সু চির বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ
সু চি - ছবি সংগৃহীত
মিয়ানমারের জান্তাপ্রধান মিন অং হ্লাইং ইন্দোনেশিয়ায় আসিয়ান বৈঠকে প্রতিনিধিত্বি করেছেন। ক্যুর পর এটাই হচ্ছে তার প্রথম বিদেশ সফর। নির্বাচিত সরকারকে বিতাড়ন করায় দেশে বিদেশে জান্তা সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছে এবং দেশের ভেতর এখন পুরো দস্তুর গৃহযুদ্ধ চলছে। সামরিক সরকার অস্ত্রের মাধ্যমে ও কিছু দালাল গোষ্ঠীর সহায়তা জনগণকে নিষ্পেষণ করে চলছে। ইতঃপূর্বে আমার লেখা নয়া দিগন্তে প্রকাশিত ‘কারেনদের ওপর বোমাবর্ষণ ও মিয়ানমারে গৃহযুদ্ধের শঙ্কা’ কলামে গৃহযুদ্ধের ওপর বিস্তারিত আলোকপাত করা হয়েছিল।
১০ সদস্যের আসিয়ান জোটের অনেক নেতা জার্কাতায় বৈঠকে গেছেন, মিয়ানমার জান্তাপ্রধানও গেছেন। থাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী ও ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট জানিয়েছেন, বৈঠকে তারা নিজেদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে পাঠাবেন। আসিয়ানের সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে রয়েছে- মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, ব্রুনাই, কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়া, লাওস, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ফিলিপাইন ও ভিয়েতনাম। মিয়ানমারে গণতন্ত্রমনা রাজনীতিবিদ, ক্ষমতাচ্যুত পার্লামেন্ট সদস্য ও নৃতাত্ত্বি¡ক জনগোষ্ঠী মিলে একটি ন্যাশনাল ইউনিটি সরকার- এনইউজি বা নাগ গঠন করেছেন। নাগ বলছে, তারাই বৈধ জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক কর্তৃত্ব। তারা জান্তাপ্রধানের উপস্থিতির বিরোধিতা করেছেন, নাগের প্রতিনিধিরাও জার্কাতায় গিয়েছিলেন, কিন্তু যথাযথ মর্যাদা পাননি। আসিয়ানের মতো গণতান্ত্রিক ফোরামে গণতন্ত্রের মৃত্যুদাতাকে সম্মান দেখানো হয়ছে অথচ সংগ্রামীদের মূল্যায়ন করা হয়নি, এতে এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের লোকজন ক্ষুব্ধ। জান্তাপ্রধান চেয়েছিলেন আসিয়ানে সওয়ার হয়ে বিদেশী সমর্থন পাবেন, কিন্তু আসিয়ান মিয়ানমার জান্তাপ্রধানকে বলেছে- সেনাদের ব্যারেকে ফিরিয়ে নিয়ে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকারকে সম্মান দিতে। কিন্তু জান্তাপ্রধান ফিরে গিয়ে জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধকে আরো উসকে দিয়ে ধোঁকাবাজের কাতারে শামিল হয়েছেন।
