ইসরাইল ঠিক কতটুকু শক্তিশালী?

জান্নাত খাতুন | Jun 04, 2021 02:14 pm
এফ-১৬

এফ-১৬ - ছবি : সংগৃহীত

 

১৯৬৭ সালের কথা। আরব-ইসরাইল যুদ্ধ চলছিল তখন। ওই সময় আমেরিকার গুপ্তচর জাহাজ ইউএসএস লিবার্টি পূর্ব মধ্যসাগরে অবস্থান করছিল। হঠাৎই ইসরাইলের যুদ্ধ বিমান ও টর্পেডো বোট এই জাহাজে হামলা করে। এই হামলায় জাহাজ না ডুবলেও জাহাজ প্রায় ধ্বংস হয়ে যায়, ৩৪ জন আমেরিকান প্রাণ হারায়। আরো অনেকে আহত হয়। আমেরিকা সুপার পাওয়ার হওয়া সত্ত্বেও ইসরাইল থেকে এই ঘটনার প্রতিশোধ নেয়নি। বাংলাদেশের চেয়ে ৮ গুণ ছোট একটি দেশ কীভাবে নিজের কয়েক শ' গুণ বড় দেশগুলোর চেয়েও শক্তিশালী? ইসরাইলের চার দিকে বড় বড় আরব দেশ থাকা সত্ত্বেও ইসরাইল কেন এখনো শক্তিশালী অবস্থায় টিকে আছে? চলুন মধ্যপ্রাচ্যের টিউমার রাষ্ট্র ইসরাইল কতটা শক্তিশালী তা সম্পর্কে জানা যাক।

ইসরাইল কেন এতটা শক্তিশালী? এই প্রশ্নের উত্তর হলো আমেরিকা সমর্থন। শুধু এতটুকুই নয়। এর রাজনৈতিক, ভৌগোলিক ও ঐতিহাসিক কারণও আছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানি ও পোল্যান্ডে ইহুদিদের ওপর গণহত্যা চালানো হয়। ইহুদিদের দাবি অনুযায়ী ৬০ লাখ ইহুদি এই গণহত্যায় হত্যা করা হয়। এই গণহত্যাকে 'Holocaust' বলা হয়। এই গণহত্যার অজুহাতে ব্রিটেন তাদের দখলে থাকা ফিলিস্তিনি ভূমিতে ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইল প্রতিষ্ঠা করতে দেয়। আমেরিকাও ইসরাইলকে সমর্থন দেয়। আজ আমেরিকা ও ব্রিটেন এই দুটি দেশ ইসরাইলকে রক্ষা করাকে নিজেদের দায়িত্ব মনে করে থাকে। এর একটি কারণ হলো আমেরিকা ও অন্যান্য পশ্চিমা দেশ মনে করে থাকে ইসরাইলই মধ্যপ্রাচ্যের একমাত্র দেশ যা যুদ্ধ ও শান্তি দুই অবস্থাতেই মধ্যপ্রাচ্যে তাদের স্বার্থ রক্ষা করবে। এ জন্য আমেরিকা ও পশ্চিমা দেশগুলো ইসরাইলকে সব রকম সাহায্য ও সমর্থন দেয়। ইসরাইল এই সমর্থনকে তাদের পররাষ্ট্রনীতিতে তুরুপের তাস হিসেবে ব্যবহার করে। ফলে আন্তর্জাতিক নিন্দা সত্ত্বেও আজ পর্যন্ত ইসরাইলের তেমন কোনো ক্ষতি কেউ করতে পারেনি।

