ডায়াবেটিসে কিডনি রোগ
ডায়াবেটিসে কিডনি রোগ - ছবি সংগৃহীত
বর্তমান বিশ্বে ডায়াবেটিস একটি অন্যতম রোগ এবং এর কারণে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে নানা রকম জটিলতা সৃষ্টি হয়। ডায়াবেটিসজনিত কিডনি রোগ এর মধ্যে অন্যতম। ডায়াবেটিসের প্রভাবে শারীরিক যেকোনো অঙ্গ বা সিস্টেম আক্রান্ত হতে পারে। কিডনি রোগের উপর প্রধানত ডায়াবেটিক নেফ্রোপ্যাথি এবং কিডনি বা প্রসাব নালীতে সংক্রামণ অনত্যম।
ডায়াবেটিক নেফ্রোপ্যাথি কী? কিডনি সম্পূর্ণভাবে বিকল বা অকেজো হওয়ার কারণগুলোর মধ্যে উন্নত দেশে ডায়াবেটিসকে প্রধান এবং আমাদের মত উন্নয়নশীল দেশে ইহাকে দ্বিতীয় প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ইনসুলিন নির্ভরশীল ডায়াবেটিস রোগীদের বেলায় এই রোগের হার শতকরা ৪০-৫০ ভাগ এবং যারা ইনসুলিন নির্ভরশীল নন তাদের বেলায় শতকরা ১৫-২০ ভাগ। সাধারণত ইনসুলিন নির্ভরশীল ডায়াবেটিস রোগীদের ক্ষেত্রে এই রোগের কারণে কিডনিতে প্রাথমিক বিপর্যয় শুরু হয় ৭-১০ বছরের মধ্যে, যখন কোনো উপসর্গই থাকে না শুধু প্রস্রাবে প্রোটিনের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায় এবং ১০-১৫ বছরের মধ্যে প্রস্রাবে প্রোটিনের পরিমাণ অনেক বেড়ে যায়, তখন তাকে বলা নেফ্রোটিক সিন্ড্রোম এবং এই সময়ে রোগীর শরীরে পানি আসা শুরু হয়। আর ১৫-২০ বছরের মধ্যে কিডনির কার্যক্রম হ্রাস পেতে থাকে। তখন একে ধীরগতিতে কিডনি ফেইলিউর বলা হয়।
উপসর্গ : প্রাথমিক পর্যায়ে ডায়াবেটিক নেফ্রোপ্যাথির কোনো উপসর্গ থাকে না। উপসর্গ যখন দেখা যায় ততদিনে কিডনির অনেকটা ক্ষতি হয়ে থাকে। প্রধান প্রধান উপসর্গগুলো হচ্ছে পায়ে পানি আসা এবং রক্তচাপ বৃদ্ধি পাওয়া। এদেরকে পরীক্ষা করে চোখের ও স্নায়ুতন্ত্রের জটিলতার উপস্থিতিও লক্ষ্য করা যায়। সাধারণত : ডায়াবেটিস হওয়ার ৫-১৫ বছর পরে এ ধরনের জটিলতা দেখা যায়। এই পর্যায়ে চিকিৎসায় খুব ভাল ফল লাভ সম্ভব হয় না। এ জন্যই প্রতিদিন এইসব রোগীকে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার পরে পরেই প্রস্রাবে অ্যালবুমিন আছে কি না তা পরীক্ষা করে দেখা হয়।
পরীক্ষা পদ্ধতি : প্রাথমিক পর্যায়ে শারীরিক পরীক্ষা করে উল্লেখযোগ্য কিছুই ধরা পড়ে না। তবে সময়ের তারতম্য হিসাবে ডায়াবেটিস রোগের জটিলতা, চোখের রেটিনোপ্যাথি বিভিন্ন প্রকার চর্ম ও স্নায়ু রোগের অবস্থান পরীক্ষা করে ধরা পড়ে। প্রতিটি ডায়াবেটিসের রোগীর সকালের প্রস্রাব পরীক্ষা করে প্রস্রাবে অ্যালবুমিন বা আমিষ, সুগার বা শর্করা আছে কি না তা দেখা উচিত। অনুবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে প্রস্রাবে লোহিত কণিকা, শ্বেত কণিকা ও কাষ্ট দেখা হয়। যদি প্রসাবে শ্বেত কণিকা পাওয়া যায়, প্রসাব কালাচারের মাধ্যমে জীবাণুজনিত ইনফেকশন আছে কি না তা