ভারত : অপর্না পান্ডের উগ্র দেশপ্রেম
অপর্না পান্ডে - ছবি সংগৃহীত
কঠোর ‘দেশপ্রেমী’ ‘উগ্র-জাতিবাদী’ ভারত কী করে বিদেশী পণ্য আমদানি করতে দিতে পারে? বরং এর বিনিময়ে বাংলাদেশের পুরা বাজারটা কব্জা করাই তাদের জন্য ‘দেশপ্রেম’; যার সোজা মানে হলো, ভারত কোনো ধরনের অর্থনৈতিক বা বাণিজ্যিক রাষ্ট্রজোটের সদস্য হবারই তো যোগ্য নয়।
তবু আমরা দেখেছি ওই লেখায় লিড ভারতীয় লেখক অপর্ণা পান্ডে ভারতকে ‘লারজেস্ট কান্ট্রি ইন দা রিজিয়ন’ খেতাব দিয়েছেন। আবার সেকেন্ড ওয়েভে অক্সিজেনের অভাবে পড়লে ছোট দেশ ও সার্কের সদস্য ভুটান নিজের অক্সিজেন প্লান্ট থেকে প্রতিদিন ৫০ মেট্রিক টন করে ভারতকে দিচ্ছে, এ কথাটা তিনি জ্বলুনির সাথে উল্লেখ করছেন; সেটাও এক ভারি তামাশা বটে! তাহলে তার চোখে ভারত ‘লারজেস্ট কান্ট্রি’- এটা কী অর্থে? জনসংখ্যা নাকি উদ্বৃত্ত সম্পদে বিনিয়োগ সক্ষমতায়? নিশ্চয় জনসংখ্যাই বুঝেছেন। কোনো দেশকে প্রভাবশালী হিসাবে ‘বড়’ বুঝায় তার কী থাকলে- এরা যেন তাই বোঝেন না। নইলে ভারত বড় কিনা এখানে এই তর্ক তোলার অর্থ কী? ছোট্ট ভুটানের অক্সিজেন নিতে কষ্ট হচ্ছে- এটা তো দেখছি পেটি মধ্যবিত্তসুলভ ঈর্ষা!
তার আরো মারাত্মক এক বক্তব্য হলো, তিনি এবার স্বীকার করে বলছেন, সার্কের ভিতর ভারতকে ন্যাচারাল নেতা (রিজিয়নস ন্যাচারাল লিডার) বলে পাকিস্তান স্বীকৃতি না দিতে পারার কারণেই নাকি এই জোটের সমন্বয় হয়নি কখনো।
ভারতীয় নারী লেখিকার এই বক্তব্য খুবই ক্ষুদ্র মনের। তিনি আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্ক নিয়ে কথা বলার যোগ্য মনে হচ্ছে না। এখানে ভারত ‘ন্যাচারাল লিডার’ মানে কী? আল্লাহ স্বয়ং নয় দিছে? এরকম?
আসলে বন্ধুদের ছোট গ্রুপের বেলাতেও যেটা দেখা যায়, অনেক গ্রুপে এমন বন্ধু একজন থাকে যে বন্ধুদের বিপদে এগিয়ে যায়, উদ্ধার করতে খরচ করে এবং খরচ করা অর্থ কী করে পরে ফেরত পাবে বা আদৌ ফেরত পাবে কিনা তা না জেনেই সে এটা করে। এমন দায়িত্ব নিবার এই স্বভাবÑ এমন গ্লোবাল নেতা এবং আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্কের বেলায় একেই ‘এম্পায়ার’ বা সাম্রাজ্যের শাসকের ইতি গুণধারী বলা হয়। কেউ গ্লোবাল নেতা হতে চাইলে তার এই গুণ থাকা জরুরি বা অনিবার্য। এর বাইরে ন্যাচারাল লিডার বা খামোখা লিডার বলে কিছু নেই। ভারত ‘ন্যাচারাল লিডার’ কথার মানে কি কলোনি-ব্রিটিশ কী ভারতের বাপ?
তবে বড় জোর অপর্ণা পান্ডের এমন কথা এক ‘উগ্র দেশপ্রেম’ হতে পারে। যেটার আবেগী মূল্য কিছু থাকলেও সেটা তার দেশের ভেতরেই থাকতে পারে। আর বাইরের লোকেরা শুনলে এটাকে বোকামি মনে করে বিরক্ত হবে।
আসল কথাটা হলো, নেপাল বা ভুটান ল্যান্ডলকড দেশ বলে এ থেকে দুধদোয়ানোর মতো করে এখনো সুবিধা বের করে আসছে ভারত। যেমন, নেপাল বা ভুটান বাংলাদেশকে বিদ্যুৎ বিক্রি করতে চাইলে আগে কোনো ভারতীয় কোম্পানিকে কমিশন বুঝিয়ে দিয়ে এরপর কেবল ওই ভারতীয় কোম্পানির মাধ্যমে তা বিক্রি করতে হবে। এর অর্থ হলো, ‘সাম্রাজ্যের শাসকের ইতিগুণ’ জিনিসটা নিয়েই ভারতের বুঝাবুঝি একেবারেই বাইরের। ‘স্মল’ ভারত এটা বুঝবে না।
না এটাকে ‘দাতা মহসীন’ হতেও বলা হচ্ছে না। একটা ‘ফেয়ার ডিল’, একটা ন্যায্য সম্পর্কের কথা বলা হচ্ছে; যেখানে এতে এম্পায়ারের কোনো ফাইন্যান্সিয়াল লস হলে সেটার দায় ভাগ করে নেয়া যেতে পারে। আর এতে এম্পায়ারের কোনো লস হলেও যেহেতু এতে তার স্বাভাবিক প্রভাব প্রতিপত্তি বাড়বে, এটাই তার পক্ষে নন-ফাইন্যান্সিয়াল রিটার্ন পাওয়া হবে। আসলে কারো গ্লোবাল নেতার ভূমিকায় হাজির হওয়া এতই সহজ নয় বা একপক্ষীয় সুখের নয়।
সে লেখায় শেষে খুবই ঈর্ষাকাতর এক মন্তব্য করা হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘কোভিডের এই ইমারজেন্সির কালে নগদ অর্থ ঢালার ক্ষতিকর ক্ষমতার চীন (ক্যাশ ফ্ল্যাশ ম্যালাইন পাওয়ার) তার প্রভাব বাড়িয়ে নেবার সুযোগ পেয়ে যাবে।’
ভারতের জন্য দিল্লি আসলেই দু-র-অ-স্ত। অন্তত ঈর্ষা দিয়ে এসবের কিছুই অর্জন করা যায় না! আমেরিকা ভারতের পিঠে হাত রেখেছে বলেই ভারত তার সব অক্ষমতার বন্ধাত্ব ছাড়িয়ে সক্ষম হয়ে যাবে না। আমেরিকা তা করতেও পারে না, করবে না। কারণ রাষ্ট্র মানেই নিজ একান্ত স্বার্থ আগে। আর সক্ষমতা? সেটা তো সবার নিজেরটা নিজেই অর্জন করে নিবার জিনিস!
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com