আমেরিকার সমর্থনের পর যে জিনিস ইসরাইলকে সবচেয়ে বেশি শক্তি দেয় তা হলো এর নিজস্ব প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি। এছাড়া আমেরিকা, ব্রিটেন ও ফ্রান্স তাদের তৈরি অত্যাধুনিক অস্ত্র বাধ্যতামূলকভাবে ইসরাইলকে সরবরাহ করে থাকে। আমেরিকা, ফ্রান্স ও ব্রিটেন সামান্য পরিমাণ মানবাধিকার লঙ্ঘিত হলে যেকোনো দেশের অস্ত্রের সরবরাহ আটকে দেয়। কিন্তু এর চেয়েও গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘিত হলেও আমেরিকা, ফ্রান্স ও ব্রিটেন ইসরাইলকে অস্ত্র সরবরাহ করা বন্ধ করে না। উদাহরণ স্বরূপ ২০০৬ সালের ইসরাইল-লেবানন যুদ্ধের কথা বলা যায়। তখন ইসরাইলি বিমান হামলায় নিহত শিশুদের ছবি সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছিল।

তাও আমেরিকা এফ-১৬ বিমান সরবরাহ করেছিল ইসরাইলকে। আমেরিকা এর জবাবে বলছিলো- 'যদি আমেরিকা এখন ইসরাইলের সাথে অস্ত্র বিক্রির চুক্তি ভেঙ্গে ফেলে তাহলে ভবিষ্যতে আর কোনো দেশ আমেরিকার ওপর বিশ্বাস করবে না।' যদিও এর মাত্র ১৬ বছর আগে পাকিস্তানকে এফ-১৬ সরবরাহ করতে অস্বীকার করে। অথচ এর মূল্য পাকিস্তান আগেই পরিশোধ করেছিলো। ২০১৬ সালে আমেরিকার সাথে একটি চুক্তি করে ইসরাইল। এই চুক্তি অনুযায়ী ১০ বছরে ৩৮ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র পাবে আমেরিকা থেকে। তাও একেবারে বিনামূল্যে। ইসরাইলের কাছে মোট ৬ লক্ষ ৪৩ হাজার সেনাসদস্য আছে। যার মধ্যে ১ লক্ষ ৭০ হাজার সক্রিয়। আছে ৫৯৫টি যুদ্ধ বিমান। ৬৫টি যুদ্ধ জাহাজ ও ১৬৫০টি ট্যাংক আছে। কিছু কিছু হিসেব মতে ট্যাংকের সংখ্যা ২৬০০-এর বেশি। ইসরাইলের কাছে এফ-১৫, এফ-১৬ এবং পঞ্চম প্রজন্মের এফ-৩৫ বিমানও আছে। এফ-৩৫ শত্রুর দৃষ্টি এড়িয়ে লক্ষ্য বস্তুতে আঘাত করার ক্ষমতা রাখে।

ইসরাইলের কাছে ১ লাখ ৭০ হাজার সক্রিয় সৈন্য রয়েছে। এটা আরব দেশগুলোর তুলনায় কম মনে হলেও ইসরাইলের কাছে ৪ লাখ ৬৫ হাজার রির্জাভ সৈন্যও আছে। এছাড়া প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক ইসরাইলি নাগরিক সামরিক প্রশিক্ষণ পেয়ে থাকে। এ হিসেবে বলা যায় ইসরাইলের পুরো জনসংখ্যাই সেনাবাহিনী। গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ারের র‌্যাংকিং অনুযায়ী ইসরাইল ২০তম সামরিক শক্তি। যেখানে বাংলাদেশ ৪৫তম। আমেরিকা ১ম, রাশিয়া ২য়, চীন ৩য় ও ভারত ৪র্থ। ইসরাইলের এ বছরের প্রতিরক্ষা বাজেট ২০.৫ বিলিয়ন ডলার। যেখানে বাংলাদেশের মাত্র ৩.৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বাংলাদেশ আয়তনের দিক দিয়ে ইসরাইলের চেয়ে ৮ গুণ বড়। আর জনসংখ্যার হিসাবে ১৭ গুণ বড়। কিন্তু তাও বাংলাদেশের চেয়ে ৬ গুণ বেশি শক্তিশালী ইসরাইল।

