যেভাবে বিশ্বসেরা পেসার হলেন ওয়াসিম আকরাম

অন্য এক দিগন্ত | Jun 03, 2021 09:05 pm
ওয়াসিম আকরাম

ওয়াসিম আকরাম - ছবি : সংগৃহীত

 

লাহোরের এক তরুণ হতে চেয়েছিলেন টেবিল টেনিস খেলোয়াড়। ক্রিকেট ছিল তার শখের খেলা। আর চারুকলাতে একটা ডিগ্রি অর্জন ছিল তার জীবনের লক্ষ্য। তখন যদি কেউ বলত যে এই ছেলে বিশ্বের সেরাদের সেরা হবে, এ কথা অনেকেই ঠাট্টা মনে করতেন। কিন্তু মাত্র ছয় মাসের ব্যবধানে পুরো হিসেব বদলে গেল।

১৯৬৬ সালের ৩ জুন জন্ম নেয়া ওয়াসিম আকরামের গল্পটা এমন। তাকে মনে করা হয় বিশ্বের সর্বকালের সেরা বাঁহাতি পেস বোলার। তার শুরুর দিকের গল্প শুনলে অবিশ্বাস্য লাগে, কিভাবে তিনি অল্প দিনে এই খ্যাতি অর্জন করলেন? ওই গল্প তিনি নিজেই লিখেছেন।

ওয়াসিম আকরামের আত্মজীবনীর নাম ‘ওয়াসিম’, যেখানে তিনি লেখেন, ‘লাহোরে বসবাস ছিল আমাদের। বাবা ছিলেন খুচরা যন্ত্রপাতি বিক্রেতা। মা-বাবার চিন্তা ছিল শুধুই আমাদের পড়াশোনা নিয়ে। তাই যত সুযোগ-সুবিধা দেয়া সম্ভব তা দিয়ে একটা ভালো স্কুলে ভর্তি করালেন।’

বিবিসি উর্দুকে দেয়া সাক্ষাৎকারে ওয়াসিম আকরাম বলেন, ১২ বছর বয়সে আমি মায়ের সাথে থাকতে শুরু করি, নানির বাড়িতে। আমার বাবা-মায়ের ছাড়াছাড়ি হয়ে গিয়েছিল। স্কুলে সবধরনের খেলাই খেলতাম। কিন্তু ক্রিকেটের প্রতি আগ্রহ জন্মায় যখন ক্লাস নাইনে উঠি।

ওয়াসিমের এখনো মনে আছে, তার বাড়ির কাছেই চার ভাই থাকতেন। শাহবাজ, এজাজ, শহীদ ও জুলফিকার। তাদের সাথে স্টাম্প নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় মাঠে টেনিস বল দিয়ে ক্রিকেট খেলতেন ওয়াসিম।

তিনি বলেন, আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে মূল মাঠ, ওটায় খেলার সুযোগই পেতাম না। তাই চারপাশে ছোট জায়গা খুঁজে বের করতাম, যেখানে খেলা যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠ দেখতাম আর ভাবতাম, এত সুন্দর ঘাসের মাঠে যদি খেলা যেত।

ওয়াসিমের ক্রিকেট খেলার প্রথম সাথী
ক্রিকেটে কীভাবে নিয়মিত হলেন- এমন প্রশ্নের জবাবে ওয়াসিম স্মৃতি হাতড়ে মনে করেন খালিদ মাহমুদের নাম। খালিদ মাহমুদ তখন প্রথম শ্রেণীতে ক্রিকেট খেলোয়াড়। তিনিই ওয়াসিমকে নিয়মিত ক্লাব ক্রিকেট খেলতে অনুপ্রেরণা জোগাতেন। তিনি বলেন, ‘আমি যখন টেনিস বল দিয়ে খেলতাম, তখনই অনেক জায়গায় খেলার প্রস্তাব পেতাম।’

