মিয়ানমারের ক্ষমতা এখন কার হাতে!
সু চি - ছবি সংগৃহীত
অং সান সু চির ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসির (এনএলডি) পাঁচ বছরের শাসন শেষে দ্বিতীয় মেয়াদে নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় যাবার আগেই গত ফেব্রুয়ারির প্রথম দিনেই মিয়ানমারের শাসনক্ষমতা কেড়ে নেয় সামরিক জান্তা। তবে এবারের ব্যতিক্রম হলো দেশটির সাধারণ মানুষ অতীতে কোনো সময় রাস্তায় সেনাশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলে অব্যাহতভাবে জীবনদানের ঘটনা ঘটায়নি। এবার সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে মিয়ানমারের বড় বড় শহরগুলোতে দীর্ঘ সময় ধরে বিক্ষোভই শুধু হয়নি; সেই সাথে আন্দোলনকারীরা একটি বিকল্প সরকারও গঠন করেছেন। আর সে সরকারের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় একটি অঞ্চল দখলের জন্য নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর সাথে মিলে এনএলডি নেতারা একটি গণতান্ত্রিক ফেডারেশন গঠনের চুক্তিও স্বাক্ষর করেছে। এরপর আন্দোলনকারী বৃহত্তর নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী বামাররা জান্তার বিরুদ্ধে লড়াইরত অন্য বিদ্রোহীদের কাছে সামরিক প্রশিক্ষণ নিয়ে জান্তাবিরোধী সমন্বিত সশস্ত্র প্রতিরোধ লড়াই শুরু করছে। এই লড়াইয়ে সরকার অন্তত ৩৩ শতাংশ বর্মী ভূমির ওপর তাদের কর্তৃত্ব হারিয়েছে। মিয়ানমারের জান্তা প্রধান জেনারেল মিন অং হ্লাইং নিজে স্বীকারও করে নিয়েছেন যে, পুরো মিয়ানমারের ওপর সরকারের এখন নিয়ন্ত্রণ নেই।
প্রশ্ন হলো, মিয়ানমারের জান্তাপ্রধান এ অবস্থাকে কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছেন? জান্তাবিরোধী শক্তিগুলোইবা কী অর্জন করতে চাইছে এই পরিস্থিতিতে? এই ঘাত-প্রতিঘাতের প্রভাব মিয়ানমারের ওপর কতটা, কিভাবে পড়বে? চীন, রাশিয়া, ভারত, ব্রিটেন, আমেরিকার ভূমিকাইবা তাতে কী হবে? বাংলাদেশ ও থাইল্যান্ডের মতো প্রতিবেশী দেশগুলো যারা বর্মী শরণার্থীর ভারে ভারাক্রান্ত তাদের ভূমিকাইবা কী হবে?
মিয়ানমারের সেনাবাহিনী দেশটির স্বাধীনতা-উত্তর ৯০ শতাংশ সময় এককভাবে ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করেছে। দেশটির অর্থনীতির আকার ও অন্যান্য সক্ষমতার তুলনায় সামরিক বাহিনী অনেক বড়। বিচ্ছিন্নতাবাদী বিদ্রোহ দমন করতে গিয়ে বর্মী সেনাবাহিনী এক ধরনের দক্ষতা আর সক্ষমতাও অর্জন করেছে। এ অবস্থায় দেশটির বিচ্ছিন্নতা কাটাতে কিছু রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংস্কারের পথ ধরে বেসামরিক শাসনের সীমিত পদক্ষেপ নিলেও ক্ষমতা বেসামরিক কর্তৃপক্ষের কাছে পুরোপুরি হস্তান্তর করতে বর্মী সেনাবাহিনী কখনো চায়নি। সু চির সরকারকে দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় যেতে না দিয়ে অভ্যুত্থান ঘটানোর পেছনে এটিই মূল কারণ। মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ‘তাতমাদাও’ বরাবরের মতো এবারো সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাবে ক্ষমতা সুসংহত করার জন্য। আন্দোলন দমনের জন্য তারা এর মধ্যে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়েছেও। এখন