বজ্রপাতের সাথে ম্যাগনেটিক পিলারের সম্পর্ক কতটুকু?
ম্যাগনেটিক পিলার - ছবি : সংগৃহীত
তথাকথিত ম্যাগনেটিক পিলার নিয়ে বাংলাদেশের অনেক মানুষের মাঝে বেশ কিছু ভ্রান্ত ধারণা প্রচলিত আছে। অনেক শিক্ষিত মানুষও এগুলো সম্পর্কে নানা ধরনের বানোয়াট কথা বিশ্বাস করে, প্রচার করে। তাই আমার মনে হয়েছে এই ভুল ধারণাগুলো সবারই পরিহার করা দরকার। আশা করি আলোচনাটি এ বিষয়ে আপনাকে সাহায্য করবে।
চলুন আজকের বিষয়টি একটু ব্যতিক্রম পদ্ধতিতে আলোচনা করি যাতে সব শ্রেণির পাঠকদের (বিভিন্ন বিষয়ে পড়ুয়া) বুঝতে সুবিধা হয়।
১. সর্বপ্রথমে খুব সংক্ষেপে জেনে নেই যে আর্থিং কি?
উত্তর : Earth (আর্থ) মানে হলো পৃথিবী। পৃথিবী বলতে বোঝায় মাটি, ভূগর্ভ, পাহাড়, সাগর, নদী, বন, গাছপালা, মরুভূমি, ইত্যাদি সব। আর আর্থিং (earthing) মানে হলো পৃথিবীর সাথে সংযুক্ত করে দেয়া। পৃথিবী একটি বিশাল গ্রহ। এটি প্রায় সব কিছুই হজম করতে পারে। পৃথিবীজুড়ে বজ্রপাতের সময় লাখ লাখ ভোল্টের লাখ লাখ ছোট বড় বজ্র বিদ্যুৎ একসাথে পৃথিবীতে পতিত হয় কিন্তু পৃথিবীর কোনো ক্ষতি হয় না। কেন হয় না? কারণ পৃথিবীর আছে অসীম সহ্য ক্ষমতা, যেটাকে ইংরেজিতে বলে Resistance (রেজিস্ট্যান্স)। পৃথিবীর প্রতিটা জিনিসে রেজিস্ট্যান্স আছে, মানে প্রতিটা জিনিসের ভিতর দিয়ে বিদ্যুৎ প্রবাহিত করলে সেটা বিদ্যুৎ প্রবাহকে বাধা দেয়, কম অথবা বেশি।
একটি জিনিস বা বস্তু যত বড় এবং ঘন হবে তার বাধা দওয়ার ক্ষমতা (resistance) এবং সহ্য ক্ষমতাও (tolerance) বেশি। সুতরাং পৃথিবী অনেক বড়, অনেক ঘনত্ব বিশিষ্ট একটি বস্তু। তাই এটা বিলিয়ন বিলিয়ন ভোল্টের বজ্র বিদ্যুৎ একসাথে এলেও এর কোনো ক্ষতি হয় না, সহ্য করতে পারে।
একটা উদাহরণ দেই : একটি ১০ হাত লম্বা কলমের মতো চিকন তারে যদি ২২০ ভোল্টের বিদ্যুৎ সংযোগ দিয়ে যদি অপর প্রান্তে আপনি স্পর্শ করেন, তাহলে আপনি শক্ (Shock) খাবেন। কিন্তু এক হাজার হাত লম্বা এবং তেলের ড্রামের মতো মোটা সলিড কোনো দণ্ডের এক মাথায় ২২০ ভোল্টের সংযোগ দিয়ে শেষ মাথায় আপনি যদি স্পর্শ করেন তাহলে আপনি কোনো শক্ই অনুভব করবেন না। তাহলে এই বিদ্যুৎ গেল কোথায়? আসলে এই বিদ্যুৎ শেষ মাথায় পৌঁছাতে পারে না। কেননা বিশাল পরিবাহী হওয়ায় এর রেজিস্ট্যান্স বা বাধা দেয়ার ক্ষমতা অনেক বেশি। পৃথিবীর (Earth) ক্ষেত্রে বিষয়টিও এভাবেই চিন্তা করতে পারেন।
সুতরাং আর্থিং মানে হলো- অস্বাভাবিক বিদ্যুৎ বা বজ্র বিদ্যুৎকে পৃথিবীর অভ্যন্তরে প্রবেশ করিয়ে দেয়া যাতে স্বাভাবিক কাজ বা নিয়মের কোনো ক্ষতি না হয়। এটি একটি নিরাপত্তা সরঞ্জাম (Switchgear)।
২. ম্যাগনেটিক পিলাগুলো কিসের তৈরি?
