কী হচ্ছে মিয়ানমারে
সু চি - ছবি সংগৃহীত
দক্ষিণ এশিয়া এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া- এই দুই অঞ্চলেরই অংশ হিসেবে বিবেচনা করা হয় মিয়ানমারকে। বিশ্বের মূল ধারা থেকে দীর্ঘদিন বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকা দেশটি এখন দক্ষিণ এশিয়ার বৈশ্বিক পরাশক্তির ক্ষমতার প্রতিযোগিতা ও প্রক্সি খেলার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। ব্রিটিশ উপনিবেশ আমলে মিয়ানমার বা বার্মাকে ভারত উপমহাদেশের একটি অংশ বিবেচনা করা হতো। স্বাধীন হবার পর এটি হয়ে দাঁড়ায় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের জোট- আসিয়ানের সদস্য দেশ। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা দিয়ে স্বাধীন বার্মার যাত্রা শুরু হলেও গত ৬ যুগের ইতিহাসে দেশটিকে সামরিক কর্মকর্তারাই বেশি সময় শাসন করেছেন।
অং সান সু চির ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসির (এনএলডি) পাঁচ বছরের শাসন শেষে দ্বিতীয় মেয়াদে নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় যাবার আগেই গত ফেব্রুয়ারির প্রথম দিনেই মিয়ানমারের শাসনক্ষমতা কেড়ে নেয় সামরিক জান্তা। তবে এবারের ব্যতিক্রম হলো দেশটির সাধারণ মানুষ অতীতে কোনো সময় রাস্তায় সেনাশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলে অব্যাহতভাবে জীবনদানের ঘটনা ঘটায়নি। এবার সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে মিয়ানমারের বড় বড় শহরগুলোতে দীর্ঘ সময় ধরে বিক্ষোভই শুধু হয়নি; সেই সাথে আন্দোলনকারীরা একটি বিকল্প সরকারও গঠন করেছেন। আর সে সরকারের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় একটি অঞ্চল দখলের জন্য নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর সাথে মিলে এনএলডি নেতারা একটি গণতান্ত্রিক ফেডারেশন গঠনের চুক্তিও স্বাক্ষর করেছে। এরপর আন্দোলনকারী বৃহত্তর নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী বামাররা জান্তার বিরুদ্ধে লড়াইরত অন্য বিদ্রোহীদের কাছে সামরিক প্রশিক্ষণ নিয়ে জান্তাবিরোধী সমন্বিত সশস্ত্র প্রতিরোধ লড়াই শুরু করছে। এই লড়াইয়ে সরকার অন্তত ৩৩ শতাংশ বর্মী ভূমির ওপর তাদের কর্তৃত্ব হারিয়েছে। মিয়ানমারের জান্তা প্রধান জেনারেল মিন অং হ্লাইং নিজে স্বীকারও করে নিয়েছেন যে, পুরো মিয়ানমারের ওপর সরকারের এখন নিয়ন্ত্রণ নেই।
প্রশ্ন হলো, মিয়ানমারের জান্তাপ্রধান এ অবস্থাকে কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছেন? জান্তাবিরোধী শক্তিগুলোইবা কী অর্জন করতে চাইছে এই পরিস্থিতিতে? এই ঘাত-প্রতিঘাতের প্রভাব মিয়ানমারের ওপর কতটা, কিভাবে পড়বে? চীন, রাশিয়া, ভারত, ব্রিটেন, আমেরিকার ভূমিকাইবা তাতে কী হবে? বাংলাদেশ ও থাইল্যান্ডের মতো প্রতিবেশী দেশগুলো যারা বর্মী শরণার্থীর ভারে ভারাক্রান্ত তাদের ভূমিকাইবা কী হবে?
