যেভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ইসরাইল
ইসরাইল-ফিলিস্তিন - ছবি সংগৃহীত
ফিলিস্তিনের গত ১৫০ বছরের ইতিহাস যুদ্ধ, মারামারি ও ষড়যন্ত্রে পরিপূর্ণ। ঊনিশ শতকের শেষ এবং বিশ শতকের প্রাথমিক সময়ে ফিলিস্তিন ওসমানিয়া সালতানাতের অংশ ছিল। ফিলিস্তিন ইসলাম, খ্রিস্টান ও ইহুদি ধর্মের অনুসারীদের কাছে অত্যন্ত পবিত্র ও গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ফিলিস্তিনে এই তিন ধর্মের অত্যন্ত পবিত্র স্থানগুলো রয়েছে। ওসমানিয়া সালতানাতের সময়ে ১৮৭৮ সালের করা আদমশুমারী বা জন গণনা অনুযায়ী তখন ফিলিস্তিনে ৮৬-৮৭ শতাংশ মুসলিম, ৯ শতাংশ খ্রিস্টান এবং ৩-৪ শতাংশ ইহুদি বসবাস করত। ওই সময়ে পৃথিবীর বেশির ভাগ জায়গায় ইহুদিদের সাথে খারাপ ব্যবহার করা হতো। কিন্তু ওসমানী সালতানাতে বসবাস করা ইহুদিরা শান্তিপূর্ণ জীবন যাপন করতো। আর তাদের মধ্যে একটি ইহুদি রাষ্ট্র গঠনের ইচ্ছা জোরদার হচ্ছিল। ওই সময়ের ওসমানী সুলতান দ্বিতীয় আব্দুল হামিদ ইহুদিদের এই ইচ্ছার কথা খুব ভালো করেই জানতেন। তাই তিনি ইহুদিদের ফিলিস্তিনে জমি ক্রয় ও বিদেশী ইহুদিদের ফিলিস্তিনে বসবাসের প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ান।
বিশ শতকের শুরুর দিকে ওসমানিয়া সালতানাত অত্যন্ত দুর্বল হয়ে যায়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ওসমানিয়া সালতানাত ব্রিটেন, ফ্রান্স ও রাশিয়ার বিপক্ষ শক্তি কেন্দ্রীয় শক্তি অর্থাৎ জার্মানি, অস্ট্রো হাঙ্গেরি সাম্রাজ্য এবং বুলগেরিয়া সঙ্গী হয়। ওসমানিয়া সালতানাতকে পরাজিত করার জন্য ব্রিটেনের স্থানীয় আরব নেতাদের সাহায্য প্রয়োজন ছিল। যদি আরবরা বিদ্রোহ করে তাহলেই ওসমানিয়া সালতানাতকে টুকরো টুকরো করা সম্ভব। এই উদ্দেশ্যে মিসরে নিযুক্ত ব্রিটিশ হাই কমিশনার হেনরি ম্যাকমোহন ও শরিফে মক্কা হুসেন ইবনে আলী হাশেমির মধ্যে ১৯১৫ সালের জুলাই মাস থেকে ১৯১৬ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত ১০ টি পত্র আদান প্রদান হয়। এই পত্রগুলোতে আরবদের ওসমানিয়াদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের বদলে আরব অঞ্চলগুলোকে স্বাধীনতা দেয়ার প্রস্তাব দেয়া হয়। শরীফে মক্কা হেজাজ, জর্দান, ইরাক ও ফিলিস্তিনসহ সকল আরব এলাকার শাসক হওয়ার বিনিময়ে ব্রিটেনকে সাহায্য করার সিদ্ধান্ত নেন।
