুটো। সাথে পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা। আর দ্বৈত ভূমিকায় থাকা খালেদ মাহমুদ সুজনের কোনো দোষ দেখেনি বোর্ড। একটা জরিপে দেখা গেছে, লাথি কাণ্ডে ৫৩ শতাংশ মানুষ সাকিবের পক্ষে। যেটি চাপা ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ।
সাকিবের শাস্তি মওকুফে মোহামেডান ক্রিকেট কমিটি চেয়ারম্যান মাসুদুজ্জামান ইতোমধ্যে ঢাকা সিসিডিএম কাছে একটি চিঠি পাঠিয়েছেন। তবে সিসিডিএম সদস্য সচিব আলী হোসেন জানান, তারা এখনো চিঠিটি পাননি। সংবাদমাধ্যমকে মাসুদুজ্জামান বলেন, ‘সাকিবের শাস্তি কমাতে সিসিডিএমের কাছে আমরা আবেদন করেছি। গতরাতে মেইল করেছিলাম। আজ সরাসরি সিসিডিএমে লিখেছি আমি।’
আম্পায়ারদের বিতর্কিত সিদ্ধান্ত যুগ যুগ ধরেই চলছে। সেটি হোক ক্রিকেট, ফুটবল, হকি কিংবা অন্য কোনো ডিসিপ্লিনে। বর্তমানে ফেডারেশনগুলোতে অনেক কর্মকর্তারই ক্লাব আছে। আম্পায়ারদের কি সাধ্য আছে কর্মকর্তার কথার বাইরে যায়। শেষ তক বলীর পাঠা হন আম্পায়ররা। একবার তো হকিতে বিদেশ থেকে আম্পায়ার এনেও সুরাহা হয়নি মওলানা ভাসানী স্টেডিয়ামে। তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরে যেতে হয়েছে বিদেশী আম্পায়ারকে। শক্তিশালী ক্লাবের দাপট বেশি থাকায় তাদের বিপক্ষে হয় না আউট, হয় না গোলও। প্রয়োজনে বদলে যায় বাইলজ, সুবিধার জন্য পরিবর্তন হয় ফিকশ্চার।
২০১৯ সালে ফতুল্লা স্টেডিয়ামে ভুল আউটের প্রতিবাদে ব্যাটসম্যান উইকেটের ওপর বসে আছেন। খেলা বন্ধ। আম্পায়ার খেলোয়াড়কে অনুনয় করে বলেছেন, ‘আমার কিছু করার নেই। আজ তোমাদের হারাতেই হবে। নইলে আমি আর ম্যাচ পাব না।’ সাংবাদিকের হাত ধরে বলেছেন, ‘এই কাজ ছাড়া আর কোনো কাজ নেই। ওদের পক্ষে সিদ্ধান্ত না দিলে ম্যাচ পাব না। খাব কী? প্লিজ আপনি কিছু লিখবেন না।’
শীর্ষ ও প্রভাবশালী কর্তাদের বেশির ভাগই আবাহনীর। প্রিমিয়ার ক্রিকেট লিগ পরিচালিত হয় সিসিডিএমের মাধ্যমে। সিসিডিএম চেয়ারম্যানও আবাহনীর পরিচালক। আবাহনীর আরো দুই পরিচালক ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি ছিলেন। তাদের আমলে আবাহনীর পক্ষপাতিত্ব নিয়ে এত অভিযোগ না হলেও গত কয়েক বছর ধরে ক্রিকেটে আবাহনীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে পক্ষপাতের অভিযোগ উঠেছে। ডিপিএলে খেলছে ১২টি দল। সাত রাউন্ড হয়ে গেলেও আবাহনীর কোনো ব্যাটসম্যান এলবিডব্লিউ হননি। বাকি ১১ দলের ক্ষেত্রে যা ৩৪ বার হয়েছে। তন্মধ্যে মোহামেডানের চারজন, প্রাইম ব্যাংকের ছয়জন, শেখ জামালের চারজন, শাইনপুকুরের পাঁচজন, খেলাঘরের তিনজন, ব্রাদার্স, গাজী গ্রুপ, লিজেন্ড অব রূপগঞ্জ, ওল্ড ডিওএইচএস, প্রাইম দোলেশ্বর ও পারটেক্সের দুইজন করে এলবিডব্লিউ হন।
টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার পর থেকেই আইসিসিতে বাংলাদেশের কোনো এলিট আম্পায়ার নেই। বাংলাদেশের কোনো খেলা হলে সাধারণত শরফুদ্দৌলা ইবনে সৈকত, গাজী সোহেল ও মাসুদুর রহমান মুকুলকে আম্পায়ারিং করতে দেখা যায়। সে হিসেবে ঘরোয়া ক্রিকেটে বড় কোনো ম্যাচে স্বাভাবিকভাবে তাদের আম্পায়ারিং করার কথা। আশ্চর্যজনকভাবে আবাহনী-মোহামেডানের মতো হাই ভোল্টেজ ম্যাচে তারা কেউ আম্পায়ারিংয়ের দায়িত্ব পাননি।
ঘরোয়া ক্রিকেটের আম্পায়ারিং নিয়ে বিতর্ক বহু দিন ধরে। বিসিবি প্রেসিডেন্ট পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন। তিন দিনের মধ্যে তদন্ত পেশ করতে বলা হয়েছে। আইসিসির নিয়মানুযায়ী বোর্ডের এন্টি করাপশন ইউনিট থাকে। প্রকাশ্যে গোপনে ঘরোয়া ক্রিকেটে নানা অভিযোগ এসেছে। কোনোটিই কিছু হয়নি। এটিও যে আই ওয়াশ হবে না সেটির কোনো গ্যারান্টি নেই।
বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের হয়ে দীর্ঘদিন মাঠ মাতিয়েছেন খালেদ মাসুদ পাইলট। অবসরের পর দেশের ঘরোয়া লিগগুলোতে নিয়মিত কোচিং করাতেন। আচমকা এই পেশা থেকে সরে দাঁড়ান। কারণ ব্যাখ্যায় সাবেক এই অধিনায়ক জানান, ‘ঘরোয়া ক্রিকেটে বর্তমানে কোচিং করানোর পরিবেশ নেই। আপনি যখন আগেই জানবেন যে এই দলটা চ্যাম্পিয়ন হবে সেটা কিভাবে মানবেন। আমি নিজেও এর ভুক্তভোগী।’
সাবেক অধিনায়কা ও বর্তমান বোর্ড পরিচালক নাঈমুর রহমান দুর্জয় জানান, ‘আসলে এই জিনিসগুলো অনেক আগে থেকেই ছিল। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেও ছোট দল-বড় দলের বৈষম্য দেখা গেছে। ডিআরএসের কারণে অনেক স্বচ্ছতা এসেছে। ঘরোয়া ক্রিকেটে এই প্রযুক্তিগুলো ব্যবহার করলে সমস্যা অনেকটা সমাধান হবে। তা ছাড়া ক্রিকেটকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে হলে অবশ্যই আম্পায়ারদেরকে কনসিডারেশনে নিতে হবে।