আমেরিকার সাহায্যে ইসরাইল অস্ত্র নির্মাণ শিল্পে বেশ উন্নতি করেছে। ইসরাইল ৮ম বৃহৎ অস্ত্র বিক্রিকারী দেশ এবং সবচেয়ে বড় ড্রোন বিক্রিকারী দেশ। ইসরাইলের অস্ত্র বিক্রি ২০১৮ সালে ৯ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে। যা ২০২০ সালে ৮.৩ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। ইসরাইল অটোমেটিক অস্ত্র, রাতে অনেক দূর পর্যন্ত দেখতে পাওয়ার যন্ত্র এবং দেয়ালের ওপার থেকে মানুষের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করার যন্ত্র নিজেই তৈরি করে। এছাড়া ইসরাইলের কাছে নিজস্ব এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম 'আয়রন ডোম' ও আছে। যা যেকোনো মিসাইলকে ধংস করতে সক্ষম আকাশেই। তবে সাম্প্রতিক ইসরাইল-হামাস সঙ্ঘাতে আয়রন ডোমের দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। আর ইসরাইলি প্রতিরক্ষামন্ত্রী আমেরিকা গিয়েছেন আয়রন ডোমের আধুনিকায়নের জন্য এক বিলিয়ন ডলারের আমেরিকান সাহায্যের জন্য।

ইসরাইলের কাছে পারমাণবিক অস্ত্রও আছে। কিন্তু ইসরাইল তা স্বীকার করে না এবং ইসরাইল পারমাণবিক অস্ত্রের বড় কোনো পরীক্ষা চালায়নি। তাই ইসরাইলকে পারমাণবিক শক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয় না।

ইসরাইলের সেনাবাহিনী দ্রততার সাথে শত্রুদের শেষ করার জন্য বিখ্যাত। ১৯৬৭ সালের আরব-ইসরাইল যুদ্ধের প্রথম দিনই ইসরাইল মিসরের ৩৫০ যুদ্ধ বিমান উড়ার আগেই ধ্বংস করে দেয়। এছাড়া জর্দানের পুরো বিমান বাহিনী এবং সিরিয়ার বিমান বাহিনীর প্রায় পুরোটাই ইসরাইল ধ্বংস করে দেয়। এর ফলে ইসরাইল মাত্র ছয় দিন নিজের আয়তনের চেয়ে সাড়ে তিন গুণ এলাকা দখল করে আর ছয় দিনে এই যুদ্ধ জিতে যায়। ইসরাইল তখন বায়তুল মুকাদ্দাসও দখল করে নেয়।

ইসরাইল অর্থনৈতিকভাবেই বেশ শক্তিশালী সারা পৃথিবীর ইহুদি ধনকুবেররা ছাড়াও সারা পৃথিবীর ধনী ব্যক্তিরাও ইসরাইলে বিনিয়োগ করেন। ওয়ারেন বাফেট ও বিল গেটসের মতো বিলিয়নিয়াররা ইসরাইলকে বিনিয়োগকারীদের স্বর্গ বলে থাকে। ২০১৬ সালে ইসরাইলে ১২ বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক বিনিয়োগ হয়। আরব দেশগুলোর মধ্যে মিশরে সবচেয়ে বৈদেশিক বিনিয়োগ হয় ৮ বিলিয়ন ডলার।

আন্তর্জাতিক সমর্থন, বৈদেশিক বিনিয়োগ এবং উন্নত শিল্পের কারণে ইসরাইল মধ্যপ্রাচ্যের অনেক বড় অর্থনীতি। ইসরাইলের জিডিপি ৩৪০ বিলিয়ন ডলার। ইসরাইল আমেরিকার সমর্থনের সাথে অনেক বড় শক্তি। ২০১৭ সালে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জেরুসালেমকে ইসরাইলের রাজধানী ঘোষণা করেন। আর এর বিরুদ্ধে তুরস্ক ও পাকিস্তানের চেষ্টায় জাতিসঙ্ঘে নিন্দা প্রস্তাব পাস হলেও তা ইসরাইলের কোনো কিছু করতে পারেনি।