জান্তাপ্রধান ১৭ এপ্রিল শনিবার, ২৩ হাজার ১৮৪ বন্দীকে মুক্তি দিয়েছে জার্কাতায় যাওয়ার আগে। তাছাড়া ১৭ এপ্রিল ঐতিহ্যগতভাবে মিয়ানমারের নতুন বর্ষ, পানি খেলা ও বৌদ্ধ মন্দিরে সমবেত হওয়া, আনন্দঘন পরিবেশে দিন কাঠানোর সময়। এ সময়ে যুবক-যুবতীরা জীবন সঙ্গী বাছাই করে। এই সময়টা বর্মিদের সমাজ জীবনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সেনা-সরকারের দমন অভিযানের কারণে গণতন্ত্রপন্থীরা উৎসব বর্জন করেছে এবং আসিয়ানকে অনুরোধ জানিয়েছে প্রবাস সরকারকে বা নাগ প্রতিনিধিকে আমন্ত্রণ জানাতে। সেনারা প্রথম দফায় যে তিন হাজার ৫০০ জনকে গ্রেফতার করেছিল সেখানে সু চিও রয়েছেন। হাজার হাজার বন্দীকে মুক্তি দিলে কি হবে পুলিশ ও সেনারা নতুন ৮৩২ জনের সাজা-পরোয়ানা নিয়ে ঘুরছে। এদের মধ্যে ইন্টারনেট সেলিব্রেটি, অভিনেতা ও গায়ক-গায়িকা রয়েছেন, অনেকে মিয়ানমারের আইকনও। যেমন চলচ্চিত্র পরিচালক ক্রিশ্চিনা কাই ও অভিনতা জেনি কাই। দুজন ব্যাঙ্কক যাওয়ার সময় ইয়াঙ্গুন বিমান বন্দরে গ্রেফতার হন। সেনা ক্যুর বিরুদ্ধে কথা বলায় তারা তালিকাভুক্ত হয়েছেন। ৮৩২ জনের যে কেউ ধরা পড়লে সোজা তিন বছরের জেল খাটতে হবে। ইরাবতি এই তথ্য বিদেশী মিডিয়ায় জানিয়েছে।
সু চির বিরুদ্ধে অভিযোগের অন্ত নেই। আগামী ১৪ জুন ক্যাঙ্গারু কোর্টে বিচার শুরু হচ্ছে। ফৌজদারি অপরাধের অভিযোগের ভেতর আরো আছে গত বছর নির্বাচন ক্যাম্পেইনের সময় করোনা ভাইরাস সংক্রমণে স্বাস্থ্যবিধিকে উপেক্ষা করা এবং লাইসেন্সবিহীন ওয়াকিটকি ব্যবহার করা। এভাবে একের পর এক অভিযোগ। যাদের তিনি আন্তর্জাতিক চাপ থেকে আগলে রাখার চেষ্টা করেছেন তারা এখন সু চির বুকে-পিঠে আঘাত করছেন। তার বিরুদ্ধে অফিসিয়াল সিক্রেট অ্যাক্টের মামলা আধা প্রমাণিত হয়ে বসে আছে। এই অভিযোগে সু চির কমপক্ষে ১৪ বছরের জেল হতে পারে। ক্ষমতায় থাকার সময় সু চি নিজেই এই আইনে রয়টারের রাখাইন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে তাদের গ্রেফতার করেছিলেন। একজন ওয়া লুন অপরজন ক্য সুই ও, এই দুই সাংবাদিককে ১০ রোহিঙ্গাকে সংক্ষিপ্ত বিচার করে ফাঁসিতে ঝুলানো এবং গণহত্যা-নির্যাতন করে প্রায় আট লাখ রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে ঠেলে পাঠানোর অনুসন্ধানী প্রতিবেদন আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় প্রকাশের কারণে গ্রেফতার করে জেলে ঢুকানো হয়। সু চি বিশ্বকে জানায়, তার সরকার দুজনের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিচ্ছে। কেননা, এরা রাষ্ট্রীয় গোপনীয় বিষয় প্রকাশ করেছেন। এই দুই সাংবাদিককে অনুসন্ধানমূলক প্রতিবেদন প্রকাশ করায় পুলিৎজার পুরস্কার দেয়া হয়, তারপর সু চি সরকারকে বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে চাপ দেয়ায় দুজন ছাড়া পান। অদৃষ্টের পরিহাস, আজ সেই একই আইনে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে এবং ক্যাঙ্গারো কোর্টে বিচারকাজ সম্পন্ন করা হচ্ছে। এবার সু চি আগের মতো আন্তর্জাতিক সমর্থন পাবেন এমনটি আশা করার কোনো কারণ নেই। সু চির আন্তর্জাতিক সম্মাননা-পদক রোহিঙ্গা নির্যাতনের কারণে অনেক আগেই ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে।