সশন্ত্র বিদ্রোহ জোরদার হতে চলেছে; সেটাকেও তারা দমানোর চেষ্টা করবে। এ ক্ষেত্রে বর্মী সেনা নেতৃত্ব প্রধান সহযোগিতা পাবে প্রতিবেশী চীনের। চীন সব সময় সেনা সমর্থিত সরকারকে সমর্থন করে এসেছে; আর অভ্যুত্থানের ফলে যে বিচ্ছিন্নতা তৈরি হয় তার সুবাদে একক বিনিয়োগ ও অন্যান্য সুবিধা গ্রহন করেছে। এবার মিয়ানমারের সেনানেতৃত্ব শুধু ক্ষমতা সুসংহত করার জন্যই বেইজিংয়ের সমর্থন নেবে না; একই সাথে যেসব বিদ্রোহী সংগঠনের সাথে চীনের যোগাযোগ রয়েছে বিশেষত কাচিন বিদ্রোহী ও আরাকান আর্মি, তাদের সাথে সমঝোতায় সহায়তা পেতে চাইবে।
মিয়ানমারের সামরিক জান্তার জন্য এবার আরেকটি সুবিধাজনক অবস্থা তৈরি করেছে ভারতের সাথে তার সম্পর্ক। চীন যেমন আরাকান সমুদ্রবন্দর থেকে জ্বালানি পাইপলাইন কুনমিং হয়ে জিনজিয়াং পর্যন্ত নিয়ে যাবার একটি বিকল্প জ্বালানি সড়ক তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে, তেমনিভাবে ভারতও কালাদান রিভার প্রজেক্টের মাধ্যমে উত্তর পূর্ব ভারতের সাথে বিকল্প সমুদ্র সংযোগ তৈরি করছে। মিয়ানমারের সেনা নেতৃত্ব চীন ও ভারতের সাথে সমান্তরাল সম্পর্ক তৈরি করে কৌশলগত সুবিধা আদায়ের চেষ্টা করছে।
চীনও মিয়ানমারকে একটি পর্যায় পর্যন্ত অ্যালাউ করছে বলে মনে হয়। ভারতের সাথে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর এই সম্পর্কের কারণে আমেরিকানরা চীনের বিরুদ্ধে ‘কোয়াড’ সদস্য হিসেবে ভারতকে মিয়ানমারে ব্যবহারের কোনো সুবিধাই পাচ্ছে না। এখানে অবশ্য ভারতের নিজস্ব একটি হিসাব নিকাশও রয়েছে। দিল্লির কৌশলবিদরা মনে করছেন, মিয়ানমারের জান্তার বিরুদ্ধে লড়াইরত নৃতাত্ত্বিক সংখ্যালঘুরা সফল হলে এর প্রভাব পড়বে উত্তর পূর্ব ভারতের বিদ্রোহীদের ওপর। এই অঞ্চলে ভারতের মূল ধারার হিন্দুরা সার্বিকভাবেই সংখ্যালঘিষ্ঠ। এ অবস্থায় কোনো খ্রিষ্টান সংখাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র এই অঞ্চলে প্রতিষ্ঠার অর্থ হবে, সাত রাজ্যে তার প্রভাব পড়া। অর্থনৈতিক স্বার্থের পাশাপাশি এই কৌশলগত সমীকরণটিও মিয়ানমারের সাথে দিল্লির বিশেষ সম্পর্ক বজায় রাখতে ভূমিকা পালন করছে।
ভারতের এই কৌশলগত স্বার্থের সাথে একাত্ম হয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের ক্ষুদ্র অথচ ক্ষমতাশালী রাষ্ট্র, ইসরাইলের স্বার্থ। দেশটি বার্মার সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক গোড়া থেকেই রক্ষা করে চলেছে। জান্তা শাসনের সময় যখন মিয়ানমার একেবারে একঘরে ছিল তখনো ইসরাইল মিয়ানমারের সাথে সামরিক ও অন্যবিধ সম্পর্ক রক্ষা করে চলেছে। এখন আমেরিকা ও তার মিত্ররা মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক পরিবর্তনের জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাতে চাইলেও ইসরাইলের ভূমিকা এর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তি রাশিয়ার সাথেও রয়েছে মিয়ানমারের বিশেষ সম্পর্ক। দেশটি মিয়ানমারকে বিভিন্ন কৌশলগত অস্ত্র সামরিক সরঞ্জাম বিক্রি করে চলেছে। আন্তর্জাতিক ফোরামে মিয়ানমারের পক্ষে প্রকাশ্য অবস্থান নিতেও শুরু করেছে।