এজন্যই শরিফে মক্কা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ওসমানিয়া সালতানাতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন। অন্যদিকে ব্রিটেন ধনী ও ক্ষমতাধর ইহুদিদের সমর্থন লাভের জন্য ফিলিস্তিনি ভূমিতে একটি স্বাধীন ইহুদি রাষ্ট্র ঘোষণা দেয়। ব্রিটেনের জেরুসালেম দখলের কিছু দিন পর ১৯১৭ সালের ২ নভেম্বর ব্রিটেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আর্থার বেলফোর এক ইহুদি ব্যাংকার লর্ড রথসচাইল্ডকে এজ চিঠি লিখে ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আশ্বাস দেন। এই চিঠিকে বেলফোর ঘোষণা বলা হয়। এভাবে ব্রিটেন আরবদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করছিলো। ইহুদিদের স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ব্রিটেনের ভূ রাজনৈতিক স্বার্থের জন্য লাভ জনক ছিলো। তাই ব্রিটেন আরবদের পরিবর্তে ইহুদিদের ফিলিস্তিনি ভূমি দিতে চাচ্ছিল। ফিলিস্তিনে ইহুদিদের নিয়ন্ত্রণ কেন আমেরিকা, ব্রিটেন, ফ্রান্সসহ অন্য পশ্চিমা দেশগুলোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল? চলুন এর উত্তর জানা যাক টিউমার রাষ্ট্র ইসরাইল প্রতিষ্ঠার যত কথায়।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ওসমানিয়া সালতানাতের পরাজয়ের ফলে ওসমানিয়া সালতানাতের কাছ থেকে ফিলিস্তিন, জর্দান, ইরাক, সিরিয়া, লেবানন আলাদা হয়ে যায়। ফিলিস্তিন ব্রিটেনের দখলে চলে যায়। অনুকূল পরিবেশ দেখতে পেয়ে জায়নিষ্ট বা জায়নবাদ আন্দোলনেও গতি আসে। সারা পৃথিবীর ইহুদি সংগঠনগুলো ফিলিস্তিনে আরবদের কাছ থেকে অতিরিক্ত দামে জমি ক্রয় করতে থাকে। পুরো পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে ইহুদিরা এসে ফিলিস্তিনে বসতি গড়তে থাকে। ব্রিটেনের মদদে ইহুদিদের বসতি স্থাপন স্থানীয় আরবদের দুশ্চিন্তায় ফেলে দেয়। তারা ব্রিটিশদের এই পদক্ষেপের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে। ১৯৩৬ সাল থেকে নিয়ে ১৯৩৯ সাল পর্যন্ত ফিলিস্তিনি মুসলিম আরবরা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে থাকে। ফলে ইহুদিরাও মুসলিমদের আক্রমণ করতে থাকে। এর ফলে ফিলিস্তিনের পরিবেশ অস্থিতিশীল হয়ে উঠে। ব্রিটিশ প্রশাসনের জন্য ফিলিস্তিন শাসন করা কঠিন হয়ে পড়ে। ১৯৩৭ সালে ব্রিটেন ফিলিস্তিন সমস্যা সমাধানের জন্য পিল কমিশন গঠন গঠন করে। পিল কমিশন ফিলিস্তিনকে দুই ভাগে ভাগ করার প্রস্তাব দেয়। ফিলিস্তিনি আরবরা এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করে এই প্রস্তাবকে প্রত্যাখান করে। পিল কমিশন ব্যর্থ হওয়ার পর ব্রিটেন আরো চেষ্টা করে ফিলিস্তিন সমস্যা সমাধানের জন্য। এই চেষ্টাগুলো ছিলো উডহিড কমিশন এবং ওয়াইট পেপার অফ ১৯৩৯। এই সব চেষ্টাতেই ব্রিটেন ইহুদিদেরকে তাদের জনসংখ্যা মালিকানাধীন জমির চাইতেও আরো বেশি এবং উৎকৃষ্ট জমি দিতে চাইছিল। অন্যদিকে আরবরা ফিলিস্তিনে ইহুদিদের আলাদা দেশ গঠনের সম্পূর্ণ বিরোধী ছিল। একদিকে ব্রিটেন এই সমস্যা সমাধানের দুর্বল চেষ্টা করতে থাকে। অন্যদিকে এই সময়ে ইহুদিরা বিশাল সংখ্যায় ফিলিস্তিনে বসবাস করতে থাকে।
