মিয়ানমারে বিদেশী শক্তির প্রভাব
চীনা প্রেসিডেন্ট শি, সু চি ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদি - ছবি সংগৃহীত
মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক পরিবর্তনের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র সবচেয়ে বেশি আগ্রহী হলেও ভারত ও ইসরাইলের মতো তার মিত্রদের এক অংশ এ ব্যাপারে সহযোগিতা না করার কারণে কার্যকর কোনো কিছু করতে পারছে না। এর বাইরে মিয়ানমারের অন্য দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশ আর থাইল্যান্ডের ওপরও রয়েছে চীনের বিশেষ প্রভাব। ফলে মিয়ানমারে প্রক্সি খেলা অথবা পরিবর্তনের জন্য আমেরিকান উদ্যোগ যত দ্রুত অগ্রসর হবার কথা, ততটা সম্ভবত হচ্ছে না। আমেরিকাকে এ ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করছে বলে মনে হচ্ছে ব্রিটেন এবং অস্ট্রেলিয়া; আর সীমিত বিধিনিষেধ আরোপ করে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। ওআইসিভুক্ত দেশগুলো রোহিঙ্গা ইস্যুকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্র্রকে এই বিষয়ে সহায়তা করছে। বিশেষত তুরস্ক, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া এবং সৌদি আরবের কিছুটা ইতিবাচক ভূমিকা রয়েছে।
মিয়ানমারকে গণতান্ত্রিক পরিবর্তনে বাধ্য করার জন্য আসিয়ানের সদস্য দেশগুলো বিশেষত থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার বিশেষ সহায়তা প্রয়োজন বলে মনে হয়। একই সাথে প্রয়োজন বাংলাদেশের সহায়ক ভূমিকা। আসিয়ান নেতৃবৃন্দ সাম্প্রতিক জাকার্তা শীর্ষ সম্মেলনে মিয়ানমারের সঙ্ঘাত নিরসনে সমঝোতার উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু সেটি খুব বেশিদূর অগ্রসর হয়নি। অতি সম্প্রতি মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ স্থিতি না আসা পর্যন্ত আসিয়ানকে স্বাগত না জানানোর কথা জানিয়েছে জান্তা কর্তৃপক্ষ। অন্য দিকে রোহিঙ্গা ইস্যুতে জান্তা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছে, কোনো চাপের মুখে মিয়ানমার নতি স্বীকার করবে না।
এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে চীনের সাথে সম্পর্কের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর ব্যাপারে বাংলাদেশ যে স্বপ্ন দেখেছিল, তা কার্যত ব্যর্থ হয়ে গেছে। এই অবস্থায় বাংলাদেশ রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে এক ধরনের সিদ্ধান্তহীন অবস্থায় পৌঁছে গেছে। চাপ প্রয়োগ ছাড়া এখন যে, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মিয়ানমার ফিরিয়ে নেবে না তাতে আর কোনো সন্দেহ থাকছে না। আর এই চাপ তৈরির জন্য ঢাকাকে অবশ্যই আমেরিকার নেতৃত্বাধীন বলয়ের সহায়তা নিতে হবে। এই সহায়তা নেয়ার অর্থ হলো, চীনকে ক্ষুব্ধ করা এবং বাংলাদেশের বড় বড় প্রকল্পসমূহে যে চীনা সহায়তা নেয়া হচ্ছে, সেটি বন্ধ হয়ে যাওয়া।
বাংলাদেশ রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে চীন আর আমেরিকা কোন পক্ষের দিকে ঝুঁকবে তা নিয়ে যে টানাপোড়েনে আছে, সেটি স্পষ্ট। তবে এ ক্ষেত্রে একটি বিষয় বাংলাদেশের জন্য খুবই বিব্রতকর অবস্থা তৈরি করেছে। সেটি হলো, সাধারণভাবে অন্য কোনো ইস্যুতে চীনের বিপক্ষে গেলে ভারতের উচ্ছ্বসিত সমর্থন পাওয়া যায়। এ ক্ষেত্রে রোহিঙ্গা একমাত্র ইস্যু যেখানে চীন ও ভারতের অবস্থান অনেকটাই অভিন্ন। এর ফলে রোহিঙ্গা নিয়ে আমেরিকার বলয়ে যাবার অর্থ হবে এ ব্যাপারে চীন ভারত দুই পক্ষের রোষানলে পড়া। সেটি করার মতো সামর্থ্য ঢাকার বর্তমান নেতৃত্বের কতটা রয়েছে, তা নিয়ে সংশয়ে রয়েছেন অনেক পর্যবেক্ষক।
স্মরণ রাখার বিষয় হলো, বাংলাদেশের জন্য চীনকে ক্ষুব্ধ করার ঝুঁকির একদিকে রয়েছে বেইজিংয়ের অর্থনৈতিক বা উন্নয়ন সহায়তা হারানো; অন্য দিকে সামরিক বাহিনীর প্রায় ৭০ শতাংশ অস্ত্রশস্ত্র চীনা উৎস থেকে আসে। সেই সরবরাহ লাইনে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি। এই পরিস্থিতিতে দেশের বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য বাংলাদেশকে জাপান ও বিশ্বব্যাংকের সহায়তার ওপর নির্ভর করতে হবে। আর প্রতিরক্ষা সামগ্রীর জন্য ন্যাটো বলয়ের সস্তায় অস্ত্র প্রাপ্তির দেশগুলোর দিকে বাংলাদেশকে ঝুঁকতে হবে।
এ ধরনের নীতিগত রূপান্তর যেমন বাংলাদেশের জন্য অনেক জটিল, তেমনি রোহিঙ্গা ইস্যুটিকে নিষ্পত্তিহীন অবস্থায় ঝুলিয়ে রাখাও হবে বিপর্যয়কর। আর এই ইস্যুতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ মিয়ানমারে সামরিক জান্তাবিরোধী যে প্রতিরোধ গোষ্ঠী তৈরি হয়েছে, সেটিকে এগিয়ে নেয়ার জন্যও গুরুত্বপূর্ণ।
মিয়ানমারে এখন যে অবস্থা তাতে দেশটির বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত অঞ্চল সম্প্রসারণের জন্য বিভিন্ন ক্ষেত্রে সামরিক বাহিনীর অবস্থানে হামলার ঘটনা ঘটছে। এর ফলে অনেক স্থান থেকে তাতমাদাও ক্যাম্প গুটিতে নিতে বাধ্য হচ্ছে। এভাবে এক সময় যেখানে বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণে মিয়ানমারের ২০ শতাংশের মতো ভূমি ছিল তা এখন ৩৩ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। মিয়ানমারের সেনাবাহিনীকে বিদ্রোহী হামলা প্রতিহত করতে এবং তাদের মুক্তাঞ্চল সম্প্রসারণ ঠেকাতে বিমান হামলার আশ্রয় নিতে দেখা যাচ্ছে।