চীনের কাছে যেভাবে হেরে যাচ্ছে ভারত
মোদি ও শি - ছবি সংগৃহীত
হেরে গেলেও হার স্বীকার করা যাবে না। পারলে মানুষের ক্ষতি করে বেড়াতে হবে। সেটাও না পারলে ঈর্ষা করতে হবে। গত কয়েক বছর ধরে, মানে ২০০৫ সালের পর থেকে ভারতকে চীনের সাথে তুলনা করতেই হবে, তুলনীয় বলে দাবি করতে হবেই। আমেরিকা ভারতের পিঠে হাত রাখাতে সেই থেকে ভারত ফাঁপা হলেও পরাশক্তি হয়ে যাবার ভান করতে হবে তাকে। সর্বশেষ নরেন্দ্র মোদির আমলে এসে এটা ক্রমশ মিথ্যা বলে বার বার হাজির হতে হতে কোভিডের সেকেন্ড ওয়েভে এসে এবার আপাতত স্থবির হয়েছে। কিন্তু তবু কেউ কেউ চাপাবাজি চালানোর সুখানুভবে তা বন্ধ করতে রাজি হতে চাচ্ছে না; এমনকি উদাম হয়ে গেলেও না। এর মূল কারণ আমেরিকা। তার খায়েশ, সে ভারতকে ব্যবহার করেই, একে আরো অথর্ব করে দিয়ে হলেও এশিয়ায় চীনকে ঠেকিয়ে নিজের অবস্থান ধরে রাখতে পারবেই।
আমেরিকারও নিজের স্টাডি রিপোর্ট যাই বলুক, একই সমস্যা। ফাঁপা হোক সেটাই পছন্দ। তার স্টাডি রিপোর্ট বলছে, সে চীনের কাছে গ্লোবাল অর্থনীতিতে ক্রমশ হেরে যাচ্ছে। চীন তাকে ছাড়িয়ে যাবেই।
মানে মামলাটা হলো গ্লোবাল অর্থনীতিতে নেতা থাকা আর হেরে সরে যাওয়া- এ দুইয়ের। অন্য ভাষায় বললে, এখন গ্লোবাল অর্থনীতিতে নেতৃত্বে পালাবদলের কাল যেখানে পালাবদলের স্টেজে দেখা যাবে আমেরিকা সিন-আউট হয়ে যাচ্ছে আর চীন ক্রমশ আসরে জেঁকে বসছে। এসব কথা আমেরিকার গ্লোবাল ট্রেন্ড রিপোর্টের। বাইরের কারো লেখার উদ্ধৃতি এটা নয়; যেখানে বলা হয়েছে এতদিন গ্লোবাল বিনিয়োগ পুঁজি পশ্চিমেই বসে থেকেছে আর সেই পশ্চিমে বিনিয়োগে বসে থেকেই বাকি সারা দুনিয়ার উপর আমেরিকা নেতৃত্ব ও মাতব্বরি করে এসেছে। কিন্তু এখন সেই চিরপরিচিত ট্রেন্ডে বদল ঘটছে। কারণ, সারভাইভাল বা টিকে থাকার প্রশ্ন। তাই সে এখন চীনকে শক্ত হাত ও সক্ষম বলে উঠে আসতে দেখছে। তাই পুঁজি এখন আমেরিকার হাত ছেড়ে চীনের হাত ধরতে ছুটছে। আর এতেই সারা পশ্চিমের পুঁজি একেবারে ঢলে পড়ে এশিয়া-মুখে ছুটে চলেছে। তাতে যে পশ্চিমে যুক্তরাষ্ট্র এতদিন বড় হয়েছে, কোল পেয়েছে তার প্রতি কোনো মহব্বত নেই। কারণ সারভাইভাল! সে এতে মরবে না বাঁচবে- কারণ ‘আপনি বাঁচলে বাপের নাম’- এই সম্পর্কে আছে সে।