চীন ও জাপানের সাথে মিয়ানমারের বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে। চীন ভবিষ্যৎ চিন্তা করে এবং বেল্ট ও রোড বৈশ্বিক প্রকল্প সম্প্রসারণের লক্ষ্যে আসিয়ান দেশগুলোতে ইন্টারনেট ক্যাবল সংযোগের ব্যবস্থা নিয়েছে। মিয়ানমার জান্তা চীনের ২.৫ বিলিয়ন ডলার এলএনজি পাওয়ার প্লান্ট প্রজেক্টকে গত ৭ মে স্বাগত জানিয়েছে। ক্যুর পর এটিই মিয়ানমারের সর্ববৃহৎ ইনভেস্ট প্রজেক্ট। চীনের দাই কমিউনিটির লোকজন বর্তমানে থাইল্যান্ডে এই সুবিধা ভোগ করছে। চীনা প্রেসিডেন্ট শি আশা করেন, চীন-মালয়েশিয়া প্রকল্পটি চীন-আসিয়ান পার্টনারশিপের জন্য উদাহরণ হতে পারে। চীন ও আসিয়ানের এই কার্যক্রমকে বিশ্লেষকরা নতুন সিল্ক রোডের একটি কম্পোনেন্ট হিসেবে ধরে নিয়েছে। চীনের ইউনান প্রদেশ, মিয়ানমার ভিয়েতনাম ও লাউসের সীমান্তের একটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকা।
তাদের জীবনযাত্রা ও সংস্কৃতিতে রয়েছে ভিন্নতর উচ্চতা। নতুন বর্ষে পানি খেলার বিষয়টি ইউনান ছাড়াও থাইল্যান্ড ও মিয়ানমারেও বহুল প্রচলিত। ইউনানের লোকজন মনে করে, বেল্ট অ্যান্ড রোড প্রকল্প তাদের জীবনধারার উন্নয়ন ঘটাতে একটি বড় পদক্ষেপ। আসিয়ানের অনেক দেশে চীনের দাই সম্প্রদায় রয়েছে। চীনের এই অঞ্চলটি আসিয়ান দেশের সাথে মিল রয়েছে অনেক কিছুতে। সীমান্তের চিহ্ন না থাকলে অনেক সময় বাইরের কেউ বুঝতে পারবে না কোন এলাকাটি কোন দেশের। কোনো কোনো প্যাগোডা, ব্রিজ, বাজার, স্কুল উভয় দেশে পড়েছে। সেখানের বিদ্যালয়ে দুই দেশের পতাকা উড়ানো হয়। মিয়ানমারের ছাত্রছাত্রীরা সবুজ সাদা পোশাক পরিধান করে, দাই সম্প্রদায়ের লোকজন তাদের পছন্দমতো পোশাক পরিধান করে, সে এক অদ্ভুত বিষয়। উভয় দেশের লোকজনের মাঝে গড়ে উঠেছে বিশেষ সখ্যতা ও আত্মীয়তা। তাই চীন মিয়ানমারের ব্যাপারে কঠোরতা অবলম্বন করে না। আসিয়ানের ওপর প্রভাব কায়েমের জন্য চীনের আরো পরিকল্পনা রয়েছে। আগামী কোনো আসরে তা বিস্তারিত বলার আশা রাখি। আসিয়ানকে চীনের নিগড় থেকে বের করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র এশিয়া প্যাসিফিক এলাকায় রাজনৈতিক ও সামরিক ব্যবস্থাদি গ্রহণ করছে। মিয়ানমারের ওপর যুক্তরাষ্ট্র ইতোমধ্যে কয়েক দফা অবরোধ দিয়েছে। আসিয়ান এই দুই পরাশক্তির কূটকৌশল নিয়ে সজাগ থাকার চেষ্টা করে। অনেকে মনে করেন, আসিয়ানের পক্ষে হঠাৎ নতুন কোনো বড় পদক্ষেপ নেয়া বা দৃশ্যমান পরিবর্তন করা সহজসাধ্য ব্যাপার নয়।
