রাজ্য সংখ্যার ভিত্তিতে খ্রিস্টান ধর্ম ভারতে দ্বিতীয় বৃহত্তম!
ভারতে খ্রিস্টান সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্য - ছবি সংগৃহীত
ভারত! বহু জাতি, ধর্মের ভিত্তিতে গঠিত একটি বৈচিত্র্যপূর্ণ রাষ্ট্র। হিন্দুস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্ম হলো হিন্দুধর্ম। দেশটির মোট জনসংখ্যার ৮০ ভঅগ হলো হিন্দু ধর্মের অনুসারী। জনসংখ্যার পার্সেন্টেজে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে মুসলিমরা। তারা হচ্ছে মোট জনসংখ্যার ১৪ ভাগ। তৃতীয় অবস্থানে থাকা খ্রিস্টানদের পার্সেন্টেজ মাত্র ২.৩ ভাগ।
স্বাভাবিকভাবেই ভারতের বেশিরভাগ রাজ্য হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ। কিন্তু রাজ্যের সংখ্যার ভিত্তিতে এরপরের অবস্থানে ইসলাম ধর্ম নয়, রয়েছে খ্রিস্টান ধর্ম।
ভারতের কোনো রাজ্য মুসলিম সংখ্যা গরিষ্ঠ নয়। শুধুমাত্র দুটি রাজ্যশাসিত প্রশাানিক অঞ্চল (লাক্ষাদ্বীপ এবং কাশ্মীর) মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ। বিপরীতে ভারতে খ্রিস্টান সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশ রয়েছে পাঁচটি!
ভারতবর্ষে খ্রিস্টান ধর্মের কার্যকর আবির্ভাব ইসলাম ধর্মের অনেক পড়ে হয়। ভারতবর্ষে খ্রিস্টান ধর্ম মূলত আসে ইউরোপীয় বণিক ও ধর্মপ্রচারদের মাধ্যমে।
দক্ষিণ ভারতের গোয়া, তামিলনাড়ু, কেরালা, পুদুচেরির মতো সমুদ্র তীরবর্তী রাজ্যগুলোতে প্রাথমিক পর্যায়ে খ্রিস্টান ধর্মের প্রসার ঘটে। ইউরোপীয় বণিক ও ধর্মপ্রচাররকদের প্রধান ঘাঁটি ছিলো এসব অঞ্চলই।
কিন্তু আশ্চর্যজনক হলো দক্ষিণ ভারতের কোনো রাজ্যই খ্রিস্টান সংখ্যাগরিষ্ঠ নয়। তাহলে পাঁচটি খ্রিস্টান সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্য কোথায় রয়েছে ভারতবর্ষে? আসুন জেনে নেই।
১.
ইউরোপ থেকে আসা খ্রিস্টানরা মূলত দক্ষিণ ভারতে বসবাস করত। কিন্তু তারা তাদের ধর্মীয় মিশন দূর দূরান্তের পাহাড়ি অঞ্চলে উপজাতি জনগোষ্ঠীর মাঝে ব্যাপকহারে ছড়িয়ে দেয়ার কার্যক্রম গ্রহণ করে। এই প্রকল্পের অংশ হিসেবে উত্তর-পূর্ব ভারতের সাতটি রাজ্য তথা সেভেন সিস্টার্সে ব্যাপক হারে খ্রিস্টান ধর্মের প্রচার এবং প্রসার ঘটায় ইউরোপীয় শাসকরা। ভারতবর্ষে ইংরেজ শাসন থাকার সময়কাল হতে চালু হওয়া মিশনারি কার্যক্রম ভারত স্বাধীন হওয়ার পর তো কমেইনি, উল্টা আরো বেড়েছে।
১৯০০ সালের দিকেও ভারতের সেভেন সিস্টার্সের রাজ্যগুলোতে ১০ ভাগ খ্রিস্টান ছিলো না। কিন্তু বর্তমানে এই সাতটি রাজ্যের পাঁচটিই খ্রিস্টান সংখ্যাগরিষ্ঠ!
সেভেন সিস্টার্সের কোন কোন রাজ্যে খ্রিস্টান সংখ্যাগরিষ্ঠ হিসেবে দেখানো হয়েছে?
সেভেন সিস্টার্সের সাতটি রাজ্য হলো :
ক) আসাম
খ) ত্রিপুরা
গ) মেঘালয়
ঘ) মিজোরাম
ঙ) নাগাল্যান্ড
চ) মনিপুর
ছ) অরুণাচল।
এদের মধ্যে প্রথম দুটি রাজ্য ছাড়া বাকি পাঁচটিই খ্রিস্টান অধ্যুষিত!