আরো মারাত্মক কথা হলো, গ্লোবাল পুঁজির এভাবে পশ্চিম ছেড়ে পুবে-এশিয়ায় ছুটে চলা এটা সাময়িক নয়, একেবারে স্থায়ী। মানে, এটা আর নিকট ভবিষ্যতে কখনো উল্টামুখী বা ফিরে পশ্চিমমুখী হবে না। কিন্তু আমেরিকা তা শুনার বা কান দিবার অবস্থাতেও নাই। সম্প্রতি বাইডেন সে দেশে ক্ষমতায় এসে ইউরোপকেও মিথ্যা আশায় রাজি করিয়েছেন। তারাও চীনের সাথে আগেভাগে সম্পর্ক করতে অনেকটাই এগিয়ে গিয়েছিল। তবু এখন সেসব ফেলে বাইডেনের আশ্বাসে তার পেছনে।
এর কারণ সম্ভবত আমেরিকার সাথে ইউরোপের সহমর্মিতাবোধ। মাত্র পাঁচ শ' বছরের মধ্যে যে পশ্চিম এতদিন এশিয়াকে তার গোলাম বানিয়ে রেখেছিল আজ পশ্চিমকে সেই এশিয়ার অধীনে চীনের নেতৃত্বে চলে যেতে হবে, এটা কোনো পশ্চিমা-মনের পক্ষে গ্রহণ করা সহজ নয়। সাদা শ্রেষ্ঠত্ববাদ এভাবে হেরে যাবে, গুটিয়ে যাবে, এশিয়ার পেছনে তাদের হাঁটতে হবে এটা তাদের কাছে সম্ভবত অকল্পনীয়।
অথচ সোজা ভাষায় বললে, ব্যাপারটা পুঁজির সারপ্লাস একুমুলেশন বা উদ্বৃত্ত পুঁজির পুঞ্জীভবনের অবজেকটিভ ঘটনা। এটা একেক কালপর্বে যেখানে যে ভুগোলে যত দ্রুত ঘনীভূত হবে, সেই নেতা হবে। কারণ ব্যাপক অর্থনৈতিক তৎপরতা ঘটার সবচেয়ে ফেভারেবল পরিস্থিতি পেলে সে সেখানেই পেয়ে বেড়ে উঠবে যাকে এরপর কেউ ঠেকাতে পারবে না, রোধ করতে পারবে না। সেই ভুগোলটাই এখন বর্তমান কালপর্বে হলো ‘চীনের নেতৃত্বে এশিয়া’।
এটাই কি একইভাবে এককালে ইউরোপের বিপরীতে আমেরিকার হাতে প্রবলভাবে সারপ্লাস একুমুলেশন ঘটায়নি! আর তার ফলেই কি আমেরিকা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ইউরোপেরও নেতা এবং গ্লোবাল নেতা হয়ে হাজির হয়ে ছিল না! এতকিছু পরিষ্কার জানা সত্ত্বেও আমেরিকার এক মরিয়া জিদ যে, সে ভারতের পিঠে হাত রেখে ছলনায় বলবে, এবার এশিয়ায় ভারত চীনের সমতুল্য। এই অবাস্তব এবং কোনো ডাটা যা বলে না এমনই অসত্য। কিন্তু এই কথা সে ভারতকেও বিশ্বাস করিয়েছে।
যেমন ভারতের (১৩৭ কোটি ২০১৯ সালের) জনসংখ্যা চীনের (১৪৩ কোটি) প্রায় কাছাকাছি হতেই পারে। এর মানে তো আপনাআপনি ভারতে চীনের মতো সারপ্লাস একুমুলেশন ঘটে গেছে দাবি করা যাবে না। তা সত্যও নয়। কিন্তু ভারত তা বিশ্বাস করে এত দিন গিলে বসেছিল। বস্তুত বড় জনসংখ্যার দেশ হলেই হবে না। তাতে এক ভাইব্রেন্ট অর্থনীতি হাজির করা- এটাই মূল চাবিকাঠি ও মূল চালিকাশক্তি। চীন এটা অর্জন করতে টানা চল্লিশ বছর দুই পর্বে (১৯৭০-৯০ প্রস্তুতিপর্ব আর পরে ১৯৯০-২০১০ অ্যাকশনপর্ব ) তা অতিক্রম করেছে। এটা আগে ঘটাতে পারলে তবেই