মিয়ানমারের সেনাবাহিনী দেশটির স্বাধীনতা-উত্তর ৯০ শতাংশ সময় এককভাবে ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করেছে। দেশটির অর্থনীতির আকার ও অন্যান্য সক্ষমতার তুলনায় সামরিক বাহিনী অনেক বড়। বিচ্ছিন্নতাবাদী বিদ্রোহ দমন করতে গিয়ে বর্মী সেনাবাহিনী এক ধরনের দক্ষতা আর সক্ষমতাও অর্জন করেছে। এ অবস্থায় দেশটির বিচ্ছিন্নতা কাটাতে কিছু রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংস্কারের পথ ধরে বেসামরিক শাসনের সীমিত পদক্ষেপ নিলেও ক্ষমতা বেসামরিক কর্তৃপক্ষের কাছে পুরোপুরি হস্তান্তর করতে বর্মী সেনাবাহিনী কখনো চায়নি। সু চির সরকারকে দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় যেতে না দিয়ে অভ্যুত্থান ঘটানোর পেছনে এটিই মূল কারণ। মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ‘তাতমাদাও’ বরাবরের মতো এবারো সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাবে ক্ষমতা সুসংহত করার জন্য। আন্দোলন দমনের জন্য তারা এর মধ্যে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়েছেও। এখন সশন্ত্র বিদ্রোহ জোরদার হতে চলেছে; সেটাকেও তারা দমানোর চেষ্টা করবে। এ ক্ষেত্রে বর্মী সেনা নেতৃত্ব প্রধান সহযোগিতা পাবে প্রতিবেশী চীনের। চীন সব সময় সেনা সমর্থিত সরকারকে সমর্থন করে এসেছে; আর অভ্যুত্থানের ফলে যে বিচ্ছিন্নতা তৈরি হয় তার সুবাদে একক বিনিয়োগ ও অন্যান্য সুবিধা গ্রহন করেছে। এবার মিয়ানমারের সেনানেতৃত্ব শুধু ক্ষমতা সুসংহত করার জন্যই বেইজিংয়ের সমর্থন নেবে না; একই সাথে যেসব বিদ্রোহী সংগঠনের সাথে চীনের যোগাযোগ রয়েছে বিশেষত কাচিন বিদ্রোহী ও আরাকান আর্মি, তাদের সাথে সমঝোতায় সহায়তা পেতে চাইবে।
মিয়ানমারের সামরিক জান্তার জন্য এবার আরেকটি সুবিধাজনক অবস্থা তৈরি করেছে ভারতের সাথে তার সম্পর্ক। চীন যেমন আরাকান সমুদ্রবন্দর থেকে জ্বালানি পাইপলাইন কুনমিং হয়ে জিনজিয়াং পর্যন্ত নিয়ে যাবার একটি বিকল্প জ্বালানি সড়ক তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে, তেমনিভাবে ভারতও কালাদান রিভার প্রজেক্টের মাধ্যমে উত্তর পূর্ব ভারতের সাথে বিকল্প সমুদ্র সংযোগ তৈরি করছে। মিয়ানমারের সেনা নেতৃত্ব চীন ও ভারতের সাথে সমান্তরাল সম্পর্ক তৈরি করে কৌশলগত সুবিধা আদায়ের চেষ্টা করছে।
চীনও মিয়ানমারকে একটি পর্যায় পর্যন্ত অ্যালাউ করছে বলে মনে হয়। ভারতের সাথে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর এই সম্পর্কের কারণে আমেরিকানরা চীনের বিরুদ্ধে ‘কোয়াড’ সদস্য হিসেবে ভারতকে মিয়ানমারে ব্যবহারের কোনো সুবিধাই পাচ্ছে না। এখানে অবশ্য ভারতের নিজস্ব একটি হিসাব নিকাশও রয়েছে। দিল্লির কৌশলবিদরা মনে করছেন, মিয়ানমারের জান্তার বিরুদ্ধে লড়াইরত নৃতাত্ত্বিক সংখ্যালঘুরা সফল হলে এর প্রভাব পড়বে উত্তর পূর্ব ভারতের বিদ্রোহীদের ওপর। এই অঞ্চলে ভারতের মূল ধারার হিন্দুরা সার্বিকভাবেই সংখ্যালঘিষ্ঠ। এ অবস্থায় কোনো খ্রিষ্টান সংখাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র এই অঞ্চলে প্রতিষ্ঠার অর্থ হবে, সাত রাজ্যে তার প্রভাব পড়া। অর্থনৈতিক স্বার্থের পাশাপাশি এই কৌশলগত সমীকরণটিও মিয়ানমারের সাথে দিল্লির বিশেষ সম্পর্ক বজায় রাখতে ভূমিকা পালন করছে।