২.
সেভেন সিস্টার্সের ভৌগোলিক বৈচিত্র্যতার সাথে খ্রিস্টান ধর্ম বিকাশের সম্পর্ক কি?
মূল ভারত থেকে সেভেন সিস্টার্স বলতে গেলে বিছিন্ন প্রায়। প্রস্থে পঞ্চাশ কিলোমিটারের মতো 'শিলিগুড়ি করিডোর' দ্বারা সেভেন সিস্টার্স মূল ভারতের সাথে খুবই দুর্বলভাবে সংযুক্ত। আবার এই অঞ্চলটি পাহাড়ি হওয়ার এই সরু করিডোরের মাধ্যমে যাতায়াত আরো কষ্টকর। ফলে মূল ভারতের সাথে সেভেন সিস্টার্সের রাজনৈতিক যোগাযোগ ইংরেজ আমলের আগ পর্যন্ত ছিলো না। এমনকি পরাক্রমশালী মোগল সাম্রাজ্য ও এই অঞ্চলকে বাগে আনতে পারেনি।
ব্রিটিশ শাসনামলে সর্বপ্রথম সেভেন সিস্টার্স মূল ভারতের সাথে ভৌগোলিক ও রাজনৈতিকভাবে সংযুক্ত হয়। সে সময় এই অঞ্চলের উপজাতিরা শিক্ষা-দীক্ষা, জীবনযাত্রার মানে ব্যাপক পিছিয়ে ছিলো। খ্রিস্টান মিশনারিরা সে সময় এই অঞ্চলে নানা ধরণের মানবিক তৎপরতা শুরু করে। তবে এসব মানবিক তৎপরতার আড়ালে খ্রিস্ট ধর্ম প্রচার করা ছিলো এদের অন্যতম লক্ষ্য।
ভারত স্বাধীন হওয়ার পরেও মিশনারিদের কার্যক্রম বন্ধ হয়নি। কারণ ১৯৪৭ সালের আগেই সেভেন সিস্টার্সে তাদের শক্ত ভিত গড়ে উঠে।
৩.
সংখ্যা গরিষ্ঠ খ্রিস্টান প্রদেশগুলো!
ক) মেঘালয়
বাংলাদেশের সিলেট এবং ময়মনসিংহ বিভাগের উত্তর অংশটা বরাবর ভারতের মেঘালয় রাজ্য অবস্থিত। অবশ্য অখণ্ড ভারতবর্ষে মেঘালয় অঞ্চলটি আসামে ছিল। আসামের ঐতিহাসিক শিলং শহর বর্তমানে মেঘালয়ের রাজধানী।
১৯০১ সালে মেঘালয়ে মাত্র ৬ ভাগ খ্রিস্টান ছিলো। ১৯৪৭-এ এসে এটি ২৫ ভাগে দাঁড়ায়। আর বর্তমানে মেঘালয়ে খ্রিস্টান জনসংখ্যা ৭৫ ভাগ।
মূলত ব্রিটিশ আমলে অনেকগুলো মিশনারি স্কুল, হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করা হয় মেঘালয়ের দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলগুলোতে। আর সেখানকার মিশনারীদের প্রচেষ্টার ফলে মেঘালয় এখন খ্রিস্টান অধ্যুষিত একটি প্রদেশ। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশরা উপমহাদেশ ছেড়ে চলে গেলেও এই অঞ্চলে মিশনারি কার্যক্রমে কখনোই ভাটা পড়েনি।
খ) মিজোরাম
বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের ভারত সীমান্তে অবস্থিত মিজোরাম প্রদেশটিও খ্রিস্টান ধর্ম অধ্যুষিত।
১৯০১ সালে প্রদেশটিতে খ্রিস্টান জনসংখ্যা ১ ভাগও ছিলে না। ১৯৫১ সালে এসে এটি ৯০ ভাগে দাঁড়ায়। বর্তমানে মিজোরামে খ্রিস্টান জনসংখ্যা ৮৭ ভাগ।
মিজোরাম প্রদেশটি মিজো আদিবাসী অধ্যুষিত। মিজো জনগোষ্ঠীর প্রায় পুরোটাই খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষিত হয়েছেন।
গ) নাগাল্যান্ড