১৯১৮ সাল থেকে ১৯৪৬ পর্যন্ত প্রায় ৩ লাখ ৭৫ হাজার ইহুদি ফিলিস্তিনে বসতি গড়ে ফেলে। ব্রিটিশ দখলে থাকার ৩০ বছরের মধ্যে ইহুদিরা ফিলিস্তিনের জনসংখ্যার ৬ শতাংশ থেকে বেড়ে ৩৩ শতাংশ হয়ে যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর উপনিবেশ পদ্ধতি শেষ হয়ে যাচ্ছিল। তাই ব্রিটেনও ১৯৪৭ সালের ফ্রেব্রুয়ারি মাসে ফিলিস্তিন ছেড়ে চলে যাওয়ার ঘোষণা দিলো। ফিলিস্তিন ছেড়ে চলে যাওয়ার আগে ফিলিস্তিনের ভাগ্য নির্ধারণের কাজ ব্রিটেন জাতিসঙ্ঘের ওপর ছাড়ল। জাতিসঙ্ঘ ফিলিস্তিন সমস্যা সমাধানের জন্য একটি কমিটি গঠন করে। যাকে 'ইউনাইটেড ন্যাশন্স কমিটি অন প্যালেস্টাইন ১৯৪৭' বলা হয়।
ফিলিস্তিনি আরবরা এই কমিটিকে প্রত্যাখান করে এবং নিজেদের জনগণকেও এই কমিটির সাথে কোনো প্রকার সহযোগিতা না করার আদেশ দেয়৷ ফিলিস্তিনি আরব মুসলিমদের বয়কটের ফলে ইহুদিরা পুরো ময়দান ফাঁকা পেয়ে যায়। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে দুটি ইহুদি সংগঠন এক, 'জিওশ এজেন্সি' এবং 'জিওশ ন্যাশনাল কাউন্সিল' পূর্ণ শক্তিসহকারে এই কমিটির কাছে লবিং শুরু করে দেয়। কমিটি ফিলিস্তিনের ইহুদিদের সাথে কথা বলার সমাধানের দিকে মনোযোগ দেয়। এই কমিটির সদস্য কানাডা, সুইডেন, নেদারল্যান্ডস, উরুগুয়ে, পেরু, গুয়েতেমালা এবং চেকস্লাভাকিয়া ফিলিস্তিনকে দুই ভাগে ভাগ করার পরিকল্পনা সমর্থন করে। অন্যদিকে ভারত, ইরান ও যুগোস্লাভিয়া দুই ভাগ না করার কথা বলে। অস্ট্রেলিয়া এই কমিটি সদস্যগুলোর ভিতর একমাত্র দেশ ছিল যে কোনো পরিকল্পনা সমর্থন করেনি। কমিটি সংখ্যা গরিষ্ঠ দেশগুলোর মত অনুযায়ী ফিলিস্তিনকে দুই ভাগে ভাগ করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। এছাড়া পরিকল্পনা অনুযায়ী ফিলিস্তিনের কোন অংশ কে পাবে তাও এই কমিটি নির্ধারণ করে।
ফিলিস্তিন মধ্যপ্রাচ্যে অবস্থিত। ফিলিস্তিনের পূর্বে রয়েছে লেবানন, সিরিয়া, ইরাক, জর্দান ও সৌদি আরব। পশ্চিমে আছে আফ্রিকার আরব দেশ মিসর। এই পুরো অঞ্চল তেল সমৃদ্ধ। ফিলিস্তিনের উত্তর পশ্চিমে ভূমধ্যসাগর। যার তীরে সাইপ্রাস, তুরস্ক, গ্রিসসহ অন্যান্য ইউরোপীয় দেশগুলো অবস্থিত। ইউরোপ থেকে সড়কপথে আফ্রিকা যেতে হলে ফিলিস্তিনই একমাত্র রাস্তা। ফিলিস্তিন এশিয়া ও আফ্রিকার দরজা। ফিলিস্তিন এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকার মাঝে অবস্থিত। এটাই ফিলিস্তিনের একমাত্র ভৌগোলিক অবস্থানের সুবিধা নয়। এর আরো সুবিধা আছে ফিলিস্তিনের দক্ষিণ অংশ 'গালফ অব আকাবা' বা আকাবা উপসাগরের সাথে সংযুক্ত। আকাবা উপসাগরের এক পাশে সৌদি আরব।