ভারতের এই কৌশলগত স্বার্থের সাথে একাত্ম হয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের ক্ষুদ্র অথচ ক্ষমতাশালী রাষ্ট্র, ইসরাইলের স্বার্থ। দেশটি বার্মার সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক গোড়া থেকেই রক্ষা করে চলেছে। জান্তা শাসনের সময় যখন মিয়ানমার একেবারে একঘরে ছিল তখনো ইসরাইল মিয়ানমারের সাথে সামরিক ও অন্যবিধ সম্পর্ক রক্ষা করে চলেছে। এখন আমেরিকা ও তার মিত্ররা মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক পরিবর্তনের জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাতে চাইলেও ইসরাইলের ভূমিকা এর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তি রাশিয়ার সাথেও রয়েছে মিয়ানমারের বিশেষ সম্পর্ক। দেশটি মিয়ানমারকে বিভিন্ন কৌশলগত অস্ত্র সামরিক সরঞ্জাম বিক্রি করে চলেছে। আন্তর্জাতিক ফোরামে মিয়ানমারের পক্ষে প্রকাশ্য অবস্থান নিতেও শুরু করেছে।
মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক পরিবর্তনের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র সবচেয়ে বেশি আগ্রহী হলেও ভারত ও ইসরাইলের মতো তার মিত্রদের এক অংশ এ ব্যাপারে সহযোগিতা না করার কারণে কার্যকর কোনো কিছু করতে পারছে না। এর বাইরে মিয়ানমারের অন্য দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশ আর থাইল্যান্ডের ওপরও রয়েছে চীনের বিশেষ প্রভাব। ফলে মিয়ানমারে প্রক্সি খেলা অথবা পরিবর্তনের জন্য আমেরিকান উদ্যোগ যত দ্রুত অগ্রসর হবার কথা, ততটা সম্ভবত হচ্ছে না। আমেরিকাকে এ ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করছে বলে মনে হচ্ছে ব্রিটেন এবং অস্ট্রেলিয়া; আর সীমিত বিধিনিষেধ আরোপ করে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। ওআইসিভুক্ত দেশগুলো রোহিঙ্গা ইস্যুকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্র্রকে এই বিষয়ে সহায়তা করছে। বিশেষত তুরস্ক, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া এবং সৌদি আরবের কিছুটা ইতিবাচক ভূমিকা রয়েছে।
মিয়ানমারকে গণতান্ত্রিক পরিবর্তনে বাধ্য করার জন্য আসিয়ানের সদস্য দেশগুলো বিশেষত থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার বিশেষ সহায়তা প্রয়োজন বলে মনে হয়। একই সাথে প্রয়োজন বাংলাদেশের সহায়ক ভূমিকা। আসিয়ান নেতৃবৃন্দ সাম্প্রতিক জাকার্তা শীর্ষ সম্মেলনে মিয়ানমারের সঙ্ঘাত নিরসনে সমঝোতার উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু সেটি খুব বেশিদূর অগ্রসর হয়নি। অতি সম্প্রতি মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ স্থিতি না আসা পর্যন্ত আসিয়ানকে স্বাগত না জানানোর কথা জানিয়েছে জান্তা কর্তৃপক্ষ। অন্য দিকে রোহিঙ্গা ইস্যুতে জান্তা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছে, কোনো চাপের মুখে মিয়ানমার নতি স্বীকার করবে না।
এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে চীনের সাথে সম্পর্কের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর ব্যাপারে বাংলাদেশ যে স্বপ্ন দেখেছিল, তা কার্যত ব্যর্থ হয়ে গেছে। এই অবস্থায় বাংলাদেশ রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে এক ধরনের সিদ্ধান্তহীন অবস্থায় পৌঁছে গেছে। চাপ প্রয়োগ ছাড়া এখন যে, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মিয়ানমার ফিরিয়ে নেবে না তাতে আর কোনো সন্দেহ থাকছে না। আর এই চাপ তৈরির জন্য ঢাকাকে অবশ্যই আমেরিকার নেতৃত্বাধীন বলয়ের সহায়তা নিতে হবে। এই সহায়তা নেয়ার অর্থ হলো, চীনকে ক্ষুব্ধ করা এবং বাংলাদেশের বড় বড় প্রকল্পসমূহে যে চীনা সহায়তা নেয়া হচ্ছে, সেটি বন্ধ হয়ে যাওয়া।
বাংলাদেশ রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে চীন আর আমেরিকা কোন পক্ষের দিকে ঝুঁকবে তা নিয়ে যে টানাপোড়েনে আছে, সেটি স্পষ্ট। তবে এ ক্ষেত্রে একটি বিষয় বাংলাদেশের জন্য খুবই বিব্রতকর অবস্থা তৈরি করেছে। সেটি হলো, সাধারণভাবে অন্য কোনো ইস্যুতে চীনের বিপক্ষে গেলে ভারতের উচ্ছ্বসিত সমর্থন পাওয়া যায়। এ ক্ষেত্রে রোহিঙ্গা একমাত্র ইস্যু যেখানে চীন ও ভারতের অবস্থান অনেকটাই অভিন্ন। এর ফলে রোহিঙ্গা নিয়ে আমেরিকার বলয়ে যাবার অর্থ হবে এ ব্যাপারে চীন ভারত দুই পক্ষের রোষানলে পড়া। সেটি করার মতো সামর্থ্য ঢাকার বর্তমান নেতৃত্বের কতটা রয়েছে, তা নিয়ে সংশয়ে রয়েছেন অনেক পর্যবেক্ষক।
স্মরণ রাখার বিষয় হলো, বাংলাদেশের জন্য চীনকে ক্ষুব্ধ করার ঝুঁকির একদিকে রয়েছে বেইজিংয়ের অর্থনৈতিক বা উন্নয়ন সহায়তা হারানো; অন্য দিকে সামরিক বাহিনীর প্রায় ৭০ শতাংশ অস্ত্রশস্ত্র চীনা উৎস থেকে আসে। সেই সরবরাহ লাইনে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি। এই পরিস্থিতিতে দেশের বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য বাংলাদেশকে জাপান ও বিশ্বব্যাংকের সহায়তার ওপর নির্ভর করতে হবে। আর প্রতিরক্ষা সামগ্রীর জন্য ন্যাটো বলয়ের সস্তায় অস্ত্র প্রাপ্তির দেশগুলোর দিকে বাংলাদেশকে ঝুঁকতে হবে।
এ ধরনের নীতিগত রূপান্তর যেমন বাংলাদেশের জন্য অনেক জটিল, তেমনি রোহিঙ্গা ইস্যুটিকে নিষ্পত্তিহীন অবস্থায় ঝুলিয়ে রাখাও হবে বিপর্যয়কর। আর এই ইস্যুতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ মিয়ানমারে সামরিক জান্তাবিরোধী যে প্রতিরোধ গোষ্ঠী তৈরি হয়েছে, সেটিকে এগিয়ে নেয়ার জন্যও গুরুত্বপূর্ণ।
মিয়ানমারে এখন যে অবস্থা তাতে দেশটির বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত অঞ্চল সম্প্রসারণের জন্য বিভিন্ন ক্ষেত্রে সামরিক বাহিনীর অবস্থানে হামলার ঘটনা ঘটছে। এর ফলে অনেক স্থান থেকে তাতমাদাও ক্যাম্প গুটিতে নিতে বাধ্য হচ্ছে। এভাবে এক সময় যেখানে বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণে মিয়ানমারের ২০ শতাংশের মতো ভূমি ছিল তা এখন ৩৩ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। মিয়ানমারের সেনাবাহিনীকে বিদ্রোহী হামলা প্রতিহত করতে এবং তাদের মুক্তাঞ্চল সম্প্রসারণ ঠেকাতে বিমান হামলার আশ্রয় নিতে দেখা যাচ্ছে।