চীনের লেভেলে সারপ্লাস একুমুলেশনের কথা ভাবা বা দাবি করার বাস্তবতা ভারতের জন্য তৈরি হতে পারে; যেটা ঠিকমতো একবার চালু হলে- পরে সবকিছুই চলবে। একমাত্র এরপরেই, এক পর্যায়ে এই উদ্বৃত্তের কিছু অংশ নিজ সেনাবাহিনীতে ব্যবহার বা অন্য দেশে বিপুল বিনিয়োগে খরচ (ফলে অন্য দেশের ওপর প্রভাব প্রতিপত্তি হাতে আসা) করার সামর্থ্য আসবে। এভাবে কমপক্ষে ২০ বছর চলতে পারলে সেই দেশ পরাশক্তির মর্যাদা পাবার পূর্বাবস্থায় পৌঁছাতে পারে। অথচ ভারতের ভাইব্রেন্ট অর্থনীতি, ডাবল প্রবৃদ্ধি, চীনের ন্যায় সারপ্লাস একুমুলেশন- ইত্যাদি কোনো কিছুরই খবর নেই। অথচ ভারতকে অনবরত চীনের সাথে তুলনা করতে উস্কানি দিয়ে চলেছে আমেরিকা। যেন সোনালি চাবুক হলেই জীর্ণ-শীর্ণ ঘোড়াও সবল হয়ে উঠবে।
মোদি গত সাত বছরে এই মিথ্যা ভ্যানিটিটাই ভারতের সাংবাদিকসহ ইন্টেলেকচুয়ালদের এমন বিশ্বাস করিয়েছেন যে, সেটা একটা মানসিক অসুখে পরিণত করেছে। এতে কেবল মোদির যা অর্জন তা হলো সবচেয়ে মডার্ণ-নারী-সাংবাদিক ও ফরেনডেস্ক এডিটরেরও মোদির হিন্দুত্ববাদের বিরুদ্ধেনিজের চরম অগ্রহণযোগ্যতা প্রকাশ করতে ভুলে গিয়েছেন। কারণ তিনি বিশ্বাস করেছেন ভারত নাকি একেবারে পরাশক্তি হয়ে গেছে। কাজেই এই ভারত হিন্দুত্ববাদের হলেও অসুবিধা কী! কারণ সকাল-বিকাল তাকে দেখানো হত আর সে দেখত ভারত এখন আমেরিকার সাথে ছাড়া ওঠাবসা করে না। এটা দেখে সে বিগলিত হতো। কিন্তু ফাঁপা ভিতরটা কোভিডের সেকেন্ড ওয়েভের ঝড়ে তছনছ ও উদোম হয়ে যায়। বাস্তবের ভারতে বেড বা অক্সিজেন নেই, হাসপাতাল বা চিকিৎসা নেই। প্রতিদিন চার হাজার করে রোগী মরছে। মৃতের সৎকারের খবর নেই, নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হয়েছে। অসহায় মোদি ক্ষুদ্র ভুটান বা সেই চীনসহ বিশ দেশের কাছে ত্রাণ-সাহায্য চেয়ে হাত বাড়িয়েছেন। আর এতেই ইন্টেলেকচুয়ালদের চোখ খুলেছে। যে পরাশক্তি সে কেন ত্রাণ চাইবে? এতে সব ভেঙে উদোম হয়ে গেছে যে ভারত কোনো পরাশক্তির ধারেকাছেরও কেউ নয়। এতকিছু বুঝার পরও কারো কারো আমেরিকার মিথ্যা প্রলোভনে থাকতে চাওয়া বন্ধ হয়নি।
ওয়াশিংটনের এক থিংকট্যাংক ও রিসার্চ সেন্টার হলো ‘হাডসন ইনস্টিটিউট’। তার এক পাকিস্তানি ও এক ভারতীয় ফেলো যৌথভাবে ভারতের বা গ্লোবাল মিডিয়ায় লেখা নিয়ে হাজির হচ্ছেন। তেমনই এক লেখার প্রসঙ্গ ছিল সাউথ-ইস্ট এশিয়ান জোট, সার্ক। আর তাতে শিরোনাম হলো, ‘কোভিড বলছে ভারত যদি সার্কের দায়িত্ব নিতে ব্যর্থ হয় তবে চীন নিয়ে নিবে।’