ইসরাইল আজ আমেরিকার সমর্থন নিয়ে বিশ্বের অনেক বড় শক্তি। ইসরাইলে পান যোগ্য পানির পরিমাণ কম হলেও ইসরাইল খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ং সম্পূর্ণ এবং ইসরাইল অন্যান্য আরব দেশেও খাদ্য দ্রব্য বিক্রি করে থাকে।
আমেরিকার সমর্থন ছাড়া ইসরাইলের তেমন কোনো শক্তি নেই। এটার প্রমাণ পাওয়া যায় ১৯৭৩ সালের আরব ইসরাইল যুদ্ধের সময়। তখন ইসরাইল প্রায় পরাজিত হয়েই গিয়েছিল। আর ইসরাইলকে মিসরকে সিনাই উপত্যকা ফেরত দিতে হয়। এটার আরো একটা নমুনা সাম্প্রতিক সময়ে ২০০৬ সালের লেবানন যুদ্ধে দেখা যায়। তখন ইসরাইল হিজবুল্লাহকে ধ্বংসের জন্য পুরো শক্তি দিয়ে চেষ্টা করলেও ইসরাইল তা করতে ব্যর্থ হয়। ইসরাইলকে ৫ সপ্তাহের ভিতর সেনা প্রত্যাহার করতে হয়৷ আর আজ হিজবুল্লাহ আগের চেয়ে ১০ গুণ বেশি শক্তিশালী। ইসরাইলের একটি বড় দুর্বলতা হলো ইসরাইলে ও ইসরাইলের দখলকৃত এলাকায় আরবদের জনসংখ্যা বৃদ্ধি। ইসরাইলে ৬৫ লক্ষ ইহুদি বসবাস করে। অন্যদিকে ইসরাইল ও এর দখলকৃত এলাকায় ৫৫ লক্ষ আরব বসবাস করে। যাদের মধ্যে ৯০ শতাংশের বেশি মুসলিম। ইসরাইল এই জন্য পশ্চিম তীরে ইহুদি বসতি স্থাপন করছে।

কোনো দেশের শক্তি কতটা তা তার বন্ধু শত্রুর তালিকা দেখেও বোঝা যায়। আমেরিকা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ভারত, মিশর ও জর্দানকে ইসরাইলের বন্ধু হিসেবে গণ্য করা হয়। অন্যদিকে আরবের সবচেয়ে বড় দেশ সৌদি আরবের সাথেও ধীরে ধীরে ইসরাইলের সম্পর্ক ভালো হচ্ছে।

পৃথিবীর ২৯টি দেশ ইসরাইলকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয় না। এছাড়া তুরস্ক, পাকিস্তান, সিরিয়া, সৌদি আরব ও ইরাককে ইসরাইলের সম্ভাব্য শত্রু এবং ইরানকে একমাত্র শত্রু হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সৌদি আরবকেও ইসরাইল সম্ভাব্য শত্রু হিসেবে বিবেচনা করে। কারণ বর্তমান সৌদি আরবের এই বদল মুহাম্মদ বিন সালমানের জন্য। যা পরবর্তী সময়ে থাকবে কি না তা নিয়ে ইসরাইল চিন্তিত। আর ইরান একমাত্র দেশ, যে সরকারিভাবে ইসরাইলকে ধ্বংস করার কথা বলে থাকে। সব মিলিয়ে আমেরিকার সমর্থন, শক্তিশালী অর্থনীতি ও প্রযুক্তির কারণে ইসরাইল আজ অনেক বড় শক্তি। কিন্তু শুধু আমেরিকার সমর্থন নিয়ে টিকে থাকা, মানবাধিকার লঙ্ঘন, প্রতিবেশীদের সাথে খারাপ সম্পর্ক ও আরবদের বাড়তে থাকা জনসংখ্যা ইসরাইলের এমন কিছু দুর্বলতা যা ইসরাইলের অস্তিত্বকে হুমকির মুখে ফেলতে পারে।

তথ্যসূত্র :
How Powerful Is Israel - DSJ
Global Fire Power Index
The Jerusalem Post
World Bank
Harretz
The Times Of Israel
The Guardian
Daily Mail
Reuters
The October Arab-Israeli war Of 1973:
What Happened? 8 Oct 2018,
Al-Jazeera.

লেখিকা : প্রাক্তন শিক্ষার্থী, আঙ্কারা বিশ্ববিদ্যালয়, তুরস্ক


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us