দক্ষিণ চীন সাগরে যুক্তরাষ্ট্র-চীনের ভূরাজনৈতিক বিরোধ নিয়ে আসিয়ান যেন ফাঁদে পড়েছে। গত বছরের মধ্য-জুলাইতে যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহী কেরিয়ার, ইউএএস নিমিজ এবং ইউএসএস রোনাল্ড রিগান সামরিক মহড়া চালালে প্রতিবাদে চীনও সামরিক মহড়া চালায়। চীন, দক্ষিণ চীন সাগরের ৯০ শতাংশ দাবি করে, সীমারেখাও তৈরি করেছে। এটি নিয়ে পার্শ্ববর্তী অনেক দেশেরও আপত্তি আছে। ব্রুনাই, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন ও ভিয়েতনাম প্রতিবাদ জানিয়েছে। চীনবিরোধী আবহকে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতর কাজে লাগাতে চায়। ফলে দু’দেশের বিরোধ আসিয়ানের উপরও আছড়ে পড়েছে। আসিয়ান দেশগুলো চীন এবং রিজিওনাল জায়েন্ট, মূলত যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ভারসাম্য রক্ষা করে চলছে।
আসিয়ানের সাথে এদের অর্থনৈতিক সম্পর্ক এমনভাবে বাড়াতে হবে যেন আসিয়ানের সৃষ্টি ও উদ্দেশ্য প্রতিফলিত হয়। অন্যদিকে চীনকে দ্রুত আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোর সাথে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক গোছাতে হবে। বর্তমানে কোয়াডে একটিও আসিয়ান দেশ সদস্য নেই। এমতাবস্থায় চীনের বিরুদ্ধে আসিয়ান জোট দাঁড়াবে সেটি মনে করা বোকামি। যুক্তরাষ্ট্র চীনবিরোধী পদক্ষেপে কোয়াড এবং আসিয়ানকে ব্যবহার করতে চায়। অপরদিকে চীন কোয়াডকে বাদ দিয়ে আসিয়ানে প্রভাব বিস্তার করতে চায়।
দক্ষিণ-পূর্ব এশীয়ার দেশগুলোর জোট আসিয়ান থেকে মিয়ানমারের সামরিক নেতার বৈধতা নির্ধারণ ও সংস্থাটি থেকে দেশটির সদস্যপদ বাতিলের বিষয়টি বিবেচনার আহ্বান জানিয়েছে কয়েকটি মানবাধিকার সংস্থা। জনগণের সেনা অভ্যুত্থানবিরোধী বিক্ষোভে মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে এই পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানায় সংস্থাগুলো। ‘ফর্টি রাইটস’ নামের মানবাধিকার সংস্থা বলেছে, আসিয়ান অভ্যুত্থানের নেতা মিন অং হ্লাইংকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে এবং মিয়ানমারের নির্বাচিত বেসামরিক নেতাদের অস্বীকার করছে, এর মধ্য দিয়ে জোটটি অবৈধ ও নৃশংস সামরিক শাসনকে বৈধতা দিয়েছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ৪৫টি এনজিও সংগঠন বলেছে, আসিয়ান সম্মেলনে মিয়ানমার জান্তাপ্রধান হ্লাইংকে যোগ দেয়ার আমন্ত্রণ জানিয়ে ‘নিজ জনগণের বিরুদ্ধে সামরিক শাসকদের গণহত্যাকেই বৈধতা দিয়েছে মাত্র।’
