অভাবী ও পরনির্ভরশীল রাষ্ট্র ইসরাইল
অভাবী ও পরনির্ভরশীল রাষ্ট্র ইসরাইল - ছবি : সংগৃহীত
১৯৬৭ সালের আরব-ইসরাইল যুদ্ধের পর থেকেই মুসলিম বিশ্বের কাছে ইসরাইল এক দানবের নাম। আমরা সবসময় মনে করি ইসরাইল খুব খুব শক্তিশালী ও স্বয়ংসম্পূর্ণ এক দেশ। কিন্তু বাস্তবে ইসরাইলের দুর্বলতা অনেক। আরব-ইসরাইল যুদ্ধের মাধ্যমে মুসলিম বিশ্বকে বার্তা দেওয়া হয়েছিল যে ইসরাইলের সাথে যুদ্ধ না করাই বেটার। যে কারণে এই যুদ্ধগুলো পাতানো ছিল কিনা সে বিষয়েও প্রশ্ন রয়েছে। তবে আজকে আর সেদিকে যাচ্ছি না। আজকে আমরা ইসরাইল পরনির্ভরশীলতার দিকগুলো তুলে ধরব।
জনশক্তির অভাব
জনসংখ্যার দিক দিয়ে ইসরাইল তার পাশ্ববর্তী দেশ সিরিয়া ও মিসরের চেয়ে অনেক পিছিয়ে। মিসরের জনসংখ্যা যেখানে ১০০ মিলিয়ন, সেখানে ইসরাইলের মোট জনসংখ্যা মাত্র ৯ মিলিয়ন। জনসংখ্যা কম হওয়ার কারণে আইডিএফকে সবসময় রিজার্ভ ফোর্সের উপর নির্ভর করতে হয়। তাদের বর্তমান একটিভ ফোর্স ১ লাখ ৭০ হাজারের মতো। যেখানে বাংলাদেশের একটিভ ফোর্স ৩ লাখের উপরে।
এখন ইসরাইল যদি মাত্র একটি যুদ্ধে হেরে যায় তাহলে তাদের সেনাবাহিনী তো দূরের বিষয়, রাষ্ট্রেরই অস্তিত্ব থাকবে না। এক মিসরের জনসংখ্যা তাদের চেয়ে ১০ গুণ বেশি। যুদ্ধ হলে মিসরের মৃত্যুর হার বেশি হতে পারে। তবে ইসাইল যদি একাধিক ফ্রন্টে যুদ্ধ করতে যায় তাহলে তাদের গ্রাউন্ড ফোর্স দিয়ে তেমন সুবিধা করতে পারবে না। তখন তাদের পক্ষে মিসরের বিপক্ষে জেতাই কঠিন।
এছাড়া মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে এখন ইসরাইলের মতো অনেক উন্নত যুদ্ধবিমান আছে। তাই আবার ৬৭ এর মতো ফলাফল হবে তা ভাবা ভুল। তবে ইসরাইলের কাছে পারমাণবিক অস্ত্রের বড় মজুদ আছে বলে ধারণা করা হয়। এটা সত্য হতে পারে, আবার একটা হাইপ সৃষ্টির জন্য মিথ্যাও প্রচার করতে পারে।
জনসংখ্যার ঘাটতির কারণে ইসরাইলের শ্রম শক্তিরও অনেক অভাব। তাদের লেবার ফোর্স ৪ মিলিয়নের কাছাকাছি। যা প্রয়োজনের তুলনায় কম। যে কারণে ইসরাইলকে বিদেশ থেকে মেধা ও দক্ষতার সহায়তা নিতে হয়।
সম্পদের অভাব
ইসরাইলের আয়তন মাত্র ২২ হাজার বর্গ কিলোমিটার। শত্রু দেশের একটি ফাইটার জেট মাত্র চার মিনিটে দেশটির এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে যেতে পারবে। একে তো আয়তন কম, তার মধ্যে অর্ধেকের বেশি জায়গা মরুভূমি। পানির উৎসের অভাব থাকায় ইসরাইলের অধিকাংশ জমি চাষের উপযোগীও না। দেশটির মাত্র ২০ ভাগ জমি আবাদযোগ্য। ফলে ইসরাইলকে তার খাদ্য শস্যের ৮০ শতাংশই আমদানি করতে হয়। এতে করে কৃষি থেকে তাদের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের কোনো সুযোগ নেই। যা দেশটির অর্থনীতির একটি খারাপ দিক।
ইসরাইলে কোনো প্রাকৃতিক সম্পদও নেই। তার আশেপাশের দেশগুলোতে অসংখ্য তেলের খনি থাকলেও ইসরাইলে কোনো খনি পাওয়া যায়নি। যে কারণে তাদের বাজেটের বড় একটি অংশ ব্যয় করতে হয় তেল ও কয়লা কিনতে। এর মধ্যে দেশটিতে পানির খুবই অভাব দেখা দিয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে দেশটির ৯৫ শতাংশ ওয়াটার রিসোর্স শেষের দিকে। সামান্য যা অবশিষ্ট আছে তা দিয়ে বেশিদিন চাহিদা পূরণ করা যাবে না।