ওয়াসিম আকরামের নানাবাড়ির কাছেই থাকতেন খালিদ মাহমুদ। খালিদ খেলতেন কাস্টমস দলের হয়ে। তিনি বলেন, তুমি আসল ক্রিকেট বল দিয়ে কেন খেলো না? তোমার মধ্যে সম্ভাবনা আছে।

ওয়াসিম বলেন, আমি তখন জানতাম না বল কেনার টাকা কোথায় পাবো। এটাও জানতাম না কোন ক্লাবে কীভাবে যোগাযোগ করবো। খালিদ একদিন তার সাইকেলে করে আমাকে নিয়ে গেলেন লুধিয়ানা জিমখানা ক্লাবে। যেখানে কোচ ছিলেন সিদ্দিক খান ও সৌদ খান। সাইকেলে করেই কয়েক দিন টানা আমাকে নিয়ে যেতে লাগলেন খালিদ। এতে বোঝা যায়, ক্রিকেটের প্রতি তার নিষ্ঠা ও আমার ক্রিকেট খেলার প্রতি তার আগ্রহ।

ওয়াসিমের প্রথম ক্লাব ক্রিকেট কোচ, সিদ্দিক খান ও সৌদ খানের সান্নিধ্যে আসার মধুর স্মৃতি এখনো মনে আছে ওয়াসিম আকরামের। বলেন, ঠিক দুপুর দেড়টায় আমি মাঠে থাকতাম, নেটে বল করতাম। অন্য তরুণ ক্রিকেটারদের সাথে মাটিতে পানি দেয়া, অনুশীলন করতাম। সেখানে এক শ’র বেশি তরুণ ক্রিকেটার ছিলেন। অনেকগুলো ক্লাব এই একই মাঠে অনুশীলন করতো। ওই সময়ে আমার কোচরা আমার খেয়াল রাখেন। তারা আমাকে নিজ খরচে একটা নতুন বল কিনে দেন ও তা আমাকে একেবারেই দিয়ে দেন খেলার জন্য।

ভর্তি হলাম কিন্তু সুযোগ পেলাম না
ক্রিকেটের কারণে ওয়াসিম আকরাম মাধ্যমিকের পড়ালেখায় খারাপ করেন। তবে পাস করে যান। এরপর কলেজে ভর্তি হওয়ার সময় গভর্নমেন্ট কলেজ ও ইসলামিয়া কলেজে ক্রিকেট ট্রায়ালে টিকে যান। কোচ সিদ্দিক খান আমাকে ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হতে বলেন। ওখানকার ক্রিকেট টিমটা ভালো। আমি কলেজে ভর্তি হই ঠিকই কিন্তু ওই কলেজ টিমের অধিনায়ক ছিলেন বাঁহাতি পেস বোলার, যার কারণে আমার একাদশে জায়গা হয়নি। আমি ছিলাম দ্বাদশ ব্যক্তি। মজার কথা, কলেজের দ্বিতীয় বর্ষে উঠে আর আমি ওই কলেজ টিমে খেলিনি। কারণ তখন আমি পাকিস্তানের জাতীয় দলে সুযোগ পাই।

রমিজ রাজা ও ইন্তিখাব আলমকে আউট করে দৃশ্যপটে আসা
বিবিসি উর্দুর সাথে কথা বলেন লুধিয়ানা জিমখানা ক্লাবের কোচ সৌদ খান। তিনি জানান, লাহোর জিমখানার সাথে একটি ম্যাচে ওয়াসিম আকরাম নেন চারটি উইকেট, যার মধ্যে ছিল রমিজ রাজা ও ইন্তিখাব আলমের উইকেট। এরপর সাবেক ফাস্ট বোলার খান মোহাম্মদের ক্যাম্পে ডাক পান ওয়াসিম আকরাম।