এরপর ওই লেখা শুরুর বাক্যটাও বলছে, ‘কোভিড মহামারী কেবল মানব দুর্দশা বা অর্থনৈতিক বিপর্যয়ই আনে না এর খারাপ স্ট্রাটেজিক পরিণতিও আছে। এটা দেখিয়ে দিয়েছে সাউথ এশিয়াকে নেতৃত্ব দিতে ভারত কোন সীমায় আটকে আছে! আর সেই সাথে ভারতের প্রতিবেশীদের কাছে ভারতকে নিচু দেখিয়ে চীনের ভূমিকা কত উঁচুতে।’ এভাবে চীনের সাথে খামোখা ভারতের তুলনা করা হয়েছে এ লেখায়। এক কথায় বললে এটা সেই পুরান কথা, খামোখা চীনের পর্যায়ে তুলে ভারতের বন্দনা আর কোভিডে ভারতের ইজ্জত লুটানোতে সহানুভূতি জোগাড় করা। যেমন, যে কুকুরের গায়ের চামড়া উঠে গেছে তার নাম বাঘা রাখলেও কোনো কিছু পরিবর্তন হয় না। এরা তবু সেটাই করে যাবেন। যেন ভারতের হাতে চীনের কাছাকাছি সারপ্লাস একুমুলেশন বা উদ্বৃত্ত সম্পদ আছে যা ভারত চাইলেই প্রতিবেশী দেশে বিনিয়োগ করতে সক্ষম। ফলে ‘কোভিডের কারণে প্রতিবেশীদের ওপর ভারতের স্ট্রাটেজিক প্রভাব খাটো হয়ে যাচ্ছে। না হলে চীনকে একেবারে দেখিয়ে দিত’।
তাই ওই লেখা বলছে, ‘অতএব কোভিডই দেখাচ্ছে যে, এ অবস্থায় ভারত সার্ককে নেতৃত্ব দিতে ব্যর্থ হওয়ার সুযোগটা এবার চীন নিয়ে নিবে।’ এগুলোই নায়িকাদের ফুটানি বা ভ্যানিটির মতো কথা যেন! স্টার-ইমেজ ছাড়া নায়িকাদের সিনেমা চলে না, আমরা বুঝি। কিন্তু আমেরিকা আর কতদিন ভারতের পিঠে হাত রেখে মিথ্যা প্রলোভন দিয়ে যাবে?
অসংখ্য ত্রুটিতে ভরে আছে ওই লেখা কারণ ‘হোমওয়ার্ক’ করে নেয়া হয়নি ঠিকমতো।
প্রথমত এই লেখকদ্বয়ের সার্ক সম্পর্কে ন্যূনতম কোনো ধারণা আছে মনে হয় না। যেমন সাম্প্রতিকালে ভারতই ‘সার্কে পাকিস্তান আছে’ বলে সার্ককেই বাদ দিয়ে ভাগাড়ের মতো ফেলে রাখার চেষ্টা করেছে, সে খবর এদের কাছে নেই। এমনই ২০১৬ সালের শেষের এক খবর হলো- বিডিনিউজ২৪ লিখেছিল, “সার্ক ভুলে বঙ্গোপসাগরভিত্তিক দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর আঞ্চলিক জোট ‘বিমসটেকের’ ওপর জোর দিতে বাংলাদেশকে পরামর্শ দিয়েছেন” সাবেক এক ভারতীয় কূটনীতিক ও ভারতের ওআরএফের ফেলো পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী। অর্থাৎ বলতে চাইছেন, তাই ভারতের কাছে সার্ক আপন কোনো কিছু নয়। অথচ সেই সার্ককেই তারা ভারতের জন্য উদাহরণ হিসাবে এনেছেন। দ্বিতীয়ত, চীন সার্কের মেম্বার নয়। তাহলে ‘ভারত না পারলে চীন পারবে’ এ কথা তোলা হচ্ছে কিভাবে? তৃতীয়ত, এই অঞ্চলে সার্ক ফাংশনাল কিছু হয়ে ওঠে, এমন কখনই ভূমিকা নিতে পারেনি।