অন্য পাশে মিসরের সিনাই উপত্যকা যা সুয়েজ খাল পর্যন্ত বিস্তৃত। আকাবা উপসাগরের সামনে রয়েছে লোহিত সাগর। মিসর ও ফিলিস্তিন ব্যতীত অন্যকোন একসঙ্গে দেশ ভূমধ্যসাগর ও লোহিত সাগর তীরবর্তী নয়। ইউরোপ ও এশিয়ার বাণিজ্যক জাহাজগুলো প্রথমে লোহিত সাগরে আসে তারপর সুয়েজ খাল পার হয়ে ভূমধ্যসাগরে যায়। ইউরোপ ও এশিয়ার বাণিজ্যের মেরুদণ্ড সুয়েজ খাল ফিলিস্তিন থেকে মাত্র ২০০ কিলোমিটার দূরে। সে হিসেবে সুয়েজ খালে নজর রাখা কিংবা সুয়েজ খাল বন্ধ করে দিকে দেয়ার জন্য সাইপ্রাসের চেয়েও উত্তম জায়গা হচ্ছে ফিলিস্তিন। এছাড়া সুয়েজ খালের পরিবর্তে সুয়েজ খালকে এড়িয়ে যাওয়ার জন্য যদি আরেকটি খাল খনন করতে হয় তাহলে তা শুধুমাত্র ফিলিস্তিনেই সম্ভব। কারণ মিসরের পর ফিলিস্তিনই একমাত্র দেশ যা একসাথে লোহিত সাগর ও ভূমধ্যসাগরের তীরবর্তী।
ফিলিস্তিনের দক্ষিণে রয়েছে নজব এলাকা। যা ফিলিস্তিনের আয়তনের প্রায় অর্ধেক এখানে জনসংখ্যা অত্যন্ত কম। ফিলিস্তিনের মধ্যস্থানে অবস্থিত পশ্চিম তীর। একে পশ্চিম তীর বলা হয় কারণ এটা জর্দান নদীর পশ্চিম থেকে অবস্থিত। পশ্চিম তীরের পুরো এলাকা জর্দান পর্বত মালার উচুঁ নিচু পাহাড় দ্বারা পরিবেষ্টিত। জর্দান নদী ফিলিস্তিনের পূর্ব দিকে অবস্থিত। যা ফিলিস্তিন ও জর্দানের সীমান্তও। জর্দান নদী গোলান পর্বতমালা থেকে শুরু হয়ে সি অফ গ্যালিলিতে যায় তারপর সেখান থেকে মৃত সাগরে প্রবাহিত হয়। সি অফ গ্যালিলির পাশে অবস্থিত গ্যালিলি আপার জর্দান ভ্যালি ও জারজিল ভ্যালি চাষাবাদের জন্য সবচেয়ে উপযোগী। সি অফ গ্যালিলি পানযোগ্য পানির অনেক বড় উৎস। পশ্চিম তীরের সাথে ফিলিস্তিনের অবস্থিত ফিলিস্তিনের উপকূলীয় এলাকা শ্যারেন প্লেন। এই এলাকাও চাষাবাদের জন্য খুবই উপযোগী। পশ্চিম তীরে রয়েছে জেরুসালেম শহর। যাতে তিনটি ধর্মের পবিত্র স্থান রয়েছে।
এবার জাতিসঙ্ঘ কমিটির প্রস্তাবিত ফিলিস্তিনি ভূমির বিভাজন সম্পর্কে জানা যাক। জাতিসঙ্ঘ কমিটি পুরো নজব, শ্যারন প্লেন, জারজিল ভ্যালি ও গ্যালিলি আপার জর্দান ভ্যালির পুরোটুকু ইসরাইলকে দেয়া হয়। এছাড়া পানযোগ্য পানির সবচেয়ে বড় উৎস সি অফ গ্যালিলিও ইসরাইলে দেয়া হয়। যা মোট ফিলিস্তিনি ভূমির ৫৭ শতাংশ। অন্যদিকে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য ৪৩ শতাংশ জমি দেয়া হয়৷ ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের জন্য পশ্চিম তীর, গাজা ও গোলান পর্বতমালার পাশের এলাকা দেয়া হয়।
