মহল্লার শেষ পরিবার
ছবি : দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য, তবে প্রাসঙ্গিক - ছবি : সংগৃহীত
বোমা হামলার পর আল-ওয়াহদা’র রাস্তায় যে কয়েকটি বাড়ি এখনো ঠাঁই দাড়িয়ে আছে, সেগুলির মধ্যে একটি বাড়িতে থাকে রজব। রজবদের বাড়িটি আল-কাওলাক বাড়ির ধ্বংস স্তুপের কয়েক ব্লক পাশের একটি বাড়ি। আর এই ব্লকে রজবদের বাড়িটি ছাড়া অন্য কোনো বাড়ি এখন আর অবশিষ্ট নেই।
২২ বছর বয়সী রজব পাশের একটি অফিসে কপিরাইটের কাজ করে। বোমা হামলায় ওই অফিসটিও এখন ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে।
যদিও তার বাড়িটি মাথা তুলে এখনো ঠাঁই দাড়িয়ে আছে, কিন্তু মাটি ফুঁড়ে যেমন লতা-গুল্ম বেড়িয়ে আসে, ঠিক তেমনিভাবে আল-ওয়াহদা সড়কের সেই রাতের ভয়ঙ্কর চিত্রটি রজবের পক্ষে বহন করা খুব কঠিন হয়ে পড়ছে।
রজবের সাথে আগে আমার কখনো দেখা হয়নি। সুবহে-সাদিকের পর ধ্বংসস্তুপের এলোমেলো চিত্রগুলো দেখতে দেখতে খুব ভোর বেলায় এই বাড়িটি আমার চোখে পড়ে। ভিতরে প্রবেশ করেই খোঁজখবর নেয়ার একপর্যায়ে রজবের কাছে আল-ওয়াহদা সড়কের সেই ভয়ঙ্কর রাতের অভিজ্ঞতা জানতে চাইলাম।
ডান হাতের অনামিকা আঙ্গুল দিয়ে চোখের পানি মুছে তিনি বললেন, যুদ্ধের প্রথম ৫ দিন ছিল আমাদের জন্য সত্যিই খুব ভয়ঙ্কর, কারণ বেশিরভাগ এয়ার স্ট্রাইক আমাদের আশেপাশেই হচ্ছিল। পৃথিবীতে তখন শুধুমাত্র দুটি শব্দ ছিল- একটি হচ্ছে বোম আর অপরটি হচ্ছে এয়ার স্ট্রাইক। এই দুটি শব্দ ছাড়া পৃথিবীর ভান্ডারে আর কোনো শব্দ অবশিষ্ট ছিল না। আমরা নিশ্চিত ছিলাম যে আমাদের বাড়িতে বোমা ফেলা হবে। আর ওই ভয়ে এতটাই ভীত ছিলাম যে আমরা টেবিলের নিচে লুকাচ্ছিলাম, এমনকি যা পাচ্ছিলাম তার নিচেই লুকাচ্ছিলাম।
আল-ওয়াহদা সড়কে যখন এয়ার স্ট্রাইক হচ্ছিল, তখন পরিস্থিতি এতটাই দুর্যোগপূর্ণ ছিল যে মনে হচ্ছিল আমাদেরকে শূলে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে।
আল-কাওলাকে বোমা হামলার সময়ও সমস্ত নিউরনব্যাপী এমন ভয়ঙ্কর অনুভূতিই হয়েছিল। আমি আমার জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম, দেখলাম সব জায়গায় বিস্ফোরণ ও আগুন। জীবিত মানুষকে গরম তেলের পাত্রে ছেড়ে দিলে যেমন ছটপট করে, ঠিক তেমনিভাবে প্রত্যেকেই চিৎকার করছিল, কী চলছে বা কী করা উচিত তা আমাদের ধারণা ছিল না।