সামরিক জান্তার বিপক্ষে সব দল মিলে যে কোয়ালিশন গঠন করেছে তাতে রোহিঙ্গা প্রতিরোধ গোষ্ঠীগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য রোহিঙ্গাদের নাগরিক অধিকারের স্বীকৃতি দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে প্রতিরোধ কোয়ালিশন। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের তরফ থেকে অনেক চাপ সত্ত্বেও মিয়ানমারের যে রাজনীতিকরা রোহিঙ্গাদের অধিকারের বিন্দুমাত্র স্বীকৃতি দিতে রাজি হননি, হঠাৎ করে তাদের অবস্থানে নাটকীয় পরিবর্তন বিস্ময়ের সৃষ্টি করেছে। এতে রোহিঙ্গাদের অধিকারের স্বীকৃতি শুধু নয়, ১৯৮২ সালের যে নাগরিকত্ব আইনের বলে তাদের অধিকার হরণ করা হয়, সেটি বিলোপের অঙ্গীকারও রয়েছে।
গণতন্ত্রের দাবিতে রক্তাক্ত সংগ্রামে লিপ্ত মিয়ানমারের বিরোধী দলগুলো এখন গড়ে তুলেছে একটি সমান্তরাল সরকার, যেটি ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট বা এনইউজি নামে পরিচিত। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছ থেকে স্বীকৃতি লাভের জন্য এই এনইউজি সর্বাত্মক চেষ্টা চালাচ্ছে। রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে ঘোষণাটি দেয়া হয়েছে এই এনইউজির তরফ থেকে। ঘোষণাটিকে বেশ ইতিবাচক পদক্ষেপ হিসেবে দেখছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। রোহিঙ্গাদের অধিকারের পক্ষে সোচ্চার বিভিন্ন সংগঠনও এটিকে স্বাগত জানিয়েছে।
প্রথমত, এতে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর হাতে রোহিঙ্গারা যে হত্যা-নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হয়েছে, তার স্বীকৃতির পাশাপাশি যারা এর জন্য দায়ী, তাদের বিচারের কথা বলা হয়েছে। প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতকে মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধের বিচারের এখতিয়ার দেয়ার প্রক্রিয়া শুরুর অঙ্গীকার করা হয়েছে।
দ্বিতীয়ত, এতে ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইন সংশোধন/বিলোপের অঙ্গীকার করা হয়েছে। রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব হরণের ক্ষেত্রে এই আইনটিকে ব্যবহার করে মিয়ানমারের সামরিক কর্তৃপক্ষ।
তৃতীয়ত, এই ঘোষণায় মিয়ানমার থেকে পালিয়ে যাওয়া রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে আনার জন্য প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে করা চুক্তি মেনে চলার অঙ্গীকার আছে।
২০১৭ সালে সর্বশেষ রোহিঙ্গা শরণার্থী সঙ্কট শুরু হওয়ার পর এতটা খোলাখুলি মিয়ানমারের রাজনীতিকদের রোহিঙ্গাদের অধিকারের পক্ষে কথা বলতে দেখা যায়নি। মিয়ানমারবিষয়ক বিশ্লেষক ল্যারি জ্যাগানের মতে, এটি আসলে মিয়ানমারের জাতীয় ঐক্যের সরকারের তরফ হতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ এক পদক্ষেপ। এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ‘রোহিঙ্গা’ পরিচয়ের স্বীকৃতি। এই ঘোষণার মাধ্যমে এনইউজি স্পষ্টতই মিয়ানমারের সামরিক সরকারের চেয়ে পরিষ্কার একটা ভিন্ন অবস্থান নিতে চেয়েছে। কারণ সামরিক বাহিনী এখনো পর্যন্ত বলে যাচ্ছে ‘রোহিঙ্গা’ বলে কিছু নেই।