মূলত ভারত-পাকিস্তান দ্বিপাক্ষিক অসংখ্য ক্যাচালের ইস্যু- এখানে হাজির করাতে নিষেধ থাকলেও এরা পিছনের ক্যাচালের কারণে সার্কে এসে নিষ্ক্রিয় থেকে এটা কার্যকর হতে বাধা হয়েছে। আবার এই বাধার কাজে ভারত-পাকিস্তান কারো ভূমিকাই কম ছিল তাও নয়। এর পরেও সার্ক দেশের মধ্যে শুল্ক কমিয়ে পণ্য বিনিময় বাড়ানোর একটা চেষ্টা করা হলেও তা কাজ করেনি। মূলত ভারতের পুরানা অভ্যাস যে, একদিকে বলবে শুল্ক তুলে নিয়েছে অথচ রফতানি করতে গিয়ে দেখা যাবে প্রায় সমতুল্য নন-ট্যারিফ শুল্ক আরোপ করে রেখেছে ভারতই।
কঠোর ‘দেশপ্রেমী’ ‘উগ্র-জাতিবাদী’ ভারত কী করে বিদেশী পণ্য আমদানি করতে দিতে পারে? বরং এর বিনিময়ে বাংলাদেশের পুরা বাজারটা কব্জা করাই তাদের জন্য ‘দেশপ্রেম’; যার সোজা মানে হলো, ভারত কোনো ধরনের অর্থনৈতিক বা বাণিজ্যিক রাষ্ট্রজোটের সদস্য হবারই তো যোগ্য নয়।
তবু আমরা দেখেছি ওই লেখায় লিড ভারতীয় লেখক অপর্ণা পান্ডে ভারতকে ‘লারজেস্ট কান্ট্রি ইন দা রিজিয়ন’ খেতাব দিয়েছেন। আবার সেকেন্ড ওয়েভে অক্সিজেনের অভাবে পড়লে ছোট দেশ ও সার্কের সদস্য ভুটান নিজের অক্সিজেন প্লান্ট থেকে প্রতিদিন ৫০ মেট্রিক টন করে ভারতকে দিচ্ছে, এ কথাটা তিনি জ্বলুনির সাথে উল্লেখ করছেন; সেটাও এক ভারি তামাশা বটে! তাহলে তার চোখে ভারত ‘লারজেস্ট কান্ট্রি’- এটা কী অর্থে? জনসংখ্যা নাকি উদ্বৃত্ত সম্পদে বিনিয়োগ সক্ষমতায়? নিশ্চয় জনসংখ্যাই বুঝেছেন। কোনো দেশকে প্রভাবশালী হিসাবে ‘বড়’ বুঝায় তার কী থাকলে- এরা যেন তাই বোঝেন না। নইলে ভারত বড় কিনা এখানে এই তর্ক তোলার অর্থ কী? ছোট্ট ভুটানের অক্সিজেন নিতে কষ্ট হচ্ছে- এটা তো দেখছি পেটি মধ্যবিত্তসুলভ ঈর্ষা!
তার আরো মারাত্মক এক বক্তব্য হলো, তিনি এবার স্বীকার করে বলছেন, সার্কের ভিতর ভারতকে ন্যাচারাল নেতা (রিজিয়নস ন্যাচারাল লিডার) বলে পাকিস্তান স্বীকৃতি না দিতে পারার কারণেই নাকি এই জোটের সমন্বয় হয়নি কখনো।
ভারতীয় নারী লেখিকার এই বক্তব্য খুবই ক্ষুদ্র মনের। তিনি আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্ক নিয়ে কথা বলার যোগ্য মনে হচ্ছে না। এখানে ভারত ‘ন্যাচারাল লিডার’ মানে কী? আল্লাহ স্বয়ং নয় দিছে? এরকম?