আমি আমার বাবা-মা ও ভাইদের সাথে একসঙ্গে সিঁড়ির নিচে অবস্থান নিয়েছিলাম। এবং আমরা প্রত্যেকেই জীবনের পরিসমাপ্তি হতে চলেছে ভেবে শাহাদা তিলাওয়াত করা শুরু করলাম। শাহাদা হচ্ছে ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের একটি এবং মুসলিমরা বিশ্বাস করে মৃত্যুর আগে শাহাদা তিলাওয়াত করা উচিত।
আমার বয়স যখন ৯, ঠিক তখন গাজায় প্রথম একটা ভয়াবহ যুদ্ধ দেখেছিলাম। এবং তার পর থেকে প্রতি বছরে কমবেশি যুদ্ধ দেখে বড় হয়েছি, কিন্তু এই যুদ্ধের ভয়াবহতা ছিল আমার জন্য সবচেয়ে বেশি প্রবল।
আমার চোখের সামনে এখনো ভাসছে, এয়ার স্ট্রাইকের পরে সবজায়গায় মৃত এবং আহত দেহ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, কৃষ্ণচূড়ার মতো রাস্তায় রক্ত লাল হয়ে আছে, প্রতিবেশিরা তাদের বাড়ির ধ্বংসস্তুপের নিচে আটকা পড়ে আছে। আমি জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে একটি বাড়ি খুঁজছিলাম, যেটা ছিল আমার প্রতিবেশি আবু আল-ওফের বাড়ি। কিন্তু সেখানে বাড়িটি আর দেখতে পাইনি।
আল-ওয়াহদা সড়কে বোমা হামলার রাতে অনেকগুলো পরিবার তাদের একাধিক সদস্য হারিয়েছে। তাদের মধ্যে এই আবু আল-ওফ পরিবারও রয়েছে। ওই রাতে আবু আল-ওফ, যিনি ছিলেন গাজায় করোনা রেসপন্স টিমের প্রধান, তার স্ত্রী রিম, তার ১৭ বছরের ছেলে তাওফিক ও তার ১২ বছরের মেয়ে তা’লাসহ পরিবারের ১২ জন সদস্য শহীদ হয়।
আমরা আমাদের সামনেই মৃত্যুর মিছিল দেখেছি। এই ব্লকে আমরাই একমাত্র পরিবার, যারা এখনো বেঁচে আছি। আমাদের সকল প্রতিবেশি, যারা এখন আর কেউ নেই, আমাদেরকে রেখে সবাই আল্লাহর কাছে চলে গিয়েছে। চোখের পানি মুছতে মুছতে রজব বললেন- এই অনুভূতি খুবই যন্ত্রনাদায়ক, ইটস ঠু পেইনফুল।
এরা সবাই আমাদের কাছাকাছি ছিলেন, আমরা সবাই একসাথেই বেড়ে উঠেছি, একসাথে আড্ডা দিয়েছি, কত মজার সময় পার করেছি, হাসি-কান্না, দুঃখ-কষ্ট ভাগাভাগি করেছি। এমন অনেক সময় ছিল যখন আমরা একজন আরেকজনের সাথে জানালার পাশে বসে কথা বলেছি।
আর এখন? তারা কেউ নেই। তবুও আমি যখন আমার বেডরুমের বন্ধ জানালার পাশে যাই, আমার কেবলই মনে হয় আমার প্রতিবেশি শিশুরা এখনো খেলা করছে, তাদের মধুর চিৎকার আমি এখনো শুনতে পাই।
কিন্তু যখনই জানালা খুলে বাইরে তাকায়, তখন শুনশান নীরবতা। আমি ছাড়া কোথাও কেউ নেই। হে আল্লাহ! ওরা এখন কোথায়, যারা সবসময় আমাদের চার-পাশে থাকত? সেই ভবনগুলো কোথায়? যেগুলো সবসময় দেখতাম? হে আল্লাহ! আমি এখনো বিশ্বাস করতে পারছি না।”
নোট : mondoweiss-এ মোহাম্মদ আল-হিজ্জার “Return to al-Wahda street” শিরোনামে কয়েকটি সাক্ষাতকার ছিল। ওই সাক্ষাতকারের উপর ভিত্তি করেই এই লেখাটি।