নাগা উপজাতি অধ্যুষিত এই প্রদেশটিও বর্তমানে খ্রিস্টান অধ্যুষিত। অথচ ১৯০১ সালে এখানকার খ্রিস্টান জনসংখ্যা ১ ভাগও ছিলো না। ১৯৫১ সালে খ্রিস্টান জনসংখ্যা বেড়ে ৪৬ ভাগ হয়। বর্তমানে খ্রিস্টান জনসংখ্যা ৮৮ ভাগ।
প্রদেশটির প্রভাবশালী নাগা উপজাতির প্রায় পুরো অংশই খ্রিস্টান ধর্মে বিশ্বাসী।
ঘ) মনিপুর
মণিপুরী উপজাতি অধ্যুষিত এই প্রদেশটি খ্রিস্টান ও হিন্দু জনসংখ্যা ২০১১ সালে প্রায় সমান ছিলো। তবে ২০২১ সালের আদমশুমারীর পর প্রদেশটি নিশ্চিতভাবে খ্রিস্টান সংখ্যাগরিষ্ঠ হবে।
১৯২১ সালে মণিপুরে খ্রিস্টান জনসংখ্যা ছিলো ১ ভাগ। ১৯৫১ সালে এটি বৃদ্ধি পেয়ে ১২ ভাগ হয়। বর্তমানে মণিপুরে খ্রিস্টান জনসংখ্যা ৪১.২৯ ভাগ।
প্রদেশটির প্রভাবশালী মণিপুরী জনগোষ্ঠীর বেশিরভাগ হিন্দু হলেও অন্য উপজাতিগুলোর মধ্যে খ্রিস্টান ধর্মের প্রভাব সর্বাধিক।
ঙ) অরুণাচল
চীন সীমান্তবর্তী সংঘাতপূর্ণ এই রাজ্যও বর্তমানে খ্রিস্টান অধ্যুষিত। অথচ ১৯৫১ সালে এখানে খ্রিস্টান জনসংখ্যা ১ ভাগও ছিলো না। ১৯৯১ সালে খ্রিস্টান জনসংখ্যা ১০ ভাগ হয়। আর বর্তমানে খ্রিস্টান জনসংখ্যা ৩০ ভাগ।
রাজ্যটিতে হিন্দু জনসংখ্যা ২৯ ভাগ। স্থানীয় একটি ধর্মের অনুসারী ২০ ভাগের মতো। ধারণা করা হচ্ছে ২০২১ সালের আদমশুমারীর পর খ্রিস্টান জনসংখ্যাা ৪০ ভাগের কাছাকাছি হবে।
৪.
দক্ষিণ ভারতের দুটি রাজ্য খ্রিস্টান জনসংখ্যা মোটামুটি পর্যায়ের হলেও সংখ্যাগরিষ্ঠ নয়। কেরালাতে ১৮ ভাগ খ্রিস্টান ও গোয়াতে ২৫ ভাগ খ্রিস্টান রয়েছে। কেন্দ্রশাসিত দক্ষিণ ভারতীয় অঞ্চল আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে খ্রিস্টান জনসংখ্যা ২১ ভাগ।
মজার ব্যাপার হলো, খ্রিস্টান সংখ্যাগরিষ্ঠ উত্তর-পূর্ব ভারতের পাঁচটি রাজ্যে মোট খ্রিস্টান জনসংখ্যা ৬০ লাখ। আর এক কেরালা রাজ্যেই খ্রিস্টান রয়েছে ৬০ লাখ।
সংখ্যার হিসেবে কেরালার পর সবচেয়ে বেশি খ্রিস্টান রয়েছে দক্ষিণ ভারতের আরেকটি রাজ্য তামিলনাড়ুতে। তামিলনাড়ুর মোট জনসংখ্যার মাত্র ৬ ভাগ খ্রিস্টান হলেও রাজ্যটিতে খ্রিস্টান জনসংখ্যা ৪৪ লাখ।
৫.
চীন ও ভারতের সীমানায় অবস্থিত এই দুর্গম রাজ্যগুলো ব্রিটিশ আমলের আগে কখনোই মূল ভারতের নিয়ন্ত্রণে ছিলে না। বর্তমানে রাজ্যগুলোতে স্বাধীনতার আন্দোলন তেমন জনপ্রিয় না হলেও পরিবর্তিত যেকোনো ভৌগোলিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে জনমিতিক কৌশলকে কাজে লাগিয়ে যেকোনো পরিবর্তন এই অঞ্চলে আসতে পারে। আর এই পরিবর্তন অবশ্যই পাশ্ববর্তী বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের পাহাড়ি অঞ্চলেও হাওয়া দিতে পারে। আর এই হাওয়াটা অবশ্যই ইতিবাচক হবে না!