জেরুসালেমকে আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রণে দিয়ে দেয়া হয়। ইসরাইলে শ্যারন প্লেন, গ্যালিলি আপার জর্দান ভ্যালির মতো উর্বর পাওয়ায় তার খাদ্য চাহিদা পূরণ হতে থাকে। ইহুদিরা ফিলিস্তিনের জনসংখ্যার ৩৩ শতাংশ এবং ৭ শতাংশ ভূমির মালিক ছিল। ফলে ইসরাইল কিভাবে ৫৫ শতাংশ ফিলিস্তিনি ভূমি নিয়ে গঠিত হয়। তা বোধগম্য নয়। এর ফলে এটা নিশ্চিত যে জাতিসঙ্ঘ কমিটি ইসরাইলকে উৎকৃষ্ট ও অধিক ভূমি দেয়ার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলো। ফিলিস্তিনে একমাত্র জাফা জেলায় ইহুদিরা সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিলো৷ সংখ্যায় তা ৭১ শতাংশ। আর জাফা জেলাতেই ইহুদিদের সবচেয়ে বেশি জমি ছিল ৩৯ শতাংশ। ফিলিস্তিনের কোনো জেলাতেই ইহুদিদের মালিকানায় সবচেয়ে বেশি জমি ছিল না। ইসরাইলে সি অফ গ্যালিলি দেয়ার জন্য এর পাশের সকল এলাকা ইসরাইলে দিয়ে দেয়া হয়। এটা বিবেচনা করে যে এসব এলাকার কোথাও ইহুদিদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই। এছাড়া নজবও ইসরাইলে দিয়ে দেয়া হয় যাতে ইসরাইল লোহিত সাগর তীরবর্তী হয়৷
ইসরাইল প্রতিষ্ঠার এই রেজুলেশন ছিল ১৮১। জাতিসঙ্ঘ ১৮১ নম্বর রেজুলেশন পেশ করে ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য। জাতিসঙ্ঘ আইন অনুযায়ী ইহুদি রাষ্ট্র তখন প্রতিষ্ঠিত হতো যখন এই রেজুলেশন দুই তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় পাস হতো। প্রায় সকল পশ্চিমা দেশ এই রেজুলেশনের পক্ষে ছিল এবং সকল মুসলিম দেশ এই রেজুলেশনের বিপক্ষে ছিল। তো এই হিসেবে এই রেজুলেশন দুই তৃতীয়াংশ সংখ্যা গরিষ্ঠতায় পাস হওয়া সহজ ছিল না। পশ্চিমা দেশগুলো তেলসমৃদ্ধ এই মুসলিম ভূখণ্ডে তাদের এক জোটসঙ্গী চাইছিল যে তাদের সব রকমের স্বার্থ এই অঞ্চলে রক্ষা করবে।
ইহুদি সংগঠনগুলো প্রায় ২ হাজার বছর নিজেদের রাষ্ট্র গঠিত হতে দেখছিল। তাই তারা ইসরাইল প্রতিষ্ঠার তাদের সমস্ত সম্পদ ও ক্ষমতা ব্যয় করতে থাকে। ইহুদিরা ইসরাইল প্রতিষ্ঠায় কী করেছিল তা ইতিহাসে ভালোভাবে লিপিবদ্ধ হয়ে আছে। আমেরিকার নির্বাচনে ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রচারণায় অনুদান দেয়া ইহুদি এবং ইহুদি কংগ্রেস সদস্যরা আমেরিকান প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যানের ওপর চাপ প্রয়োগ করে যাতে তিনি সারা পৃথিবীর সকল দেশকে এই রেজুলেশনের পক্ষে ভোট দিতে চাপ প্রয়োগ করেন।