মিয়ানমারে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারির ক্যু আসিয়ানের জন্য একটি বড় ধরনের আঘাত। আসিয়ান বিশ্লেষকরা এখন মনে করছেন, যুগোপযোগী নেতৃত্ব ও সহযোগিতার জন্য কাঠামোর পরিবর্তন দরকার। এবারের আসিয়ান বৈঠকে নেতাদের মধ্যে ইতস্তত মনোভাব পরিলক্ষিত হয়েছে। আসিয়ানের একটি প্রশংসনীয় নীতি হলো- সদস্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করা বা কোনো পরিবর্তনের পরামর্শ-নির্দেশনায় না যাওয়া। ফলে মিয়ানমার সমস্যা সমাধানে আসিয়ান কোনো ফলপ্রসূ ভূমিকা পালন করতে পারেনি। মানবাধিকার রক্ষায় মত প্রকাশের স্বাধীনতা গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান। মত প্রকাশ করা না গেলে বা মত প্রকাশকে কোথাও বাধা দেয়া হলে সেটি প্রকারান্তরে গণতন্ত্র, গণমুক্তি, চেতনা ও সুবিচারকে ধ্বংস করে দেয়। তাহলে এক কথায় বলা যায়, মত প্রকাশের স্বাধীনতা মূল রাজনৈতিক হাতিয়ার। মিয়ানমারের জান্তা ও কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্র যদি আসিয়ানের সদস্য থাকে তবে সেগুলো দিয়ে জনগণের চেতনার কোনো সেবা করা সম্ভব নয়। কর্তৃত্ববাদী দেশ পরিচালকরা সবসময় অবাধ ও মুক্ত সমাজব্যবস্থা ও ন্যায়বিচারকে ভয় পায়, তাই এসব ‘সেক্টরকে’ কুক্ষিগত বা অনুগত রাখাসহ সাধারণ নাগরিক আধিকার ও গণতন্ত্রের উন্মেষের কণ্ঠনালী টিপে ধরে।
মূল কথা হলো, সার্বিক ভালো কাজের জন্য আসিয়ানের সেই ইচ্ছাও নেই, যোগ্যতাও নেই। সংস্থাকে যদি অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে, জনগণের ক্ষমতায়নের উদ্দেশ্যে কাঠামোর পরিবর্তন করা না হয়, সদস্য রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রায়কে কার্যকরীভাবে প্রয়োগ করা না যায় তবে এসব সংস্থা না থাকাই ভালো।
মিয়ানমারে দীর্ঘদিনের গণহত্যা, নিষ্পেষণ, সেনাদের নারীধর্ষণ, লুটপাটের কোনো প্রতিকার দেশের জনগণ পায়নি। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর নির্যাতন ও পাশবিকতা আসিয়ান বন্ধ করতে পারেনি। এসবের পরিপ্রেক্ষিতে নতুন South East Asia Community-এর প্রস্তাব করা হয়েছে গত ১২ মে।
এখানেও গণতন্ত্র, সুবিচার, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, মানবাধিকার, অন্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার মূল নীতিগুলো গ্রহণ করা হয়েছে, যতক্ষণ না গণমানুষ নির্যাতনের শিকার হয়। তাই এই কনসেপ্টকে গ্রহণ করার জন্য আহ্বান জানানো হয়েছে। আরো একটি বিষয়- আসিয়ান মূলত অভীষ্ট বিন্দুতে পৌঁছে গেছে। ১৯৬৭ সালের কোল্ড ওয়্যারকালীন আঞ্চলিক ও ভূখণ্ডগত বিরোধ, পারস্পরিক অবিশ্বাস, সহযোগিতা বাড়ানো, শান্তি প্রতিষ্ঠা, সম্পদ বৃদ্ধি ও কমিউনিজমের প্রসার বন্ধ করতে কার্যকর ভূমিকা রেখেছে। এখন ভূরাজনৈতিক অবস্থার পরিবর্তনের কারণে এ সংস্থাকেও ঢেলে সাজানো দরকার।