১৯৮৪ সালের জুন মাসে শুরু হয় ক্যাম্প। ওই ক্যাম্পে রামিজ রাজা, ইজাজ আহমেদ ও মহসিন কামালরাও ছিলেন। প্রায় ১০০ ক্রিকেটারের ক্যাম্পের নেতৃত্বে ছিলেন পাকিস্তানের সাবেক টেস্ট ক্রিকেটার আগা সাদাত।

সৌদ খান বলেন, এক দিন ওয়াসিম এসে বলেন যে আমি ক্যাম্পে নতুন বল পাই না। আমি আগা সাদাতকে বলি, ছেলেটাকে নতুন বলে বল করতে দেন। ওয়াসিম এই অপেক্ষায়ই ছিল। কোনো ব্যাটসম্যানের জন্যই নতুন বলে ওয়াসিম আকরামকে খেলা সহজ কথা না।

ওয়াসিম আকরাম তার বইয়ে লেখেন, আগা সাদাত আমাকে বেশ পছন্দ করেন। তিনি খান মোহাম্মদকে বলে দেন, যাতে আমার অ্যাকশন ও সুইং নিয়ে কাজ করেন।

ওয়াসিম আকরাম বলেন, ক্যাম্পের দ্বিতীয় ভাগ ছিল করাচিতে। আমার বাবা বিমানের টিকেট কিনে দেন, যাতে আমি ট্রেনে ক্লান্ত না হয়ে যাই। তখন প্রধান নির্বাচক ছিলেন সাহিব আহসান। তিনি আসেন ও আগা সাদাতের ও খান মোহাম্মদের সাথে কথা বলেন, আমার বোলিং নিয়ে। ক্যাম্পের শেষে খান মোহাম্মদ বলেন, তিনি মনে করেন আমি পাকিস্তান ক্রিকেট দলেও খেলতে পারবো।

প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেট না খেলেই টেস্ট ক্রিকেট
ওয়াসিম আকরাম বলেন, আমি অবাক হয়ে যাই যখন দেখি নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে একটি তিন দিনের ম্যাচে ডাক পেলাম। তখনো আমি কোনো প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেট খেলিনি। তখনো বিশ্বাস হচ্ছিল না যে একাদশে সুযোগ পাবো। কিন্তু ম্যাচের আগের দিন জাভেদ মিয়াঁদাদ বলেন, তুমি খেলছো।

ওয়াসিম বলেন, জাভেদ মিয়াঁদাদ হুট করেই আমাকে পছন্দ করেছেন এমন না। তিনি করাচি ক্যাম্পে গিয়েছিলেন, কোচদের সাথে কথা বলেন। এমনকি আমাকে দলে নেয়ার ব্যাপারেও তার মতামত ছিল ইতিবাচক। আমাকে টেস্ট ক্রিকেট বোলার তাহির নাকাশের পরিবর্তে দলে নেয়া হয় রাওয়ালপিন্ডির ওই ম্যাচে।

স্মরণীয় শুরু
ওই তিন দিনের প্রস্তুতি ম্যাচের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে ওয়াসিম আকরাম বলেন, ১৮ বছর বয়সী কারো জন্য এই শুরুটা ছিল বিশেষ কিছু। মাত্র একবার নেটে বল করেই সরাসরি দলে। প্রথম উইকেটটা পাই জন রাইটের, প্রথম ইনিংসে ৫০ রান দিয়ে সাত উইকেট পাই। পরের ইনিংসেও আরো দু’টি উইকেট। আমি টেস্ট ক্রিকেট খেলতে চাইতাম ঠিকই। কিন্তু তখন ভাবিনি সুযোগ পাবো। পাকিস্তান দল যখন নিউজিল্যান্ড সফরে যাবে ওই ক্যাম্পে আমি ডাক পেলাম। জাভেদ মিয়াঁদাদ নির্বাচকদের সাফ বলে দিলেন তিনি আমাকে দলে চান।