এনইউজি’র এই ঘোষণা মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের অধিকার নিয়ে সক্রিয় গ্রুপগুলোর মধ্যেও আশাবাদ তৈরি করেছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনও একে স্বাগত জানিয়েছে। তবে রোহিঙ্গা নেতাদের অনেকে মনে করেন, এই ঘোষণায় কিছু অস্পষ্টতা এখনো রয়ে গেছে। যুক্তরাজ্যভিত্তিক একটি সংগঠন বার্মিজ রোহিঙ্গা অর্গানাইজেশনের প্রেসিডেন্ট টুন খিন একটা ইতিবাচক পদক্ষেপ হিসেবে একে স্বাগত জানিয়ে বলেছেন, এই ঘোষণায় অনেক কিছু বলা হলেও রোহিঙ্গারা যে মিয়ানমারেরই এথনিক গোষ্ঠী এবং অন্যান্য এথনিক গোষ্ঠীর মতো তাদেরও যে সমান অধিকার আছে- সেটা স্পষ্ট করে বলা নেই। এর প্রকাশ্য স্বীকৃতি আমরা চাই।’
মিয়ানমারের প্রায় সব প্রধান বিরোধী দলের রাজনীতিকদের নিয়ে গত ১৬ এপ্রিল গঠিত এনইউজিতে ফেব্রুয়ারিতে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা হারানো এনএলডির নির্বাচিত পার্লামেন্টারিয়ানদের পাশাপাশি বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর প্রতিনিধি এবং দলের রাজনীতিকরা আছেন। এটি মিয়ানমারের মূল গণতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রতিনিধিত্ব করে, কিন্তু এটি যতটা প্রতিনিধিত্বমূলক হওয়া উচিৎ, ততটা নয়। যেমন রোহিঙ্গাদের কাউকে রাখা হয়নি এই সরকারে।
গত মাসে যুক্তরাষ্ট্রের হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভসের ফরেন অ্যাফেয়ার্স কমিটির এক সভায় এনইউজির এক দূতকে কংগ্রেসম্যান ব্রাড শেরম্যান প্রশ্ন করেছিলেন, রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে তাদের অবস্থান কী, যার কোনো সদুত্তর দিতে তিনি ব্যর্থ হন। এনইউজি যে রোহিঙ্গা প্রশ্ন তাদের অবস্থান বদলিয়েছে, আন্তর্জাতিক চাপ সেখানে বড় ভূমিকা রাখছে বলে অনেকে মনে করছেন।
একথা ঠিক, রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে চূড়ান্ত সমঝোতা হলে মিয়ানমারের প্রতিরোধ লড়াই ব্যাপকতা পেতে পারে। তবে একটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ যে, মিয়ানমারকেন্দ্রিক পরাশক্তিসমূহের লড়াই বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা থেকে বিচ্ছিন্ন কোনো কিছু নয়। যুক্তরাষ্ট্রের বাইডেন প্রশাসন চীন ও রাশিয়াবিরোধী যে অবস্থান আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নিতে চলেছে তার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হতে পারে এটি। ফলে এর সাথে বৈশ্বিক রাজনীতির গতি প্রকৃতির একটি নিবিড় যোগসূত্র থাকবে।
চীন-রাশিয়া আর যুক্তরাষ্ট্র ও পাশ্চাত্যের মিত্রদের মধ্যে উত্তেজনার আরো কিছু ক্ষেত্র রয়েছে। বিশেষত মধ্যপ্রাচ্যের ইসরাইল-ফিলিস্তিন, ইউরোপ ফ্রন্টে ইউক্রেন এবং দক্ষিণ চীন সাগরে তাইওয়ানকেন্দ্রিক উন্নয়ন যে মাত্রারই হোক না কেন, মিয়ানমারকেন্দ্রিক ঘটনাকে প্রভাবিত করবে।
তবে একথা স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হচ্ছে যে, বৈশ্বিক উত্তেজনার এক গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হতে যাচ্ছে মিয়ানমার ও এর আশপাশের এলাকা যার উত্তাপ বাংলাদেশ ও থাইল্যান্ডের মতো প্রতিবেশীরা কোনোভাবেই এড়াতে পারবে বলে মনে হচ্ছে না।
mrkmmb@gmail.com