নির্ণয় করা হয়ে থাকে। ২৪ ঘণ্টার প্রস্রাব পরীক্ষা করে কত পরিমাণ অ্যালবুমিন যাচ্ছো তা নির্ণয় করা হয়। ২৪ ঘণ্টায় অ্যালবুমিন ৩০০ মি:গ্রা: এর উপরে গেলেই ডায়াবেটিস নেফ্রোপ্যাথি ভাবা হয়। প্রতিটি রোগীর রক্তের ইউরিয়া, ক্রিয়েটিনিন, সোডিয়াম, পটাশিয়াম, ক্লোরাইড, বাইকার্বনেট পরীক্ষা করে দেখা হয়। প্রস্রাবে যদি ৩০০ মি:গ্রা: এর উপরে অ্যালবুমিন যায় এবং সাথে সাথে রক্তে ইউরিয়া ও ক্রিটিনিন স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি থাকে তখন কিডনি অকেজো হওয়ার প্রাথমিক পর্যায় ধরা হয়।
চিকিৎসা ব্যবস্থা : ডায়াবেটিক নেফ্রোপ্যাথির চিকিৎসা নির্ভর করে ডায়াবেটিস দ্বারা কিডনি কতখানি আক্রান্ত হয়েছে তার উপর। প্রাথমিক পর্যায়ে ডায়াবেটিস রোগীর নেফ্রোপ্যাথি ধরার সাথে সাথে উচ্চ রক্তচাপ হওয়ার লক্ষণও দেখা যায়। এই সমস্ত ক্ষেত্রে রোগীর ডায়াবেটিসকে নিয়ন্ত্রণের ভেতরে আনা হয়। এর সাথে সাথে খাবারের তালিকা সঠিক আছে কি না তা বিশেষভাবে খতিয়ে দেখা হয়। প্রসাবে যদি অ্যালবুমিন নির্গত হয় তাহলে এসিই ইনহেবিটর জাতীয় ওষুধ দেয়া হয়। এসিই ইনহেবিটর জাতীয় ওষুধ কিডনির ছাকনির উপর কাজ করে। অ্যালবুমিন নির্গত হওয়ার পরিমাণকে কমিয়ে দেয়।
রোগীর যদি এ পর্যায়ে উচ্চ রক্তচাপ থাকে তাহলে তা অবশ্যই নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখার ব্যবস্থা করা হয় এবং তা এসিই ইনহেবিটর দ্বারা করাই শ্রেয়। কিডনির কাজ বেশি লোপ পেয়ে গেল এসিই ইনহেবিটর জাতীয় ওষুধ ব্যবহার করা ঝুঁকিপূর্ণ কারণ ইহাতে রক্তে পটাসিয়ামের পরিমাণ বাড়ায় যাহা শরীরের জন্য ক্ষতিকারক। এই পর্যায়ে রোগীর খাবারে আমিষের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখা হয় অর্থাৎ রক্তের ক্রিয়েটনিনের উপর নির্ভর করে আমিষের পরিমাণ ০.৫-০-,৭৫ গ্রাম প্রতি কেজি শরীরের ওপনের উপর ভিত্তি করে নির্ধারণ করা হয়। অনেক রোগীর ডায়াবেটিক নেফ্রোপ্যাথি হওয়ার পর পা ও পেটে পানি আসে।
এই সমস্ত ক্ষেত্রে খাওয়ার পানি নিয়ন্ত্রণ করতে হয় যা ২৪ ঘণ্টায় ১ লিটারের মধ্যে রাখা প্রয়োজন। পানি শরীর থেকে বের করার জন্য ফ্রুসেমাইড বা লুপ ডাইয়ুবেটিক্স জাতীয় ওষুধ দেয়া হয়ে থাকে এবং কিডনির কার্যকারিতা ও শরীরে পানির পরিমাণ অনুযায়ী ওষুদের মাত্রা নির্ধারণ করা হয়। রোগীর যদি উচ্চ রক্তচাপ থাকে তা অবশ্যই নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখতে হবে। উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের জন্য নিফেডিপিন বা ক্যালসিয়াম চ্যানেল ব্লকার বা মিথাইল ডোপ জাতীয় ওষুধ নিরাপদ। প্রস্রাবে জীবাণুজনিত ইনফেকশন বা শরীরে কোথাও ইনফেকশন হলেই এন্টবাইওটিক ব্যবহারের সময়ও সতর্কতা অবরম্বন করতে হবে।
লেখক : পরিচালক ও অধ্যাপক (অব:) জাতীয় কিডনি ইনস্টিটিউট, ঢাকা