উত্তর : লোহা তামা পিতল টাইটানিয়াম ধাতব পদার্থগুলো বিভিন্ন অনুপাতে যুক্ত করে ছাঁচে ঢেলে তৈরি করা হয়েছে এই পিলারগুলো। এতে ধাতব ম্যাগনেট বা ধাতব চুম্বক মিলানোর বিষয়টি একটি মুখরোচক গল্প মাত্র।
প্রাকৃতিক পরিবেশে, বিশেষ করে ইউরোপের বিভিন্ন খনিতে কালো রংয়ের এক ধরনের পাথর পাওয়া যায় যেগুলোতে চৌম্বকের কিছু গুণাবলি দেখা যায়। এই পাথরগুলোকে বলে লোডস্টোন (Lodestone) বা খনিজ চুম্বক বা প্রাকৃতিক চুম্বক। এগুলোর চৌম্বকত্ব খুবই দুর্বল। এবং এই পাথরটি অন্যান্য ধাতব পদার্থের সাথে গলিয়ে ম্যাগনেটিক পিলার তৈরি করার বিষয়টি যুক্তিযুক্ত নয়।
হজরত ঈসা নবীর জন্মের প্রায় ৬০০ বছর আগে গ্রিসের আনাতোলিয়া'র (বর্তমান তুরস্কের পশ্চিম অংশ) ম্যাগনেসিয়া (magnesia) নামক এলাকায় থ্যালেস অব মেলিতাস (Thales of Miletus) নামের এক দার্শনিক প্রথম এর সন্ধান দেন বা আবিষ্কার করেন।
৩. ম্যাগনেটিক পিলার কি বজ্রপাতের সময় আর্থিং হিসেবে কাজ করে?
উত্তর : না না না না, না! বজ্রপাতের সময় এই ধাতব দণ্ড বা পিলারটি আর্থিং হিসেবে কাজ করতে কোনো ভূমিকা রাখে না। কারণ এই পিলারগুলো মাটির কয়েক ফুট নিচে পোঁতা আছে। (যদিও ব্রিটিশ আমলে এগুলোর মাথা দৃশ্যমান করে পোঁতা হয়েছিল।)
এগুলো যদি আর্থিং হিসেবে কাজ করতে, তাহলে এর আকারে এবং গঠনে পরিবর্তন আনতে হতো। যেমন এগুলোকে আরো লম্বা করে মাটির অনেক গভীরে প্রবেশ করিয়ে ভেজা অংশে ঢুকানো হতো এবং সেটার সাথে কোনো মোটা তার যুক্ত করে বিদ্যুতের খাম্বার মতো অনেক উচুঁতে উঠিয়ে রাখতে হতো। এবং তারটি অবশ্যই কম রেজিস্ট্যান্সের কোনো ধাতব যেমন- খাঁটি তামা (Copper) দিয়ে তারা তৈরি করত।
৪. ব্রিটিশরা এমন পিলার স্থাপন করেছিল কেন?
উত্তর : ওই সময় এই বাংলা অঞ্চলটি ছিল ব্রিটিশদের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অন্তর্গত এলাকা। তখন ছিল জমিদারি প্রথা এবং ভূমির খাজনা আদায় ছিল জমিদারদের অন্যতম প্রধান আয়ের উৎস। তাই ব্রিটিশরা খাজনা আদায়, নিখুঁত ভূমি বণ্টন, নিখুঁত সীমানা নির্ধারণ এবং ভূমি জরিপ ইত্যাদির সুবিধার্থে মৌজাগুলোর সীমানায় এসব পিলার পুঁতে স্থায়ীভাবে নির্ধারণ করে দেয়। যেহেতু এগুলো যুগ যুগ ধরে মাটির নিচে থাকবে তাই এগুলোকে মরিচারোধী করতে বিভিন্ন ধাতুর মিশ্রণে (এলয়) তৈরি করা হয়েছে। এলয় ধাতু হওয়ায় এগুলোর গলনাংক অনেক বেশি। এর ফলে চুরি করে নিয়ে এগুলো দিয়ে অন্য কিছু বানানো তখনকার সময় সম্ভব ছিল না।
ব্রিটিশরা এটাও ভেবেছিল যে এগুলো মাটির অনেক গভীরে চলে গেলেও মেটাল ডিটেক্টর দিয়ে এগুলোর অবস্থান শনাক্ত করা সম্ভব হবে।
(এগুলোর নিজস্ব কোনো ফ্রিকোয়েন্সি বলে কিছু নেই। ফ্রিকোয়েন্সি মেপে নির্দিষ্ট দূরত্ব পরপর এগুলো বসানোর বিষয়টি একেবারেই মিথ্যা এবং পিলারের সাথে ফ্রিকোয়েন্সির বিষয়টি একেবারেই অসামঞ্জস্যপূর্ণ।)
আর প্রজাদের জমির অস্থায়ী সীমানাগুলোতে একজাতের বহু বর্ষজীবি ঘাস লাগিয়ে দিত। যেগুলো যুগ যুগ ধরে পানি, বৃষ্টি, খরা সহ্য করে বেঁচে থাকতে পারে। (ফুলঝাড়ু ঘাস, আমাদের চাঁদপুর জেলার মতলব থানার মোহনপুর গ্রামে এগুলোকে চেঙ্গামুড়া নামে চিনে)
৫. বজ্রপাত বেড়ে যাওয়ার কারণ কী?
