চাকরির বয়সসীমা বাড়ানো ঠিক হবে?
চাকরির বয়সসীমা বাড়ানো ঠিক হবে? - ছবি সংগৃহীত
বাংলাদেশে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের সর্বোচ্চ সাধারণ বয়সসীমা ৩০ বছর। মুক্তিযোদ্ধা, চিকিৎসক আর বিশেষ কোটার ক্ষেত্রে এই বয়সসীমা ৩২ বছর। সরকারি ছাড়াও আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানেও একই বয়সসীমা অনুসরণ করা হয়। আর চাকরি থেকে অবসরের সাধারণ বয়সসীমা ৫৯ বছর। মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষেত্রে তা ৬০ বছর। বিচারকদের ক্ষেত্রে ৬২ বছরের নির্দেশ আছে আদালতের। তবে তা কার্যকর হয়নি।
বাংলাদেশ এখন ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ট-এর দেশ। জনসংখ্যার ১৫ থেকে ৫৯ বছর বয়সী শতকরা ৬৮ ভাগ, যারা কর্মক্ষম। বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু এখন ৭৩ বছর। তবে নারীদের গড় আয়ু ৭৫ বছর। পুরুষের ৭১ বছর। সরকারি চাকরিকে পদ খালি আছে তিন লাখ ১৩ হজার ৮৪৮টি। সরকারি চাকরিতে কর্মরত আছেন ১২ লাখ ১৭ হাজার ৬২ জন। বাংলাদেশে প্রতিবছর ২০ লাখের মত নাগরিক চাকরির বাজারে প্রবেশ করেন। সরকারি নয়, এখন বেসরকারি খাতই হচ্ছে চাকরির বড় ক্ষেত্র।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সের অধ্যাপক ড. এ কে এম নুরুন্নবী বলেন, বাংলাদেশ এখন ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ট-এর যুগে প্রবেশ করেছে। ৬৮ ভাগ মানুষ এখন কর্মক্ষম। এই সুবিধা আমাদের নিতে হবে। কারণ, এই সময়টি থাকবে না। ২০৫০ সালে প্রতি পাঁচজনে একজন হবেন বৃদ্ধ। কাজ করতে সক্ষম নয় এমন মানুষের সংখ্যা বাড়বে। বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু বাড়ছে।
তিনি মনে করেন, 'একটা দিক হলে তরুণ যে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী তাদের কাজে লাগানো। আবার গড় আয়ু বাড়ার ফলে বয়স্ক কর্মক্ষমও বাড়ছে। এই দুই শ্রেণিকে কাজে লাগাতে চাকরিতে প্রবেশের বয়স যেমন বাড়ানো দরকার। তেমনি অবসরের বয়সও বাড়ানো দরকার।' বিশ্বের অন্তত আটটি দেশে এখন চাকরি থেকে অবসরের সর্বোচ্চ বয়স ৬৭ বছর। ৭০ বছরে অবসরের দেশও আছে।
করোনায় বাংলাদেশের চাকরিপ্রার্থীরা বিপাকে পড়েছেন। কারণ নিয়োগ পরীক্ষা না হওয়ায় চাকরি প্রার্থীরা বয়স হারাচ্ছেন। আবার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরীক্ষা না হওয়ায় তাদের বয়সও বেড়ে যাচ্ছে। এই করোনার সময় কমপক্ষে দুই লাখ চাকারি প্রার্থী তাদের চাকরির বয়স হারিয়েছেন।
আর সাধারণভাবে বাংলাদেশে প্রতি বছর যে ২০ লাখ মানুষ চাকরির বাজারে প্রবেশ করেন তাদের মধ্যে সর্বোচ্চ ১৬ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হয়। চার লাখ বেকার থাকেন। আর এই বেকারদের বেশির ভাগই উচ্চশিক্ষিত। এরকম বেকার কয়েকজন উচ্চশিক্ষিতের কথা হলো, চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ালে তাদের চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনা বাড়বে। আর গড় আয়ু যেহেতু বাড়বে তাই প্রবেশের সময়সীমাও বাড়ানো উচিত। বিশেষ করে এই করোনা প্রবেশের বয়স বাড়ানো খুব জরুরি।
বাংলাদেশে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা দেশ স্বাধীন হওয়ার পর করা হয় ২৭ বছর। তার আগে ছিল ২৫ বছর। ১৯৯১ সালে তা বাড়িয়ে করা হয় ৩০ বছর। দুই বছর আগে সরকার নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয় চাকরিতে প্রবেশের বয়স ৩২ থেকে ৩৫ এবং অবসরের বয়স ৬০ থেকে ৬২ করার। কিন্তু সেটা নিয়ে এখন আর কোনো কথা হচ্ছে না। করোনার সময় দুই দফায় কিছুটা বয়সের ছাড় দেয়া হলেও তা সাময়িক।
এর আগে ২০১২ সালে জাতীয় সংসদের তখনকার স্পিকার অ্যাডভোকেট আব্দুল হামিদ নিজেই চাকরিতে প্রবেশের বয়স ৩৫ বছর করার প্রস্তাব করেছিলেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক মনে করেন, যেহেতু বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু বাড়ছে তাই চাকরিতে প্রবেশ এবং অবসরের বয়স বাড়ানো যেতে পারে। তার মতে, 'সরকারি চাকরির বিজ্ঞাপন সঠিক সময়ে দিলে এই সমস্যার অনেকটাই কেটে যাবে। বয়স বাড়ানোর সাথে সঠিক সময়ে চাকরিতে প্রবেশের সুযোগ সৃষ্টি করাও জরুরি।' তিনি বলেন, এই করোনার সময় চাকরির বিজ্ঞপ্তি সঠিক সময় প্রকাশ করলে যারা চাকরিপ্রার্থী তারা আবেদন করে রাখবেন। যখন পরীক্ষা হবে এই সময়ের বয়সকেই বিবেচনায় নেয়া হবে। ফলে এখন যে সংকট হচ্ছে তার ৮০ ভাগ কেটে যাবে।
বাংলাদেশে এখন যে পরিমান চাকরি প্রার্থী প্রতি বছর বের হচ্ছে সেই তুলনায় সরাকারি চাকরি খুবই কম বলে জানান সিপিডির অর্থনীতিবিদ ড. খন্দকার গোলাম মোয়জ্জেম। তার মতে, 'গড় আয়ু বাড়ার ফলে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ালে একটি নতুন সংকট হতে পারে। যারা সদ্য বিশ্ববিদ্যালয় পাশ করে সরকারি চাকরিতে যোগ দিতে চান তারা বাড়তি প্রতিযোগিতার মুখে পড়তে পারেন। যা তাদের আগ্রহ নষ্ট করে দিতে পারে। কারণ, করোনা বাদ দিলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রাজনৈতিক অস্থিরতা বা সেশন জ্যাম নেই।আবার অবসরের বয়স বাড়ালে পদ শূণ্য হতে দেরি হবে।'
তবে তিনি এই করোনার সময়টি বিশেষ বিবেচনায় নেয়া দরকার বলে মনে করেন। তার কথা, 'ভবিষ্যতে সরকারি চাকরির সুযোগ বাড়বে। যদি স্বাভাবিক নিয়মে সরকারি চাকরিতে নিয়মিত নিয়োগ দেয়া হয় তাহলে সমস্যা অনেকটাই কেটে যাবে।'
সূত্র : ডয়চে ভেলে