প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদেশগুলো- ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন, সিঙ্গাপুর ও থাইল্যান্ডের সম্মিলিত ভিশন ও উদ্দেশ্য এর মধ্যে অর্জিত হয়েছে; শান্তি ও সম্পদ বৃদ্ধি পেয়েছে, কমিউনিজমকে বাধা দিতে সক্ষম হয়েছে। আসিয়ান কম্বোডিয়ায় ভিয়েতনামের দখলদারিত্ব শেষ করতে ভালো ভূমিকা রেখেছে। নেতারা স্বার্থকভাবে কোল্ড ওয়্যার সময় পার করেছেন। ১৯৯০ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত বৈশ্বিক বাজার সম্প্রসারিত হয়েছে, তার ঢেউ ইন্দোচীন ও মিয়ানমারেও লেগেছে। আসিয়ান পাঁচ সদস্য থেকে ১০ সদস্য রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। সদস্য রাষ্ট্রের জনগণ আদর্শিক মতবিরোধ ও টেনশন পছন্দ করছে না। তথ্য প্রবাহের কারণে জনগণ এখন অনেক সজাগ। এই প্রজম্মের জনগণ বৈশ্বিক বা গ্লোবাল ভিলেজ ধারণার সাথে সম্পৃক্ত হয়ে গেছে। টেকনোলজির প্রসার ও ব্যবহারের মাধ্যমে ‘গ্লোবাল ভিলেজ’কে ‘ইলেকট্রনিক ওয়ার্ল্ডে’ পরিণত করতে চায়। এরকম অবস্থায় স্বৈরাচারী সামরিক শাষকের জননিষ্পেষণের বাধাহীন কার্যক্রমকে কোনো দেশের জনগণ আর গ্রহণ করবে না।
এ এলাকার জনগণের বিশ্বাস- দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া বৈশ্বিক শক্তি অর্জনে যোগ্যতা অর্জন করেছে। এখানে রয়েছে জুতসই ভূরাজনৈতিক অবস্থান, দুটি সাগরের বেষ্টনী যা দিয়ে বিশ্বের তাবৎ জাহাজ চলাচলা করে, রয়েছে প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্য, দক্ষ ও অদক্ষ জনশক্তি যা বৈশ্বিক বাজারে একটি শক্তি হিসেবে বহিঃপ্রকাশ করতে পারে। ২০০৭ সালে আসিয়ান সনদে নতুন সত্তাকে শক্তিশালী কর হয়, তা হলো- গণতন্ত্র ও মানবাধিকার, সব সদস্যকে মেনে চলার অঙ্গীকার। আন্তঃসরকার মানবাধিকার কমিশনও গঠন করা হয়। এখন মিয়ানমার এসব কিছুতে যেন কামানের তোপ নিক্ষেপ করছে। সংস্থার গোড়ায় এক গলদ থেকে গেছে, আসিয়ান সদস্য পদের জন্য কোনো দেশে গণতান্ত্রিক সিস্টেম চালু থাকতে হবে এমন কোনো শর্ত পাওয়া যায়নি। ফলে সেটি লেজেগোবরে অবস্থার মতো। সদস্য দেশগুলোতে নানা ধরনের রাজনৈতিক মডেল রয়েছে। কোনো কোনো দেশে চরম কর্তৃত্ববাদী শক্তি জনগণকে শাসন-শোষণ করছে। সদস্য দেশগুলো নিজেদের প্রতিশ্রুতি অবহেলা করছে, কোথাও কোথাও জনগণ অবরুদ্ধ।
আসিয়ান এক কাজ করতে পারে, কর্তৃত্ববাদী সরকার যে সব দেশে রয়েছে তারা পরবর্তী দশকে আবশ্যিকভাবে গণতন্ত্রের দরজা উন্মুক্ত করবে নতুবা সে দেশের সদস্যপদ বাতিল করবে। যদিও এতে নেতাদের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হবে, তথাপি ৬৫০ মিলিয়ন মানুষের বিষয়গুলো একটি অবস্থানে নিয়ে আসা প্রয়োজন। আসিয়ান পদক্ষেপ নিলে ভয়ের কিছু নেই। আসিয়ান যদি না পারে দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার জনগণ চাইবে এই সংস্থার বদলে South East Asia Community দিয়ে পরিবর্তিত হোক কোটি কোটি মানুষের এক নতুন আসিয়ান।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত যুগ্ম সচিব ও গ্রন্থকার