উত্তর : বজ্রপাত বেড়ে যাওয়ার কারণ সম্পূর্ণভাবে পরিবেশগত বিষয়। এতে ম্যাগনেটিক পিলার না থাকা বা এতে মানুষের কোনো হাত নেই। জলবায়ুর পরিবর্তন, বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ইত্যাদি কারণে গত দুই দশক ধরে পৃথিবী জুড়ে ক্রমেই বজ্রপাতের সংখ্যা বাড়ছে।
নাসা'র (NASA) হিসাব মতে পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি বজ্রপাত হয় উগান্ডার লেক ভিক্টোরিয়া এলাকায়, গড়ে বছরের ২৪২ দিনই সেখানে বজ্রপাত হয়। ভেনিজুয়েলার লেক মারাকেইবো (Lake Maracaibo) এলাকায় প্রতি ১ বর্গ কিমি এলাকায় বছরে গড়ে ২৩৩ বার বজ্রপাত হয়। তবে সংখ্যার হিসেবে সবচেয়ে বেশি এবং ভয়াবহ বজ্রপাত হয় আফ্রিকার দেশ ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গো'তে। (শুধু কঙ্গো আলাদা আরেকটি দেশ)।
পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি বজ্রপাতপ্রবণ ১০টি শহরের মধ্যে ৫টি শহরই ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গোর। বাকি পাঁচটি শহরের মধ্যে ২টি কলম্বিয়ার, ১টি পাকিস্তানের, ১ টি ভেনিজুয়েলা'র এবং ১টি ক্যামেরুনের শহর। তালিকার ১০০ শহরের মধ্যেও বাংলাদেশের কোনো শহরের নাম নেই।
বজ্রপাতের ঘটনাগুলো নাসা'র আবহাওয়া বিষয়ক স্যাটেলাইটে (Meteorologycal Satellite) সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ করা হয় এবং রেকর্ড রাখা হয়।
৬. বজ্রপাতে এখন বেশি মানুষ মারা যাচ্ছে কেন?
উত্তর : আমার মতে, গত এক দশকে বজ্রপাতের কারণে বাংলাদেশে মানুষের মৃত্যু বেশি হওয়ার বেশ কয়েকটি কারণ হতে পারে। তার মধ্যে প্রধানতম কয়েকটি হলো-
ক) দেশজুড়ে বহু বর্ষজীবি উঁচু গাছের সংখ্যা ব্যাপকভাবে কমে যাওয়া, যেমন তাল, নারিকেল, দেবদারু ইত্যাদি গাছ কমে গেছে। আগে গ্রামাঞ্চলে বসতবাড়িতে, পুকুরের আইল, সড়কের পাশে এবং বিলেও প্রচুর তালগাছ এবং উঁচু দেবদারু গাছ দেখা যেত। যেগুলো বজ্রপাতের সময় 'লাইটনিং এ্যারেস্টার'-এর মতো কাজ করতো। অর্থাৎ উঁচু গাছগুলো বজ্রপাতকে 'আকর্ষণ' করে মাটির অভ্যন্তরে পাঠিয়ে দিতো (এখনো দেয়)।
খ) মানুষ বেড়েছে। প্রতি বর্গ কিলোমিটারে মানুষের ঘনত্বও বেড়েছে, অর্থাৎ পুরো দেশ ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা হয়েছে। সুতরাং যেখানেই বজ্রপাত হোক, জানমালের ক্ষয়ক্ষতি তো কিছুটা হবেই।
গ) এখন নিমিষেই মৃত্যুর খবর দ্রুত জানা যাচ্ছে। ফলে মনে হয় যেন বজ্রপাতে মানুষের মৃত্যুহার বেড়েছে। তুলনামূলক কম হলেও ৩০-৪০ বছর আগেও অনেক মানুষ মারা যেত যেগুলোর ৯৯ ভাগই সংবাদ মাধ্যমে আসত না। এমনকি দুই তিন কিলোমিটার দূরের গ্রামে কেউ বজ্রপাতে মারা গেলেও খবর পাওয়া যেত তিন চার দিন পর!
যাহোক, সংক্ষিপ্ত আলোচনা শেষে এটাই বলতে চাই যে যেকোনো বিষয় শুধু লোকমুখে শুনেই আমরা বিশ্বাস করব না, সাধ্যমতো সে বিষয়ে একটু পড়াশোনা করব এবং সঠিক জিনিসটি জানব। আর এভাবেই আমরা একদিন উন্নত মানুষ হবো ইনশাআল্লাহ্।
তথ্যসূত্র
অর্জিত বিদ্যা, গুগল, নাসা ইত্যাদি