ওয়াসিম আকরাম ও ওয়াকার ইউনুসকে নিয়ে লেখা একটি বইয়ে জন ক্রিস ওয়াসিমের সরলতা নিয়ে লেখেন। যখন নিউজিল্যান্ডগামী দলের সাথে যোগ দেন ওয়াসিম, তখন তিনি জাভেদ মিয়াঁদাদকে জিজ্ঞেস করেন, পুরো সফরে কত টাকা লাগবে? আর কত টাকা সাথে রাখতে হবে? জাভেদ মিয়াঁদাদ হাসিতে ফেটে পড়ে বলেন, ৫০ হাজার ডলার। ওয়াসিম জানতেনই না এসব খরচ দেয় ক্রিকেট বোর্ড।

টেস্টে ১০ উইকেট নেয়া সর্বকনিষ্ঠ বোলার
ওয়াসিম আকরামের প্রথম টেস্ট ছিল অকল্যান্ডে, সেখানে তিনি ছিলেন নিষ্প্রভ। ১০৫ রান দিয়ে দু’টি উইকেট নেন। ওয়াসিম তার বইয়ে লেখেন, জায়গাটা ডানেডিন ও সেই মৌসুমে পেস বোলারদের জন্য দারুণ। জাভেদ মিয়াঁদাদ চারজন পেসার রাখেন। আমিও টিকে যাই দলে।

ডানেডিনেই ওয়াসিম ১০ উইকেট পেয়ে যান, টেস্ট ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে কম বয়সী ক্রিকেটার হিসেবে ম্যাচে ১০ উইকেট নেন। তবে পাকিস্তান এই টেস্টে ২ উইকেটে হারে, ওয়াসিম এখনো আফসোস করেন, নিউজিল্যান্ডের নিচের দিকের ব্যাটসম্যানদের তিনি আউট করতে পারেননি বলে।

ইমরান খানের সাথে দেখা
ওয়ামিসের সাথে ইমরান খানের দেখা হয় অস্ট্রেলিয়ায়। ইমরান ছিলেন ওয়াসিমের আদর্শ। তার আগের সিরিজে ছিলেন ইনজুরিতে।

ওয়াসিম বলেন, ইমরান খান আমার সাথে কথা বলেন। তিনি বলেন, নিউজিল্যান্ডে আমার বোলিং ভালো হয়েছে। ইমরান খান বলেন, অস্ট্রেলিয়ার অ্যারান ডেভিডসনের পরে তখন ওয়াসিমই ছিলেন সেরা বাঁহাতি পেস বোলার। স্বস্তিও প্রকাশ করেন একজন দারুণ সঙ্গী পেলাম বলে।

কাউন্টি ক্রিকেটে বাজিমাত
ওয়াসিম আকরাম ইংল্যান্ডের কাউন্টি ক্রিকেটে জনপ্রিয় ছিলেন। সেখানে শুরুটাও ছিল দারুণ। ১৯৮৭ সালের এপ্রিল মাসে পাকিস্তান ও ইংল্যান্ডের মধ্যে একটি সিরিজের সময় ইংলিশ ব্যাটসম্যান নেইল ফেয়ারব্রাদার আমাকে জিজ্ঞেস করেন আমি ল্যাংকাশায়ারের হয়ে খেলতে চাই কি না। আমি প্রশ্ন করি, সেখানকার লিগে? সে আসলে ল্যাংকাশায়ার কাউন্টি দলের কথা বলছিলেন। আমি অনেক খুশি হয়েছিলাম। এরপর যখন পাকিস্তানের ক্রিকেট দল ইংল্যান্ড সফরে যায়, ওইবার আমি ল্যাংকাশায়ারের কর্তাদের সাথে কথা বলি। পাকিস্তান ক্রিকেট দলের ম্যানেজার সাহিব আহসান আমাকে এই চুক্তি করতে সাহায্য করেন। ল্যাংকাশায়ারে ১১ বছর খেলেন ওয়াসিম আকরাম।

সূত্র : বিবিসি


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us