আমেরিকান স্টেট ডিপার্টমেন্ট আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকার দুর্বল দেশগুলোকে এই রেজুলেশনের পক্ষে ভোট দিতে চাপ প্রয়োগ করে। ২৬ জন আমেরিকান সিনেটরের পক্ষ থেকে টেলিগ্রাম পাঠানো হয় দক্ষিণ আমেরিকা ও আফ্রিকার দেশগুলোতে। সেই টেলিগ্রামে আমেরিকার সহায়তার বিনিময়ে ইসরাইল প্রতিষ্ঠার পক্ষে ভোট দিতে বলা হয়। তারপর ১৯৪৭ সালের ২৯ নভেম্বর জাতিসঙ্ঘ রেজুলেশন ১৮১ এর জন্য ভোটাভুটি হয়। ৫৭টি দেশের মধ্যে আমেরিকাসহ ৩৩টি দেশ এই রেজুলেশনের পক্ষে এবং সৌদি আরব, পাকিস্তান, তুরস্কসহ ১৩টি দেশ এই রেজুলেশনের বিপক্ষে ভোট দেয়। ১০টি দেশ ভোট দেয়া থেকে বিরত থাকে এবং থাইল্যান্ড ভোট দিতে অনুপস্থিত থাকে। এভাবে দুই তৃতীয়াংশ সংখ্যা গরিষ্ঠতায় ইসরাইল প্রতিষ্ঠার রেজুলেশন পাস হয়ে যায়। ব্রিটেন ঘোষণা করে যে ১৯৪৭ সালের ১৪ মে রাতে ব্রিটেন ফিলিস্তিন ছেড়ে চলে যাবে।
ইহুদি নেতৃবৃন্দের এক দিন আগে ১৩ মে ইসরাইলের স্বাধীনতা ঘোষণা করে। ফিলিস্তিনি মুসলিমরা সাধারণ হরতালের ডাক দেয়। যা ইহুদি-আরব সহিংসতায় রূপ নেয়। যা পরে ইসরাইল ও ৭টি আরব দেশের যুদ্ধে রূপ নেয়। এই ৭টি দেশ ছিলো সৌদি আরব, জর্দান, লেবানন, মিসর, সিরিয়া এবং ইরাক। এই যুদ্ধ ৯ মাস চলে এবং এই যুদ্ধে ইসরাইল প্রস্তাবিত ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের অনেক ভূমিও দখল করে নেয়। এরপর ১৯৬৭, ১৯৭৩ সালে বড় আকারে আরব ইসরাইল যুদ্ধ হয়। আর প্রত্যেকবারই প্রস্তাবিত ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের ভূমি আরো সঙ্কুচিত হয়।
বর্তমানে ইসরাইল পশ্চিম তীরে ইহুদি বসতি নির্মাণ করছে। এটা আন্তর্জাতিক আইনের সরাসরি লঙ্ঘন। জাতিসঙ্ঘসহ বেশির ভাগ সংস্থা ও দেশ এটাকে বেআইনি মনে করে। অন্যদিকে আমেরিকাই একমাত্র দেশ যে এ ব্যাপারে ইসরাইলের সাথে আছে। নিপীড়িত ফিলিস্তিনিরা নিজেদের স্বাধীনতার সংগ্রাম করছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি অভিয়োগের চেয়ে তাদের সবচেয়ে বেশি অভিযোগ আরব মুসলিম শাসকদের প্রতি। কারণ তারা সব ধরনের প্রয়োজনীয় উপকরণ থাকা সত্ত্বেও নিজেদের প্রথম কিবলা এবং নিজেদের ভাইদের রক্ষা করছে না। উল্টা ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করছে।
তথ্যসূত্র
Arab and Israelis: Conflict and
Peacemaking in the middle east by
Abdel Monem Said Aly, Shai Fledman,
Khalil Shikaki.
The Israel Lobby and US Foreign
Policy by John J. Mearshimer,
Stephene M. Walt.
Truman and Israel by Michael Josehp Cohen.
pexels.com
pixabay.com
videvo.com
The New York Times
The Palestine Post
undocs.org
Al-Jazeera
BBC
i24news.tv
alarabiya.net
britannica.com
rollingstone.com
geopoliticalfutures.com
passia.org
লেখিকা : সাবেক শিক্ষার্থী, আঙ্কারা বিশ্ববিদ্যালয়, তুরস্ক