বিদেশি বাজারনির্ভর অর্থনীতি
ইসরাইলের অর্থনীতি বিদেশি বাজারনির্ভর। কারণ দেশটির জনসংখ্যা কম হওয়ার কারণে বাজার খুবই ছোট৷ তাদের অর্থনীতির ৩০ শতাংশই নির্ভর করে রফতানির উপর৷ যা শিল্পোন্নত দেশগুলোর তুলনায় অনেক বেশি। শিল্পোন্নত দেশগুলোর মাত্র ১০ ভাগ নির্ভর করে আমদানি ও রফতানির উপর। সেখানে ইসরাইলের অর্থনীতির প্রায় তিন ভাগের এক ভাগই রফতানিনির্ভর।
১৫-১৬ বছর আগেও ইসরাইল কমলা ও কিছু কৃষিপণ্য রফতানি করে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করত। কিন্তু বর্তমানে তাদের রফতানির ৮০ শতাংশই ইলেকট্রনিকস কম্পোনেন্টস। এখানেও তাদের একটি সমস্যা রয়েছে। ইসরাইলের ৪০ শতাংশের বেশি ইলেকট্রনিকস পণ্য যুক্তরাষ্ট্রে রফতানি হয়ে থাকে। যদিও যুক্তরাষ্ট্রে তাদের চেয়ে কম খরচে ভালো পণ্য উৎপাদন করা হয়। এছাড়া তারা এই সেক্টরে চীন, জাপান ও জার্মানির চেয়ে এখনও পিছিয়ে। ফলে তাদের অর্থনীতি ভবিষ্যতে স্থিতিশীল থাকবে কিনা সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।
দারিদ্র্যপীড়িত এক দেশ
২০২০ সালে ইসরাইলের মোট জিডিপি ছিল ৪০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ইসরাইলের মাথাপিছু আয় প্রায় ৪৩ হাজার ডলার। কিন্তু এরপরও বিশ্বের অন্যতম দারিদ্র্যপীড়িত দেশের তালিকায় তাদের নাম রয়েছে। এর কারণ হচ্ছে তারা অবৈধ দখলদারিত্বকে নিয়মমাফিক করার জন্য বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে ইহুদিদের নিয়ে আসে। এর পেছনে তাদের প্রচুর অর্থ ব্যয় হয়। যার ফলে তারা ম্যানুফ্যাকচার কিংবা মাইনিংয়ে তেমন বিনিয়োগ করতে পারে না।
ইসরাইলকে প্রতি বছর ৩.৮ বিলিয়ন ডলার করে অর্থ সহায়তা দেয় যুক্তরাষ্ট্র। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী ও ধনাঢ্য ইহুদিরাও নানাভাবে ইসরাইলকে সহায়তা করে থাকে। যদি যুক্তরাষ্ট্র কিংবা মার্কিন ইহুদিরা হাত গুটিয়ে নেয় তাহলে ইসরাইলকে বড় সঙ্কটের মুখে পড়তে হবে। এছাড়া দেশটিতে পুঁজিবাদ শক্ত ঘাঁটি তৈরি করেছে। ২০১০ সালের এক রিপোর্ট অনুযায়ী ইসরাইলের ৬০ শতাংশ কোম্পানি মাত্র ১৮টি পরিবারের নিয়ন্ত্রণে। অথচ দেশটির ২১ শতাংশ মানুষ এখনো দারিদ্র্য সীমার নিচে বাস করে। সংখ্যায় যা ১.৮ মিলিয়ন। এর মধ্যে অর্ধেক শিশু। পূর্ব জেরুসালেমে যে আরবরা থাকেন তাদের মধ্যে প্রায় ৪৪ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্য সীমার নিচে বাস করে। কারণ ইসরাইলে তারা দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক।
বিদেশী প্রভুদের মাধ্যমে সৃষ্ট ইসরাইলকে সবসময় প্রভুদের মুখাপেক্ষী হয়েই বাঁচতে হচ্ছে। ভবিষ্যতেও তাদের আত্মনির্ভরশীল রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার কোনো সুযোগ নাই।