আসলে বন্ধুদের ছোট গ্রুপের বেলাতেও যেটা দেখা যায়, অনেক গ্রুপে এমন বন্ধু একজন থাকে যে বন্ধুদের বিপদে এগিয়ে যায়, উদ্ধার করতে খরচ করে এবং খরচ করা অর্থ কী করে পরে ফেরত পাবে বা আদৌ ফেরত পাবে কিনা তা না জেনেই সে এটা করে। এমন দায়িত্ব নিবার এই স্বভাবÑ এমন গ্লোবাল নেতা এবং আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্কের বেলায় একেই ‘এম্পায়ার’ বা সাম্রাজ্যের শাসকের ইতি গুণধারী বলা হয়। কেউ গ্লোবাল নেতা হতে চাইলে তার এই গুণ থাকা জরুরি বা অনিবার্য। এর বাইরে ন্যাচারাল লিডার বা খামোখা লিডার বলে কিছু নেই। ভারত ‘ন্যাচারাল লিডার’ কথার মানে কি কলোনি-ব্রিটিশ কী ভারতের বাপ?
তবে বড় জোর অপর্ণা পান্ডের এমন কথা এক ‘উগ্র দেশপ্রেম’ হতে পারে। যেটার আবেগী মূল্য কিছু থাকলেও সেটা তার দেশের ভেতরেই থাকতে পারে। আর বাইরের লোকেরা শুনলে এটাকে বোকামি মনে করে বিরক্ত হবে।
আসল কথাটা হলো, নেপাল বা ভুটান ল্যান্ডলকড দেশ বলে এ থেকে দুধদোয়ানোর মতো করে এখনো সুবিধা বের করে আসছে ভারত। যেমন, নেপাল বা ভুটান বাংলাদেশকে বিদ্যুৎ বিক্রি করতে চাইলে আগে কোনো ভারতীয় কোম্পানিকে কমিশন বুঝিয়ে দিয়ে এরপর কেবল ওই ভারতীয় কোম্পানির মাধ্যমে তা বিক্রি করতে হবে। এর অর্থ হলো, ‘সাম্রাজ্যের শাসকের ইতিগুণ’ জিনিসটা নিয়েই ভারতের বুঝাবুঝি একেবারেই বাইরের। ‘স্মল’ ভারত এটা বুঝবে না।
না এটাকে ‘দাতা মহসীন’ হতেও বলা হচ্ছে না। একটা ‘ফেয়ার ডিল’, একটা ন্যায্য সম্পর্কের কথা বলা হচ্ছে; যেখানে এতে এম্পায়ারের কোনো ফাইন্যান্সিয়াল লস হলে সেটার দায় ভাগ করে নেয়া যেতে পারে। আর এতে এম্পায়ারের কোনো লস হলেও যেহেতু এতে তার স্বাভাবিক প্রভাব প্রতিপত্তি বাড়বে, এটাই তার পক্ষে নন-ফাইন্যান্সিয়াল রিটার্ন পাওয়া হবে। আসলে কারো গ্লোবাল নেতার ভূমিকায় হাজির হওয়া এতই সহজ নয় বা একপক্ষীয় সুখের নয়।
সে লেখায় শেষে খুবই ঈর্ষাকাতর এক মন্তব্য করা হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘কোভিডের এই ইমারজেন্সির কালে নগদ অর্থ ঢালার ক্ষতিকর ক্ষমতার চীন (ক্যাশ ফ্ল্যাশ ম্যালাইন পাওয়ার) তার প্রভাব বাড়িয়ে নেবার সুযোগ পেয়ে যাবে।’
ভারতের জন্য দিল্লি আসলেই দু-র-অ-স্ত। অন্তত ঈর্ষা দিয়ে এসবের কিছুই অর্জন করা যায় না! আমেরিকা ভারতের পিঠে হাত রেখেছে বলেই ভারত তার সব অক্ষমতার বন্ধাত্ব ছাড়িয়ে সক্ষম হয়ে যাবে না। আমেরিকা তা করতেও পারে না, করবে না। কারণ রাষ্ট্র মানেই নিজ একান্ত স্বার্থ আগে। আর সক্ষমতা? সেটা তো সবার নিজেরটা নিজেই অর্জন করে নিবার জিনিস!
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com